
স্তম্ভিত বিশ্ব, ক্ষুব্ধ বিবেক, হতচকিত মানবতা। ২০শে মার্চ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রির শেষ প্রহরে গর্জে উঠেছে দাজ্জালের বোমা। পশুত্ব মুখ ব্যাদান করে হামলে পড়েছে নিরীহ ইরাকীদের উপরে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক আইন-কানূন সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম রাষ্ট্রনায়ক জর্জ ডব্লিউ বুশ অন্যূন ১০,০০০ মাইল দূর থেকে উড়ে এসে হামলা শুরু করেছেন দুর্বল ইরাকের উপর। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈলখনি দখলের জন্য বুশ-ব্লেয়ার-হাওয়ার্ড তৈল ব্যবসায়ী বুর্জোয়া চক্র জোট বেঁধেছে। মিসরের বিগত যুগের অহংকারী সম্রাট ফেরাঊন তার প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি হবে এই ভয়ে বনু ইস্রাঈলীদের ঘরে পুত্র সন্তান জন্ম নিলেই তাকে মেরে ফেলার চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে বিশ্ব ইতিহাসকে কালিমালিপ্ত করেছিল। তারও আগে ইরাকের নিন্দিত সম্রাট নমরূদ জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত ইব্রাহীমকে পুড়িয়ে নিঃশেষ করতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর বিধানের সম্মুখে সবই ব্যর্থ হয়েছিল। এযুগের বুশ-ব্লেয়ার চক্র নমরূদ-ফেরাঊনকে বহুগুণ ছাড়িয়ে গেছে। কেননা নমরূদ-ফেরাঊন ব্যাপক গণহত্যা করেনি, মানুষের আবাসস্থল ঘরবাড়ি ধ্বংস করেনি, শহর-বন্দর জ্বালিয়ে দেয়নি। অথচ এরা তাই-ই করছে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে’। বিশ্বের অগণিত বিবেকবান মানুষ এই অন্যায়-অনৈতিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিদিন ঘৃণা ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। খৃষ্টান ধর্মগুরু পোপ পলের আবেদন ও প্রার্থনাও হয়েছে ইরাকীদের সমর্থনে। ক্ষুব্ধ মানুষ বুশ-এর ছবি মাড়িয়ে, তার কুশপুত্তলিকায় ফাঁসি দিয়ে, থুথু নিক্ষেপ করে, তাকে জুতিয়ে লাথিয়ে ও আগুনে জ্বালিয়ে ঘৃণা প্রকাশ করছে বিশ্বব্যাপী সর্বত্র। তবুও এই হিংস্র হায়েনাদের বিবেকে ধাক্কা লাগছে না। মযলূম ইরাকের নৈতিক বিজয় ইতিমধ্যেই সাধিত হয়ে গেছে। কারণ অন্যূন ১০০০ গুণ অধিক শক্তিশালী আমেরিকার বিরুদ্ধে ইরাকের এটি কোন যুদ্ধ নয়। বরং ডাকাতের হামলা থেকে স্রেফ আত্মরক্ষা মাত্র।
বুশ তার ভাষণে বলতে চেয়েছেন যে, তার এ হামলা হচ্ছে ‘ইরাকীদের রক্ষার জন্য’, ‘বিশ্বকে রক্ষার জন্য জন্য’ এবং ‘ইরাকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য’। এটা নাকি ইরাকী জনগণের কল্যাণে পরিচালিত ‘মুক্তিযুদ্ধ’। মিথ্যারও একটা স্তর আছে। কিন্তু এতবড় ডাহা মিথ্যা যে কোন রাষ্ট্রনেতা বলতে পারেন, তা কল্পনাও করা যায়নি। খোদ ইবলীসও সম্ভবতঃ এমন তাযা মিথ্যা বলতে লজ্জাবোধ করবে। তবুও এসবই সত্য। কারণ শক্তি ও অর্থ তার হাতে। সম্ভবতঃ বুশ-এর রক্তচক্ষুর ভয়েই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি চুপ মেরে আছে। কিন্তু তারা জানে না যে, ক্ষিপ্ত কুকুর কারু বন্ধু নয়। আজ ওরা ইরাককে ধরেছে, কাল তোমাকে ধরবে এটা নিশ্চিত। কারণ ইরাকী তেলের স্বাদ পাওয়ার পর এই হিংস্র দ্বিপদ পশুরা বিশ্বের সর্ববৃহৎ তৈলখনির অধিকারী সঊদী আরবের তেলের স্বাদ গ্রহণের জন্য উঠে পড়ে লাগবে। পার্শ্ববর্তী কুয়েত, কাতার, বাহরায়েন এগুলি তো ওদের কাছে সকালের নাশতার মত। অতএব ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী হকপন্থীদের যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মুকাবিলায় এগিয়ে আসা কর্তব্য। জালে আটকে পড়া সিংহকে একটি ছোট্ট মুষিক উদ্ধার করেছিল তার ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে জাল ছিঁড়ে ফেলার মাধ্যমে। মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো কিছুই না পারুক শত্রু বাহিনীকে তৈল সরবরাহ বন্ধ করে দিলেই তো যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। বিশ্বের বাকী রাষ্ট্রগুলি ইঙ্গ-মার্কিনীদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ও তাদের উৎপাদিত পণ্য বর্জন করে এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।
ইরাকে আমরা মানবতার পতন অবলোকন করছি। ইতিপূর্বে আফগানিস্তানে এ দৃশ্য আমরা দেখেছি। গত শতাব্দীতে জাপান, ভিয়েতনাম, বসনিয়া, সোমালিয়া ও কসোভোর মর্মান্তিক ইতিহাস বিশ্ববাসী এখনো ভুলে যায়নি। তারও পূর্বে ১৪৯২ সালের ১লা এপ্রিল তারিখে খ্রিষ্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও তার স্ত্রী ইসাবেলার চক্রান্তে ইউরোপের একমাত্র সমৃদ্ধ মুসলিম রাষ্ট্র স্পেনের রাজধানী গ্রানাডায় ৭ লক্ষ মুসলিম নর-নারীকে প্রতারণার মাধ্যমে মসজিদে ভরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে ৮০০ বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইসলামী শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিল। মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানোর এই বিয়োগান্ত ঘটনাকে স্মরণ করে আজও খ্রিষ্টান বিশ্ব April Fool's day পালন করে থাকে। কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছে কয়জন? এটা কে না জানে যে, সাদ্দাম হোসেন আমেরিকারই সৃষ্টি এবং তাকে দিয়েই ১৯৮০ সালে ইরানে হামলা চালিয়ে শক্তিশালী ইরান ও ইরাক উভয়কে ৮ বছরের যুদ্ধে কাবু করা হয়েছে। অতঃপর একই সাদ্দামকে দিয়ে ১৯৯০ সালে অন্যায়ভাবে তার সহযোগী ও বন্ধু প্রতিবেশী কুয়েতে আগ্রাসন চালানো হয়। আর এই সুযোগে আমেরিকা ‘ত্রাণকর্তা’ সেজে কুয়েত ও সঊদী আরবের মাটিতে ঘাঁটি স্থাপন করে। ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রের দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ হিসাবে তারা প্রথমে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ইসলাম বিরোধী আক্বীদা প্রচার করে ‘খেলাফত’-এর বিরুদ্ধে যুবশক্তিকে ক্ষেপিয়ে তোলে। অতঃপর কামাল পাশার মাধ্যমে ১৯২৪ সালে মুসলিম ঐক্যের প্রতীক ‘ওছমানী খেলাফত’ ধ্বংস করে ক্রমে মধ্যপ্রাচ্যকে ১৪টি রাষ্ট্রে বিভক্ত করে। তারপর তারা সাদ্দামকে দিয়ে প্রতিবেশী ইরান, কুয়েত ও সঊদী আরবের সাথে ইরাকের সুসম্পর্ক বিনষ্ট করে। অতঃপর বিগত ১৩ বছর যাবত জাতিসংঘ অবরোধের মাধ্যমে তারা শক্তিশালী ইরাককে দুর্বলতর করেছে। অতঃপর এবারের হামলায় তারা ইরাক দখল করে তাকে তিন টুকরা করে সেখানে তিনটি পুতুল সরকার কায়েম করবে। পরবর্তী টার্গেট অনুযায়ী তারা সঊদী আরবকে কুক্ষিগত ও ত্রিধাবিভক্ত করে সেখানেও তিনটি পুতুল সরকার কায়েম করবে। যেটা ওয়েবসাইট সূত্রে প্রাপ্ত বৃটিশ লেবার পার্টির পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান জর্জ গ্যালাওয়ের বক্তব্য থেকে এবং ২১.২.১৯৯৯ সংখ্যা ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত রবার্ট বি কাপলান-এর ‘রি-ড্রয়িং অব মিড-ঈস্ট ম্যাপ’ নামক নিবন্ধ থেকে জানা যায়।
গণতন্ত্রের লালনভূমি ইংল্যান্ড-আমেরিকার সরকারী ও বিরোধী দলের অধিকাংশ সদস্য বুশ ও ব্লেয়ারের এই অন্যায় আগ্রাসনকে সমর্থন করেছে। বিশাল অংকের যুদ্ধ বাজেট পাস করে দিয়েছে। যদিও তাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ নেতাদের এই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দৈনিক মিছিল-মিটিং করে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী চলছে নিন্দার ঝড়। একদিনেই সোয়াশো কোটি মানুষ পৃথিবীর ছয়শো শহরে ইঙ্গ-মার্কিন হামলা পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছিল। শহরে-গ্রামে-বাজারে সর্বত্র বুশের গলায় এখন ছেঁড়া জুতা ঝুলছে। ‘বুশ-ব্লেয়ারের গালে গালে জুতা মারো তালে তালে’-এ ধরনের শ্লোগানে মুখর এখন বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ। বুশ এখন শয়তানের প্রতিমূর্তি। অন্যায়কারী ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে লোকেরা বলছে, ‘তুই মানুষ না বুশ’। আমেরিকার জনগণ Hang Bush লিখে বুশের ফাঁসি দাবী করছে। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার জনগণেরও একই প্রতিবাদী কণ্ঠ ধ্বনিত হচ্ছে প্রতিদিন। নিন্দা ও বিক্ষোভের ঝড় ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে পৃথিবীব্যাপী। কিন্তু এগুলি জনমত নয়। এগুলির কোন মূল্য যুদ্ধবাজদের কাছে নেই। কেননা একবার ভোট দিয়ে যাদেরকে পার্লামেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, স্ব স্ব মেয়াদকাল পর্যন্ত তারা যা খুশী তাই-ই করবে, এটাই গণতন্ত্র ও সেটাই সত্য ও ন্যায়ের মানদন্ড (?)। আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া এখন সেদেশের তৈল ব্যবসায়ী কতগুলি অর্থগৃধণু মন্ত্রী-এমপিদের হাতে যিম্মী। এদেরকে কি রোখার কেউ নেই? নিশ্চয়ই আছে।
আল্লাহর ওয়াদা এই যে, তিনি মানুষকে মানুষ দিয়েই প্রতিরোধ করে থাকেন (বাক্বারাহ ২/২৫১)। অতএব বাকী বিশ্বের রাষ্ট্রনেতা ও সাধারণ জনগণের মধ্য থেকেই আল্লাহ পাক কিছু বান্দাকে নিশ্চয়ই নির্বাচন করবেন এই যুলুম প্রতিরোধের জন্য। তাই একদিকে আমাদেরকে যেমন প্রাণভরে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। অন্যদিকে তাঁরই নির্দেশ অনুযায়ী সর্বশক্তি দিয়ে মযলূম ইরাকীদের সাহায্যে এগিয়ে যেতে হবে। এ দুঃসময়ে যদি বাকী বিশ্ব ও বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব তাদের যথাযোগ্য ভূমিকা পালন না করে, তাহ’লে পৃথিবী থেকে এখনই মানবতা বিদায় নেবে। পশুত্বের জয় হবে। ১৯৩৯ সালে যেমন জার্মান নেতা এডলফ হিটলারের যুদ্ধবাদী নীতির কারণে ২য় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় ও ‘লীগ অব নেশন্স’-এর অপমৃত্যু ঘটে, বর্তমানে তেমনি নয়া হিটলার জর্জ বুশ-এর যুদ্ধবাদী নীতির কারণে হয়তোবা ‘জাতিসংঘে’র (UNO) অপমৃত্যু ঘটবে। ফলে পৃথিবীর মানুষ তাদের সর্বশেষ সান্ত্বনার স্থলটুকুও হারাবে। পরিশেষে বলব, হে মানুষ! তোমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ভয় কর। তাঁর সর্বাধিক প্রিয় সৃষ্টি হিসাবে মানুষের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত কর। পশুত্বকে প্রতিরোধ কর। আল্লাহর বিধান মেনে নিয়ে মযলূমের সাহায্যে এগিয়ে এসো। যালেমকে থামিয়ে দাও। নিশ্চয়ই সত্য বিজয়ী হবে, মিথ্যা পরাজিত হবে আল্লাহর ইচ্ছা হ’লে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন![1]
[1]. ৬ষ্ঠ বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, এপ্রিল ২০০৩।