
গত ১৬ই মে রবিবার বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী বিল ২০০৪ পাস হয়ে গেল। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মঞ্জু), জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ও স্বতন্ত্র তিনজন সহ সংসদে উপস্থিত ২৬৬ জন সদস্য একযোগে উক্ত বিলে সম্মতি প্রদান করেছেন। প্রধান বিরোধী দল (আওয়ামী লীগ) তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে উক্ত বিলের বিরোধিতা করেছে।
কিন্তু আমরা উক্ত বিলের প্রধান দু’টি বিষয়ের বিরোধিতা করছি আল্লাহ প্রেরিত ইলাহী বিধানের বিরোধী হওয়ার কারণে। সেটি হ’ল সকল সরকারী অফিস ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি টাঙ্গানো এবং জাতীয় সংসদে ৪৫টি মহিলা এম.পি-র আসন সংরক্ষিত রাখা। কারণ প্রথমতঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ঐ ঘরে (রহমতের) ফেরেশতা প্রবেশ করে না যে ঘরে (সাধারণ) কুকুর থাকে কিংবা (প্রাণীর) ছবি থাকে’।[1] তিনি বলেন, প্রত্যেক ছবি প্রস্ত্ততকারী জাহান্নামী। তার প্রস্ত্ততকৃত প্রতিটি ছবিতে (ক্বিয়ামতের দিন) রূহ প্রদান করা হবে এবং জাহান্নামে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে’। অতঃপর রাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) প্রশ্নকারীকে বলেন, যদি তুমি একান্তই ছবি তৈরী করতে চাও, তাহ’লে বৃক্ষ-লতা বা এমন বস্ত্তর ছবি তৈরী কর, যাতে প্রাণ নেই’।[2] মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় গৃহে (প্রাণীর) ছবিযুক্ত কোন জিনিসই রাখতেন না। দেখলেই ভেঙ্গে চূর্ণ করে দিতেন’।[3] খলীফা আলী (রাঃ) একদা স্বীয় পুলিশ প্রধান আবু হাইয়াজ আল-আসাদীকে বলেন, আমি কি তোমাকে এমন একটি কাজে পাঠাবো না, যে কাজে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে পাঠিয়েছিলেন? সেটি হ’ল এই যে, তুমি এমন কোন ছবি ছাড়বে না, যাকে নিশ্চিহ্ন না করবে এবং এমন কোন উঁচু কবর দেখবে না, যাকে সমান না করে দেবে’।[4] শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, এই আদেশ কেবল আলী (রাঃ) নয়, তাঁর পূর্বে খলীফা ওছমান (রাঃ)-এর সময়েও জারি ছিল’ (তাহযীর পৃঃ ৯২)। মক্কা বিজয়ের সময় রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশে ওমর (রাঃ) সর্বপ্রথম কা‘বা গৃহের মূর্তিগুলি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেন। অতঃপর সকল মূর্তি ও ছবি নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বা গৃহে প্রবেশ করলেন না’ (আবুদাঊদ)। উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) বলেন, কা‘বা গৃহে প্রবেশ করে বালতিতে কাপড় ভিজিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছবি সমূহ মুছতে থাকেন ও বলেন, আল্লাহ ঐ জাতিকে ধ্বংস করুন! যারা ছবি তৈরী করে। অথচ সেগুলিকে তারা সৃষ্টি করতে পারে না’ (মুসনাদে আবুদাঊদ ত্বায়ালেসী, সনদ ‘জাইয়িদ’ দ্রঃ আত-তাহরীক, সেপ্টেম্বর’০২, দরসে হাদীছ ‘ছবি ও মূর্তি’)।
উপরোক্ত হাদীছ সমূহ প্রমাণ করে যে, প্রাণীদেহের সব ধরনের ছবি, মূর্তি, প্রতিকৃতি ও ভাষ্কর্য সব সময়ের জন্য নিষিদ্ধ। সম্মানের উদ্দেশ্যে অর্ধদেহী বা পূর্ণদেহী সকল প্রকার প্রাণীর ছবি টাঙ্গানো বা স্থাপন করা নিষিদ্ধ। কেবলমাত্র হীনকর কাজে ব্যবহারের জন্য, জনগুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যে, রেকর্ড রাখার স্বার্থে ও বাধ্যগত কারণ ব্যতীত কোন প্রাণীর ছবি তোলা বা সংরক্ষণ করা জায়েয নয়। অথচ এই নিষিদ্ধ কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের জাতীয় নেতা ও নেত্রীদের ছবি তাদের বিরোধীদের হাতে সর্বত্র পদদলিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে। আমরা ছবি টাঙ্গানোর আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছিলাম (এপ্রিল-মে’০২, পৃঃ ৫০)। এরপরেও সরকারের হুঁশ তো ফেরেইনি, বরং এতকাল ছিল কেবল প্রধানমন্ত্রীর ছবি, এবার যোগ হ’ল তার সাথে প্রেসিডেন্টের ছবি। অতএব ঐ সংসদে ও বঙ্গভবনে কিভাবে আল্লাহর রহমত নাযিল হবে, যেখানে সম্মানার্থে ছবি টাঙানো থাকে?
দ্বিতীয় বিষয়টি হ’ল : জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন। উদ্দেশ্য, মহিলাদের ক্ষমতায়ন। জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের নেত্রী রওশন এরশাদ সমর্থন দিয়েছেন কেবল মহিলাদের ক্ষমতায়নের স্বার্থেই। সরকারী দলের বক্তব্যও তাই। ভাবখানা এই যে, পুরুষ শাসিত সমাজে ক্ষমতাহারা মহিলা সমাজ এ যাবত পুরুষের অধীনে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে। এখন তারা ক্ষমতা হাতে নিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচতে চান এবং স্বাধীনভাবে পুরুষ সমাজকে এক চোট দেখে নিবেন।
আমরা বলতে চাই সংবিধানের উক্ত সংশোধনী স্বভাবধর্ম ইসলামের বিরোধী। ইসলাম পুরুষকে নারীর উপরে কর্তৃত্বশীল করেছে (নিসা ৪/৩৪) এবং নারীকে করেছে পুরুষের প্রতি আনুগত্যশীল। প্রত্যেক পুরুষ ও নারীর অবচেতন হৃদয় নিঃসন্দেহে বিষয়টি স্বীকার করে। যদিও মঞ্চে ও মিছিলে এবং জাতীয় সংসদের বিতর্ক অনুষ্ঠানে তারা সর্বদা এর বিপরীত বলতে চেষ্টা করেন। সরকারের জানা উচিত ছিল যে, চিত্র জগতের নগ্ন মেয়েরা আর এনজিওদের কাছে আত্মবিক্রীত নারীবাদী সংগঠনগুলি এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ পর্দানশীন মা-বোনদের প্রতিনিধি নয়। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, ইসলামী বিধানে পুরুষের স্বাভাবিক কর্মস্থল হ’ল বাইরে এবং নারীর হ’ল ঘরে। ইসলাম নারীকে সাংসারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জটিল ও দুর্বহ বোঝা বহনের দুরূহ কষ্ট থেকে রেহাই দিয়েছে এবং তাকে সন্তান পালন ও পারিবারিক শান্তি-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করেছে। কর্মজীবী পুরুষ সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনী শেষে ঘরে ফিরে আসে তার প্রেমময়ী স্ত্রীর কাছে, সন্তান স্কুল-কলেজ শেষে ফিরে আসে স্নেহময়ী মায়ের কাছে, তাদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের কাছে। কিন্তু আজকের বস্ত্তবাদী সমাজ নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহমর্মিতাপূর্ণ সেই চিরন্তন অবস্থানকে ধ্বংস করে কথিত ক্ষমতায়নের সুড়সুড়ি দিয়ে নারীকে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী বানাতে চায় এবং গৃহের শান্তি ও পারিবারিক শৃংখলা বিনষ্ট করতে চায়। রাজনীতির প্রতারণাপূর্ণ ও পারস্পরিক সংঘর্ষশীল অঙ্গনে নারীকে ডেকে এনে তার সুন্দর ও সুকুমার বৃত্তিকে ধ্বংস করার পিছনে সত্যিকার অর্থে নারীর কোন কল্যাণ নেই, বরং অকল্যাণই বেশী। বরং আমরা বলব, আল্লাহ প্রেরিত অহীর বিধানের কোন একটিরও বিরোধিতায় মানবজাতির কোন কল্যাণ নেই। আমরা বুঝতে পারি না ‘আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই’ ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে যেসব ইসলামপন্থী দলের নেতারা জাতীয় সংসদে মন্ত্রী ও এম.পি-র আসনে বসে আছেন, তারা কোন্ দলীলের ভিত্তিতে উক্ত বিলে সমর্থন দিলেন? নাকি নিজেদের ফাসিদ ‘ক্বিয়াস’ ও কথিত ‘হিকমতে’র দোহাই দিয়ে সবকিছুকে জায়েয করে নিচ্ছেন? নারীর ক্ষমতায়ন দূরে থাক, ঐসব পুরুষ নেতাদের নিজেদের কি কোন ক্ষমতা আছে? তারা নিশ্চয়ই তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে উক্ত বিলের উক্ত বিষয় দু’টির পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মতি-মর্যির বাইরে কিছু করার নৈতিক সাহস ও ক্ষমতা কোনটাই তাদের নেই। তাহ’লে আগামীতে বিভিন্ন দলের কৃপায় ক্ষমতাসীন ৪৫ জন মহিলা এম.পি-র ক্ষমতা কতটুকু হবে? জাতীয় সংসদে পুরুষ এম.পি-দের পাশে মহিলা এম.পি-দের শোভা বর্ধন এবং সকল বিষয়ে স্ব স্ব দলের পক্ষে সমর্থন ও ভোট প্রদান ব্যতীত তাদের আর কোন কাজ থাকবে কি? তাহ’লে কি প্রয়োজন এইসব অথর্ব আসন সৃষ্টি করার ও অযথা তাদের বেতন-ভাতা, টেলিফোন বিল ও পুলিশী প্রহরার জন্য জাতীয় বাজেট থেকে লাখ লাখ টাকা খরচের অংক বৃদ্ধি করার?
হ্যাঁ, দেশের প্রেসিডেন্ট এবং সকল দলের এম.পি-দের জন্য একটি সহজ পথ খোলা ছিল। সেটি এই যে, তারা বলতে পারতেন যে, উপরোক্ত দু’টি বিষয় সংবিধানের ৮ম সংশোধনী বিল ১৯৮৬-এর বিরোধী হচ্ছে বিধায় বাতিলযোগ্য। কেননা ৮ম সংশোধনীতে ‘ইসলাম’-কে বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অতএব তার বিপরীত কোন বিল বা বিষয় কেউ উত্থাপন করলে উক্ত সংশোধনীর দোহাই দিয়ে ইসলামপন্থী যে কোন এম.পি তার বিরোধিতা করতে পারতেন। কিন্তু তাদের কেউ এমনকি মহামান্য প্রেসিডেন্টও যখন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি, তখন স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে, তাহ’লে কি ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ নামক সংশোধনীটি কেবল ইসলামভক্ত জনগণকে খুশী করে প্রতারণার মাধ্যমে তাদের ভোট নেওয়ার একটি অপকৌশল মাত্র? হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ নামধারীরা ৮ম সংশোধনীটি বাতিলের যে দাবী করে আসছে, ইসলামপন্থী জোট সরকার কি তাহ’লে সেটা কার্যতঃ মেনে নিয়েছেন? সরকারের নিকটে আমরা আমাদের পূর্বের দাবীর (সম্পাদকীয়, সেপ্টে’০২) পুনরুক্তি করছি যে, সংবিধানের সংশোধনী এনে বাংলাদেশকে ‘ইসলামী খেলাফত’ ঘোষণা করুন এবং বিশ্বব্যাপী ‘ইসলামী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসুন। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন![5]
[1]. বুখারী হা/৩২২৫; মুসলিম হা/২১০৬; মিশকাত হা/৪৪৮৯।
[2]. বুখারী হা/২২২৫; মিশকাত হা/৪৫০৭ ‘পোষাক’ অধ্যায়।
[3]. বুখারী হা/৫৯৫২; মিশকাত হা/৪৪৯১ ‘পোষাক’ অধ্যায়।
[4]. মুসলিম হা/৯৬৯; মিশকাত হা/১৬৯৬ ‘জানায়েয’ অধ্যায়।
[5]. ৭ম বর্ষ ৯ম সংখ্যা জুন ২০০৪।