কসোভো বর্তমানে একটি বিপন্ন মানবতার নাম। কসোভোর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণ সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান সার্বদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে সবকিছু ফেলে নিঃস্ব হাতে বানের স্রোতের মত পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র সমূহে পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? কি তাদের অপরাধ? তাহ’লে আসুন একবার পিছন ফিরে তাকাই।

ইউরোপের বলকান অঞ্চলে আড্রিয়াটিক সাগর পাড়ে অবস্থিত বৃহত্তর যুগোশ্লাভিয়ার বিভিন্ন অংশে রয়েছে সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, কসোভো এবং আলবেনিয়া প্রভৃতি রাজ্য ও অঞ্চলগুলো। আলবেনিয়া, বসনিয়া, হার্জেগোভিনা ও কসোভোর অধিকাংশ অধিবাসী মুসলমান। দীর্ঘকাল ধরে যুগোশ্লাভিয়া তথা সার্বিয়ার শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট ও জাতিগত বৈষম্যের শিকার কসোভো ও অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যগুলির মুসলমানদের মধ্যে অসন্তোষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল। ১৯৯১ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে যুগোশ্লাভিয়া ফেডারেশনের ৪টি অঙ্গরাজ্য স্বাধীনতা ঘোষণা করে। একই ধারায় যখন বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনা স্বাধীনতা ঘোষণা করল, তখন তাদের উপরে নেমে এল ইতিহাসের বর্বরতম নির্যাতন ও বিতাড়নের বিভীষিকাময় ইতিহাস। আন্তর্জাতিক ইহূদী-খ্রিষ্টান চক্র কোনক্রমেই ইউরোপের মাটিতে কোন স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বরদাশত করতে পারেনি। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত চার বছর একটানা প্রতারণা ও পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে হাযার হাযার মুসলমানকে হত্যা ও প্রায় ৬ লাখ মুসলমানকে বিতাড়িত করে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে পঙ্গু করে দিয়ে তারা ক্ষান্ত হয়। সার্ব খ্রিষ্টানদের পক্ষ নিয়ে এ সময় রাশিয়া প্রকাশ্যে অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ভূমিকা রাখা।

এইভাবে সব অঙ্গরাজ্য হারিয়ে এখন যুগোশ্লাভিয়া বলতে রয়েছে সার্বিয়া ও মন্টেনিগ্রো। কসোভো উক্ত সার্বিয়া রাজ্যেরই একটি প্রদেশের নাম, যার ২০ লাখ অধিবাসীর মধ্যে মুসলমান ১৮ লাখ ও সার্ব খ্রিষ্টান মাত্র ২ লাখ। মুসলমান মূলতঃ পার্শ্ববর্তী আলবেনীয় বংশোদ্ভূত। তাই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে আলবেনীয়দের সাথে তাদের রয়েছে সার্বিক মিল। ফলে সার্বিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়েও তাদের রয়েছে স্বতন্ত্র ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। বর্তমান সংঘাতের মূল কারণ এখানেই। একদিকে উগ্র সার্ব জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে মুসলিম জাতিসত্তা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। মার্শাল টিটোর আমল থেকে কসোভোর মুসলমানগণ যে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে আসছিল, বর্তমান যুগোশ্লাভ প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচের সরকার সেটুকুও কেড়ে নিয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে যখন এ সমস্যার সুরাহা হ’ল না। বরং কসোভোর যাবতীয় সরকারী চাকুরী-বাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা সর্বত্র সার্ব প্রাধান্য চাপিয়ে দেওয়া হ’তে লাগল, তখনই ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসে কসোভোর পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী নিয়ে আত্মপ্রকাশ করল ‘কসোভো লিবারেশন আর্মি’ বা সংক্ষেপে ‘কেএলএ’।

শুরু হ’ল সশস্ত্র সংগ্রাম। সার্ব পুলিশের পরে নেমে এল সার্ব সেনাবাহিনী তাদের হিংস্র থাবা নিয়ে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে ও মুসলিম নাগরিকদের নির্বিচার গণহত্যা চালাতে শুরু করল সার্ব সেনাবাহিনী। ফলে রাতারাতি উদ্বাস্ত্ত হয়ে ছুটতে লাগল তারা পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে সবকিছু ফেলে রেখে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের টনক নড়ল। তারা আপোষ রফার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোন ফলোদয় হ’ল না। অবশেষে গত ২৪ শে মার্চ থেকে ন্যাটো বিমান হামলা শুরু করেছে। কিন্তু তাতে সার্বদের হিংস্রতা মোটেই কমেনি; বরং আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষ্যাপা কুকুরের মত তারা মুসলমানদের উপরে হামলা ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তাই অনেকেই ইতিমধ্যে ন্যাটোর বিমান হামলাকে মুসলিম বিশ্বকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য নিছক একটা ‘আই ওয়াশ’ বলে ধারণা করছেন। কম্যুনিস্ট রাশিয়া ও চীন সার্ব দস্যুদের প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছে এবং তাদের উপরে ন্যাটো হামলার নিন্দা করেছে। প্রতিবেশী অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো যুগোশ্লাভ সরকারকে আদর্শিক কারণে নৈতিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে অথবা চুপ রয়েছে। বসনিয়ার মত কসোভোর বিরুদ্ধে যুগোশ্লাভ সরকার পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছে এবং ইতিমধ্যেই কসোভোর ৬ লাখ মুসলমান পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহে আশ্রয় নিয়েছে। কসোভোকে মুসলিম শূন্য অথবা মুসলিম সংখ্যালঘু অঞ্চলে পরিণত করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে তারা এগোচ্ছে। কেননা ন্যাটো বা বৃহৎ শক্তি বলয়ের কেউই এখনও কসোভোর স্বাধীনতাকে সমর্থন করেনি। অথচ কসোভোতে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটিই মাত্র পথ খোলা রয়েছে। সেটা হ’ল তার পূর্ণ স্বাধীনতা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যত দ্রুত এটা মেনে নিবে, তত দ্রুত সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

কসোভোর দুর্দশাগ্রস্থ ভাইদের খাদ্য, পানীয় ও আশ্রয় দানে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকটে আহবান জানিয়েছে। কিন্তু দুঃখ হয় ওআইসি-র জন্য। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের প্রতিনিধিত্বশীল এই সংস্থা আজও মুখ খোলেনি। যেমন খোলেনি পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বিপন্ন মানবতা কি এমনিভাবেই কাঁদতে থাকবে? তবুও বলব ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, অাঁধারে তার সূর্য হাসে; হারা শশীর হারা আলো অন্ধকারেই ফিরে আসে’। হজ্জের মহামিলনের মাসে এবং ঈদুল আযহার কুরবানীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ ও দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদাত্ত আহবান জানাই এবং সাথে সাথে কসোভো সহ বিশ্বের সকল প্রান্তের বিপন্ন মানবতার জন্য আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা জানাই- ‘আল্লাহ তুমি মযলূমদের সাহায্য কর’! আমীন![1]

[1]. ২য় বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, এপ্রিল ১৯৯৯।






বিষয়সমূহ: স্বদেশ-বিদেশ
জশনে জুলূস ও আমরা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান কাম্য - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শিক্ষার মান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
১লা বৈশাখ ও নারীর বস্ত্রহরণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে পরামর্শ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ডেঙ্গুজ্বর : আসুন! অন্যায় থেকে তওবা করি ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেই - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জীবন দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের উপায় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জবাবদিহিতার অনুভূতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
করোনা ভাইরাস - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ভেসে গেল স্বপ্নসাধ! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ভাল আছি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.