দেশে ইসলামী শিক্ষার সংকোচন নীতি প্রকাশ্যভাবেই চলছে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশের সব ধরনের সরকারই যেন ইসলামকে ভীতির চোখে দেখে। এই ভীতির কারণ সম্ভবতঃ দু’টি। নৈতিক ও রাজনৈতিক। নৈতিক ভীতি এজন্য যে, ক্ষমতাসীন দল বা সরকার এবং সরকারী আমলাতন্ত্রের প্রধান একটি অংশ প্রায় সকল দেশেই নৈতিকতার বিচারে অত্যন্ত নীচু মানের হয়ে থাকেন। তারা ইসলামের উন্নত নৈতিকতাকে প্রশংসা করলেও তার বাস্তবায়ন কখনোই কামনা করেন না। বিশেষ করে ইসলামের ফৌজদারী আইনকে তারা দারুণ ভীতির চোখে দেখেন। দ্বিতীয়তঃ স্বাধীনভাবে ইসলামী শিক্ষার বিকাশ ঘটলে মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটবে, যা বিশ্বের অমুসলিম সরকার ও রাষ্ট্রগুলির এবং তাদের সেবাদাস মুসলিম দেশসমূহের রাজনীতিক ও আমলাদের বড় অংশ মোটেই কামনা করেন না।

বৃটিশ আমল থেকেই উপমহাদেশে এ ষড়যন্ত্র চলে আসছে। কেবল জনগণের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য নামকাওয়াস্তে সরকারীভাবে প্রথম মাদরাসা শিক্ষা চালু করা হয়েছিল কলিকাতায় বৃটিশ আমলে ১৭৮০ সালে। যদিও তারা তাদের উপনিবেশ চিরস্থায়ী করার জন্য সে সময় অখন্ড বাংলার ৮০ হাযার ছোট-বড় মাদরাসা কার্যতঃ বন্ধ করে দিয়েছিল। তারপর স্বাধীন পাকিস্তান হ’ল, স্বাধীন বাংলাদেশ হ’ল। কিন্তু ইসলামী শিক্ষার বিকাশ হয়নি। বরং ছলে-বলে-কৌশলে একে সর্বদা সংকুচিত করার চেষ্টা হয়েছে। যা এখন দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ্যেই নযরে পড়ছে।

ইসলামী শিক্ষা মানুষের সার্বিক জীবন পরিচালনার জন্য সামগ্রিক উপাদান সমৃদ্ধ একটি সমন্বিত শিক্ষার নাম। ইংরেজ সরকার লর্ড মেকলের মাধ্যমে ১৯৩৬ সালে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাগতিক শিক্ষা থেকে পৃথক করে ধর্মীয় ও বৈষয়িক দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন। এর মাধ্যমে তারা পরোক্ষভাবে ইসলামী শিক্ষাকে আধুনিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি বৈষয়িক ক্ষেত্রে অচল প্রমাণ করতে চাইলেন। পাখির একটি ডানা ভেঙ্গে দিলে তার যে অবস্থা হয়, ইসলামী শিক্ষাকে মাদরাসা শিক্ষার নামে নির্দিষ্ট একটি মাযহাবী ফিক্বহ, মানতেক ও হিকমতের মধ্যে বন্দী করে ইসলামকে বাস্তবে অনুরূপ পঙ্গু করে ফেলা হয়। ‘মাদরাসা শিক্ষা’ নামে ঐ অপূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষাই গত ৬৩ বছর যাবত চলে আসছে। বর্তমানে সেটুকুকেও সহ্য করতে না পেরে অবশেষে মাদরাসা সমূহ বন্ধ করে দেওয়ার বাস্তব প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ২৫১টি মাদরাসার অনুদান বন্ধ হয়েছে। আরও কয়েক হাযার মাদরাসা বন্ধের প্রক্রিয়া চলেছে। শুধু মাদরাসা নয়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও ‘আরবী’ ও ‘ইসলামী শিক্ষা’ বিষয় খোলা হয়নি। যদিও তার নাম হ’ল বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ প্রথম শ্রেণী থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণী পর্যন্ত সকল বিষয়ের সাথে ইসলামী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত ছিল। কিন্তু কোন সরকারই সে উদ্যোগ নেয়নি। বরং সকলের কাছে যেন আরবী ও ইসলামী শিক্ষাই হ’ল সবচেয়ে অবহেলিত সাবজেক্ট। ফলে স্বাভাবিক জনরোষ ঠেকানোর জন্য রাজনৈতিক মোকাবিলার নামে ‘মৌলবাদে’র জিগির তোলা হচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষাবোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের কিছু আমলা ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের বিরুদ্ধে সর্বদা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।

শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলামী শিক্ষার এই অবস্থা। অথচ শতকরা ৫০ ভাগ মুসলমানের দেশ মালয়েশিয়ায় আরবী ও ইসলামী শিক্ষা সেদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দু’টি প্রধান স্তম্ভ। সকল মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীর জন্য প্রাথমিক স্তর হ’তে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ‘ইসলাম শিক্ষা’ এবং সকল অমুসলিম ছাত্র-ছাত্রীর জন্য ‘নৈতিক শিক্ষা’ বাধ্যতামূলক। সে দেশের ‘আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়’ সারা বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে। অথচ বাংলাদেশের একমাত্র সরকারী ‘ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়’টি দিন দিন ধর্মহীনতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মালয়েশিয়া ইসলামী শিক্ষা নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে চলেছে। আর বাংলাদেশ ইসলামী শিক্ষা বাদ দিয়ে অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। নিরপেক্ষ চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রই বলবেন যে, এদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনীতি-অর্থনীতির কোথাও কোন সুস্থতা ও উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সন্ত্রাস ও দুর্নীতি উপর থেকে নীচতলা পর্যন্ত সর্বত্র সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। লোনা পানি যেমন উর্বর মাটিকে বিনষ্ট করে দেয়, দুর্নীতির বিষাক্ত স্রোত তেমনি পুরা সমাজ দেহকে জ্বরাগ্রস্ত করে ফেলেছে। প্যারালাইসিসের রোগীর যেমন কোন অনুভূতি থাকে না, তেমনি দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের উপর থেকে নীচু পর্যন্ত কারু যেন এখন আর কোন অনুভূতি নেই।

কেন নেই? কারণ একটাই। আমাদের মধ্যে দ্বীন নেই। ইসলামী সমাজ হ’ল ইলাহী দ্বীনভিত্তিক সমাজ। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ঠিক তার উল্টা। একারণে তারা ইসলামকে বরদাশত করতে পারে না। বর্তমানে সেই আদর্শিক সংঘাত প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। এ সংঘাত রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবার ও সমাজের সর্বত্র ফুটে উঠছে। ইসলামী শিক্ষা সংকোচন তারই একটি অংশ মাত্র। অতএব সচেতন ব্যক্তি মাত্রকেই হুঁশিয়ার হ’তে হবে। নইলে তুরস্ক ও আলজেরিয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়।

আমরা বিশ্বাস করি যে, ইসলামী শিক্ষার পূর্ণ বিকাশ সাধনের মধ্যেই বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতি নিহিত। এমনকি এর মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার গ্যারান্টি। সরকার যদি ইসলামী শিক্ষার বিপরীতে অবস্থান নেয়, যা ইতিমধ্যেই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, তবে সেটা হবে একটা মারাত্মক ভুল। সরকার ও দেশবাসীর ভালভাবে জেনে রাখা আবশ্যক যে, প্রতিবেশী বা দূরদেশী কোন কাফির বা মুশরিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ সরকারের প্রকৃত বন্ধু নয়। আমাদের নিকটে আল্লাহ প্রেরিত মহান ইসলামের অমূল্য সম্পদ রয়েছে। মানবাধিকার, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিক্ষার জন্য আমাদেরকে অন্য কোন মোড়ল রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী থাকতে হবে না। আমাদের জাতীয় সম্পদ আমাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা খাতে তথা ইসলামী শিক্ষার পূর্ণ বিকাশের খাতে ব্যয় করতে হবে। মাদরাসা তথা ইসলামী শিক্ষার সংকোচন বন্ধ করতে হবে।

পরিশেষে আমরা মাদরাসা শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার দ্বিমুখী ধারাকে সমন্বিত করে একক ইসলামী শিক্ষার পূর্ণ বিকাশ চাই। যে শিক্ষার বদৌলতে মুসলমান এক হাযার বছর যাবত বিশ্ববিজ্ঞানে নেতৃত্ব দিয়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছে বিশ্ব রাজনীতিতে। সেই শিক্ষা ব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে আনার জন্য আসুন সকলে নতুনভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন!






বিষয়সমূহ: শিক্ষা-সংস্কৃতি
কাশ্মীর ট্রাজেডী - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সত্য-মিথ্যার মানদন্ড - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আত্মহত্যা করবেন না - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মাহে রামাযান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দুর্নীতি ও কোটা সংস্কার আন্দোলন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিশ্বের শাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর তাকীদ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হে ছায়েম অনুধাবন কর! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সংস্কারের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
গণজোয়ার ও গণঅভ্যুত্থান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নৈতিক অবক্ষয় প্রতিরোধের উপায় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বন্যায় বিপন্ন মানবতা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সত্যদর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.