ছিয়াম আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ক্ষমা লাভের অতুলনীয় একটি মাধ্যম। মহান আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মাদীর উপরে রামাযানের মাসব্যাপী ছিয়ামকে ফরয করেছেন। পাশাপাশি বছরের অন্যান্য মাসগুলোতেও বিভিন্ন ধরনের নফল ছিয়াম বিধিবদ্ধ করেছেন। তন্মধ্যে রয়েছে মাসিক, সাপ্তাহিক ও বিশেষ দিনের ছিয়াম। জান্নাত পিয়াসী বান্দাগণ এসব ছিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহর রেযামন্দী হাছিল করতে পারে। সেই সাথে আল্লাহ বান্দাদের এমন কিছু বিশেষ আমলের সুসংবাদ দিয়েছেন, যা সম্পাদনের মাধ্যমে ছিয়াম পালন না করেও ছিয়ামের ন্যায় ফযীলত লাভ করা যায়। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা এই বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
১. বিবাদ মীমাংসা করা :
মুসলিম সমাজের কোথাও সম্পর্কের অবনতি ঘটলে যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে এসে এই বন্ধন অটুট রাখা এবং বিবাদ মীমাংসায় কল্যাণময় ভূমিকা রাখা ঈমানের দাবী। কেননা ইসলাম মুসলমানদের বৃহত্তর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوْا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ- ‘মুমিনগণ পরস্পরে ভাই ব্যতীত নয়। অতএব তোমরা তোমাদের দু’ভাইয়ের মধ্যে সন্ধি করে দাও। আর আল্লাহকে ভয় কর। তাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে’ (হুজুরাত ৪৯/১০)। তিনি আরো বলেন, وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا، ‘আর মুমিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হ’লে তোমরা তাদের মাঝে মীমাংসা করে দাও’ (হুজুরাত ৪৯/১০)।
মুসলমানদের পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসার মাধ্যমে একজন বান্দা একই সাথে ছিয়াম, ক্বিয়াম ও দান-ছাদাক্বার নেকী লাভ করতে পারে। আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِأَفْضَلَ مِنْ دَرَجَةِ الصِّيَامِ وَالصَّلَاةِ وَالصَّدَقَةِ، قَالُوا: بَلَى، قَالَ: صَلَاحُ ذَاتِ البَيْنِ، فَإِنَّ فَسَادَ ذَاتِ البَيْنِ هِيَ الحَالِقَةُ، وقَالَ: هِيَ الحَالِقَةُ لَا أَقُولُ تَحْلِقُ الشَّعَرَ، وَلَكِنْ تَحْلِقُ الدِّينَ، ‘আমি কি তোমাদেরকে ছালাত, ছিয়াম ও ছাদাক্বার চেয়ে উত্তম আমলের ব্যাপারে অবহিত করব না? ছাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, পরস্পর সুসম্পর্ক স্থাপন করা। কারণ পরস্পর সুসম্পর্ক নষ্ট হওয়ার অর্থ হ’ল মুন্ডনকারী। তিনি বলেন, এটা মুন্ডনকারী বলতে আমি বলছি না যে, তা মাথা মুড়িয়ে দেয়, বরং তা দ্বীনকে মুন্ডন করে দেয় (বিনাশ করে)’।[1] আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ বলেন, এই হাদীছে ‘ফাসাদ দ্বীনকে বিনষ্ট করে’ বলার মাধ্যমে ঝগড়া-বিবাদের ভয়াবহতা বর্ণনা করা হয়েছে এবং বিবাদ মীমাংসা করাকে মর্যাদার দিক দিয়ে ছিয়াম, ক্বিয়াম ও ছাদাক্বার চেয়েও উত্তম আমল গণ্য করা হয়েছে’।[2]
২. মিসকীন ও বিধবা মহিলাকে সহযোগিতা করা :
সহায়-সম্বলহীন ইয়াতীম, মিসকীন ও অসহায় বিধবা মহিলাদের সহযোগিতার মাধ্যমে একজন মুসলিম ছিয়াম পালনকারী, তাহাজ্জুদ আদায় অথবা আল্লাহর পথে সংগ্রামরত মুজাহিদের মত মর্যাদা লাভ করতে পারে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,السَّاعِي عَلَى الأَرْمَلَةِ وَالمِسْكِينِ كَالـمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللهِ أَوْ كَالَّذِي يَصُومُ النَّهَارَ وَيَقُومُ اللَّيْلَ، ‘বিধবা ও মিসকীনদের ভরণ-পোষণের জন্য চেষ্টারত ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদ অথবা সারাদিন ছিয়াম পালনকারী ও রাতের বেলা (তাহাজ্জুদ) ছালাত আদায়কারীর সমান ছওয়াবের অধিকারী’।[3] অপর বর্ণনায় এসেছে, كَالْقَائِمِ لَا يَفْتُرُ، وَكَالصَّائِمِ لَا يُفْطِرُ، ‘(তার মর্যাদা হ’ল) সেই তাহাজ্জুদগুযারের মত, যে কখনো অলস হয় না এবং সেই ছিয়াম পালনকারীর মত, যে কখনো ছিয়াম ভাঙ্গে না’।[4] শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন, বিধবা ও ইয়াতীম-মিসকীনকে সহযোগিতা করার অর্থ হ’ল তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা, তাদের উপকার করা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো দেখভাল করা’।[5]
৩. সচ্চরিত্রবান হওয়া :
সচ্চরিত্রবান ব্যক্তিরা তাদের সদাচরণের মাধ্যমে ছায়েম ও তাহাজ্জুদগুযারের মর্যাদা লাভ করতে পারে। মা আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,إِنَّ الْمُؤْمِنَ لَيُدْرِكُ بِحُسْنِ خُلُقِهِ دَرَجَاتِ قَائِمِ اللَّيْلِ صَائِمِ النَّهَارِ، ‘নিশ্চয়ই মুমিন বান্দা তার সদাচরণের মাধ্যমে রাতে ক্বিয়ামকারী এবং দিনে ছিয়াম পালনকারীর মর্যাদা লাভ করে থাকে’।[6] শুধু তাই নয় ক্বিয়ামতের দিন মীযানে (পাল্লাতে) সবচেয়ে ভারী বস্ত্ত হবে সদাচরণ। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَا مِنْ شَيْءٍ يُوضَعُ فِي المِيزَانِ أَثْقَلُ مِنْ حُسْنِ الخُلُقِ، وَإِنَّ صَاحِبَ حُسْنِ الخُلُقِ لَيَبْلُغُ بِهِ دَرَجَةَ صَاحِبِ الصَّوْمِ وَالصَّلَاةِ، ‘মীযানে (পাল্লাতে) যা কিছু রাখা হবে, তন্মধ্যে সবচেয়ে ভারী বস্ত্ত হবে সচ্চরিত্র। একজন সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি তার সদাচারের মাধ্যমে (নফল) ছিয়াম পালনকারী ও রাতের (নফল) ছালাত আদায়কারীর মর্যাদায় উপনীত হয়’।[7] হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, মানুষের সাথে আচার-আচরণের ক্ষেত্রে তিনটি উপায়ে সচ্চরিত্রবান হওয়া যায়। (১) উপকার ও সহযোগিতার মাধ্যমে মানুষের কষ্ট দূর করা (২) শ্রম ও অর্থের মাধ্যমে দানশীল হওয়া এবং (৩) হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে কথা বলা’।[8]
৪. পানাহারের পর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা :
আল্লাহর প্রতিটি অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি অন্যতম বড় নে‘মত হ’ল খানাপিনা। মহান আল্লাহ খানাপিনার ব্যাপারে শুকরিয়া আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَاشْكُرُوا لِلَّهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমরা তোমাদের যে রূযী দান করেছি, সেখান থেকে পবিত্র বস্ত্ত সমূহ ভক্ষণ কর। আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা কেবল তাঁরই দাসত্ব করে থাক’ (বাক্বারাহ ২/১৭২)। আল্লাহর এই নির্দেশকে মান্য করে যারা খানাপিনার পরে শুকরিয়া আদায় করে, তিনি তাদেরকে ছায়েমের মর্যাদা দান করেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,الطَّاعِمُ الشَّاكِرُ بِمَنْزِلَةِ الصَّائِمِ الصَّابِرِ، ‘কৃতজ্ঞ আহারকারী ধৈর্যশীল ছিয়াম পালনকারীর সমান মর্যাদাশীল’।[9] ইবনু বাত্ত্বাল (রহঃ) বলেন,هَذَا مِنْ تَفَضُّلِ اللهِ عَلَى عِبَادِهِ أَنْ جَعَلَ لِلطَّاعِمِ إِذَا شَكَرَ رَبَّهُ عَلَى مَا أَنْعَمَ بِهِ عَلَيْهِ ثَوَابَ الصَّائِمِ الصَّابِرِ، ‘বান্দার প্রতি আল্লাহর অন্যতম অনুগ্রহ হ’ল তিনি আহারকারীর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, সে যদি নে‘মতপ্রাপ্ত হয়ে স্বীয় রবের শুকরিয়া আদায় করে, তাহ’লে ধৈর্যশীল ছায়েমের নেকী লাভ করতে পারবে’।[10] উল্লেখ্য যে, শুকরিয়া আদায়ের অর্থ হ’ল হৃদয় দিয়ে আল্লাহর নে‘মতকে উপলব্ধি করা, যবান দিয়ে এর প্রশংসা করা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে নে‘মতদাতার আনুগত্য করা। সুতরাং শুধু মুখে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলাই কেবল শুকরিয়া নয়; বরং তা শুকরিয়া আদায়ের একটি অংশ মাত্র।[11]
৫. জুম‘আর দিনের আদব রক্ষা করা :
জুম‘আ মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন। জুম‘আর দিনের আমলের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদের যে দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, তন্মধ্যে পাঁচটি আমল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ غَسَّلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَاغْتَسَلَ، ثُمَّ بَكَّرَ وَابْتَكَرَ، وَمَشَى وَلَمْ يَرْكَبْ، وَدَنَا مِنَ الْإِمَامِ فَاسْتَمَعَ وَلَمْ يَلْغُ؛ كَانَ لَهُ بِكُلِّ خُطْوَةٍ عَمَلُ سَنَةٍ؛ أَجْرُ صِيَامِهَا وَقِيَامِهَا، ‘(১) যে ব্যক্তি জুম‘আর দিন অন্যকে গোসল করাল এবং নিজে গোসল করল। (২) (মসজিদে) আগে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দিল এবং নিজেও আগেভাগে মসজিদে গেল। (৩) পায়ে হেঁটে গেল এবং কোন কিছুতে (যানবাহনে) আরোহণ করল না। (৪) অতঃপর ইমামের নিকটবর্তী হয়ে মনোযোগ সহকারে খুৎবা শ্রবণ করল এবং (৫) কোন অনর্থক কাজ করল না। তাহ’লে তার জন্য প্রতি কদমে এক বছরের (নফল) ছিয়াম ও (রাত্রিকালীন) ক্বিয়ামের নেকী রয়েছে’।[12] সিন্ধী (রহঃ) বলেন, এর অর্থ হ’ল- সেই ব্যক্তি তার প্রতি পদক্ষেপের বিনিময়ে এক বছর নিয়মিত ছিয়াম ও তাহাজ্জুদ আদায়ের মর্যাদা লাভ করবে’।[13] সুতরাং কারো বাড়ী থেকে মসজিদে যাওয়ার জন্য যদি ১০০ কদম হাঁটতে হয়, আর সে যদি জুম‘আর দিনের উল্লেখিত পাঁচটি আদব রক্ষা করতে পারে, তাহ’লে তার আমলনামায় ১০০ বছরের নফল ছিয়াম ও রাতে তাহাজ্জুদ ছালাত আদায়ের ছওয়াব লিখে দেওয়া হবে।
৬. মুসলিম ভূখন্ডের সীমান্ত পাহারা দেওয়া :
আল্লাহর পথে পাহারা দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যে ইবাদত সম্পাদনের মাধ্যমে বান্দা অশেষ নেকী হাছিল করার পাশাপাশি ছিয়াম পালন করার নেকী লাভ করে। সালমান ফারেসী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, رِبَاطُ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ خَيْرٌ مِنْ صِيَامِ شَهْرٍ وَقِيَامِهِ، وَإِنْ مَاتَ جَرَى عَلَيْهِ عَمَلُهُ الَّذِي كَانَ يَعْمَلُهُ، وَأُجْرِيَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ، وَأَمِنَ الْفُتَّانَ، ‘আল্লাহর পথে একদিন ও এক রাত সীমান্ত পাহারা দেওয়া একমাস ছিয়াম পালন এবং ইবাদতে রাত জাগার চেয়েও শ্রেষ্ঠ। আর যদি এ অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে, তাহ’লে তার আমলের ছওয়াব জারী থাকবে, তার জন্য (শহীদদের মত) রিযিক অব্যাহত রাখা হবে এবং সে (কবরের) ফেৎনা সমূহ থেকে নিরাপদ থাকবে’।[14] অর্থাৎ একদিন-একরাত সীমান্ত পাহারা দেওয়ার মাধ্যমে টানা একমাস তাহাজ্জুদ ও নফল ছিয়াম পালন করার নেকী পাওয়া যায়।
৭. সর্বাবস্থায় তাক্বওয়া অবলম্বন করা :
সকল ইবাদতের মূল উৎস হ’ল তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি। তাক্বওয়া ব্যতীত কোন ইবাদত একনিষ্ঠভাবে সম্পাদন করা সম্ভব নয়। ইসলামের চতুর্থ খলীফা আলী ইবনে আবী ত্বালেব (রাঃ) তাক্বওয়ার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন,التقوى هي الخوف من الجليل والعمل بالتنزيل والقناعة بالقليل والاستعداد ليوم الرحيل، ‘মহান আল্লাহকে ভয় করে চলা, তাঁর নাযিলকৃত কিতাব অনুযায়ী আমল করা, অল্পে তুষ্ট থাকা এবং মৃত্যুর দিনের জন্য সদা প্রস্ত্তত থাকার সমন্বিত নাম হ’ল তাক্বওয়া’।[15] ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) যখন জিহাদের জন্য কোন বাহিনী প্রেরণ করতেন, তাদের উপদেশ দিয়ে বলতেন,لا تصوموا فإن التقوى على الجهاد أفضل من الصوم، ‘তোমরা (জিহাদরত অবস্থায়) ছিয়াম রাখবে না। কেননা জিহাদে তাক্বওয়া অবলম্বন করা ছিয়াম পালন করার চেয়েও উত্তম’।[16] অনুরূপভাবে সকল ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে-গোপনে আল্লাহভীতির মাধ্যমে বান্দা ছায়েমের মর্যাদা পেতে পারে। যেমন আয়-রোযগারের ক্ষেত্রে হারাম বর্জন করে হালাল পন্থায় রোযগার করার চেষ্টা করা। হালাল উপার্জনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কাযী আবূ ইয়া’লা মাওছীলী (রহঃ) বলেন, هُوَ أَفْضَلُ مِنْ التَّفَرُّغِ إلَى طَلَبِ الْعِبَادَةِ مِنْ الصَّوْمِ وَالصَّلَاةِ وَالْحَجِّ، ‘এটা (আল্লাহর ভয়ে হালাল উপার্জন করা) ছিয়াম, ছালাত ও হজ্জের মত ইবাদত সম্পাদনের প্রতি মনোযোগী হওয়ার চেয়ে উত্তম’।[17] এখানে ছিয়াম, ছালাত ও হজ্জের মাধ্যমে তিনি নফল ইবাদতকে বুঝিয়েছেন।
৮. জ্ঞান অর্জন করা ও তা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করা :
দ্বীনের বিধি-বিধান পালনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয।[18] আল্লাহ বলেন, فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، ‘অতএব তুমি জান যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)। এখানে প্রতিটি ইবাদতের পূর্বে জ্ঞান অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাইতো মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেছেন,أَنَّ الْعِلْمَ حَيَاةُ الْقُلُوبِ مِنَ الْجَهْلِ، وَمَصَابِيحُ الْأَبْصَارِ مِنَ الظُّلَمِ، يَبْلُغُ الْعَبْدُ بِالْعِلْمِ مَنَازِلَ الْأَخْيَارِ، وَالدَّرَجَاتِ الْعُلَى فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، التَّفَكُّرُ فِيهِ يَعْدِلُ الصِّيَامَ، وَمُدَارَسَتُهُ تَعْدِلُ الْقِيَامَ، بِهِ تُوصَلُ الْأَرْحَامُ، وَبِهِ يُعْرَفُ الْحَلَالُ مِنَ الْحَرَامِ، وَهُوَ إِمَامُ الْعَمَلِ، وَالْعَمَلُ تَابِعٌ لَهُ، ‘জ্ঞান অন্তরগুলোকে মূর্খতা থেকে পুনর্জীবিত করে এবং আঁধার কাটিয়ে দূরদর্শিতার প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয়। জ্ঞানের মাধ্যমেই বান্দা উত্তমদের স্তরে উপনীত হয় এবং দুনিয়া-আখেরাতে সুউচ্চ মর্যাদায় উন্নীত হয়। ইলম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ছিয়াম সমতুল্য এবং তার পঠন-পাঠন ক্বিয়ামুল লায়লের মত। জ্ঞানের মাধ্যমেই আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা যায় এবং এর মাধ্যমেই হালাল ও হারাম সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। জ্ঞান হ’ল আমলের নেতা এবং আমল জ্ঞানের অনুগামী’।[19]
ইমাম ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় জ্ঞানই দ্বীনের মূল স্তম্ভ এবং সর্বোচ্চ আলো। কখনো কখনো জ্ঞানার্জনের নিমিত্তে বইয়ের পাতাগুলো উল্টানো নফল ছিয়াম, ছালাত, হজ্জ এবং জিহাদ অপেক্ষা উত্তম হয়ে থাকে। এমন কিছু মানুষ আছে, যে ইলম থেকে বিমুখ থাকার কারণে নিজের ইবাদতে প্রবৃত্তির অনুসরণে ডুবে থাকে। সে নফল ইবাদত করতে গিয়ে অনেক অকাট্য ফরয ইবাদতকে নষ্ট করে দেয়। স্পষ্ট ওয়াজিবকে ত্যাগ করে তার ধারণাপ্রসূত উত্তম (?) কাজ করে। (অথচ শরী‘আতে সেটা উত্তম কাজ নয়)। হায়! যদি তার নিকটে সঠিক জ্ঞানের একটি আলোকবর্তিকা থাকত, তাহ’লে অবশ্যই সে সঠিক পথ পেত’।[20]
৯. ছায়েমদের খেদমত করা :
ছিয়ামের ন্যায় নেকী লাভ করার অন্যতম একটি উপায় হ’ল ছায়েমদের খেদমত করা। আনাস (রাঃ) বলেন, كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي السَّفَرِ، فَمِنَّا الصَّائِمُ وَمِنَّا الْمُفْطِرُ، قَالَ: فَنَزَلْنَا مَنْزِلًا فِي يَوْمٍ حَارٍّ، أَكْثَرُنَا ظِلًّا صَاحِبُ الْكِسَاءِ، وَمِنَّا مَنْ يَتَّقِي الشَّمْسَ بِيَدِهِ، قَالَ: فَسَقَطَ الصُّوَّامُ، وَقَامَ الْمُفْطِرُونَ، فَضَرَبُوا الْأَبْنِيَةِ وَسَقَوْا الرِّكَابَ ‘আমরা একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে একটি সফরে ছিলাম। আমাদের কেউ ছিয়াম পালন করেছেন, আবার কেউ ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর প্রচন্ড গরমের সময় আমরা এক প্রান্তরে অবতরণ করলাম। চাদর বিশিষ্ট লোকেরাই আমাদের মধ্যে সর্বাধিক ছায়া লাভ করতে সক্ষম হ’ল। আমাদের কেউ কেউ নিজ হাত দ্বারা সূর্যের কিরণ থেকে নিজেকে রক্ষা করছিলেন। অবশেষে ছায়েমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ল এবং ছিয়াম ত্যাগকারীরা সুস্থ থাকল। ফলে তারা তাঁবু খাটালো এবং উটকে পানি পান করাল, [কিন্তু ছায়েমরা কোন কাজ করল না (বুখারী)] তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ذَهَبَ الْمُفْطِرُونَ الْيَوْمَ بِالْأَجْرِ، ‘আজকে তো ছিয়াম পরিত্যাগকারীরা সব নেকী অর্জন করে নিল’।[21] মূলত ছায়েমদের খেদমত করার কারণে রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে এই কথাটি বলেছেন। যার মর্ম হ’ল খেদমতকারীরা একই সাথে সেবা করার এবং ছিয়াম পালন করার ছওয়াব হাছিল করল।[22]
১০. ছায়েমদের ইফতার করানো :
ছিয়াম না রেখেও ছিয়ামের মর্যাদা হাছিলের উৎকৃষ্ট মাধ্যম হ’ল ছায়েমদের ইফতার করানো। যায়েদ ইবনু খালিদ আল-জুহানী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ، غَيْرَ أَنَّهُ لَا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْئًا، ‘যে ব্যক্তি কোন ছায়েমকে ইফতার করায়, সেই ব্যক্তির জন্যেও ছায়েমের সমপরিমাণ ছওয়াব রয়েছে। কিন্তু এর ফলে ছায়েমের নেকী থেকে বিন্দুমাত্র কমানো হবে না’।[23]
উপসংহার :
নেক আমল আমাদের মূল সম্বল। মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের মূল পাথেয়। যে ব্যক্তি যত বেশী পাথেয় সঞ্চয় করবে, তার আখেরাতের জীবন তত বেশী সমৃদ্ধ হবে। আর যে পাথেয় সংগ্রহের ব্যাপারে গাফেল থাকবে, তার আখেরাত হবে অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাই বুদ্ধিমান মুমিনের কর্তব্য হ’ল- ছওয়াব অর্জনের সুযোগগুলো কখনো হাতছাড়া না করা এবং সাধ্যানুযায়ী নেক আমলের চেষ্টা করা। আর কোন আমলের দ্বিগুণ নেকী পাওয়ার অন্যতম উপায় হ’ল অন্যকে সেই আমলের দাওয়াত দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ، ‘যে ব্যক্তি অন্য কোন মানুষকে কোন নেক কাজের পথ দেখায়, সে ঐ নেক কাজ সম্পাদনকারীর সমান ছওয়াব পায়’।[24] সুতরাং কেউ যদি উল্লেখিত আমলগুলোর দাওয়াত অন্যদেরকে দেয় এবং তারা যদি সেই আমলগুলো করে, তাহ’লে শিক্ষাদানকারীও সমান ছওয়াব লাভ করবে ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ আমাদেরকে উক্ত আমলগুলো সম্পাদন করে ছিয়ামের নেকী লাভের সুযোগ দান করুন এবং তাঁর ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আখেরাতের প্রস্ত্ততি গ্রহণের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম.এ (অধ্যয়নরত), আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. তিরমিযী হা/২৫০৯; আবূদাঊদ হা/৪৯১৯; মিশকাত হা/৫০৩৮, সনদ ছহীহ।
[2]. আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ, শারহু সুনান আবীদাঊদ ২৮/২০৩।
[3]. তিরমিযী হা/১৯৬৯; নাসাঈ হা/২৫৭৭; ইবনু মাজাহ হা/২১৪০, সনদ ছহীহ।
[4]. বুখারী হা/৬০০৭; মুসলিম হা/২৯৮২।
[5]. উছায়মীন, শারহু রিয়াযিছ ছালেহীন ৩/১০০।
[6]. আবূদাঊদ হা/৪৭৯৮; মিশকাত হা/ ৫০৮২, সনদ ছহীহ।
[7]. তিরমিযী হা/২০০৩; আবূদাঊদ হা/ ৪৭৯৯, সনদ ছহীহ।
[8]. ইবনুল মুফলিহ, আল-আদাবুশ শার‘ঈয়্যাহ, ২/২১৬ পৃঃ।
[9]. তিরমিযী হা/২৪৮৬; ইবনু মাজাহ হা/১৭৬৪; মিশকাত হা/৪২০৫, সনদ ছহীহ।
[10]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী ৯/৫৮৩ পৃঃ।
[11]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকিন ২/২৪৬ পৃঃ।
[12]. আবূদাঊদ হা/৩৪৫; তিরমিযী হা/৪৯৬; ইবনু মাজাহ হা/১০৮৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৪০৫, সনদ ছহীহ।
[13]. ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ ৪/৪৭২।
[14]. বুখারী হা/২৮৯২; মুসলিম হা/১৯১৩।
[15]. শানক্বীত্বী, লাওয়ামি‘উদ দুরার, পৃঃ ১১০; সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, পৃ. ৪২১।
[16]. ইবনু রজব হাম্বলী, লাত্বায়েফুল মা‘আরেফ, পৃঃ ১২৫।
[17]. আল-আদাবুশ শার‘ঈয়্যাহ ৩/২৬৭।
[18]. ইবনু মাজাহ হা/২২৪; ছহীহুত তারগীব হা/৭২; মিশকাত হা/২১৮, সনদ ছহীহ।
[19]. মাদরিজুস সালেকীন ৩/২৪৬পৃঃ ।
[20]. ইবনুল জাওযী, ছায়দুল খাত্বের, পৃঃ ১১৩।
[21]. বুখারী হা/২৮৯০; মুসলিম হা/১১১৯।
[22]. ফাৎহুল বারী ৪/১৮৪।
[23]. তিরমিযী হা/৮০৭; ইবনু মাজাহ হা/১৭৪৬, সনদ ছহীহ।
[24]. মুসলিম হা/১৮৯৩; আবূদাঊদ হা/৫১২৯; তিরমিযী হা/২৬১৭; মিশকাত হা/২০৯।