আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, আল্লাহ তাদের ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসন ক্ষমতা প্রদান করবেন, যেমন তিনি দান করেছিলেন পূর্ববর্তীদেরকে’ (নূর ২৪/৫৫)। তিনি স্বীয় রাসূলকে বলেন, ‘তুমি বল, হে আল্লাহ! তুমি রাজাধিরাজ। তুমি যাকে খুশী রাজত্ব দান কর ও যার কাছ থেকে খুশী রাজত্ব ছিনিয়ে নাও। তুমি যাকে খুশী সম্মানিত কর ও যাকে খুশী লাঞ্ছিত কর। তোমার হাতেই যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয় তুমি সকল কিছুর উপরে সর্বশক্তিমান’ (আলে ইমরান ৩/২৬)।
পৃথিবীতে এযাবত তিনটি শাসনব্যবস্থা দেখা গিয়েছে, ‘রাজতন্ত্র, খেলাফত ও গণতন্ত্র’। তিনটি পরিভাষার মধ্যে তিনটি আদর্শের প্রতিফলন রয়েছে। রাজতন্ত্রে রাজার ইচ্ছাই চূড়ান্ত। তাঁর হাতেই থাকে সার্বভৌমত্বের চাবিকাঠি। ‘খেলাফতে’ আল্লাহ সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস এবং অহি-র বিধানই চূড়ান্ত। আর ‘গণতন্ত্রে’ জনগণের ইচ্ছাই চূড়ান্ত এবং জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস।
‘গণতন্ত্রে’ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল দেশ শাসন করে। সংখ্যালঘু দল বা দলগুলি বিরোধী দল হিসাবে গণ্য হয়। তাদের সম্মিলিত ভোট যদি সংখ্যাগুরু দলের প্রাপ্ত ভোটের চাইতে বেশীও হয়, তথাপি তারা দেশ শাসনের অনুমতি পায় না। যেমন ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এযাবত কোন দলই সেদেশে জাতীয়ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এমনকি ২০১৯ সালে ভারতে ভূমিধ্বস বিজয়ী বলে অভিহিত হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক দল ‘বিজেপি’ জোটও ৩৮ শতাংশের বেশী ভোট পায়নি। এভাবেই প্রচলিত গণতন্ত্রে জনগণের নামে চলে যবরদস্তী দলীয় শাসন। এখানে দলের কিংবা দলনেতার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকেই জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলে প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার করা হয়। তাছাড়া মেয়াদ ভিত্তিক নির্বাচন প্রথার কারণে এইসব দেশে সর্বদা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং অস্থিতিশীল সামাজিক অবস্থা বিরাজ করে। গণতন্ত্রে জনগণের অংশীদারিত্বের কথা বলা হ’লেও কেবল ভোটের সময় কিছু লোকের ভোট দেওয়া ব্যতীত অন্য কোন কিছুতেই জনমতের তোয়াক্কা করা হয় না। এমনকি অধিকাংশ জনগণের আক্বীদা-বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থা চাপিয়ে দিতেও শাসকদল কসুর করেন না। তাছাড়া বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রের চেহারা একেক দেশে একেক রূপ। তাই বর্তমান যুগে গণতন্ত্র জনমত প্রতিফলনের যথার্থ বাহন নয়।
পক্ষান্তরে ‘ইসলামী খেলাফত’ হ’ল, আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠাকারী শাসন ব্যবস্থার নাম। যা রাসূল (ছাঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের রেখে যাওয়া শাসন নীতির প্রতিনিধিত্ব করে’। এর লক্ষ্য হ’ল, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সৃষ্টিকে পরিচালনা করা ও তার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। যা প্রতিষ্ঠার উপায় হ’ল দু’টি : শিরক বিমুক্ত নির্ভেজাল তাওহীদ ভিত্তিক দাওয়াত ও বিদ‘আতমুক্ত ছহীহ সুন্নাহ ভিত্তিক আমল। কথা, কলম ও সংগঠনের মাধ্যমে জনমত গঠন ও সমাজে পরিবর্তন আনাই হবে যার মৌলিক লক্ষ্য। এজন্য সমাজের প্রতিটি স্তরে, গ্রামে ও মহল্লায় যখন একদল সচেতন আল্লাহভীরু ও যোগ্য নেতা-কর্মী তৈরী হবে, যারা আল্লাহকে রাযী-খুশী করার জন্য জান-মাল বাজি রেখে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধে এগিয়ে আসবে, তখন সংখ্যায় যত নগণ্যই হৌক, আল্লাহর সাহায্যে তারাই জয়লাভ করবে। অতঃপর বৃহত্তর সাংগঠনিক ইমারতের পথ বেয়েই একদিন জাতীয় ভিত্তিক ‘ইসলামী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ।
বর্তমানে যেকোন মুসলিম দেশে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা খুবই সহজ। যেমন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট যিনি অবশ্যই একজন বিজ্ঞ মুসলিম ও সামর্থ্যবান পুরুষ হবেন, প্রথমে রাষ্ট্রের এক বা একাধিক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি এবং যোগ্য ও মুত্তাক্বী আলেমকে পরামর্শদাতা হিসাবে নিয়োগ দিবেন। যাঁরা তখন বা পরে কোন প্রশাসনিক পদে থাকবেন না। অতঃপর তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তর থেকে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি বাছাই করে তিনি একটি ‘মজলিসে শূরা’ নিয়োগ দিবেন। শূরা সদস্যগণ একজনকে ‘আমীর’ নির্বাচন করবেন। এ বিষয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ হ’লে সর্বোচ্চ তিনদিনের বৈঠকে তা নিরসন করবেন এবং সকলে একমত হবেন। ‘আমীর’ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি নতুনভাবে ‘শূরা’ গঠন করবেন এবং শূরা সদস্যদের আনুগত্যের ‘বায়‘আত’ নিবেন। অন্যেরা তা মেনে নিবেন। ‘আমীর’ মজলিসে শূরার পরামর্শক্রমে আল্লাহর বিধান মতে দেশ চালাবেন। তাদের মধ্য থেকে বাছাই করা কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে তিনি একটি ছোট্ট কেবিনেট বা মন্ত্রীসভা গঠন করবেন।
বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভ হ’ল তিনটি : বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ। এর মধ্যে বিচার ও শাসন বিভাগের প্রধান পদগুলি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক মনোনীত হয়। প্রেসিডেন্ট দেশের প্রধান বিচারপতি মনোনয়ন দেন। অতঃপর প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে আইনসভার সদস্যগণ নির্বাচিত হন ও তারাই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন। অতঃপর তিনি প্রেসিডেন্টের নিকট শপথ গ্রহণ করেন। সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকেই সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ফলে তাঁর পরামর্শের বাইরে প্রেসিডেন্টের এমনকি বক্তৃতা করারও ক্ষমতা থাকে না। এর ফলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানটির অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
ইসলামী খেলাফতে বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগের সাথে আইনসভা তথা পার্লামেন্ট সদস্য নিয়োগকেও আমীরের উপর ন্যস্ত করা হয়, জনগণের উপর নয়। ইসলামী শাসন ও নেতৃত্ব ব্যবস্থায় কেবল ‘আমীর’ নির্বাচিত হন, অন্যেরা নন। প্রতিটি দেশেই রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতার জন্য একক ও স্থায়ী নেতৃত্বের প্রতি প্রবণতা লক্ষণীয়। যা মানুষের স্বভাব ধর্মের অনুকূলে। সেকারণ ইসলামী খেলাফতে আমীর যোগ্য থাকা অবধি নিজ দায়িত্বে বহাল থাকেন। সকল দেশে নেতৃত্ব চেয়ে নেবার বা আদায় করে নেবার মানসিকতা বিরাজমান। কিন্তু ইসলামে নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়া, নেতৃত্বের লোভ করা ও তার আকাংখা করা নিষিদ্ধ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৩৬৮৩)। এটিকে ক্বিয়ামতের দিন সবচেয়ে বড় জওয়াবদিহিতার বিষয় হিসাবে কঠিনভাবে ভয় করা হয় (মুসলিম হা/১৮২৫; মিশকাত হা/৩৬৮২)। আর সেকারণেই ইসলামী খেলাফতে নেতৃত্ব নিয়ে সাধারণতঃ কোন ঝগড়া হয় না এবং দেশের উন্নতি ও অগ্রগতি বিঘ্নিত হয় না।
জনৈক রাষ্ট্রনীতি বিশারদ পন্ডিত বলেন, Best government is the least government. Least government is the best government. ‘উত্তম সরকার হ’ল, ছোট সরকার। আর ছোট সরকার হ’ল উত্তম সরকার’। ২০০৭ সালের ১২ই জানুয়ারী থেকে ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১০ জন উপদেষ্টা নিয়ে ফখরুদ্দীন আহমাদের দু’বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল এদেশে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ও দৃষ্টান্তযোগ্য। অতএব দলীয় স্বার্থে মন্ত্রী-এমপি ও উপদেষ্টাদের বহর সৃষ্টি করা রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় ব্যতীত কিছু নয়। ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থার মধ্যে কেউ ডিক্টেটরশিপ-এর গন্ধ পেলে তাকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের লালনভূমি বলে খ্যাত আমেরিকার কেবিনেট ব্যবস্থার দিকে তাকাতে অনুরোধ করব। যেখানকার সদস্যবৃন্দ সকলেই প্রেসিডেন্ট কর্তৃক মনোনীত হন এবং তারা প্রেসিডেন্ট-এর নিকট দায়ী থাকেন।
বর্তমানে পৃথিবীর ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্র যদি স্ব স্ব দেশে ‘খেলাফত’ ব্যবস্থা কায়েম করে, তাদের যদি নিজস্ব সূদ বিহীন ঋণদান সংস্থা থাকে এবং তারা যদি ইতিপূর্বে প্রতিষ্ঠিত ‘ওআইসি’কে কার্যকর ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়, তাহ’লে ২৭টি দেশের সংস্থা ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ বা ‘ইইউ’-এর চাইতে ‘জাতিসংঘে’ তাদের অবস্থান শক্তিশালী হবে। শর্ত হবে একটাই, ক্ষুদ্র বাণিজ্যিক ও অন্যান্য স্বার্থের ঊর্ধ্বে মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহ’লে অতি সহজেই কাশ্মীর, ফিলিস্তীন, উইঘুর ও রোহিঙ্গা সহ বিশ্বের সর্বত্র মুসলিম বিতাড়ন ও নির্যাতন বন্ধ হয়ে যাবে। মুসলিম উম্মাহ সেদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।