ফিলিস্তীনী জনগণের সাহস ও চেতনার প্রতীক, নির্যাতিত মানবতার প্রতিরোধ সংগ্রামের অগ্নিপুরুষ, ফিলিস্তীনীদের প্রায় অর্ধ শতাব্দীকালের কিংবদন্তীতুল্য নেতা ইয়াসির আরাফাত চলে গেলেন। রেখে গেলেন একরাশ প্রশ্ন : তিনি কি সন্ত্রাসী ছিলেন, না শান্তিবাদী ছিলেন? তিনি কি ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন, না ধর্মচেতনা সম্পন্ন ছিলেন? প্রথম কথায় আসা যায়। হিংসুক ও নোংরা মানসিকতা সম্পন্ন কিছু ইহূদী ও খ্রিষ্টানের কাছে তিনি ছিলেন ‘সন্ত্রাসী’। তারা তাঁর মৃত্যুতে খুশী হয়ে আনন্দে নেচেছে। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী সাধারণ মানুষ তার জন্য কেঁদেছে। কি ছিল কারণ?

চার বছর বয়স থেকে মাতৃস্নেহহারা শিশু মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ আরাফাত ওরফে ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তীনের হাযার বছরের স্থায়ী বাশিন্দাদেরকে কেবল মুসলিম হওয়ার অপরাধে (?) মুহাজির বেশে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন উদ্বাস্ত্ত শিবিরে অপরের দান-ভিক্ষা নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে দেখেছেন। দেখেছেন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধ্বজাধারী ইঙ্গ-মার্কিন চক্রান্তকারীদের মদদে বিভিন্ন দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইহূদীদের আমদানী করে ফিলিস্তীনে জোর করে বসাতে। দেখেছেন নির্যাতিত মানুষের ত্রাণকর্তা, সর্বহারাদের আশ্রয় বলে খ্যাত কম্যুনিস্ট রাশিয়ার নগ্ন সমর্থনে জাতিসংঘে ফিলিস্তীন বিভক্তির প্রস্তাব পাস হ’তে। দেখেছেন চোখের সামনে ফিলিস্তীনীদের উপর বহিরাগত ইহূদীদের নির্মম হত্যা, লুণ্ঠন ও বিতাড়নের লোমহর্ষক দৃশ্য। ২০ বছরের তরুণ আরাফাতের ভেতরকার জিহাদী চেতনা তাই শাণিত হয়ে উঠেছিল সেদিন। গঠন করলেন ফিলিস্তীনী ছাত্র সংগঠন। শুরু করলেন প্রতিরোধ সংগ্রাম। পরবর্তীতে ঐ চেতনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার সারাটি জীবনে কখনো আল-ফাতাহ গেরিলা নেতা হিসাবে, কখনো পিএলও চেয়ারম্যান হিসাবে, কখনো প্রেসিডেন্ট আরাফাত হিসাবে। আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলি তাকে দমন করার জন্য নানা বিলাসী প্রস্তাব দিয়ে তাকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে। তাই দেখা গেছে শান্তিবাদী নেতা হিসাবে তাকে নোবেল প্রাইজ নিতে আন্তর্জাতিক কাশিমবাজারের কুঠি হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করতে। আবার কখনো দেখা গেছে সর্বহারাদের স্বর্গ বলে পরিচিত মস্কো-পিকিং-এর নেতাদের সাথে তাদের রাজধানীতে আপ্যায়িত হ’তে। কিন্তু না! আরাফাত তার নিজস্ব চেতনাতে আবার ফিরে এসেছেন অবশেষে। নির্যাতিত ফিলিস্তীনীদের সাথেই তিনি আমৃত্যু অবস্থান করেছেন রামাল্লায় তার সদর দফতরে। মৃত্যুর পূর্বের তিন বছর সেখানে বাস্তবে গৃহবন্দী থেকেছেন বোমা হামলার মধ্যে সর্বদা জীবন ও মৃত্যুর মুখোমুখি অবস্থানে।

সংখ্যাগুরু ফিলিস্তীনী আরব মুসলিম জনগণকে বিতাড়িত করে বহিরাগত মুষ্টিমেয় ইহূদীরা ফিলিস্তীনের ৮০ ভাগ এলাকা জবর দখল করে সেখানে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করল কথিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মোড়লদের মদদে। অথচ সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েও তিনি ফিলিস্তীনের স্বাধীনতা ফিরে পাননি। ফলে যে হারানোর বেদনায় তরুণ বয়সে তাঁর সংগ্রামী জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল, সেই হারানোর বেদনা নিয়েই তাঁকে বৃদ্ধ বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় হ’তে হ’ল।

ইয়াসির আরাফাত তাই কখনোই সন্ত্রাসী ছিলেন না। মূল সন্ত্রাসী তারাই, যারা তাকে অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য করেছিল। ১৯৮২ সালে লেবাননের ফিলিস্তীনী উদ্বাস্ত্ত শিবিরে হামলা চালিয়ে তৎকালীন ইসরাঈলী প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও আজকের প্রধান মন্ত্রী এরিয়েল শ্যারণ যখন অন্যূন ৩০০০ ফিলিস্তীনী মুহাজিরকে বোমা মেরে হত্যা করেছিল, তখন তাকে কেউ সন্ত্রাসী বলেনি। আজও যখন সে প্রতিদিন ফিলিস্তীনে গোলা বর্ষণ করে নিরীহ মুসলিম নরনারী-শিশুকে হত্যা করছে, তখন তাকে কেউ সন্ত্রাসী বলছে না। অথচ ইহূদী কামানের বিরুদ্ধে ফিলিস্তীনীরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করলে সেটা হচ্ছে সন্ত্রাস। এটাই হ’ল আজকের নিষ্ঠুর বাস্তবতা। কিন্তু এটা মূলতঃ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ। যদি এটা স্রেফ আল্লাহর জন্য হয়, পরকালীন মুক্তির জন্য হয়, বিপন্ন মানবতার কল্যাণের জন্য হয়, তাহলে এটা হবে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ। এ পথে মরলে শহীদ, বাঁচলে গাযী। এ পথের সংগ্রামীদের কোন মৃত্যু নেই। তারা অমর। মুসলিম সন্তান ইয়াসির আরাফাতের হৃদয়ের গভীরে যদি উক্ত নিয়ত ক্রিয়াশীল থাকে, তবে তিনি উক্ত মর্যাদা পাবেন আল্লাহর মেহেরবানী হলে। যদিও বিশ্ব বাস্তবতার আন্তর্জাতিক চাপে তাকে কখনো দেখা গেছে ধর্মনিরপেক্ষ হ’তে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর প্রথম ক্বিবলা ও মে‘রাজের স্মৃতিধন্য পবিত্র বায়তুল মুক্বাদ্দাস স্বাধীন করে সেখানেই মৃত্যু শয্যা গ্রহণের আগ্রহ পোষণকারী ইয়াসির আরাফাতের চেতনায় যে ইসলামী বিশ্বাস ক্রিয়াশীল ছিল, এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে। যেমন এখানেই মৃত্যু বরণের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন যালেম ফেরাঊনের হাত থেকে মযলূম বনু ইস্রাঈলীদের মুক্তিদূত বিশ্বনন্দিত নবী হযরত মূসা (আঃ)। এমনকি হযরত আদম (আঃ) ও হযরত ইউসুফ (আঃ) এখানেই নিজেদের দাফন হওয়ার অছিয়ত করেছিলেন।

কোন সমাজে কোন বিপ্লবী সংস্কারকের আবির্ভাব ঘটলে তাকে প্রশংসার চেয়ে সমালোচনার বাণে বেশী বিদ্ধ হ’তে হয়। কিন্তু তার মৃত্যুর পরেই মানুষ তাকে চিনতে পারে। ইয়াসির আরাফাতও প্রশংসার চেয়ে সমালোচনার আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন বেশী। কিন্তু তার মৃত্যুর পরে দেখছি বিশ্বকে কাঁদতে। মুসলিম-অমুসলিম সকল মযলূম মানবতা আজ তার জন্য শূন্যতা অনুভব করছে। এটাই তার বড় পাওয়া। যদিও সে পাওয়া তিনি দেখে যেতে পারেননি। যালেম ও মযলূমের দ্বান্দ্বিক ইতিহাসে চিরকাল আরাফাতরাই স্থান পেয়ে থাকেন। চিরকাল ঘৃণাভরে উচ্চারিত হবে ঘৃণিত বুশ ও শ্যারণদের নাম। কিন্তু আরাফাতরা থাকবেন চিরদিন স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে। আমরা তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং তাঁর রেখে যাওয়া ফিলিস্তীন মুক্তি আন্দোলন সফল হৌক সেই প্রার্থনা করছি।

জানা আবশ্যক যে, আল-কুদ্স কেবল আরাফাতের নয়, কেবল ফিলিস্তীনীদের নয়, আল-কুদ্স সকল মুসলমানের। তাই আল-কুদ্সের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বের সকল মুসলমানের শামিল হওয়া কর্তব্য। মুসলিম নেতৃবৃন্দ যদি কখনো বিষয়টি উপলব্ধি করেন এবং ‘ওআইসি’কে সক্রিয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক জোটে রূপান্তরিত করেন, তাহলে ফিলিস্তীন তো বটেই, আফগানিস্তান, ইরাক, কাশ্মীর, চেচনিয়া, সূদান, সোমালিয়া সহ বিশ্বের সকল স্থান হ’তে মুসলিম নির্যাতন নিমেষে বন্ধ হয়ে যাবে। মযলূম মানবতা ইসলামের সুমহান আদর্শের ছোঁয়া পেয়ে ধন্য হবে। সারা পৃথিবী একদিন ইসলামী খেলাফতের ছায়াতলে চলে আসবে ইনশাআল্লাহ।[1]


[1]. ৮ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০০৪।






বিষয়সমূহ: বিবিধ
ইল্ম ও আলেমের মর্যাদা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
খোশ আমদেদ মাহে রামাযান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বন্দী ফিলিস্তীন : জবাব সশস্ত্র জিহাদ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মাহে রামাযান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রশ্ন ফাঁস - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হে কল্যাণের অভিসারীগণ! এগিয়ে চল - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
এশিয়ার দুর্গের পতন। অতঃপর.. - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরাফাত চলে গেলেন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ধর্ম দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শেয়ার বাজার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইনোসেন্স অফ মুসলিম্স - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল-কুরআনের আলোকে ক্বিয়ামত
আরও
আরও
.