বলা হয় ‘শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড’। তবে তা যদি হয় আদর্শহীন কুশিক্ষা তখন সে শিক্ষাই হবে জাতি ধ্বংসের মূল কারণ। কোন জাতির জাতিসত্তাকে চিরতরে বিলীন করতে চাইলে সর্বাগ্রে সে জাতির শিক্ষাব্যবস্থার উপর দন্ত-নখর বসাতে হয়। আর সে কাজটিই অত্যন্ত সুচতুরভাবে করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। শতকরা ৯৫ভাগ মুসলমানের এই দেশে মুসলিম জাতিসত্তাকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য নাস্তিতক্যবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী এই নয়া শিক্ষা কারিকুলাম জাতির স্কন্ধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ‘কারিকুলাম’ (Curriculum) বা শিক্ষাক্রম হ’ল একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংবিধান। শিক্ষা কার্যক্রম কি উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে, কি বিষয়বস্তুর মাধ্যমে উদ্দেশ্য অর্জিত হবে; কখন, কিভাবে, কি উপকরণের সাহায্যে তা বাস্তবায়িত হবে, শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতি কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে এসবের যাবতীয় পরিকল্পনার রূপরেখাকেই শিক্ষাক্রম বা কারিকুলাম বলা হয়।
গত বছর (২০২৩ সালে) প্রথম, ৬ষ্ঠ ও সপ্তম এই তিনটি শ্রেণীতে পরীক্ষামূলকভাবে এই কারিকুলাম চালু হয়েছিল। তখন থেকেই সারাদেশে এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। অভিভাবকগণ রাজপথে নামেন। মিছিল, মিটিং, সমাবেশ এবং বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে এর অসারতা তুলে ধরেন। কিন্তু কর্তা ব্যক্তিদের কর্ণকুহরে কিছুই প্রবেশ করেনি। এরি মধ্যে চলতি বছর আরো চারটি শ্রেণীতে চালু করা হয় এই কারিকুলাম। দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে। এরপর ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণীতে, ২০২৬ সালে একাদশ শ্রেণীতে এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণীতে ধাপে ধাপে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হবে মর্মে জানানো হয়। এভাবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে জাতি ধ্বংসের নীল নকশা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহল। কি আছে এই কারিকুলামে? কেন এর বিরোধিতা? মুসলিম জাতিসত্তা বিলীনে এই কারিকুলামের ভূমিকা কি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার প্রয়াস পাব আমরা আলোচ্য নিবন্ধে।
কি আছে এই কারিকুলামে?
নতুন কারিকুলামে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। নিকটঅতীতে চালু হওয়া সৃজনশীল পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। দশম শ্রেণীর আগের সব পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ বিভাজন মাধ্যমিক পর্যায় থেকে উঠিয়ে একাদশ শ্রেণীতে নেয়া হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষা সকলের জন্য অভিন্ন রাখা হয়েছে। সঙ্গত কারণে অধ্যায় বা বিষয়সূচী কমাতে হবে। ফলে যারা বিজ্ঞান ও গণিত শিখতে আগ্রহী তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এর মাধ্যমে সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হ্রাস পাবে। একইভাবে ব্যবসায় শিক্ষা (Commerce) বিভাগের কোন বই মাধ্যমিক স্তরে রাখা হয়নি। বরং জীবন ও জীবিকা বইয়ে আংশিক কিছু অধ্যায় সংযোজন করা হয়েছে মাত্র। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
নতুন কারিকুলামে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে। দূরঅতীতে ফলাফলে বিভাগ/শ্রেণী ও পরবর্তীতে চালু হওয়া গ্রেডিং পদ্ধতি আর থাকছে না। শিখনকালীন, সামষ্টিক ও আচরণিক এই তিনটি পর্যায়ে সম্পনণ হবে নতুন মূল্যায়ন প্রক্রিয়া। জিপিএর পরিবর্তে ফলাফল হবে তিন স্তরে। এর মধ্যে প্রথম স্তরকে বলা হবে পারদর্শিতার প্রারম্ভিক স্তর। দ্বিতীয় স্তরকে বলা হবে অন্তর্বতী বা মাধ্যমিক স্তর। আর সর্বশেষ, অর্থাৎ সবচেয়ে ভালো স্তরটিকে বলা হবে পারদর্শী স্তর। মূল্যায়ন কার্যক্রমে তিন ধরনের চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করা হবে। মূল্যায়ন কার্যক্রমে অংশ নিলেই বর্গাকৃতির চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করা হবে। আর বৃত্ত দিয়ে বোঝানো হচ্ছে একজন শিক্ষার্থী শিখেছে। আর ত্রিভুজ দিয়ে বোঝানো হচ্ছে সর্বোচ্চ ভাল অর্থাৎ ঐ শিক্ষার্থীরা সব কাজে পারদর্শী। বিগত দিনের ন্যায় কাগজে-কলমে কোন লিখিত পরীক্ষা থাকবে না।
নতুন কারিকুলামের পাঠ্যবই সমূহে শালীনতাহীন এবং উঠতি বয়সী যুবক-যুবতীদের জন্য চরম ঝুকিপূণ বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে, যা ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য পাঠদানেও লজ্জাকর। ৬ষ্ঠ শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ৪৭ থেকে ৪৯ পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালে নারী-পুরুষের দেহের পরিবর্তন, নারী-পুরুষের শরীর থেকে কি নির্গত হয়, কোন অঙ্গের আকার কেমন হয়, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কেমন আকর্ষণ হয় ইত্যাদি শেখানো হচ্ছে। ‘বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের ১০ম অধ্যায়ের ‘মানব শরীর’ শিরোনামে ১০৯ থেকে ১১২ পৃষ্ঠায় নারী-পুরুষের গুপ্তাঙ্গ, লোম গজানো, নিতম্ব, উরু, স্রাব, মাসিক, সেক্স হরমোন ইত্যাদি কোমলমতি শিশুদের পড়ানো হচ্ছে, যা চরম উদ্বেগের বিষয়।
অপরদিকে পাঠ্যপুস্তক থেকে ইসলাম ঘনিষ্ঠ বিষয়বস্ত্তগুলোকে বাদ দিয়ে ইসলাম বিরোধী বিষয়বস্তুকে সুপরিকল্পিতভাকে যোগ করা হয়েছে। বাদ দেয়া হয়েছে ইসলামী শিক্ষার নানা বিষয়। নবম শ্রেণীর ইসলাম শিক্ষা বই থেকে ইসলামের অকাট্য ফরয বিধান ‘জিহাদ’ অধ্যায়টিই বাদ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব মানচিত্রের ছবি থেকে ফিলিস্তীনকে বাদ দিয়ে সে জায়গায় অবৈধ দখলদার সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ‘ইসরাঈলে’র নাম সংযুক্ত করা হয়েছে।
নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের এখন প্রতিদিনই স্কুলব্যাগে বই-পুস্তকের পরিবর্তে বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে স্কুলে যেতে হয়। এখন আর আগের মত ক্লাসে পড়াশোনা করতে হয় না। বাড়ীতেও পড়াশোনার কোন চাপ নেই। ব্যবহারিক শিক্ষার নামে শিখানো হচ্ছে নাচ, গান, রান্না-বান্না, ঘর গোছানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি। এ্যাসাইনমেন্টের নামে কোমলমতি সন্তানদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে চরিত্র বিধ্বংসী ডিভাইস। রাতভর ইন্টারনেটের জগতে ঘুরে সন্তান কি করছে কে পাহারা দিবে? এই প্রশ্ন এখন সচেতন অভিভাবক মহলের।
মাদ্রাসা শিক্ষা ধ্বংসের কারিকুলাম : নতুন এই কারিকুলামে মাদ্রাসা শিক্ষাকে যেন টার্গেট করা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদেরকে ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুনের বিপরীতে অশ্লীলতা-বেহায়াপনা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। গান-বাজনা, নৃত্য, ঢোল-তবলা, হারমোনিয়াম ইত্যাদি চরিত্র বিধ্বংসী জাহান্নামী সংস্কৃতিকে জাতীয় সংস্কৃতি বলে কোমলমতি সন্তানদের বিশেষত মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে। উদাহরণত দু’একটি যেমন-
ইবতেদায়ী প্রথম শ্রেণীর ‘ইংলিশ ফর টুডে’ বইতে শিক্ষার্থীদের ইংলিশ কনভার্সেশন/কথোপকথন শেখাতে গিয়ে ইতিপূর্বে সালাম বিনিময় রাখা হয়েছিল। কিন্তু এখন সেখানে সালাম বাদ দিয়ে ‘গুড মর্নি’, ‘হাই’, ‘হ্যালো’ ইত্যাদি নিয়ে আসা হয়েছে।
বিগত বছরের ইবতেদায়ী শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকগুলোর ছবিতে শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীদের হিজাব, টুপি ও পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে তাদেরকে হিজাব, টুপি ও পাঞ্জাবি বিহীন অবস্থায় উপস্থাপন করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন স্থানে ‘আমার আত্মপরিচয়’ শিরোনামে নাম, লিঙ্গ, বয়স, পসন্দের খাবার, পোষাক, খেলা, শখ উল্লেখ থাকলেও ধর্মের পরিচয় সেখানে রাখা হয়নি।
মাদ্রাসা বোর্ডের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ বইয়ের প্রচ্ছদে গোল বৃত্তের মধ্যে হিজাবহীন মেয়ের হারমোনিয়াম বাজানোর দৃশ্য, আরেক মেয়ের নৃত্যের ছবি ও এক ছেলের ছবি অাঁকার দৃশ্য দেখে সমঝদার পাঠকের বুঝতে বাকী থাকার কথা নয় যে, কর্তাব্যক্তিদের উদ্দেশ্য কি? এই বইয়েরই ২১ পৃষ্ঠায় ‘নব আনন্দে জাগো’ শিরোনামের গল্পে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসব-আয়োজন সম্পর্কে উল্লেখ করা হয় যে, ‘..এ ছাড়া আয়োজন করা হয় যাত্রাপালা, সার্কাস, বাউল গান, লোকনাটক, পুতুলনাচ ও গানের অনুষ্ঠান। এসবই আমাদের সংস্কৃতির অমূল্য অংশ, যা সংরক্ষণ করা আমাদের দেশ ও জাতীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ লোকশিল্পই হল আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির শিকড়’ (পৃ: ২৩)।
একই বইয়ের ৩৭-৩৮ পৃষ্ঠায় শিখানো হচ্ছে সংগীতের স্বর, নাচ ও অভিনয়। যেমন- ‘সংগীতের মূল স্বর হলো ৭টি- সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি। একাধিক স্বরের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় সুর। সংগীত, নাচ আর অভিনয় এরা পরস্পরের আত্মার আত্মীয়। সংগীতের সাথে যেমন সম্পর্ক রয়েছে নাচের, তেমনি নাচের সাথে আবার মিল রয়েছে অভিনয়ের। নাচ বলতে বুঝায় শরীরের ছন্দবদ্ধ নানা ভঙ্গি’। অতঃপর পর্দাহীনা এক মেয়েরে হারমোনিয়াম বাজানোর দৃশ্য এবং ছেলে ও মেয়েদের নৃত্যের অঙ্গভঙ্গির কিছু দৃশ্য দেখানো হয়েছে। একই বইয়ের ৪১-৪৩ পৃষ্ঠায় শিখানো হচ্ছে ঢোল ও তবলা বাজানোর নিয়ম। সেখানে এক ছাত্রকে তবলা বাজাতে দেখা যায়। যা দেখে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা হারমোনিয়াম, ঢোল-তবলা বাজানো ও নৃত্য শিখবে।
প্রিয় পাঠক! পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, নতুন কারিকুলামে লিখিত কোন পরীক্ষা রাখা হয়নি। শিখনকালীন, সামষ্টিক ও আচরণিক এই তিনটি পর্যায়ে সম্পনণ হবে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া। সেকারণ এখন থেকে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরাও ক্লাসে হারমোনিয়াম, ঢোল-তবলা বাজিয়ে এবং নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে তাদের যোগ্যতা প্রদর্শন করে মূল্যায়নে ভাল করতে হবে। এছাড়া কোন উপায় নেই। অন্যথা তারা এবিষয়ে অকৃতকার্য হবে। আশা করি বুঝতে কারো বাকী নেই যে, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ক্রমান্বয়ে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
৬ষ্ঠ শ্রেণীর ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ের ৪১ পৃষ্ঠায় ‘আমার কৈশোরের যত্ন’ শিরোনামে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের ছবি দিয়ে গল্পটি সাজানো হয়েছে। এরা দু’জন শৈশবে বন্ধু ছিল, কৈশোরে বন্ধু এবং যৌবনেও বন্ধু। যৌবনে গিয়ে ছেলে বন্ধুটি মেয়ে বন্ধুর ওড়না ধরে আছে।
উক্ত বইয়ের ৪৭-৫০ পৃষ্ঠায় ‘কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন বিষয়ে সহায়ক তথ্য ও ধারণা’ শিরোনামে যা উপস্থাপন করা হয়েছে তা লজ্জাহীনতা বৈ কিছুই নয়। এগুলো জানার জন্য পুঁথিগত বিদ্যার প্রয়োজন হয় না। যুগ-যুগান্তর ধরে প্রকৃতিগগতভাবেই মানুষ এগুলো জানে ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়। এর জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বইয়ের পাতা নষ্ট করা ও শিক্ষক রাখার প্রয়োজন হয় না। নিশ্চয়ই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, উক্ত বইয়ের লেখকদের মা-চাচী-খালারাও বয়ঃসন্ধিকাল পার করেছেন পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়াই।
একই বইয়ের ৫৬ পৃষ্ঠায় ‘চলো বন্ধু হই’ শিরোনামে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে একসঙ্গে সাইকেল চালানার দৃশ্য উপস্থাপন করে এবং ছেলের সাথে মেয়ের বন্ধুত্ব স্থাপনের দৃশ্য দেখিয়ে মুসলিম তরুণ ও যুবকদের ফ্রি মিক্সিংয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া উক্ত বইয়ের প্রচ্ছদের চিত্রও আপত্তিকর। সেখানে দু’টি মেয়ে মুখোমুখি বসে একজনের পায়ের পাতার সাথে আরেকজনের পায়ের পাতা মিলিয়ে তার উপরে নিজেদের হাতের আঙগুল দিয়ে উচ্চতা তৈরী করে ধরে আছে, আর তার উপর দিয়ে আরেকটি মেয়ে হাই জাম্প দিয়ে পার হচ্ছে। অদূরে দাঁড়িয়ে ১টি ছেলে ও ৩টি মেয়ে দেখছে। বুঝানো হচ্ছে যে, মেয়েরা আর মেয়েদের গন্ডিতে থাকবে না, এরাও ছেলেদের ন্যায় হাইজাম্প, লংজাম্প ইত্যাদি সবধরনের খেলায় অংশগ্রহণ করবে। তা আবার মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। এছাড়া প্রায় সব বইয়ের প্রচ্ছদে বাদ্য-বাজনার ছবি, ভেতরে হিজাব বিহীন ছবি, ছেলে-মেয়েদের একত্রিত ছবি, কখনো মহিলাদের বেপর্দা ছবিতে ভরপুর।
ট্রান্সজেন্ডার: সপ্তম শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে ‘শরীফ’ থেকে ‘শরীফা’ হওয়ার ন্যক্কারজনক গল্পের অবতারণা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে পশ্চিমাদের এলজিবিটিকিউ (LGBTQ) তথা সমকামী আন্দোলনকে প্রমোট করা হয়েছে। এই ধরনের ট্রান্সজেন্ডারের গল্প ৭ম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে ঢুকিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বেহায়াপনার দিকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। যদিও খোদ অমুসলিমরাও এই জঘন্য কর্মকান্ডের ঘোর বিরোধিতা করেছে। গণতন্ত্রের পাদপীঠ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘কেউ চাইলেও লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারে না’ তিনি বলেন, ‘পুরুষ পুরুষই, নারী নারীই’। ট্রান্সজেন্ডার বা এলজিবিটি মতাদর্শ অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে কানাডায় বিক্ষোভ করেছেন লাখ লাখ পিতা-মাতা। এ বছরের শুরুতে জেলখানায় জন্মগত পুরুষ এক ট্রান্সজেন্ডার নারী প্রকৃত নারী রুমমেটকে ধর্ষণের ইস্যুতে স্কটল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগে বাধ্য হন। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের অবস্থানও এলজিবিটির বিরুদ্ধে। চীনের একই মনোভাব। সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অক্ষুণ্ণ রাখতে আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর অবস্থানও এলজিবিটির বিরুদ্ধে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোও ট্রান্সজেন্ডার মতাদর্শের বিরুদ্ধে অবস্থা নিয়েছে। বিশ্বসেরা টেক-বিলিনিয়ার ইলন মাস্কও ট্রান্সজেন্ডারের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশের সংসদে বিতর্কের বিষয় হয়- ‘পুরুষ কি গর্ভে সন্তান ধারণ করতে পারে?’ অথচ ইসলাম বহু পূর্বেই এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরেছে। পুরুষ ও নারী জাতির গঠন, আকৃতি, স্বভাব, কর্মক্ষেত্র সম্পূর্ণ পৃথক। নারী সন্তান ধারণ ও লালন-পালন করবে, আর পুরুষ রিযিকের সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে। মহান আল্লাহ মানুষের মধ্যে পুরুষ ও নারী এ দু’টি জাতিই সৃষ্টি করেছেন। তৃতীয় কোন লিঙ্গের উল্লেখ শরী‘আতে নেই। হিজড়ারা মূলতঃ অঙ্গ প্রতিবন্ধী। এরাও এই দুই শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত। ট্রান্সজেন্ডার বলে কোন পরিভাষা না আছে ইসলামে, না আছে মেডিকেল সাইন্সে। এগুলো শয়তানী মস্তিষ্ক থেকে তৈরী হওয়া শয়তানী পরিকল্পনা। যা যেনা-ব্যভিচারের দিকে প্রলুব্ধ করে।
মূলতঃ পশ্চিমা কুরুচিপূর্ণ বিকৃত কালচারকে এদেশে বৈধতা দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে রাম ও বামপন্থী একটি গোষ্ঠী। আর দূর থেকে এদের ইন্ধন দিচ্ছে একই ঘারানার পশ্চিমা অপশক্তি। উল্লেখ্য, শুধুমাত্র একজন নারী নিজেকে পুরুষ দাবী করলে সে পুরুষ এবং একজন পুরুষ নিজেকে নারী দাবী করলে সে নারী; এক্ষেত্রে জৈবিক ও দৈহিক গঠন কোন বিষয় না এমন চিন্তা ও মানসিকতা অসুস্থ চিন্তা ব্যতীত কিছুই নয়। মহান আল্লাহর ভাষায় এরা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়, বরং তার চেয়েও অধিক প্রথভ্রষ্ট (আ‘রাফ ৭/১৭৯)।
বলাবাহুল্য যে, শুধু মনে করার কারণে কারো লিঙ্গ পরিবর্তন হ’তে পারে না। এমনকি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমেও লিঙ্গ পরিবর্তন হয় না। এভাবে না কোন পুরুষ নারী হয়ে যায় আর না কোন নারী পুরুষ হয়। এরপরও যদি কেউ এমনটি মনে করে বা এর স্বীকৃতি দেয় তাহ’লে সে মূলতঃ আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে পরিবর্তন সাধন করল। যা স্পষ্ট হারাম। আল্লাহ বলেন, আমার সৃষ্টির মধ্যে কোন পরিবর্তন নেই (রূম ৩০/৩০)। তাই যে কোন ধর্মের সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি ও রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি এর সমর্থন করতে পারে না।
দুর্ভাগ্য, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এ সমস্ত ঘৃণ্য, জঘন্য পশুত্বকে উৎসাহিত করা হয়েছে। আমাদের ফুলের মত পবিত্র সন্তানদেরকে এসব বাজে বিষয় শিখানোর মাধ্যমে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? অভিভাবকরা সাবধান!
নতুন কারিকুলাম নিয়ে অভিভাবকদের অভিমত : অভিভাবকরা মনে করেন, উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের শিক্ষা কারিকুলামে যে পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে তা মূলতঃ শিক্ষার্থীদের মেধাহীন করার চক্রান্ত। অবিলম্বে এই কারিকুলাম বাতিল করাসহ আট দফা দাবী জানিয়েছেন অভিভাবকদের সংগঠন ‘সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন’। দাবীগুলো হচ্ছে- ১. ‘শিক্ষানীতি বিরোধী’ নতুন কারিকুলাম সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে। ২. নম্বরভিত্তিক দু’টি লিখিত পরীক্ষা চালু রাখতে হবে। ৩. নবম শ্রেণী থেকেই শিক্ষার্থীর আগ্রহ অনুযায়ী বিষয় নির্বাচনের সুযোগ রাখতে হবে। ৪. ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ ইত্যাদি নির্দেশক বা ইন্ডিকেটর বাতিল করে নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখতে হবে। ৫. সবসময় সব শিখন, প্রজেক্ট ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক ক্লাসের ব্যয় সরকারকে বহন করতে হবে এবং স্কুল পিরিয়ডেই সব প্রজেক্ট সম্পন্ন হ’তে হবে। ৬. শিক্ষার্থীদের দলগত ও প্রজেক্টের কাজে ডিভাইসমুখী হ’তে নিরুৎসাহিত করতে হবে এবং তাত্ত্বিক বিষয়ে অধ্যয়নমুখী করতে হবে। ৭. প্রতিবছর প্রতি ক্লাসে নিবন্ধন ও সনদ দেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে, প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা চালু রাখতে হবে এবং এসএসসি ও এইচএসসি দু’টি পাবলিক পরীক্ষা বহাল রাখতে হবে। ৮. সবসময় সব শ্রেণীতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই তা মন্ত্রিপরিষদ ও সংসদে উত্থাপন করতে হবে।
পরিশেষে বলব, জাতিকে মেধাশূন্য, আদর্শহীন ও নাস্তিক বানানোর এই কারিকুলাম বাতিল করে তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিশেষত মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা যেখানে কুরআন-হাদীছ শিখবে, দৈনন্দিন জীবন চলার সুন্নাতী পদ্ধতি শিখবে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখবে, রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে আখলাকে হাসানার অধিকারী হয়ে সমাজকে আলোকিত করবে, সেখানে আদর্শহীন ও চরিত্রহীন করার গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে এই নতুন শিক্ষা কারিকুলাম। ঈমানদার মুসলমানরা কখনো নাস্তিক্যবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী এই কারিকুলাম সমর্থন করতে পারে না। মহান আল্লাহ আমাদের জাতিসত্তাকে যাবতীয় অপশিক্ষা ও অপসংস্কৃতি থেকে হেফাযত করুন-আমীন!