আল্লাহর দাসত্ব ছেড়ে মানুষকে মানুষের দাসত্বে বন্দী করা এবং ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’-এর বহু প্রাচীন অপরাজনীতির আধুনিক দার্শনিক নাম হ’ল ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র। বর্তমানে যা সরকারী ও বিরোধীদলীয় হানাহানিতে বিপর্যস্ত একটি জরাজীর্ণ সমাজের নাম। দুই বিপরীত জোটের পেশীশক্তি ও জনবলের প্রদর্শনী এবং সেইসাথে খুন-যখম ও মিথ্যা মামলায় জেলহাজত প্রভৃতি অমানবিক কর্মকান্ডই হ’ল প্রচলিত নির্বাচনী রাজনীতির আবশ্যিক অনুষঙ্গ। এর মূলে প্রকৃত গলদ হ’ল দল ও প্রার্থীভিত্তিক নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা, যা মানুষকে নেতৃত্ব আদায়ে আগ্রাসী করে তোলে। কুয়াতে পচা বিড়াল রেখে সমস্ত পানি সেচে ফেললেও যেমন গন্ধ দূর হয় না, তেমনিভাবে এই মূল গলদ দূর না করে ফ্রী ও ফেয়ার ইলেকশনের জন্য যত আইন করা হোক না কেন, কোনটাই কাজে আসবে না। ইসলাম বহু পূর্বেই এর সমাধান দিয়েছে। যেমন-

(১) দল ও প্রার্থীবিহীনভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন হবে। সর্বাধিক সহজ, দ্রুত, নিরাপদ ও বিশ্বস্ত মিডিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালিত হবে। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে উক্ত নির্বাচন পরিচালনা করবেন। যেহেতু কোন প্রার্থী থাকবে না, সেহেতু কোনরূপ ক্যানভাস ও অন্যায় পথ তালাশের সুযোগ থাকবে না। নির্বাচিত নেতা জানতে বা বুঝতেও পারবেন না, কারা তাকে ভোট দিয়েছে বা দেয়নি। এর ফলে তাঁর মানসিকতা থাকবে সবার প্রতি উদার ও নিরাসক্ত। ফলে দলীয় চাপ ও আবেগমুক্ত মনে তিনি পূর্ণ আল্লাহভীতির সাথে নিরপেক্ষভাবে দেশ শাসন করতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন ইচ্ছা করলে দেশের শীর্ষস্থানীয় ৫/৬ জন ইসলামী নেতার নাম তাঁদের পূর্ণ পরিচয়সহ প্রস্তাব আকারে পেশ করতে পারেন। প্রস্তাবিতদের বাইরে অন্যকেও ভোট দেয়ার সুযোগ থাকবে। এভাবে রাষ্ট্রের একজন আমীর বা প্রেসিডেণ্ট নির্বাচিত হবেন। অতঃপর রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি স্তম্ভ বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ ও আইনসভার মধ্যে বর্তমানের বিচার ও শাসন বিভাগের ন্যায় আইনসভাও প্রেসিডেণ্ট কর্তৃক মনোনীত হবে। এম,পি, নির্বাচনের প্রচলিত প্রথা থাকবে না। সরকারী ও বিরোধীদল বলে কিছু থাকবে না। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে মেধা, যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রতিনিধি মনোনয়ন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। সর্বত্র সমাজের উত্তম ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শমতে প্রশাসন চলবে। নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য ও প্রতিভা বিকাশের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন সমূহ থাকবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হবে সকল সংগঠনের মূল লক্ষ্য।

(২) নেতৃত্ব নির্বাচনে অধিকাংশের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশন একটি নীতিমালা করতে পারেন। যেমন, নেতাকে প্রদত্ত ভোটের কমপক্ষে ৫৫ শতাংশের সমর্থন পেতে হবে। প্রথমবারে যদি কেউ উক্ত সমর্থন না পান, তবে দু’সপ্তাহের মধ্যে পুনরায় নির্বাচন হবে। কমিশন মনে করলে এ সময় নিকটতম তিনজনের নাম প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু ভোটের পার্সেন্টেজ ও পরস্পরের মধ্যেকার ভোটের দূরত্ব প্রকাশ করা যাবে না এবং কারু পক্ষে কেউ কোন ক্যানভাস করতে পারবে না। করলে সেটা ঐ নেতার জন্য মাইনাস পয়েন্ট হিসাবে গণ্য হবে। যার বিধানসমূহ নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করবেন। ২য় ও ৩য় জনকে নেতা ইচ্ছা করলে ভাইস প্রেসিডেণ্ট ও প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিতে পারেন কিংবা তারা নেতার মনোনীত পার্লামেন্টের সদস্য হতে পারেন।

(৩) ইসলামের বিধান অনুযায়ী আমীরকে (১) আল্লাহভীরু যোগ্য পুরুষ (২) সুস্থ মস্তিষ্ক ও দূরদর্শী (৩) নির্লোভ সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ (৪) ইসলামী শরী‘আতে অভিজ্ঞ ও সালাফে ছালেহীনের অনুসারী (৫) নিরহংকার, সাহসী ও আমানতদার এবং (৬) ছালাত-ছিয়াম ও যাকাতে অভ্যস্ত হতে হবে। 

(৪) ইসলামী নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থায় অল্পসংখ্যক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির সুপরামর্শে নেতা নির্বাচিত হন। প্রয়োজনে পরামর্শ গ্রহণের পরিধি বাড়ানো যায়। এজন্য নির্বাচককে অবশ্যই অধিক জ্ঞানী ও দূরদর্শী হতে হয়। কেননা জহুরী জহর চেনে। সেকারণ ২৫ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে সামাজিকভাবে সৎ ও জ্ঞানী ব্যক্তিগণই কেবল ভোটার হবেন। এতে সমাজের বখাটে-লম্পট, চোর-ডাকাত, সূদখোর-ঘুষখোর, লুটেরা-সন্ত্রাসী, মদখোর-মাদকব্যবসায়ী, চোরাকারবারী, প্রতারকচক্র, আদমব্যাপারী, ঋণখেলাপী, চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ, ধর্ষক-খুনী, অপহরণকারী, ভূমিদস্যু প্রভৃতি চিহ্নিত সমাজবিরোধীরা ভোট দেওয়ার যোগ্যতা হারাবে। এটা করলে মানুষ আপনা থেকেই অনেকটা সংশোধন হয়ে যাবে। এদের দাপট কমে যাবে। নিজ পরিবার ও সমাজের কাছে এরা লজ্জিত ও ধিকৃত হবে।

(৫) ভোটারদের ভোটের গুরুত্ব সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আমানতসমূহ যথাস্থানে সমর্পণ কর’ (নিসা ৫৮)। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি উত্তম সুফারিশ করবে, সে তার অংশ পাবে। আর যে ব্যক্তি মন্দ সুফারিশ করবে, সে তার অংশ পাবে’ (নিসা ৮৫)। ভোট হ’ল সুফারিশ। এক্ষণে তার সুফারিশে নির্বাচিত নেতা স্বীয় নেতৃত্বকালে যত নেকীর কাজ করবেন, ভোটার তার একটা অংশ পাবে। পক্ষান্তরে পাপ করলেও ভোটার তার অংশ পাবে।

নেতাকেও তার দায়িত্ব সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ যাকে জনগণের নেতৃত্বে বসান, অতঃপর যদি সে জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হিসাবে মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তার উপরে জান্নাতকে হারাম করে দেন’ (মুসলিম হা/১৪২)। ওমর (রাঃ) বলেন, যদি ফোরাত নদীর কূলে রাষ্ট্রের অবহেলায় একটি বকরীও মারা যায়, আমি মনে করি ওমরকে সেজন্য ক্বিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে’ (হিলইয়াতুল আউলিয়া ১/৫৩)

(৬) নির্বাচিত নেতা সাবেক রাষ্ট্রনেতা, প্রধান বিচারপতি এবং যোগ্য আলেমদের সমন্বয়ে পাঁচজনের একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবেন। অতঃপর তাদের ও অন্যান্য বিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ মতে সীমিত সংখ্যক সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি বাছাই করে একটি মজলিসে শূরা বা পার্লামেন্ট নিয়োগ দিবেন এবং তার মধ্য থেকে অথবা কিছু বাইরে থেকে নিয়ে একটা ছোট মন্ত্রীসভা গঠন করবেন। এভাবে রাষ্ট্রের মূল যিম্মাদার হবেন প্রেসিডেন্ট। অন্যেরা হবেন তাঁর পরামর্শদাতা ও সহযোগী।

ইসলামী খেলাফতে রাষ্ট্রপ্রধান হবেন ‘আমীর’। যিনি একই সাথে জনগণের প্রতিনিধি ও আল্লাহর প্রতিনিধি হবেন। তিনি সর্বদা আল্লাহ এবং মজলিসে শূরা ও জনগণের নিকটে দায়বদ্ধ থাকবেন। যা Check & Balance-এর সর্বোত্তম নমুনা হিসাবে কাজ করবে। আমীর আল্লাহর বিধানের বাইরে কোন বিধান জারী করতে পারবেন না এবং অহি-র বিধান জারী করতে কোনরূপ দুর্বলতা প্রদর্শন করবেন না। অধঃস্তন প্রশাসনে কোনরূপ নির্বাচন হবে না। বর্তমানে ডিসি ও ইউএনও-এর ন্যায় ইউনিয়ন প্রশাসকও সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। সাথে একাধিক অতিরিক্ত প্রশাসক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। যারা নিয়মিত গ্রামে-গঞ্জে সফর করবেন। জনগণের কথা শুনবেন ও তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হবেন।

দেশের বিচার ও প্রশাসন বিভাগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকবে এবং ইসলামী নীতির অনুসরণে কাজ করবে। একইভাবে মজলিসে শূরা বা পার্লামেন্ট ইসলামী নীতি অনুযায়ী স্বাধীনভাবে আমীরকে আইনগত পরামর্শ দিবে। আমীরের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের করা যাবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এবং তা ইমারতের অযোগ্যতা প্রমাণিত করলে আদালতের রায়ে এবং পার্লামেন্টের অনুমোদনক্রমে আমীর যেকোন সময় অপসারিত হবেন। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় ইমারতের যোগ্য থাকা পর্যন্ত তিনি উক্ত পদে বহাল থাকবেন।

এভাবে নেতৃত্ব নির্বাচনের ফল দাঁড়াবে এই যে, জাতি সর্বদা একদল দক্ষ, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে প্রশাসনের সর্বত্র দেখতে পাবে। রাজনৈতিক দলাদলি ও সন্ত্রাস থেকে জাতি মুক্তি পাবে। একক ও স্থায়ী নেতৃত্বের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হবে। সামাজিক শান্তি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)






সার্বভৌমত্ব দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দেউলিয়া হ’ল শ্রীলংকা! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বন্যায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নদীর ভাঙ্গনে দেশের মানচিত্র বদলে যাচ্ছে - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পর্দা নারীর অঙ্গভূষণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলামী শিক্ষার বিকাশ চাই - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
স্বভাবধর্মের বিকাশ চাই! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উৎস হৌক যাকাত ও ছাদাক্বা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সামাজিক অস্থিরতা ও তা দূরীকরণের উপায় সমূহ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিশ্বের শাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর তাকীদ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
১লা বৈশাখ ও নারীর বস্ত্রহরণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বর্বর ইস্রাঈলী হামলা; ফিলিস্তীনের বিজয় আসন্ন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.