মানুষের জীবন মূলতঃ অসংখ্য ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড, পল ও অনুপলের সমষ্টির নাম। যাকে ‘হায়াত’ বলা হয়। আল্লাহ নির্ধারিত সময়ে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার মত এক সময় জীবনের আলো নিভে যাবে ও ‘মউত’ সংঘটিত হবে। মানুষের এই হায়াত ও মউত সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘কে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর আমল করে, সেটা পরীক্ষা করার জন্য তিনি তোমাদের হায়াত ও মউত সে সৃষ্টি করেছেন’ (মুলক ৬৭/২)। এই ‘সর্বাধিক সুন্দর আমল’ বা কাজের হিসাব নেওয়ার জন্যই আমাদের দৈনিক, মাসিক ও বাৎসরিক হিসাব তৈরী করতে হয় ও তার ভাল-মন্দ পর্যালোচনা করে সামনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আমাদের নতুন জীবন শুরু হয়। পিছনের দিনটি আর ফিরে আসে না। এইভাবে অতীত ও বর্তমানের দোলাচলে আমাদের অনিশ্চিত জীবন তরী এগিয়ে চলেছে চূড়ান্ত মুহূর্তের দিকে। জীবনদাতা আল্লাহর নিকটে জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড ও মিনিটের হিসাব দিতে হবে। তাই সচেতন মুমিনের নিকটে সময়ের মূল্য সবচাইতে বেশী। এইভাবে সময়ের গুরুত্ব বিবেচনা করেই দিন, মাস ও বর্ষ গণনা গুরুত্ব লাভ করেছে।

আল্লাহ পাক পুরা বৎসরকে ১২টি মাসে গণনা করেছেন (তওবা ৯/৩৬)। পৃথিবীর সকল জাতি তা মেনে নিয়েছে। এরি মধ্যে বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে রেখে তাদের বর্ষ গণনা শুরু করেছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রবীঊল আউয়াল মাসে মদীনায় হিজরত করলেও ওমর (রাঃ) আরবদেশে প্রচলিত বছরের প্রথম মাস হিসাবে মুহাররম থেকেই হিজরী সন গণনার সূত্রপাত করেন। মুগল আমলে ভারতবর্ষে হিজরী সন গণনা করা হ’ত ও সেই ভিত্তিতে রাজস্ব আদায় করা হ’ত। কিন্তু চান্দ্র মাসগুলি সৌর ঋতুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় প্রজাদের পক্ষে অন্য মৌসুমে রাজস্ব আদায়ে বিপাকে পড়তে হ’ত। বিষয়টি চিন্তা করে সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খৃঃ) বাংলাদেশে রাজস্ব আদায়কে নিয়মানুগ করার জন্য ফসল ওঠার মৌসুমের সাথে সংগতি রেখে নতুন একটি সন বা বর্ষপঞ্জী তৈরী করার জন্য তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্য পন্ডিত ফাৎহুল্লাহ সিরাজীকে দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি চান্দ্র মাসের পরিবর্তে সৌর মাস অনুযায়ী নতুন বাংলা সন উদ্ভাবন করেন ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। কিন্তু বাংলা সনের গণনা শুরু হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসনারোহণের বছর ৯৬৩ হিজরী মোতাবেক ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ হ’তে। ঐ সময় ছিল হিজরী সনের মুহাররম মাস ও বাংলাদেশে ছিল শকাব্দের দ্বিতীয় মাস বৈশাখ মাস। সেকারণে বাংলাদেশে নতুন বাংলা সনের প্রথম মাস হিসাবে নির্ধারণ করা হয় বৈশাখ মাসকে। যদিও শকাব্দের প্রথম মাস শুরু হয় পহেলা চৈত্র হ’তে। পরবর্তীকালে মাস গণনার সুবিধার্থে ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ১৯৬৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী যে রিপোর্ট প্রদান করেন, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার তা অনুমোদন করে এবং বর্তমান বাংলাদেশ সরকার তা বহাল রাখে। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলা নববর্ষের সৃষ্টি মূলতঃ রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে এবং এর প্রচলন হয় সম্রাট আকবরের নির্দেশে পন্ডিত ফাৎহুল্লাহ সিরাজীর হাতে ও বর্তমান সংশোধিত রূপ লাভ করে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে জ্ঞানতাপস ড. শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে। সম্ভবতঃ মুসলমানদের দ্বারা প্রবর্তিত ও হিজরী সনের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বাধীনতার পর হ’তেই বাংলা সনের পরিবর্তে শকাব্দ ব্যবহার করে আসছেন। ফলে ঢাকায় যেদিন ১লা বৈশাখ হয় কোলকাতায় সেটা হয় তার পরের দিন।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, চান্দ্র বর্ষ ৩৫৪ দিন ৮ ঘণ্টা ৪৮ মিনিটের কিছু বেশী সময়ে সম্পন্ন হয় এবং সৌর বর্ষ ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডে সম্পন্ন হয়। হিজরী সন বাংলা সনের চেয়ে প্রতি ৩৩ বৎসরে এক বৎসর এগিয়ে যায়। ফলে হিজরী সন হ’তে বাংলা সনের উৎপত্তি হ’লেও এই কম-বেশীর কারণে বিগত ৪৪৩ বছরে হিজরী সনের সাথে বাংলা সনের ১৩ বছরের পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। এখন বাংলা ১৪০৬ সাল কিন্তু তার সঙ্গে ১৩ বছর যোগ হয়ে এখন হিজরী ১৪১৯ সাল। সৌরবর্ষ সূর্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় বাৎসরিক ঋতু পরিক্রমা, মাস, দিন, ঘণ্টা নির্দিষ্ট সময়ে আবর্তিত হয়। ফলে আমাদের গণনা কার্যেও সুবিধা হয়। কিন্তু চান্দ্রবর্ষ চন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় এবং সৌরবর্ষ হ’তে বছরে ১০/১১ দিন কম হওয়ায় ছিয়াম, হজ্জ ইত্যাদি ইবাদত পালনে সুবিধা হয়। সারা বছর সকল ঋতুতে ঘুরে-ফিরে রামাযান, হজ্জ, ঈদ ইত্যাদি পালনের সুযোগ ঘটে। অন্যথায় কোন দেশে হয়ত শুধু গ্রীষ্মকালেই রামাযান আসত কিংবা কোন দেশে কেবল শীত কালেই। এতে নির্দিষ্ট এলাকার জন্য অবিচার হ’ত। ইসলাম বিশ্বধর্ম। তাই বিশ্বের সকল এলাকার বান্দাগণের প্রতি সুবিচার করার জন্য ফরয ইবাদতগুলির সময়কালকে আল্লাহ চান্দ্র মাসের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন।

উপরোক্ত আলোচনায় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, নববর্ষ কোন উদযাপনের বিষয় নয়। বরং হিসাব কষার দিন। হিজরী নববর্ষ কখনো বিশেষভাবে উদযাপিত হয়েছে বলে খুলাফায়ে রাশেদীনের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। প্রতিটি দিন, মাস ও বর্ষ আল্লাহর সৃষ্টি। বান্দার কর্তব্য অতীতের হিসাব করে বর্তমানকে ব্যবহার করা ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা গ্রহণ করা।

বাংলাদেশে নববর্ষ মূলতঃ তিনটি। ১- ইংরেজী নববর্ষ ১লা জানুয়ারী, ২- হিজরী নববর্ষ ১লা মুহাররম ও ৩- বাংলা নববর্ষ ১লা বৈশাখ। এর মধ্যে বাংলা নববর্ষ হ’ল সবচেয়ে উপেক্ষিত। কেননা এ দেশের সরকারী-বেসরকারী দিন, তারিখ, সময় সবকিছু নির্ধারিত হয় ইংরেজী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। চীন ও জাপান যেমন নিজস্ব ভাষা ও সনের উপরে দাঁড়িয়েই ইংরেজীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে এগিয়ে চলেছে, ইচ্ছা করলে আমরাও সেটা পারি। কিন্তু সেটা হৌক বা না হৌক আমাদের লক্ষ্য এখন অন্যদিকে। আর তা হ’ল নববর্ষ উদযাপনের নামে বেলেল্লাপনা, বেহায়াপনা ও মূর্তি সংস্কৃতির প্রচলন করা। প্রত্যেক জাতির সংস্কৃতির মধ্যে তাদের আক্বীদা-বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার ছাপ থাকে। কিন্তু এবার রাজধানী ঢাকায় যে নববর্ষ উদযাপিত হ’ল এবং পত্রিকা সমূহের রিপোর্ট মতে কপালে চাঁদতারা খচিত সাপ, ঘোড়া, পেঁচা ইত্যাদি পশু-পক্ষীর মুখোশ মিছিল, টিএসসিতে দু’ঘণ্টা ধরে প্রকাশ্যে ফ্রি স্টাইলে নারী নিপীড়ন, সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে কপালে চন্দনতিলক দিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবী ও লালপেড়ে শাড়ী পরে ঢোল-তবলা বাজিয়ে যে মিছিল করা হ’ল, এগুলি কোন্ সংস্কৃতির নিদর্শন? ‘এসো হে বৈশাখ! দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো’ বলে আহবান কোন আক্বীদার প্রতিনিধিত্ব করে? মূলতঃ বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্নভাবে ১লা বৈশাখকে মূল্যায়ন করেছেন তাঁদের স্ব স্ব ধারণা অনুযায়ী। যেমন প্রেসিডেন্ট তাঁর বাণীতে বলেছেন, ‘বিগত বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতার আলোকে নতুন উপলব্ধিতে কর্মক্ষেত্রে নিজেকে আরও নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়োজিত করতে হবে’। প্রধানমন্ত্রী* বলেছেন, ‘উন্মত্ত সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও কূপমন্ডূকতার বিরুদ্ধে নিত্য সংগ্রামমুখর বাঙালীর জাতীয় জীবনে নববর্ষ নতুন উদ্যমে বাঁচার সাহস যোগায়’। বিরোধী দলীয় নেত্রী** ‘নববর্ষের প্রথম দিন চলমান গণ আন্দোলনকে গণ অভ্যুত্থানে পরিণত করার শপথ নেওয়া’র আহবান জানান। ঢাকার রাজপথে যখন সংস্কৃতিসেবীরা ৫০ থেকে ২০০ টাকা প্লেট ইলিশ-পান্তা খাওয়ার বিলাসিতা করছেন। বাংলার নিভৃত পল্লীতে তখন অসংখ্য মানুষ অনাহারে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। তাই বলি নববর্ষ উদযাপনের নামে অহেতুক অপচয় ও অপসংস্কৃতির আমদানী বন্ধ করে দেশের প্রতিটি পয়সা ও প্রতিটি ঘণ্টা ও মিনিট দেশ গড়ার কাজে লাগান। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!

* শেখ হাসিনা। ** বিএনপি সভানেত্রী খালেদা জিয়া।






বিষয়সমূহ: শিক্ষা-সংস্কৃতি
মাহে রামাযান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মে‘রাজুন্নবী (ছাঃ) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্প - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নৈতিকতা ও উন্নয়ন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ব্যবসার নামে প্রতারণার ফাঁদ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
স্বাধীনতা দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রস্তাবিত নারী উন্নয়ন নীতিমালা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
রক্তঝরা কাশ্মীর, নিষ্পিষ্ট গুজরাট ও জেনিন : মুসলিম বিশ্বের নীরবতা ও অমুসলিম বিশ্বের কপটতার মাঝখানে - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দুর্নীতি ও কোটা সংস্কার আন্দোলন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নৈতিক অবক্ষয় প্রতিরোধের উপায় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
তাওহীদ দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
চলে গেলেন আফ্রিকার সিংহ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.