রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। নিজের চেয়ে তিনি অন্যের কথা বেশী ভাবতেন। নিজের কাছে না থাকলে কখনো কখনো ঋণ করেও তিনি অভাবী-দরিদ্রদের দান করতেন। অনেক সময় ঋণ পরিশোধ করতে তাকে বেগ পেতে হ’ত। কিন্তু তিনি সদা আল্লাহর উপরে ভরসা করতেন। এমনই একটি ঘটনা বিবৃত হয়েছে নিম্নোক্ত হাদীছে।-

আব্দুল্লাহ আল-হুরায়নী বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মুওয়াযযিন বিলাল (রাঃ)-এর সাথে হাল্ব শহরে (আলেপ্পো নগরীতে) সাক্ষাৎ করলাম। তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, হে বিলাল! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ব্যয় (দান-ছাদাক্বা) সম্পর্কে আমাকে বলুন। তিনি বললেন, তাঁর নবুঅত লাভের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর (প্রায়) সব ব্যয় সংক্রান্ত দায়িত্বই তাঁর পক্ষ থেকে আমি পালন করতাম। তাঁর কাছে যখন কোন মুসলমান আসত আর তিনি তাকে অভাবী মনে করতেন, তখন তিনি আমাকে নির্দেশ দিতেন। আমি বেরিয়ে পড়তাম এবং কারো থেকে ধার নিতাম, তারপর তা দিয়ে চাদর ও অন্য কিছু কিনে তাকে পরিধেয় ও আহার্য দান করতাম। অবশেষে একদিন এক মুশরিক আমার পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল, হে বিলাল! আমার যথেষ্ট অর্থ-সম্পদ আছে। সুতরাং তুমি আমার নিকট থেকে ছাড়া অন্য কারো থেকে ধার নিও না। তখন আমি তাই করলাম।

এরপর কোন একদিন আমি ওযূ করে আযান দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছি এমন সময় ঐ মুশরিককে একদল ব্যবসায়ীর মাঝে দেখতে পেলাম। তারপর সে আমাকে দেখতে পেয়ে বলল, হে হাবশী! বিলাল বলেন, আমি তাকে বললাম, বল। সে আমার উপর আক্রমণ করল এবং কঠোর বা গুরুতর অন্যায় কথা বলল। সে বলল, তুমি কি জান, একমাস পূর্ণ হ’তে আর কয়দিন বাকী? আমি বললাম, সামান্য কয়েকদিন। তখন সে বলল, তোমার মেয়াদ পূর্ণ হ’তে আর চারদিন বাকী। এরপর আমার পাওনার বিনিময়ে আমি তোমাকে পাকড়াও করব। কেননা তোমাকে যে ঋণ আমি দিয়েছি তা তোমার বা তোমার নবীর সম্মানার্থে নয়। আমি তো এজন্য তোমাকে ঋণ দিয়েছি যে, তার মাধ্যমে তুমি আমার দাসে পরিণত হবে আর আমি তোমাকে মেষ চরাতে পাঠাব, যেমনটি তুমি পূর্বে করতে। তিনি (বিলাল) বলেন, তখন আমার অন্য দশ জনের মত মনকেও দুশ্চিন্তায় পেয়ে বসল। আমি (সেখান থেকে) প্রস্থান করলাম এবং ছালাতের আযান দিলাম।

অবশেষে আমি যখন এশার ছালাত আদায় করলাম এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর সহধর্মিণীগণের কাছে ফিরে গেলেন তখন আমি তাঁর সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করলাম। তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, ঐ মুশরিকটি যার কথা আমি আপনার কাছে উল্লেখ করেছিলাম যে, আমি তার নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করতাম। সে আজ আমাকে এমন এমন কথা বলেছে (ঋণ পরিশোধের চাপ দিয়েছে)। অথচ আপনার বা আমার কারও কাছেই ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা নেই। সুতরাং সে তো আমাকে লাঞ্ছিত করে ছাড়বে। তখন তিনি আমাকে ইসলাম গ্রহণকারী এই মহল্লাবাসীদের কারো কারো কাছে যেতে বললেন, যাতে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে এমন কিছু দান করেন, যা দিয়ে আমি আমার দেনা পরিশোধ করবো। তখন আমি সেখান থেকে বের হয়ে আমার বাড়িতে আসলাম এবং আমার তরবারি, বল্লম, বর্শা ও পাদুকা আমার শিয়রের কাছে রাখলাম, আর আমার মুখমন্ডল দিগন্তমুখী করে রাখলাম। ফলে যখন আমার ঘুম আসছিল তখনই আমি জেগে উঠছিলাম। এরপর যখন রাত ঘনিয়ে এসেছে অনুভব করলাম তখন ঘুমিয়ে পড়লাম।

অবশেষে ভোরের প্রথম আলো প্রকাশ পেল। তখন আমি চলে যেতে উদ্যত হ’লাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম এক ব্যক্তি ডেকে বলছে, হে বিলাল! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ডাকে সাড়া দাও। তখন আমি তাঁর কাছে আসার জন্য রওয়ানা হ’লাম। এমন সময় দেখতে পেলাম পিঠে বোঝাসহ চারটি উট। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এসে তাঁর অনুমতি প্রার্থনা করলাম। নবী করীম (ছাঃ) আমাকে বললেন, বিলাল সুসংবাদ গ্রহণ কর। আল্লাহ তোমার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করেছেন। তখন আমি আল্লাহর হাম্দ ও শোকর আদায় করলাম। তিনি বললেন, তুমি কি বসিয়ে রাখা উট চারটি অতিক্রম করে আসনি? আমি বললাম, অবশ্যই। তিনি বললেন, এই উটগুলি ও এগুলোর পিঠের উপর যা কিছু রয়েছে তুমি সবকিছুর মালিক। তখন আমি দেখতে পেলাম উটগুলোর পিঠে খাবার ও পোষাক সামগ্রী রয়েছে, যা ফাদাকের শাসক তাঁর কাছে উপঢৌকন স্বরূপ পাঠিয়েছেন। এগুলি তুমি নিয়ে যাও এবং তোমার ঋণ পরিশোধ করে দাও।

বিলাল বলেন, আমি তাই করলাম। প্রথমে সেগুলোর পিঠের বোঝাগুলি নামিয়ে সেগুলোকে ঘাস খাওয়ালাম। তারপর ফজরের আযান দিলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত শেষ করলে আমি বাকীউল গারক্বাদের দিকে বের হয়ে গেলাম। আমি কানে আঙগুল ভরে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করলাম, যাদের রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে কোন পাওনা আছে তারা যেন উপস্থিত হয়। এভাবে আমি পণ্যসামগ্রী বিক্রয় করে করে ঋণ পরিশোধ করতে থাকলাম। এমনকি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে পৃথিবীর আর কারো কোন পাওনা অবশিষ্ট রইল না। পরিশেষে আমার কাছে দুই বা দেড় উকিয়া স্বর্ণ রয়ে গেল। আমি মসজিদে গেলাম, কিন্তু বেলা হয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ লোক চলে গেছে। এসময় আমি দেখতে পেলাম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একাকী মসজিদে বসে আছেন। আমি তাঁকে সালাম করলে তিনি বললেন, তোমার পূর্বের ঋণের কি অবস্থা? আমি বললাম, আল্লাহর রাসূলের সকল ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে, এখন কিছুই বাকী নেই। তিনি বললেন, কিছু বাড়তি রয়েছে কি? আমি বললাম, হ্যাঁ, দুই দীনার। তিনি বললেন, দেখ সে দু’টি থেকে আমাকে স্বস্তি দিতে পার কি-না? সে দু’টি থেকে তুমি আমাকে রেহাই না দেওয়া পর্যন্ত আমি আমার পরিবারবর্গের কারো কাছে যাচ্ছি না। কিন্তু আমাদের কাছে কোন প্রার্থী আসল না।

তাই তিনি মসজিদে রাত্রি যাপন করলেন। এমনকি দ্বিতীয় দিন সকাল ও দুপুর মসজিদেই অবস্থান করলেন। অবশেষে দিন শেষে দু’জন আরোহী আসল। তখন আমি তাদেরকে নিয়ে গিয়ে দীনার দু’টি দ্বারা তাদের জন্য খাদ্য ও পোষাকের সংস্থান করলাম। অবশেষে যখন তিনি এশার ছালাত পড়লেন তখন আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছের দীনার দু’টির কি খবর? আমি বললাম, তা থেকে আল্লাহ আপনাকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন। তখন তিনি তাঁর কাছে দীনার দু’টি থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হ’তে পারে এই আশঙ্কা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহু আকবার ও আলহামদুলিল্লাহ বললেন। এরপর আমি তাঁর পিছু পিছু চললাম। অবশেষে তিনি তাঁর স্ত্রীদের কাছে এসে তাঁদেরকে একজন একজন করে সালাম করলেন এবং তিনি তাঁর রাত্রি যাপনস্থলে পেঁŠছলেন। আর এটাই ঐ বিষয় যে সম্পর্কে তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে। (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৬/৫৫ পৃঃ; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/৬৩৫১, সনদ ছহীহ)


শিক্ষা :

১. প্রয়োজনে কাফের-মুশরিকের নিকট থেকেও ঋণ গ্রহণ করা যায়।

২. ঋণ করেও দরিদ্র-মিসকীনকে দান-ছাদাক্বা করা যায়।

৩. আল্লাহর উপরে ভরসা করলে তিনি মুমিনকে সাহায্য করেন এবং আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করেন।

৪. পাওনাদার খারাপ আচরণ করলেও ধৈর্যধারণ করতে হয়।

৫. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ভবিষ্যতের জন্য কোন কিছু জমা করতেন না। কখনও কিছু থাকলে তা তিনি দান করে দিতেন।

অতএব উপরোক্ত হাদীছ থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন গঠন করতে পারলে ইহকাল ও পরকালে কামিয়াবী হাছিল করা যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন-আমীন!

মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার

পিঞ্জুরী, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ।






বিষয়সমূহ: যাকাত ও ছাদাক্বা
আলী (রাঃ) ও খারেজীদের মধ্যকার ঘটনা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
আল্লাহর রহমত ব্যতীত কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না - উম্মে হাবীবা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মুসলিম ও মুশরিকদের একত্রিত মজলিসে সালাম দেয়ার পদ্ধতি - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
প্রতিবেশীর অসদাচরণের প্রতিকার - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
হাদীছের গল্প - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
হিংসা-বিদ্বেষ না করার ফল জান্নাত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
হোদায়বিয়ায় রাসূল (ছাঃ)-এর মু‘জেযা এবং ছাহাবীগণের অতুলনীয় বীরত্ব - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
সর্বাবস্থায় পূণ্যবান স্বামীর অনুগত হওয়াই পূণ্যবতী স্ত্রীর বৈশিষ্ট্য - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
ছুটে যাওয়া সুন্নাত আদায় প্রসঙ্গে - .
যে পানি পান করায় সে পরেই পান করে - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
যু-ক্বারাদ ও খায়বার যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর মু‘জেযা এবং ছাহাবীগণের অতুলনীয় বীরত্ব - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
তাক্বদীরের উপর বিশ্বাস - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
আরও
আরও
.