১৪
বছর যাবৎ বিনা পারিশ্রমিকে কিডনী প্রতিস্থাপন করে চলেছেন। নিজে একজন শল্য
চিকিৎসক হিসাবে অর্জন করেছেন ১ হাযারেরও বেশী কিডনী প্রতিস্থাপন করার
সম্মান, যা দেশের সর্বমোট কিডনী প্রতিস্থাপনের তিন ভাগের এক ভাগ। যাতে
সফলতার হারও ৯৫ শতাংশ। জমানো টাকায় গাড়ি না কিনে, কিনেছিলেন ডায়ালাইসিস
মেশিন। গড়ে তুলেছেন বিশেষায়িত হাসপাতাল। অত্যন্ত বিনয়ী ও প্রচারবিমুখ ডা.
কামরুল ইসলাম গাড়ী-বাড়ী অর্থবিত্তে নয়, সুখ খুঁজে পেয়েছেন মানব সেবায়।
ডা. কামরুল মানবসেবার মহান ব্রত থেকেই চিকিৎসাকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। পেছনে ছিল পিতা-মাতার অনুপ্রেরণা। নিজের পেশাকে কেবল সামাজিক ও আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের সিঁড়ি বানাননি তিনি। বরং সরকারী চাকুরী ছেড়ে দিয়ে দেশের দরিদ্র কিডনী রোগীদের জন্য নামমাত্র মূল্যে কিডনী প্রতিস্থাপন ও মানসম্মত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের জন্য তৈরি করেছেন বিশেষায়িত এক প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর কিডনী ডিজিজেস (সিকেডি) অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল’। ঢাকার শ্যামলীর ৩ নম্বর সড়কে অবস্থিত ৬ তলার একটি সাদামাটা ভবনে চলছে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম।
যেখানে প্রতিবেশী দেশে কিডনী প্রতিস্থাপনের জন্য ব্যয় করতে হয় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা, সেখানে সিকেডি হাসপাতালে সার্জারী, প্রয়োজনীয় মেডিসিন, সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ১৫ দিন আইসিইউতে থাকার পরও মোট খরচ হয় মাত্র ২ লাখ ১০ হাযার টাকা। এছাড়া ১৫ দিন পরও যদি তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তবে তাকে থাকতে হবে কিডনী আইসিইউতে। এক্ষেত্রেও কোন খরচ নেওয়া হয় না। এছাড়া ট্রান্সপ্লান্টের পরেই দায়িত্ব শেষ হয় না ডা. কামরুল ইসলামের। আজীবনের জন্য কিডনী দাতা ও কিডনী গ্রহীতার জন্য রয়েছে নিয়মিত ফ্রী চেকআপ এবং রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা। কিডনী প্রতিস্থাপনের আগে ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হ’লে হাসপাতালেই রয়েছে মাত্র ১৫০০ টাকায় ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা।
চলমান করোনা মহামারির মধ্যে গণস্বাস্থ্য কিডনী ডায়ালাইসিস সেন্টার ছাড়া যখন সব সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে ডায়ালাইসিসসহ কিডনী রোগীদের অন্য সেবা কার্যক্রমগুলো বন্ধ ছিল, তখনও সিকেডি হাসপাতাল তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। মহামারির দেড় বছরে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ২৫০টির বেশী কিডনী। বর্তমানে এই হাসপাতালে প্রতি সপ্তাহে ৪টি করে কিডনী প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। যা দেশের অন্য যেকোন হাসপাতালের তুলনায় বেশী।
নির্ধারিত ন্যূনতম খরচ বাদে কিডনী প্রতিস্থাপনের জন্য বিশেষজ্ঞ সার্জনের কোন ফী নেন না ডা. কামরুল। এছাড়া কিডনী সংরক্ষণের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা এক ধরনের মূল্যবান তরলের বিকল্পও আবিষ্কার করেছেন তিনি। এভাবে নিজ পেশার মাধ্যমে সমাজের নিম্ন আয়ের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতার অনন্য নযীর স্থাপন করে চলেছেন তিনি।
ডা. কামরুল বলেন, আমি এ হাসপাতাল ধনীদের জন্য করিনি। ধনীদের জন্য দেশে বহু হাসপাতাল রয়েছে। যারা ২০ শতাংশ মানুষকে সেবা দিচ্ছে। অন্যদিকে ৮০ শতাংশ মানুষ যারা এসব হাসপাতালে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে না, দেশের বাইরে যাওয়ার মতো সামর্থ্য যাদের নেই, আমার হাসপাতাল তাদের জন্য। যে কারণে আমার এ হাসপাতালে কর্পোরেট হাসপাতালের মতো আরামদায়ক পরিবেশ আমি দিতে পারি না। তবে আমাদের টার্গেট বিশ্বমানের চিকিৎসা দেওয়া। মাঝে মাঝে উচ্চবিত্তরা আমার এখানে আসলে একটু বিপদে পড়ে যান। কারণ তাদের লিফট প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমার এখানে লিফট নেই।
মধ্য ও নিম্নবিত্তদের জন্য শেষ নিঃশ্বাস অবধি হাসপাতাল চালাতে চান ডা. কামরুল। তবে এ যাত্রায় নিতে চান না কোন অনুদান। শুধু রোগীদের জন্য নয়, ভাবেন প্রতিষ্ঠানের আড়াইশ’ কর্মীর কথাও। তাদের জন্য হাসপাতালের পক্ষ থেকে রয়েছে বিনামূল্যে খাওয়ার ব্যবস্থা। তাদের ভবিষ্যতের জন্য ব্যাংকে টাকাও জমাচ্ছেন তিনি।
এতকিছুর পরেও ডা. কামরুল আক্ষেপ করে বলেন, প্রতিদিন অনেক রোগী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই হাসপাতালে ফলোআপের জন্য আসেন। এদের বেশীর ভাগই দরিদ্র। তারা সারারাত সফর করে ঢাকায় এসে সারাদিন হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সন্ধ্যায় ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরে যান। মাঝের সময়টাতে তাদের একটু বিশ্রাম ও খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলে শান্তি পেতাম। যা এখনো আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
তিনি সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেন, আমি হয়ত টাকা নেই না। কিন্তু আমাকে আপনারা সবাই যে প্রচারণা, সম্মান-ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছেন। আমার তো ভয় হয়। মৃত্যুর পরের জীবনে যদি আমি এগুলোর কোন বিনিময় না পাই!
মুক্তিযুদ্ধে মৃত্যুবরণকারী পিতার অনুপ্রেরণা আর মানবসেবায় আগ্রহ থেকেই চিকিৎসাসেবা বেছে নিয়েছিলেন ইশ্বরদীর সন্তান ডা. কামরুল। ৭১-এ স্বামী হারানোর পর এসএসসি পাস করা মা রহীমা খাতূন তার চার ছেলেকে মানুষ করার জন্য আবার পড়াশুনা শুরু করেন। এইচএসসি পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সমাজ বিজ্ঞানে ১ম স্থান অধিকার করে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হন।
ডা. কামরুল এসএসসি ও এইচএসসিতে বোর্ড স্ট্যান্ড করেন এবং ১৯৮২ সালে তখনকার ৮টি মেডিকেল কলেজের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় ১ম স্থান অধিকার করেন। ১৯৮৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করার পর সরকারী ডাক্তার হিসাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগ দেন। পরবর্তীতে সার্জারিতে এফসিপিএস ও এডিনবরা রয়েল কলেজ থেকে এফআরসিএস এবং ইউরোলজিতে ৫ বছর মেয়াদি এমএস কোর্স সম্পন্ন করে জাতীয় কিডনী ও ইউরোলজি হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। অতঃপর সরকারী হাসপাতালের নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি ২০১১ সালে সরকারী চাকুরী থেকে ইস্তেফা দিয়ে শ্যামলীতে নিজ উদ্যোগে উক্ত কিডনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।
[আমরা তার মহতী উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। সেই সাথে অন্যদের প্রতি মানব সেবায় এগিয়ে আসার আহবান জানাই। (স.স.)]