ছাহাবায়ে
কেরাম সুন্নাত প্রতিপালনে এবং বিদ‘আত প্রতিরোধে ছিলেন আপোষহীন। তাঁরা
বিদ‘আতকে কখনও প্রশ্রয় দিতেন না। এমনই একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত
হাদীছে।-
আমর ইবনু ইয়াহ্ইয়া হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার পিতাকে তার পিতা হ’তে হাদীছ বর্ণনা করতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমরা প্রতিদিন ফজর ছালাতের পূর্বে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর বাড়ির দরজার নিকট গিয়ে বসে থাকতাম। তিনি যখন বের হ’তেন তখন আমরা তাঁর সাথে মসজিদে যেতাম। আমাদের বসে থাকা অবস্থায় একদিন আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) আমাদের নিকট এসে বললেন, আবু আব্দুর রহমান (ইবনু মাসঊদ) কি তোমাদের নিকটে বের হয়েছিলেন? আমরা বললাম, না এখনো বের হননি। ইবনু মাসঊদ বের না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাদের সাথে বসে থাকলেন। তিনি বের হ’লে আমরা সবাই তার নিকটে গেলাম। আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) তাকে বললেন, হে আবু আব্দুর রহমান! আমি এখনই মসজিদে এমন কিছু দেখলাম যা আমার নিকট অপছন্দনীয় মনে হ’ল। তবে আলহামদুলিল্লাহ, সেটি (বাহ্যিক দৃষ্টিতে) আমার কাছে ভালোই মনে হ’ল। তিনি বললেন, সেটি কী? উত্তরে আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বললেন, জীবিত থাকলে আপনি অচিরেই তা দেখবেন। এরপর তিনি বললেন, আমি মসজিদে গোলাকার হয়ে কিছু লোককে বসে থাকতে দেখলাম, যারা ছালাতের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রত্যেক হালকায় একজন বিশেষ লোক রয়েছে। আর তাদের প্রত্যেকের হাতে নুড়ি-পাথর রয়েছে। লোকটি বলছে, তোমরা একশ’ বার ‘আল্লাহু আকবার’ পাঠ কর। তারা একশবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলছে। এরপর সে বলছে, তোমরা একশ’ বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বল। তারা একশত বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলছে। সে একশ’ বার ‘সুবহা-নাল্লাহ’ বলতে বললে তারা একশ’ বার ‘সুবহা-নাল্লাহ’ বলছে। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বললেন, আপনি তাদেরকে কী বলেছেন? তিনি বললেন, আমি আপনার মতামত ও নির্দেশের অপেক্ষায় কিছুই বলিনি। তখন তিনি বললেন, আপনি তাদের গুনাহ সমূহ গণনা করে রাখতে বলেননি কেন? আর আপনি তাদের নিশ্চয়তা দিতেন যে, এভাবে গণনা না করাতে তাদের নেকী সমূহ বিনষ্ট হবে না। অতঃপর তিনি পথ চলা শুরু করলে আমরা তাঁর সাথে পথ চলতে লাগলাম। অবশেষে তিনি হালকা সমূহের কোন একটি হালকার নিকট পৌঁছলেন। তাদের নিকট গিয়ে বললেন, আমি তোমাদেরকে যা করতে দেখছি তা কী? তারা বলল, হে আবূ আব্দুর রহমান! এগুলো নুড়ি-পাথর। এর দ্বারা আমরা তাকবীর, তাহলীল ও তাসবীহ গণনা করছি। তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের গুনাহসমূহ গণনা কর আর আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, এভাবে গণনা না করলেও তোমাদের ছওয়াবসমূহ বিনষ্ট হবে না। ‘হে মুহাম্মাদের উম্মতগণ! কত দ্রুত তোমাদের ধ্বংস এসে গেল’? তোমাদের নবী (ছাঃ)-এর বহু ছাহাবী এখনও জীবিত আছেন। এটি তাঁর (মুহাম্মাদ (ছাঃ-এর) পোশাক, যা পুরাতন হয়নি এবং পানপাত্র যা ভেঙ্গে যায়নি। যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর (আল্লাহর) কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই তোমরা হয় এমন এক মিল্লাতের (ধর্মের) উপর আছ, যা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর এর মিল্লাত অপেক্ষা অধিকতর সঠিক? অথবা তোমরা পথভ্রষ্টতার দার উন্মোচনকারী! তারা বলল, হে আবু আব্দুর রহমান! আল্লাহর কসম! আমরা এর দ্বারা কেবল ভালো উদ্দেশ্য করছিলাম। তখন তিনি বললেন, বহু লোক নেকী অর্জনের ইচ্ছা করে কিন্তু আদৌ তাদের নেকী অর্জিত হয় না। রাসূল (ছাঃ) আমাদের নিকট হাদীছ বর্ণনা করেছেন যে, এমন বহু মানুষ থাকবে যারা কুরআন তেলাওয়াত করবে, কিন্তু তা তাদের গলদেশ অতিক্রম করবে না। (অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তারা ইসলাম থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমন তীর শিকার ভেদ করে বের হয়ে যায়)। আল্লাহর কসম! আমি জানি না তোমাদের অধিকাংশই তারা কি-না? অতঃপর তিনি চলে গেলেন। আমর ইবনু সালামা বলেন, হালকার বহু লোককে আমি নাহরাওয়ানের যুদ্ধে খারেজীদের সাথে মিলিত হয়ে যুদ্ধ করতে দেখেছি (দারেমী হা/২০৪, ভূমিকা, অনুচ্ছেদ-২৩; ছহীহাহ হা/২০০৫)।
শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, এতে তরীক্বাপন্থী ও সুন্নাহর পদ্ধতি বিরোধী হালকায়ে যিকিরকারীদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। বেশি ইবাদত করার মধ্যে কল্যাণ নেই; বরং ইবাদত সুন্নাত অনুযায়ী এবং বিদ‘আত মুক্ত হওয়াতেই কল্যাণ রয়েছে। এদিকে ইঙ্গিত করেই ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, মধ্যমপন্থায় সুন্নাতের উপর টিকে থাকা বিদ‘আতে ইজতিহাদ করা অপেক্ষা উত্তম। ছোট বিদ‘আত বড় বিদ‘আতের দিকে ধাবিতকারী। এজন্য দেখা যায়, হালকায়ে যিকিরকারীরা পরবর্তীতে খারেজী হয়ে যায়, যাদেরকে আলী (রাঃ) হত্যা করেন। এ হাদীছ থেকে আরো শিক্ষা অর্জন করা যায় যে, তাসবীহ গণনা করতে হবে আঙ্গুল দ্বারা, তাসবীহ দানার মাধ্যমে নয়। তাসবীহ দানার মাধ্যমে তাসবীহ গণনা করা বিদ‘আত। ইউসিরাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে বললেন, তোমাদের জন্য তাসবীহ, তাহলীল, তাকদীস (সুবহানাল মালিকিল কুদ্দূস অথবা সুববূহুন কুদ্দূসুন রববুল মালাইকাতি ওয়ার রূহ বলা) পাঠ করা যরূরী। তাসবীহ গণনার ক্ষেত্রে তোমরা অলসতা কর না; অন্যথা তোমরা তাওহীদ ভুলে যাবে ও রহমত হ’তে বঞ্চিত হবে। আর তোমরা আঙ্গুলের মাধ্যমে তাসবীহ পাঠ কর। নিশ্চয়ই আঙ্গুলকে জিজ্ঞেস করা হবে এবং আঙ্গুল কথা বলবে (তিরমিযী হা/৩৫৮৩; আবুদাঊদ হা/১৫০১; ছহীহুল জামে‘ হা/৪০৮৭; মিশকাত হা/২৩১৬)। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে ডান হাতে তাসবীহ গণনা করতে দেখেছি (আবুদাঊদ হা/১৫০২; বায়হাকী, সুনানুল কুবরা হা/২৮৫০)। ছালত ইবনু বাহযাম (রহঃ) বলেন, একদা ইবনু মাসঊদ (রাঃ) তাসবীহ দানা দ্বারা তাসবীহ গণনাকারী মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তার নিকট হ’তে তাসবীহ দানা নিয়ে ছিঁড়ে দূরে নিক্ষেপ করলেন। এরপর এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যে নুড়ি-পাথর দিয়ে তাসবীহ গণনা করছিল। তিনি তাকে পা দিয়ে মৃদু আঘাত করে ও ধমক দিয়ে বললেন, অগ্রগামী হয়ে পড়েছ, এক অন্ধকারাচ্ছন্ন বিদ‘আতে লিপ্ত হয়ে পড়েছ, নাকি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের চেয়ে বেশি জ্ঞানী হয়ে গেছ? (ইবনু ওয়ায্যাহ, আল-বিদউ‘ হা/২১, ১/৩০; যঈফা হা/৮৩-এর আলোচনা)।
স্মর্তব্য যে, প্রচলিত ‘আল্লাহু’ ‘আল্লাহু’, ‘হু হু’ বা ‘ইল্লাল্লাহ’ শব্দে কোন যিকর নেই। উক্ত মর্মে যে হাদীছটি রয়েছে, তার অর্থ হ’ল ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ (মুসলিম হা/১৪৮, আহমাদ হা/১৩১৬০; মিশকাত হা/৫৫১৬)। শায়খ আলবানী বলেন, ‘শুধু ‘আল্লাহ’ শব্দে যিকর করা বিদ‘আত, সুন্নাতে যার কোন ভিত্তি নেই’ (মিশকাত ৩/১৫২৭ পৃঃ, হা/৫৫১৬-এর টীকা-১ দ্রঃ)। সর্বোত্তম যিকর হচ্ছে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ (ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৩০৬)। যা নিরিবিলি ও নিম্নস্বরে হবে।