ভ্যালোরি টেইলর। ৮০ বছর বয়স পেরিয়েও তরুণী। সেবা নিয়ে এগিয়ে যেতে চান বহুদূর। লিকলিকে গড়ন। বয়স তার উদ্যমে বাধা হ’তে পারেনি। বললেন, মানুষ বলে টোমার বিয়ে হয়েছে? আমি বলি, হয়েছে। কার সঙ্গে? সিআরপি (সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড)-এর সঙ্গে! তারপর হেসে ফেললেন। চোখের কোণে অশ্রু জমল। যে হাসি তৃপ্তির। যে হাসি সেবায় সুস্থ মানুষের আনন্দের প্রতিচ্ছবি। তার হাতে গড়া প্রিয় প্রতিষ্ঠান ‘সিআরপি’ গত ৯ই ডিসেম্বর ৪৪ বছরে পা দিল।
সিআরপিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২৪ বছর আগে একটি শিশুকে ফার্মগেট ব্রিজের নিচে ফেলে যায় কেউ একজন। সেখান থেকে ফার্মগেটে অবস্থিত চ্যারিটেবল মিশন নামের এক প্রতিষ্ঠান তাকে তাদের হেফাযতে নেয়। সিআরপির বিশেষায়িত স্কুলে নিয়ে আসা হয়। অনাথ এই শিশুটি সিআরপির সার্বিক তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠতে থাকে। বর্তমানে সিআরপি তার চলাচলের উপযোগী হুইল চেয়ার, বাসস্থান, কর্মসংস্থান ও বিবাহের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। হয়তো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু দেখে পরিবার ফেলে গেছে। এ রকম হাযারো মানুষকে আলোর পথ দেখিয়েছে সিআরপি।
প্রতিবন্ধী যেকোন মানুষ এই সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা পায়। বেশী ভারী বোঝা মাথায় নেওয়া, গাছ বা উঁচু থেকে পড়ে যাওয়া কিংবা অন্য কোন কারণে মানুষ মেরুরজ্জুতে আঘাত পেতে পারে। সারা দেশ থেকে এই সমস্যা নিয়ে রোগীরা যায় সিআরপিতে।
ভ্যালোরি টেইলর ১৯৬৭ সালে লন্ডনের সেন্ট টমাস হাসপাতাল থেকে ফিজিওথেরাপির ওপর পড়াশোনা করেন। ইচ্ছা মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। মাত্র ১৫ মাসের জন্য অভিজ্ঞতা নিতে এসেছিলেন চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায়। তিনি বলেন, মনে হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান আমার ভালো লাগবে না। তারপর চন্দ্রঘোনার সৌন্দর্য অবাক করলেও কষ্ট পেতে থাকি, যখন দেখি ঐ হাসপাতালে একটি হুইলচেয়ারও নেই। অথচ সেখানে পঙ্গুদের চিকিৎসা করতে হয়। তারপর বাংলাদেশকে ভালোবেসে রয়ে গেলেন সেখানেই। তঁার বাংলাদেশে অবস্থানের বয়স বাংলাদেশের মোট বয়সেরও চেয়েও বেশী। তিনি মুগ্ধ এই দেশের মানুষের আতিথেয়তায়।
১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৯ সালে এই হাসপাতালের দু’টি পরিত্যক্ত গুদামঘরে তিন-চারজন রোগী নিয়ে শুরু করেন সিআরপি। ১৯৯০ সালে ঢাকার কাছে সাভারে পাঁচ একর জায়গা কিনে সিআরপির স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তোলেন টেইলর। যেটি এখন ১০০ বেডের হাসপাতাল। এখানে ১০০ জন স্পাইনাল ইনজুরি রোগীকে সেবা দেওয়া হয়। এছাড়া দেশের পঁাচটি বিভাগে ১৩টি শাখা রয়েছে সিআরপির। বছরে প্রায় ৮০ হাযার রোগীকে সেবা দেওয়া হয়। বর্তমানে সিআরপিতে ১ হাযারের বেশী কর্মী কাজ করছেন। তাদের অনেকে এখানে চিকিৎসা নিতে এসে পুনর্বাসিত হয়েছেন।
বিভিন্ন দেশের দাতাগোষ্ঠী ও সংস্থার অনুদানে পরিচালনা করা হয় সিআরপির কার্যক্রম। যারা সিআরপিতে বিভিন্ন সময়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করতে এসেছিলেন, পরে তারাই এটিকে পরিচালনার জন্য অর্থের জোগান দিতে থাকেন।
কুমিল্লার বাসিন্দা সিআরপির সেবা নেওয়া রফীকুল ইসলাম সোহেল বলেন, ২০১৪ সালের সড়ক দুর্ঘটনায় স্পাইনাল কর্ড ইনজুরড হওয়ায় শারীরিক চলনক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। পরে সিআরপিতে চিকিৎসা গ্রহণ করি। পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হুইল চেয়ারে বসেই জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা লাভ করি। সিআরপি আমাকে শিখিয়েছে জীবনের জটিল পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে কিভাবে মানিয়ে নিতে হবে ও মূলধারার মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে।