কপটতা মানব মনের এক দুষ্টু ক্ষত। এর ফলে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হয়। কখনো এর ফলে নিরপরাধ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুনাফিক্ব সরদার আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনে সুলূলের মুনাফিক্বীর শিকার হয়েছিলেন নবীপত্নী নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারিণী মা আয়েশা (রাঃ)। যে কারণে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা অহি-র মাধ্যমে আয়েশা (রাঃ)-এর পবিত্রতার কথা ঘোষণা করেন। আয়েশা (রাঃ)-এর প্রতি আরোপিত অপবাদ সম্পর্কেই আলোচ্য হাদীছ।-

উরওয়াহ ইবনু যুবায়ের, সা‘ঈদ ইবনু মুসায়্যিব, আলক্বামাহ ইবনু ওয়াক্কাস ও ওবায়দুল্লাহ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু উতবাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সহধর্মিণী আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, ... তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন সফরে যেতে ইচ্ছা করতেন, তখন তিনি তাঁর স্ত্রীগণের মধ্যে (নির্বাচনের জন্য) লটারী করতেন। এতে যার নাম উঠত তাকেই তিনি সঙ্গে নিয়ে সফরে যেতেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এমনি এক যুদ্ধে তিনি আমাদের মাঝে লটারী করেন, এতে আমার নাম উঠে আসে। তাই আমিই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে সফরে গেলাম। এ ঘটনাটি পর্দার হুকুম নাযিলের পর ঘটেছিল। তখন আমাকে হাওদাসহ সওয়ারীতে উঠানো ও নামানো হ’ত। এমনিভাবে আমরা চলতে থাকলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন এ যুদ্ধ থেকে নিষ্কৃতি লাভ করলেন, তখন তিনি (গৃহাভিমুখে) প্রত্যাবর্তন করলেন। ফেরার পথে আমরা মদীনার নিকটবর্তী হ’লে তিনি একদিন রাতের বেলা রওয়ানা হওয়ার জন্য আদেশ করলেন। রওয়ানা হওয়ার ঘোষণা দেয়া হ’লে আমি উঠলাম এবং (প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য) পায়ে হেঁটে সেনাছাউনী পেরিয়ে (সামনে) গেলাম। অতঃপর প্রয়োজন সেরে আমি আমার সওয়ারীর কাছে ফিরে এসে বুকে হাত দিয়ে দেখলাম যে, (ইয়ামনের অন্তর্গত) যিফার শহরের পুঁতি দ্বারা তৈরি করা আমার গলার হারটি ছিঁড়ে কোথায় পড়ে গেছে। তাই আমি ফিরে গিয়ে আমার হারটি খোঁজতে লাগলাম। হার খুঁজতে খুঁজতে আমার আসতে দেরী হয়ে যায়। আয়েশা (রাঃ) বলেন, যে সমস্ত লোক উটের পিঠে আমাকে উঠিয়ে দিতেন তারা এসে আমার হাওদা উটের পিঠে উঠিয়ে দিলেন। তারা ভেবেছিলেন, আমি হাওদার মধ্যেই আছি। কারণ খাদ্যাভাবে মহিলারা তখন খুবই হালকা হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের দেহ মাংসল ছিল না। তারা খুবই স্বল্প পরিমাণ খানা খেতে পেত। তাই তারা যখন হাওদা উঠিয়ে উপরে রাখেন, তখন তারা হালকা হাওদাটিকে কোন প্রকার অস্বাভাবিক মনে করেননি। অধিকন্তু আমি ছিলাম একজন অল্প বয়স্কা কিশোরী। এরপর তারা উট হাঁকিয়ে নিয়ে চলে যায়। সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর আমি আমার হারটি খুঁজে পাই এবং নিজ জায়গায় ফিরে এসে দেখি তাদের (সৈন্যদের) কোন আহবানকারী এবং কোন জওয়াব দাতা সেখানে নেই। তখন আমি আগে যেখানে ছিলাম সেখানে বসে রইলাম। ভাবলাম, তারা আমাকে দেখতে না পেয়ে অবশ্যই আমার কাছে ফিরে আসবে। ঐ স্থানে বসে থাকা অবস্থায় ঘুম চেপে ধরলে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। বনু সুলামী গোত্রের যাকওয়ান শাখার ছাফওয়ান ইবনু মু‘আত্তাল (রাঃ) (যাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফেলে যাওয়া আসবাবপত্র সংগ্রহের জন্য পশ্চাতে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন) সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর সেখানে ছিলেন। তিনি সকালে আমার অবস্থানস্থলের কাছে এসে একজন ঘুমন্ত মানুষ দেখে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে চিনে ফেললেন। পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। তিনি আমাকে চিনতে পেরে ‘ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন’ পড়লে আমি তা শুনে জেগে উঠলাম এবং চাদর টেনে আমার চেহারা ঢেকে ফেললাম। আল্লাহর কসম! আমি কোন কথা বলিনি এবং তাঁর থেকে ইন্না লিল্লাহ... পাঠ ব্যতীত অন্য কোন কথাও শুনতে পাইনি। এরপর তিনি সওয়ারী থেকে নামলেন এবং সওয়ারীকে বসিয়ে তার সামনের পা নিচু করে দিলে আমি গিয়ে তাতে উঠে পড়লাম। পরে তিনি আমাকে সহ সওয়ারীকে টেনে আগে আগে চললেন। অতঃপর ঠিক দুপুরে প্রচন্ড গরমের সময় আমরা গিয়ে সেনাদলের সঙ্গে মিলিত হ’লাম। সে সময় তাঁরা একটি জায়গায় অবতরণ করছিলেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এরপর যাদের ধ্বংস হওয়ার ছিল, তারা (আমার উপর অপবাদ দিয়ে) ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের মধ্যে এ অপবাদ দেয়ার ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল সে হচ্ছে আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনে সুলূল।

উরওয়াহ (রাঃ) বলেন, আমি জানতে পেরেছি যে, তার (আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনে সুলূল) সামনে অপবাদের কথাগুলো প্রচার করা হ’ত এবং আলোচনা করা হ’ত, আর অমনি সে এগুলোকে বিশ্বাস করত। সে খুব ভাল করে শুনত আর শোনা কথার ভিত্তিতেই ব্যাপারটিকে প্রমাণ করার চেষ্টা করত। উরওয়াহ (রাঃ) আরো বর্ণনা করেছেন যে, অপবাদ আরোপকারী ব্যক্তিদের মধ্যে হাসসান বিন ছাবিত, মিসতাহ ইবনু উছাছা এবং হামনা বিনতু জাহশ (রাঃ) ব্যতীত আর কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। তারা কয়েকজন লোকের একটি দল ছিল। এটুকু ব্যতীত তাদের ব্যাপারে আমার আর কিছু জানা নেই। যেমনটি (আল-কুরআনে) মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন। এ ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তাকে আবদুল্লাহ ইবনু উবাই বিন সুলূল বলে ডাকা হয়ে থাকে। উরওয়াহ (রাঃ) বলেন, আয়েশা (রাঃ) এ ব্যাপারে হাসসান বিন ছাবিত (রাঃ)-কে গালমন্দ করাকে পসন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, হাসসান বিন ছাবিত (রাঃ) তো সেই লোক, যিনি তার এক কবিতায় বলেছেন,

فَإِنَّ أَبِىْ وَوَالِدَهُ وعِرْضِىْ   لِعِرْضِ مُحَمَّدٍ مِنْكُمْ وِقَاءُ

আমার মান-সম্মান এবং আমার বাপ-দাদা

মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মান-সম্মান রক্ষায় নিবেদিত।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, অতঃপর আমরা মদীনায় আসলাম। মদীনায় এসে এক মাস পর্যন্ত আমি অসুস্থ থাকলাম। এদিকে অপবাদ রটনাকারীদের কথা নিয়ে লোকেদের মধ্যে আলোচনা ও চর্চা হ’তে থাকল। কিন্তু এগুলোর কিছুই আমি জানি না। তবে আমি সন্দেহ করছিলাম এবং তা আরো দৃঢ় হচ্ছিল আমার এ অসুখের সময়। কেননা এর আগে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে যে রকম স্নেহ-ভালবাসা পেতাম, আমার এ অসুখের সময় তা আমি পাচ্ছিলাম না। তিনি আমার কাছে এসে সালাম করে কেবল ‘তুমি কেমন আছ’ জিজ্ঞেস করে চলে যেতেন। তাঁর এ আচরণই আমার মনে ভীষণ সন্দেহ জাগিয়ে তোলে। তবে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাইরে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত এ জঘন্য অপবাদের ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। উম্মু মিসতাহ (রাঃ) (মিসতাহর মা) একদা আমার সঙ্গে পায়খানার দিকে বের হন। আর প্রকৃতির ডাকে আমাদের বের হওয়ার অবস্থা এই ছিল যে, এক রাতে বের হ’লে আমরা আবার পরের রাতে বের হ’তাম। এটা ছিল আমাদের ঘরের পার্শ্বে পায়খানা তৈরি করার আগের ঘটনা। আমাদের অবস্থা প্রাচীন আরবের লোকদের মতো ছিল। তাদের মতো আমরাও প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার জন্য ঝোপঝাড়ে চলে যেতাম। এমনকি (অভ্যাস না থাকায়) বাড়ির পার্শ্বে পায়খানা তৈরি করলে আমরা খুব কষ্ট পেতাম। আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা আমি এবং উম্মু মিসতাহ (যিনি ছিলেন আবু রূহম ইবনে মুত্তালিব ইবনে আবদে মুনাফের কন্যা, যার মা সাখার ইবনু আমির-এর কন্যা ও আবূবকর ছিদ্দীকের খালা এবং  মিসতাহ ইবনু উছাছা ইবনু আববাদ ইবনে মুত্তালিব যার পুত্র) একত্রে বের হ’লাম। আমরা আমাদের প্রয়োজন সেরে বাড়ি ফেরার পথে উম্মু মিসতাহ তার কাপড়ে জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বললেন, মিসতাহ ধ্বংস হোক। আমি তাকে বললাম, আপনি খুব খারাপ কথা বললেন। আপনি কি বদর যুদ্ধে যোগদানকারী ব্যক্তিকে গালি দিচ্ছেন? তিনি আমাকে বললেন, ওগো অবলা! সে তোমার সম্বন্ধে কি কথা বলে বেড়াচ্ছে তুমি তো তা শোননি? আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, সে আমার সম্পর্কে কি বলছে? তখন তিনি অপবাদ রটনাকারীদের কথাবার্তা সম্পর্কে আমাকে জানালেন। আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, এরপর আমার পুরানো রোগ আরো বেড়ে গেল। আমি বাড়ি ফেরার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার কাছে আসলেন এবং সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেমন আছ? আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি আমার পিতা-মাতার কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক খবর জানতে চাচ্ছিলাম, তাই আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললাম, আপনি কি আমাকে আমার পিতা-মাতার কাছে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিবেন? আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে অনুমতি দিলেন। তখন আমি আমার আম্মাকে বললাম, আম্মাজান, লোকজন কি আলোচনা করছে? তিনি বললেন, বেটী এ ব্যাপারটিকে হালকা করে ফেল। আল্লাহর কসম! সতীন আছে এমন স্বামীর সোহাগ লাভে ধন্যা সুন্দরী রমণীকে তাঁর সতীনরা বদনাম করবে না, এমন খুব কমই হয়। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, সুবহানাল্লাহ। লোকজন কি এমন গুজবই রটিয়েছে? আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, সারারাত আমি কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে সকাল হয়ে গেল। এর মধ্যে আমার চোখের পানিও বন্ধ হ’ল না এবং আমি ঘুমাতেও পারলাম না। এরপর ভোরবেলাও আমি কাঁদছিলাম। তিনি আরো বলেন যে, এ সময় অহী নাযিল হ’তে দেরি হওয়ায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর স্ত্রীর (আমার) বিচ্ছেদের বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ ও আলোচনা করার নিমিত্তে আলী ইবনু আবু ত্বালিব এবং উসামাহ ইবনু যায়েদ (রাঃ)-কে ডেকে পাঠালেন।

তিনি [আয়েশা (রাঃ)] বলেন, উসামাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের পবিত্রতা এবং তাদের প্রতি (নবী করীম (ছাঃ)-এর) ভালবাসার কারণে বললেন, তাঁরা আপনার স্ত্রী, তাঁদের সম্পর্কে আমি ভাল ব্যতীত আর কিছুই জানি না। আলী (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আল্লাহ তো আপনার জন্য সংকীর্ণতা রাখেননি। তিনি ব্যতীত আরো বহু মহিলা আছে। অবশ্য আপনি এ ব্যাপারে দাসী [বারীরাহ (রাঃ)]-কে জিজ্ঞেস করুন। সে আপনার কাছে সত্য কথাই বলবে। আয়েশা (রাঃ) বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বারীরাহ (রাঃ)-কে ডেকে বললেন, হে বারীরাহ! তুমি তাঁর মধ্যে কোন সন্দেহপূর্ণ আচরণ দেখেছ কি? বারীরাহ (রাঃ) বললেন, ঐ আল্লাহর শপথ! যিনি আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন, আমি তাঁর মধ্যে কখনো এমন কিছু দেখিনি, যার দ্বারা তাঁকে দোষী বলা যায়। তবে তাঁর সম্পর্কে কেবল এটুকু বলা যায় যে, তিনি হ’লেন অল্প বয়স্কা কিশোরী। রুটি তৈরী করার জন্য আটা খামির করে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন আর বকরী এসে অমনি তা খেয়ে ফেলে।

তিনি [আয়েশা (রাঃ)] বলেন, সেদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে মিম্বরে বসে আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই-এর ক্ষতি থেকে রক্ষার আহবান জানিয়ে বললেন, হে মুসলিম সম্প্রদায়! যে আমার স্ত্রীর ব্যাপারে অপবাদ রটিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছে তার এ অপবাদ থেকে আমাকে কে মুক্ত করবে? আল্লাহর কসম! আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে ভাল ব্যতীত আর কিছুই জানি না। আর তারা এক ব্যক্তির (ছাফওয়ান ইবনু মু‘আত্তাল) নাম উল্লেখ করছে, যার ব্যাপারেও আমি ভাল ব্যতীত কিছু জানি না। সে তো আমার সঙ্গেই আমার ঘরে যায়।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, বানু আব্দুল আশহাল গোত্রের সা‘দ (ইবনু মু‘আয) (রাঃ) উঠে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে এ অপবাদ থেকে মুক্তি দেব। সে যদি আউস গোত্রের লোক হয়, তাহ’লে তার শিরশ্ছেদ করব। আর যদি সে আমাদের ভাই খাযরাজের লোক হয়, তাহ’লে তার ব্যাপারে আপনি যা বলবেন তাই করব। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এ সময় হাস্সান বিন ছাবিত (রাঃ)-এর মায়ের চাচাতো ভাই খাযরাজ গোত্রের নেতা সা‘দ ইবনু উবাদা (রাঃ) দাঁড়িয়ে এ কথার প্রতিবাদ করলেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এ ঘটনার আগে তিনি একজন সৎ ও নেক্কার লোক ছিলেন। গোত্রীয় অহঙ্কারে উত্তেজিত হয়ে তিনি সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ)-কে বললেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। আল্লাহর কসম! তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না এবং তাকে হত্যা করার ক্ষমতাও তোমার নেই। সে তোমার গোত্রের লোক হ’লে তুমি তার নিহত হওয়া কখনো পসন্দ করতে না। তখন সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ)-এর চাচাতো ভাই উসাইদ ইবনু হুযাইর (রাঃ) সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাঃ)-কে বললেন, বরং তুমিই মিথ্যা বলছ। আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। তুমি হ’লে মুনাফিক। তাই মুনাফিকদের পক্ষ নিয়ে কথাবার্তা বলছ।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, এ সময় আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্র খুব উত্তেজিত হয়ে যায়। এমনকি তারা যুদ্ধের সংকল্প করে বসে। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের শান্ত করলেন এবং নিজেও চুপ হয়ে গেলেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি সেদিন সারাক্ষণ কেঁদে কাটালাম। চোখের ধারা আমার বন্ধ হয়নি এবং একটু ঘুমও হয়নি। তিনি (আয়েশা) বলেন, আমি কান্না করছিলাম আর আমার পিতা-মাতা আমার পার্শ্বে উপবিষ্ট ছিলেন। এমনি করে একদিন দুই রাত কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দিলাম। এর মধ্যে আমার একটুও ঘুম হয়নি। বরং অনবরত আমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। মনে হচ্ছিল যেন, কান্নার কারণে আমার কলিজা ফেটে যাবে। আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার আববা-আম্মা আমার পার্শ্বে উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময় একজন আনছারী মহিলা আমার কাছে আসার অনুমতি চাইলে আমি তাকে আসার অনুমতি দিলাম। সে এসে বসল এবং আমার সঙ্গে কাঁদতে আরম্ভ করল। তিনি বলেন, আমরা কান্না করছিলাম এই মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের কাছে এসে সালাম করলেন এবং আমাদের পাশে বসে গেলেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, অপবাদ রটানোর পর আমার পার্শ্বে এসে এভাবে তিনি আর বসেননি। এদিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একমাস অপেক্ষা করার পরও আমার ব্যাপারে তাঁর নিকট কোন অহী আসেনি। আয়েশা (রাঃ) বলেন, বসার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কালিমা শাহাদত পড়লেন। এরপর বললেন, আয়েশা! তোমার ব্যাপারে আমার কাছে অনেক কথাই পৌঁছেছে, যদি তুমি এর থেকে পবিত্র হও, তাহ’লে শীঘ্রই আল্লাহ তোমাকে এ অপবাদ থেকে মুক্ত করবেন। আর যদি তুমি কোন গুনাহ করে থাক, তাহ’লে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তওবা কর। কেননা বান্দা গুনাহ স্বীকার করে তওবা করলে আল্লাহ তা‘আলা তওবা কবুল করেন।

তিনি [আয়েশা (রাঃ)] বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর কথা শেষ করলে আমার অশ্রুধারা বন্ধ হয়ে যায়। এক ফোঁটা অশ্রুও আমি আর বের করতে পারলাম না। তখন আমি আমার আববাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যা বলছেন, আমার হয়ে তার জবাব দিন। আমার আববা বললেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কি জবাব দিব, তা জানি না। তখন আমি আমার আম্মাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যা বলছেন, আপনি তার উত্তর দিন। আম্মা বললেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কি উত্তর দিব, তা জানি না। সে সময় আমি ছিলাম অল্প বয়স্কা কিশোরী। কুরআনও বেশী পড়তে পারতাম না। তথাপি এ অবস্থায় আমি নিজেই বললাম, আমি জানি আপনারা এ অপবাদের ঘটনা শুনেছেন, আপনারা তা বিশ্বাস করেছেন এবং বিষয়টি আপনাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে। এখন যদি আমি বলি যে, এর থেকে আমি পবিত্র তাহ’লে আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি এ অপরাধের কথা স্বীকার করে নেই, যে সম্পর্কে আল্লাহ জানেন যে, আমি এর থেকে পবিত্র, তাহ’লে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন। আল্লাহর কসম! আমি ও আপনারা যে বিপাকে পড়েছি এর জন্য ইউসুফ (আঃ)-এর পিতার কথা ব্যতীত আমি কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি বলেছিলেন, ‘পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়। তোমরা যা বলছ, এ ব্যাপারে আল্লাহই একমাত্র আমার আশ্রয়স্থল’ (...)। অতঃপর আমি মুখ ঘুরিয়ে আমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আল্লাহ তা‘আলা জানেন যে, সে মুহূর্তেও আমি পবিত্র। অবশ্যই আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন। তবে আল্লাহর কসম! আমি কখনও ভাবিনি যে, আমার সম্পর্কে আল্লাহ অহী অবতীর্ণ করবেন, যা পাঠ করা হবে। আমার সম্পর্কে আল্লাহ কোন কথা বলবেন, আমি নিজেকে এতটা উত্তম মনে করিনি বরং আমি নিজেকে এর চেয়ে অনেক অধম ভাবতাম। তবে আমি আশা করতাম যে, হয়তো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে স্বপ্নযোগে দেখানো হবে, যার ফলে আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করবেন। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখনো তাঁর বসার জায়গা ছেড়ে যাননি এবং ঘরের লোকজনও কেউ ঘর হ’তে বেরিয়ে যায়নি। এমন সময় তাঁর উপর অহী অবতরণ শুরু হ’ল। অহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় তাঁর যে বিশেষ ধরনের কষ্ট হ’ত তখনও সে অবস্থা হ’ল। এমনকি ভীষণ শীতের দিনেও তাঁর শরীর হ’তে মোতির দানার মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ল ঐ বাণীর গুরুভারে, যা তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এ অবস্থা কেটে গেলে তিনি হাসিমুখে প্রথম যে কথা উচ্চারণ করলেন সেটা হ’ল, হে আয়েশা! আল্লাহ তোমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দিয়েছেন।

তিনি [আয়েশা (রাঃ)] বলেন, এ কথা শুনে আমার মা আমাকে বললেন, তুমি উঠে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি সম্মান কর। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি তাঁর দিকে উঠে যাব না। মহান আল্লাহ ব্যতীত কারো প্রশংসা করব না। আয়েশা (রাঃ) বললেন, আল্লাহ (আমার পবিত্রতার ব্যাপারে) যে দশটি আয়াত অবতীর্ণ করেছেন, তা হ’ল, ‘যারা এ অপবাদ রটনা করেছে তারা তো তোমাদেরই একটি দল; এ ঘটনাকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে কঠিন শাস্তি। এ কথা শোনার পর মুমিন পুরুষ এবং নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করেনি এবং বলেনি যে, এটা তো সুস্পষ্ট অপবাদ? তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সেহেতু তারা আল্লাহর বিধানে মিথ্যাচারী। দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে, তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে তার জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করত। যখন তোমরা মুখে মুখে এ মিথ্যা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিল না এবং একে তোমরা তুচ্ছ ব্যাপার বলে ভাবছিলে। অথচ আল্লাহর কাছে তা ছিল খুবই গুরুতর ব্যাপার। আর এ কথা শোনামাত্র তোমরা কেন বললে না যে, এ বিষয়ে বলাবলি করা আমাদের জন্য উচিত নয়? আল্লাহ পবিত্র মহান! এ তো এক গুরুতর অপবাদ। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক তাহ’লে কখনো অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করবে না; আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখেরাতে মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউই অব্যাহতি পেতে না। আল্লাহ দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু’ (নূর ২৪/১১-২০)

আমার পবিত্রতার ব্যাপারে আল্লাহ এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ করলেন। আত্মীয়তা এবং দারিদ্রের কারণে আবূবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) মিসতাহ ইবনু উছাছাকে আর্থিক ও বৈষয়িক সাহায্য করতেন। কিন্তু আয়েশা (রাঃ) সম্পর্কে তিনি যে অপবাদ রটিয়েছিলেন, এ কারণে আবূবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) কসম করে বললেন, আমি আর কখনো মিসতাহকে আর্থিক সাহায্য করব না। তখন আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ গ্রহণ না করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন ও অভাবগ্রস্তকে এবং আল্লাহর রাস্তায় যারা গৃহত্যাগ করেছে তাদেরকে কিছুই দিবে না। তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। শোন! তোমরা কি পসন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল; পরম দয়ালু’ (নূর ২৪/২২)। আবূবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) বলে উঠলেন, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম! অবশ্যই আমি পসন্দ করি যে, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিন। এরপর তিনি মিসতাহ (রাঃ)-এর জন্য যে অর্থ খরচ করতেন, তা পুনরায় দিতে শুরু করলেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম! আমি তাঁকে এ অর্থ দেয়া আর কখনো বন্ধ করব না।

আয়েশা (রাঃ) বললেন, আমার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যায়নাব বিনত জাহশ (রাঃ)-কেও জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি যায়নাব (রাঃ)-কে বলেছিলেন, তুমি আয়েশা (রাঃ) সম্পর্কে কি জান অথবা বলেছিলেন তুমি কি দেখেছ? তখন তিনি বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার চোখ ও কানকে হিফাযত করেছি। আল্লাহর কসম! আমি তাঁর ব্যাপারে ভাল ব্যতীত আর কিছুই জানি না। আয়েশা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণের মধ্যে তিনি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আল্লাহ তাঁর তাক্বওয়ার কারণে তাঁকে রক্ষা করেছেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, অথচ তাঁর বোন হামনা (রাঃ) অপবাদ রটনাকারীদের মতো অপবাদ ছড়াচ্ছিল। ফলে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্তদের সঙ্গে ধ্বংস হয়ে গেলেন (বুখারী হা/৪১৪১)

পরিশেষে বলব, যে কোন সংবাদ যাচাই-বাছাই করে বিশ্বাস করা আল্লাহর নির্দেশ (হুজুরাত ৬)। খবর পেয়ে তার সত্যতা যাচাই না করে তার উপর আমল করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। এতে করে পরবর্তীতে লজ্জিত ও অপদস্ত হ’তে হয়। এজন্য এসব থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। আয়েশা (রাঃ)-এর ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল। মুনাফিকদের অনুমান নির্ভর ঘটনায় রঙ মাখিয়ে আয়েশা (রাঃ)-এর উপর অপবাদ আরোপ করা হয়েছিল। যার পরিণতিতে রাসূল (ছাঃ), তাঁর পত্নী আয়েশা (রাঃ) ও মুমিনগণ মাসাধিক কাল সীমাহীন কষ্ট ভোগ করেন। তাই ধারণা করে কোন কিছু বলা থেকে আমাদেরকে বিরত থাকতে হবে (হুজুরাত ১২)। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!

জাদীদা, গোবিন্দা, পাবনা।






মৃত্যুর ভয় - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আল্লাহর রহমত ব্যতীত কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না - উম্মে হাবীবা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বিদ‘আত প্রতিরোধে ছাহাবীগণের ভূমিকা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
যে পানি পান করায় সে পরেই পান করে - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
প্রতিবেশীর অসদাচরণের প্রতিকার - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
দ্বীনের আসমানী প্রশিক্ষণ - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
সালমান ফারেসী (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
জুম‘আর দিনে দো‘আ কবুলের সময় - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
জাবের ইবনু আব্দিল্লাহ (রাঃ)-এর উটের ঘটনা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
মুসলিম ও মুশরিকদের একত্রিত মজলিসে সালাম দেয়ার পদ্ধতি - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
ইমামকে সতর্ক করতে মুক্তাদীর করণীয় - .
হিংসা-বিদ্বেষ না করার ফল জান্নাত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আরও
আরও
.