পৃথিবীতে মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বিভিন্ন প্রয়োজনে তাকে অন্যের মুখাপেক্ষী হ’তে হয়। কেউ কারো দ্বারা উপকৃত হ’লে উত্তমভাবে উপকারীর প্রতিদান প্রদান করা উচিত। এ শিক্ষাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের দিয়ে গেছেন। এ সম্পর্কেই নিম্নোক্ত হাদীছ।-

ইমরান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে এক সফরে ছিলাম। আমরা রাতে চলতে চলতে শেষ রাতে এক স্থানে ঘুমিয়ে পড়লাম। মুসাফিরের জন্য এর চেয়ে মধুর ঘুম আর হ’তে পারে না। (আমরা এমন গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন ছিলাম যে,) সূর্যের উত্তাপ ছাড়া অন্য কিছু আমাদের জাগাতে পারল না। সর্বপ্রথম জাগলেন অমুক, তারপর অমুক, তারপর অমুক। (রাবী) আবু রাজা‘ (রহঃ) তাঁদের সবার নাম নিয়েছিলেন। কিন্তু আওফ (রহঃ) তাঁদের নাম মনে রাখতে পারেননি। চতুর্থবারে জাগ্রত হওয়া ব্যক্তি ছিলেন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)।

নবী করীম (ছাঃ) ঘুমালে আমরা তাঁকে কেউ জাগাতাম না, যতক্ষণ না তিনি নিজেই জেগে উঠতেন। কারণ নিদ্রাবস্থায় তাঁর উপর কী অবতীর্ণ হচ্ছে তা আমাদের অজানা। ওমর (রাঃ) জেগে মানুষের অবস্থা দেখলেন। তিনি ছিলেন দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তি। তিনি উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর বলতে আরম্ভ করলেন এবং ক্রমাগত উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর বলতে থাকলেন। এমনকি তাঁর শব্দে নবী করীম (ছাঃ) জেগে উঠলেন। তখন লোকেরা তাঁর নিকট ওযর পেশ করল। তিনি বললেন, কোন ক্ষতি নেই বা  তিনি বললেন, কোন ক্ষতি হবে না। এখান হ’তে চল। তিনি চলতে লাগলেন। অনতিদূরে গিয়ে তিনি অবতরণ করলেন। অতঃপর ওযূর পানি আনালেন এবং ওযূ করলেন। ছালাতের আযান দেয়া হ’ল। তিনি লোকদের নিয়ে ছালাত আদায় করলেন। ছালাত শেষে তিনি দেখলেন, এক ব্যক্তি লোকদের  সাথে ছালাত আদায় না করে আলাদা দাঁড়িয়ে আছে। নবী করীম (ছাঃ) তাকে বললেন, হে অমুক! তোমাকে লোকদের সাথে ছালাত আদায় করতে কিসে বিরত রাখল? তিনি বললেন, আমার উপর গোসল ফরয হয়েছে। কিন্তু পানি নেই। তিনি বললেন, পবিত্র মাটি নেও (তায়াম্মুম কর), এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট। অতঃপর নবী করীম (ছাঃ) পুনরায় সফর শুরু করলেন। লোকেরা তাঁকে পিপাসার কষ্টের কথা জানাল। তিনি সেখানে অবতরণ করলেন। তারপর অমুক ব্যক্তিকে ডাকলেন। (রাবী) আবু রাজা‘ (রহঃ) তার নাম উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু আওফ (রহঃ) তা ভুলে গেছেন। তিনি আলী (রাঃ)-কেও ডাকলেন। তারপর তাদের উভয়কে বললেন, তোমরা খুঁজে পানি নিয়ে এসো।

তাঁরা পানির খোঁজে বের হ’লেন। তাঁরা পথে এক মহিলাকে  চামড়ার দুই মশক ভর্তি পানি উটের পিঠে করে নিয়ে যেতে দেখলেন। তাঁরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, পানি কোথায়? সে বলল, গতকাল এ সময়ে আমি পানির নিকটে ছিলাম। আমার গোত্রের লোকেরা পিছনে রয়ে গেছে। তাঁরা বললেন, এখন আমাদের সঙ্গে চল। সে বলল, কোথায়? তারা বললেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট। সে বলল, সেই লোকটির নিকট, যাকে ছাবী (ধর্মত্যাগী) বলা হয়? তাঁরা বললেন, হ্যাঁ, তোমরা যাকে এটা বলে থাক। আচ্ছা, এখন চল। তাঁরা তাকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসলেন এবং সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। ইমরান (রাঃ) বললেন, লোকেরা মহিলাকে তার উট হ’তে নামালেন। তারপর নবী করীম (ছাঃ) একটি পাত্র আনতে বললেন এবং উভয় মশকের মুখ খুলে তাতে পানি ঢাললেন এবং সেগুলোর মুখ বন্ধ করে দিলেন। তারপর সে মশকের নীচের মুখ খুলে দিলেন। লোকদের মধ্যে পানি পান করার ও জন্তু-জানোয়ারকে পানি পান করানোর ঘোষণা দেওয়া হ’ল। তাঁদের মধ্যে যার ইচ্ছা পানি পান করলেন ও স্বীয় জন্তুকে পান করালেন। অবশেষে যে ব্যক্তির গোসল দরকার ছিল, তাকেও এক পাত্র পানি দিয়ে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, এ পানি নিয়ে যাও এবং গোসল সম্পন্ন কর। ঐ মহিলা দাঁড়িয়ে দেখছিল যে, তার পানি নিয়ে কী করা হচ্ছে। আল্লাহর কসম! যখন তার থেকে পানি নেয়া শেষ হ’ল তখন আমাদের মনে হ’ল, মশকগুলো পুর্বাপেক্ষা অধিক ভর্তি। তারপর নবী করীম (ছাঃ) বললেন, মহিলার জন্য কিছু জমা কর। লোকেরা মহিলার জন্য আজওয়া (উন্নতমানের খেজুর), আটা ও ছাতু এনে জমা করলেন। যখন তাঁরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী জমা হ’লে একটা কাপড়ে বেঁধে মহিলাকে উটের উপর সওয়ার করালেন এবং ছাহাবীগণ তার সামনে কাপড়ে বাঁধা গাঁঠরিটি রেখে দিলেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি জান যে, আমরা তোমার পানি হ’তে কিছুই কম করিনি; বরং আল্লাহ তা‘আলাই আমাদের পানি পান করিয়েছেন।

অতঃপর সে তার পরিবারের নিকট ফিরে গেল। তার বেশ দেরী হয়েছিল। পরিবারের লোকজন তাকে জিজ্ঞেস করল, হে অমুক! তোমাকে কিসে আটকে রেখেছিল? সে বলল, একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা! দু’জন লোকের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তারা আমাকে সেই লোকটির কাছে নিয়ে গিয়েছিল, যাকে ছাবী (ধর্মত্যাগী) বলা হয়। সে এই এই ঘটনা ঘটাল। আল্লাহর কসম! সে এর ও এর মধ্যে লোকদের মধ্যে বড় যাদুকর। তিনি আল্লাহর সত্যিকার রাসূল (ছাঃ) বৈকি? এ ঘটনার পর মুসলিমরা ঐ মহিলার গোত্রের আশপাশের মুশরিকদের উপর হামলা করতেন। কিন্তু মহিলার সাথে সম্পর্কযুক্ত গোত্রের কোন ক্ষতি করতেন না। একদা মহিলা নিজের গোত্রকে বলল, আমার মনে হয়, তারা ইচ্ছা করে আমাদের নিষ্কৃতি দিচ্ছে। এসব দেখে কি তোমরা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে না? তারা সবাই মহিলাটির কথা মেনে নিল এবং ইসলামে দাখিল হয়ে গেল’ (বুখারী হা/৩৪৪; দারেমী হা/৭৪৩; মু‘জামুল কাবীর হা/২৭৬)

পরিশেষে বলা যায়, কারো উত্তম আচরণ ও উপকারের বিনিময়ে তার সাথে উত্তম ব্যবহার করা এবং সাধ্যমত উপকারীর প্রতিদান দেওয়া উচিত। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন-আমীন!

-আব্দুর রহীম, নিয়ামতপুর, নওগাঁ।






হিংসা-বিদ্বেষ না করার ফল জান্নাত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
সন্তানের প্রতি নূহ (আঃ)-এর অন্তিম উপদেশ - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
রূহ কবয ও মৃত্যুকাল মুসলিম ও কাফিরের অবস্থা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
সৎ লোকের দো‘আ - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
হানযালা (রাঃ)-এর আল্লাহভীতি - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
সৌন্দর্যই মর্যাদার মাপকাঠি নয় - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
কবর আযাবের কতিপয় কারণ - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
রাসূল (ছাঃ)-এর দাওয়াতী কৌশল - আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ
মৃত্যুর ভয় - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
জুম‘আর দিনে দো‘আ কবুলের সময় - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
সর্বাবস্থায় পূণ্যবান স্বামীর অনুগত হওয়াই পূণ্যবতী স্ত্রীর বৈশিষ্ট্য - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের জীবন-যাপন - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
আরও
আরও
.