উপস্থাপনা :
বিশিষ্ট ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম ইসলামকে সঠিক দ্বীন হিসাবে জানার পর
ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং নিজেকে মুসলিম হিসাবে তাঁর
জাতির কাছে পেশ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীছ-
আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবং তাঁর সাথীরা অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে যখন মদীনায় এসে পৌঁছলেন, তখন মদীনায় প্রচার হ’ল আল্লাহর নবী এসেছেন। লোকেরা উঁচু জায়গায় উঠে দেখতে লাগল আর উচ্চৈঃস্বরে বলতে লাগল, আল্লাহর নবী এসেছেন। নবী করীম (ছাঃ) বরাবর সামনের দিকে এগুতে লাগলেন। অবশেষে আবু আইয়ুব আনছারীর বাড়ীর নিকটে এসে অবতরণ করলেন। আবু আইয়ুব আনছারী তখন তার পরিবারের লোকদের সাথে কথা বলছিলেন। এ সময়ে আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম নবী করীম (ছাঃ)-এর আগমনের খবর শুনতে পেলেন।
তিনি এসময়ে তার বাগানে খেজুর পাড়ছিলেন। খবর শুনেই তিনি পাড়া খেজুরগুলো তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে নিয়ে তা সাথে করেই নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে চলে আসলেন এবং নবী (ছাঃ)-এর মুখনিঃসৃত কিছু কথাবার্তা শুনে আবার ঘরে ফিরে গেলেন। নবী করীম (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের লোকদের মধ্য কার বাড়ী এখান থেকে অধিকতর নিকটে। আবু আইয়ুব আনছারী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি অধিক নিকটে। এই যে আমার বাড়ি আর এটা আমার বাড়ির দরজা। তিনি বললেন, যাও, আমাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা কর। আবু আইয়ুব আনছারী বললেন, আল্লাহ বরকত দান করুন আপনারা চলুন। তারপর নবী করীম (ছাঃ) যখন আবু আইয়ুবের ঘরে পৌঁছলেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম আবার আসলেন এবং বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল! আপনি সত্য দিন নিয়ে এসেছেন। ইহুদী সম্প্রদায় খুব ভালভাবেই জানে যে, আমি তাদের নেতা এবং তাদের নেতার ছেলে। আমি তাদের মধ্যে বড় আলেম এবং বড় আলেমের ছেলে। আপনি তাদেরকে ডাকুন এবং আমার ইসলাম গ্রহণের খবরটা তারা জানার পূর্বেই আমার সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞেস করুন। কেননা তারা যদি জানতে পারে যে, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি তাহ’লে তারা আমার ব্যাপারে এমন সব কথা বলবে যা আমার মধ্যে নেই। তখন নবী (ছাঃ) তাদেরকে ডেকে পাঠান। তারা এসে নবী করীম (ছাঃ)-এর খেদমতে হাযির হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বললেন, হে ইহুদী সম্প্রদায়! তোমরা ধ্বংসের মুখোমুখি। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর। সেই সত্তার কসম! যিনি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, তোমরা নিশ্চয়ই জান যে, আমি আল্লাহর রাসূল এবং হক দিন নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছি। সুতরাং তোমরা মুসলিম হয়ে যাও। তারা বলল, আমরা এটা জানি না। একথা নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে তারা তিনবার বলল। নবী (ছাঃ) বললেন, আচ্ছা বলতো, আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম তোমাদের মাঝে কেমন লোক? তারা বলল, তিনি তো আমাদের নেতার ছেলে এবং আমাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ আলেম ও শ্রেষ্ঠ আলেমের ছেলে। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আচ্ছা বলতো যদি সে ইসলাম গ্রহণ করে তবে কেমন হবে? তারা বলল, আল্লাহ না করুন, তিনি কিছুতেই ইসলাম গ্রহণ করতে পারেন না। তিনি আবার বললেন, সে যদি ইসলাম গ্রহণ করে? তারা বলল, আল্লাহ না করুন। তিনি কখনো ইসলাম গ্রহণ করতে পারেন না। তিনি পুনরায় বললেন, আচ্ছা বলতো, সে যদি ইসলাম গ্রহণ করে? তারা বলল, আল্লাহ না করুন তিনি কখনো ইসলাম গ্রহণ করতে পারেন না। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, হে ইবনু সালাম! একটু এদের সামনে এসো। তিনি বেরিয়ে এলেন এবং ইহুদীদেরকে বললেন, হে ইহুদী সম্প্রদায়! আল্লাহকে ভয় কর। সেই সত্তার কসম! যিনি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, তোমরা নিশ্চয়ই জান যে, ইনি আল্লাহর রাসূল এবং তিনি সত্য দিন নিয়ে এসেছেন। একথা শুনে তারা বলে উঠল, তুমি মিথ্যাবাদী। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে সেখান থেকে বের করে দিলেন (ছহীহ বুখারী, হা/৩৬২১)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মদীনা আগমনের খবর আব্দুল্লাহ ইবনে সালামের নিকট পৌঁছলে তিনি এসে নবী করীম (ছাঃ)-কে কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, আমি আপনাকে এমন তিনটি বিষয়ে প্রশ্ন করব যা নবী ছাড়া আর কেউ জানে না- (এক) ক্বিয়ামতের সর্বপ্রথম আলামত কি? (দুই) জান্নাতবাসীগণ সর্বপ্রথম কোন খাদ্য খাবে? (তিন) কিসের কারণে সন্তান (আকৃতিতে কখনো) তার পিতার অনুরূপ হয়, আবার কখনো মায়ের মত হয়? নবী করীম (ছাঃ) বললেন, এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জিবরাঈল এইমাত্র আমাকে বলে গেলেন। আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম বলেন, ফেরেশতাদের মধ্যে তিনিই তো ইহুদীদের শত্রু। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ক্বিয়ামতের সর্বপ্রথম আলামত হ’ল আগুন, যা মানুষকে পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে নিয়ে সমবেত করবে। আর জান্নাতবাসীগণ সর্বপ্রথম যে খাদ্য খাবে তা হ’ল মাছের কলিজার অতিরিক্ত টুকরো, যা কলিজার সাথে লেগে থাকে। আর সন্তানের ব্যাপারটা হ’ল এই- নারী-পুরুষের মিলন কালে যদি নারীর আগে পুরুষের বীর্যপাত ঘটে তবে সন্তান বাপের অনুরূপ হয়, আর যদি পুরুষের আগে নারীর বীর্যপাত ঘটে তবে সন্তান মায়ের আকৃতি ধারণ করে। তখন আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই এবং নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন, হে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)! ইহুদীরা এমন একটি জাতি যারা অপবাদ রটনায় অত্যন্ত পটু। কাজেই আমার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে তারা জ্ঞাত হবার আগে আপনি আমার ব্যাপারে তাদের নিকট জিজ্ঞেস করুন। তারপর ইহুদীরা এলে নবী করীম (ছাঃ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম কেমন লোক? তারা বলল, তিনি আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি এবং সর্বোত্তম ব্যক্তির ছেলে। তিনি আমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তির ছেলে। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আচ্ছা আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম যদি ইসলাম গ্রহণ করে, তবে কেমন ব্যক্তি হবে? তারা বলল, আল্লাহ তাকে এ থেকে রক্ষা করুন। তিনি পুনরায় একথা বললেন। তারাও সেই একই জবাব দিল। এমন সময় আব্দুল্লাহ ভেতর থেকে তাদের সামনে বেরিয়ে এলেন এবং বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা‘বূদ নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। তখন তারা বলতে লাগল, এ লোকটা আমাদের মধ্য সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তি এবং সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তির ছেলে। তারপর তারা তাকে খুব হেয় প্রতিপন্ন করল। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের ব্যাপারে আমি এটাই আশংকা করছিলাম (ছহীহ বুখারী হা/৩৩২৯)।
আব্দুল্লাহ ইবনু সালামের মর্যাদা : সা‘দ ইবনু আবি ওয়াককাছ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম ছাড়া ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল (অর্থাৎ জীবিত) কোন লোকের উদ্দ্যেশ্যে আমি নবী (ছাঃ)-কে এ কথা বলতে শুনিনি, নিশ্চয়ই সে জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত। রাবী বলেন, তার সম্পর্কে (সূরা আহকাফের) এ আয়াতটি নাযিল হয়, وَشَهِدَ شَاهِدٌ مِّن بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى مِثْلِهِ (احقاف ১০) কুরআন আল্লাহর নিকট থেকে আগত এ বিষয়ে বনী ইসরাঈলদের মধ্যে থেকেও একজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছে (ছহীহ বুখারী হা/৩৫২৮)।
ইলিয়াস বিন আলী আশরাফ
জগতপুর, বুড়িচং, কুমিল্লা।