উপক্রমণিকা :

সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক অভিশাপ। সমাজতন্ত্র স্বাধীন মানুষকে পরাধীন, যান্ত্রিক ও ইতর বস্ত্ততে পরিণত করে। পক্ষান্তরে পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানুষকে বল্গাহীন স্বাধীন, নিপীড়ক, স্বার্থপর ও স্বেচ্ছাচারী করে তুলে। আর ইসলামী অর্থনীতি এই দুই মেরুর অর্থ ব্যবস্থার মাঝে সমন্বয় সাধন করে সমৃদ্ধশালী, সার্বজনীন কল্যাণকামী সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা পালন করে। মোটকথা মানব রচিত কোন তন্ত্র-মন্ত্র বা অর্থব্যবস্থা সার্বজনীন হ’তে পারে না। অর্থনৈতিক সফলতা ও মুক্তি একমাত্র আল্লাহ প্রেরিত অভ্রান্ত সত্যের উৎস কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী অর্থনীতির মাঝেই নিহিত আছে।

সমাজতন্ত্র ইতিমধ্যে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। যেমনি তার আকস্মিক আবির্ভাব, তেমনি আকস্মিক তার তিরোভাব। যেসব দেশ এখনও সমাজতন্ত্রের দাবীদার তারা বহুবার পরিবর্তন, সংযোজন, সংকোচন ও সংশোধনের মাধ্যমে প্রকারান্তরে পুঁুজিবাদের নামাবলী গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে। আর পুঁজিবাদের ইতিহাস তো শোষণ-নিপীড়ন, বঞ্চনা, অন্যায় যুদ্ধ ও সংঘাতের রক্তস্নাত ইতিহাস। পুঁজিবাদের দর্শন চরম ভোগবাদী ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতার দর্শন। পক্ষান্তরে ইসলামী অর্থনীতির দর্শন হ’ল জনহিতকর, সুষম ও সর্বযুগোপযোগী দর্শন। যা আবহমানকাল থেকে মানব কল্যাণে অবদান রেখে আসছে। আলোচ্য প্রবন্ধে উল্লিখিত ত্রিবিধ অর্থনৈতিক দর্শন, কার্যক্রম, কল্যাণ-অকল্যাণ ইত্যাদি বিষয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

পুঁজিবাদের পরিচয়, উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ :

পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রথম ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তিগত মালিকানার সীমাহীন অধিকার। এতে কেবল নিত্য নৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি স্বীয় মালিকানায় রাখারই সুযোগ নয়, তাতে সকল প্রকার উৎপাদন-উপায় এবং যন্ত্রপাতি ইচ্ছামত ব্যবহার ও প্রয়োগেরও পূর্ণ সুযোগ লাভ করা যায়। ব্যক্তি নিজ ইচ্ছামত অবলম্বিত যে কোন পন্থা ও উপায়ে অর্থোপার্জন করতে পারে এবং যে কোন পথে তা ব্যয় এবং ব্যবহারও করতে পারে; যেখানে ইচ্ছা সেখানে কারখানা স্থাপন করতে পারে এবং যতদূর ইচ্ছা মুনাফাও লুটতে পারে। শ্রমিক নিয়োগের যেমন সুযোগ রয়েছে, তাদেরকে শোষণ করে একচ্ছত্রভাবে মুনাফা লুণ্ঠনের পথেও সেখানে কোন বাধা ও প্রতিবন্ধকতা নেই। ব্যক্তি বা গোটা সমাজ মিলিত হয়েও কাউকে কোন প্রকার কাজ হ’তে বিরত রাখতে পারে না- সে অধিকার কারো নেই।[1]

এই ধরনের অর্থ ব্যবস্থা একদিকে সূদখোর, মহাজন, শোষক, কারখানা মালিক ও যালেম জমিদার-জায়গীরদারের সৃষ্টি করে। অপরদিকে মজুর-কৃষকদের এক সর্বহারা বুভূক্ষুদের দল তৈরী করে। এইরূপ অর্থ ব্যবস্থা যে সমাজে কার্যকরী হবে, সেখানে স্বভাবতই সহানুভূতি, সহৃদয়তা, মায়া-মমতা, পারস্পরিক সাহায্য প্রভৃতি মানবীয় ভাবধারা এক বিন্দুও পাওয়া যাবে না। প্রত্যেক ব্যক্তিই আত্মনির্ভর হয়ে জীবন যাপনে বাধ্য হবে, কেউ কারো বন্ধু বা সাহায্যকারী হবে না। অভাবগ্রস্ত ও বুভূক্ষুদের জীবন সংকীর্ণতর হয়ে যাবে। ফলে সমাজের প্রত্যেকটি ব্যক্তিই জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অন্যান্যদের মুকাবিলায় চরম স্বার্থপর ও প্রতিহিংসামূলক ভূমিকা অবলম্বন করতে বাধ্য হবে।[2]

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এই ভয়ানক চিত্র সর্বপ্রথম বৃটেনে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর তা ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে ‘মূলনীতি’ হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় জনসাধারণের কল্যাণ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রশ্নই ছিল না। এজন্য মিল-কারখানায় যেসব পণ্য উৎপাদিত হ’ত সেগুলো ন্যূনতম মজুরিতে সর্বাধিক উৎপাদন এবং ব্যক্তিস্বার্থের নীতিতে উৎপাদন করা হ’ত। ফলে উৎপাদিত পণ্য দ্বারা গুদামগুলো ভরে গেল। অপরদিকে রফতানীর পথ সীমিত হওয়ায় এসব পণ্য গুদামে নষ্ট হ’তে লাগল। কিন্তু পণ্যের এরূপ প্রাচুর্য হওয়া সত্ত্বেও শ্রমিক ও গরীবরা এসব দ্বারা কোন প্রকার উপকৃত হ’ল না। পণ্য উৎপাদনের প্রাথমিক যুগে যেমন তারা নিজেদের প্রয়োজনে এসব পণ্য কিনতে পারত না, তেমনি প্রাচুর্যের সময়েও তারা এসব কেনার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত রইল।

সুতরাং পুঁজিবাদী ব্যবস্থারূপে এই ভূতের লোভাতুর দৃষ্টি অন্যান্য রাষ্ট্রের উপরও পড়া আরম্ভ হয়। সেসব দেশকে পরাধীনতার শৃংখলাবদ্ধ করার জন্য সে ‘আরো চাই’ ‘আরো চাই’ ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে চলে। নিজ দেশের স্বাধীন ব্যবসায়ীদের দাসে পরিণত করার পর ‘ভূমির ক্ষুধা’ (সাম্রাজ্যবাদী লোভ) নিবারণের জন্য সে দুর্বল দেশ ও জাতিগুলোর সার্বভৌমত্ব হরণ করা শুরু করে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে ইউরোপীয়দের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পালা আরম্ভ হয়। অবশেষে ভারতের মত বিরাট দেশও তাদের উপনিবেশে পরিণত হয়। অল্পদিনের মধ্যে সারা পৃথিবী বৃটিশ ও অন্যান্য পুঁজিবাদী শক্তির বাণিজ্যিক বাজারে রূপান্তরিত হয়।[3]

শিল্প বিপ্লবের ফলে উপনিবেশবাদ আরও জেঁকে বসে। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের আবিষ্কার ও শিল্প উৎপাদনের ক্রমবিকাশমান কলাকৌশলকে বেনিয়ারা নিজেদের স্বার্থে ব্যাপক ও নির্দয়ভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে। এরই ফসল শিল্প বিপ্লব। একই সাথে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হ’ল ‘খাও, দাও আর ফূর্তি কর’ এই ভোগবাদী দর্শন দিয়ে। প্রকৃতপক্ষে যান্ত্রিক ও ইতর বস্ত্তবাদ হয়ে পড়লো সমাজ দর্শনের ভিত। ভোগবাদী জীবন ও বস্ত্তবাদের সমন্বয়ের আগুনে ঘি ঢালার কাজটি সম্পন্ন করল অবাধ ও নিরংকুশ ব্যক্তি মালিকানা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ধ্যান-ধারণা। প্রথম দিকে চার্চের পুরোহিতরা কিছুটা বাধার সৃষ্টি করতে চাইলেও তাদের সে চেষ্টা রাজন্যবর্গ ও বুর্জোয়া শ্রেণীর চাপে স্রোতের মুখে খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। এরই সাথে পরবর্তীকালে যুক্ত হ’ল মানবতার অস্তিত্ববিনাশী ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর অফুরন্ত নে‘মত ভোগের চরম বাধাসৃষ্টিকারী সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ। পুঁজিবাদ এভাবেই তার শক্তিমত্তা ও দাপট বৃদ্ধি করে চলল। বাণিজ্যিক পুঁজিবাদ দিয়ে তার শুরু। ক্রমে শিল্প পুঁজি, বিনিয়োগ পুঁজি ইত্যাদি পর্যায় পেরিয়ে সে পৌঁছেছে বহুজাতিক পুঁজির বিশাল বাজারে। এ বাজার তারই রচিত, বিশ্বকে শোষণের জন্যে তারই উদ্ভাবিত কৌশল। এর অপ্রতিহত গতি ও সাফল্যকে ধরে রাখতে পুঁজিবাদের উদ্ভাবিত সর্বশেষ কৌশল হ’ল বিশ্বায়ন (Globalization) ও উদারীকরণ (Liberalization)।[4]

পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য :

পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল- ১. জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গী ২. ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রদর্শন ৩. অবাধ ব্যক্তি স্বাধীনতা ৪. উন্মুক্ত ও অবাধ অর্থনীতি ৫. ব্যক্তির নিরংকুশ মালিকানা ৬. লাগামহীন চিন্তার স্বাধীনতা ৭. গণতন্ত্রের নামে বুর্জোয়া শ্রেণীর শাসন ৮. পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদী।[5]

পুঁজিবাদের ত্রুটি :

পুঁজিবাদ যেহেতু মানব রচিত মতবাদ সেহেতু এর ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। নিম্নে সংক্ষিপ্তাকারে পুঁজিবাদের ত্রুটিগুলো তুলে ধরা হ’ল।-

১. অপচয়মূলক প্রতিযোগিতা ২. অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও বেকারত্ব ৩. সম্পদের ত্রুটিপূর্ণ বণ্টন। ৪. একচেটিয়া ব্যবসায়ীর উদ্ভব ও তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা সংহতকরণ। ৫. বাণিজ্য চক্রের পর্যায়ক্রমিক উপস্থিতি এবং ৬. চরম নৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের ক্রম বিস্তৃতি।

পুঁজিবাদের বর্তমান চিত্র :

১. একক পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ ২. চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজমান (ধনী-দরিদ্রের জীবন যাপনের ব্যয়সূচক বিগত দুই দশকে ১০ঃ১ হ’তে ৭০ঃ১ এ উন্নীত) ৩. বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের ছলে বিশ্বকে শোষণের কৌশল গ্রহণ ৪. যুগপৎ চরম দারিদ্র্য ও ভোগ-বিলাসপূর্ণ জীবন যাপন নিত্যকার দৃশ্য ৫. গণতন্ত্রের ধোঁকা দিয়ে মুষ্টিমেয় বিত্তশালী লোকের শাসন প্রতিষ্ঠা ৬. স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রবাহ ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে পুঁজিবাদী জীবনাদর্শের স্লোপয়জনিং ৭. এনজিও কালচার পত্তনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে শোষণের বিস্তৃতি ৮. আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল এবং ৯. ইসলামের মুকাবিলায় সমাজতন্ত্রের সাথে অভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ।[6]

সমাজতন্ত্রের পরিচয়, স্বরূপ, উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ :

পুঁজিবাদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ যে অর্থব্যবস্থা মানব সমাজে আত্মপ্রকাশ করেছে, তা কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র। পুঁজিবাদী সমাজের মযলূম শোষিত মানুষকে বুঝ দেওয়া হয়েছে যে, ব্যক্তিগত মালিকানাই সকল প্রকার বিপর্যয়ের মূল কারণ। এর উচ্ছেদেই সকল অশান্তি ও শোষণ-নির্যাতনের চির অবসান ঘটবে। এজন্য কমিউনিজমের অর্থনীতিতে প্রথম পদক্ষেপেই ব্যক্তিগত মালিকানা অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে এবং অর্থ উৎপাদনের সমস্ত উপায়-উপাদান ও যন্ত্রপাতি (Means and Instruments of production) জাতীয় মালিকানা বলে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ফলে কমিউনিস্ট সমাজে জাতীয় অর্থোৎপাদনের উপায়-উপাদানের উপর রাষ্ট্র পরিচালক মুষ্টিমেয় শাসক গোষ্ঠীর নিরংকুশ কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছে। তারা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিশেষ প্লান-প্রোগ্রাম ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সকল উপায়-উপাদান ব্যবহার করে থাকে। তাদের নির্ধারিত নীতি অবনত মস্তকে মেনে নিতে একান্তভাবে বাধ্য হয় সে সমাজের কোটি কোটি মানুষ।[7]

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণ-নির্যাতন শেষ পর্যন্ত শ্রমিক ও গরীব শ্রেণীকেও অধিকার-সচেতন করে তোলে। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে অধিকার আদায়ের জন্য তারা সংগ্রাম শুরু করে। বিভিন্ন স্থানে সংগঠন গড়ে তোলে। এমনকি তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ তাদের প্রতি সমর্থন জানানো শুরু করে। বিংশ শতাব্দীতে সোভিয়েত রাশিয়ার মত বিরাট দেশে মেহনতী মানুষের বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়। এরপর কার্লমার্কসের সমাজতান্ত্রিক মতবাদ অনুযায়ী আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও কায়েম করা হয়।[8]

জার্মান ইহুদী কার্লমার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) ভাগ্যের অন্বেষণে ঘুরতে ঘুরতে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম হয়ে একসময়ে পৌঁছে যান পুঁজিবাদের তৎকালীন সবচেয়ে বড় ধ্বজাধারী দেশ ইংল্যান্ডে। সেদেশে তখন রবার্ট ওয়েন, থমাস হজকিন্স, সিডনী ওয়েব, চার্লস ফুরিয়ার, সেন্ট সাইমন, লুই ব্লা, জেরেমি বেন্থামের মতো ফেবিয়ান সোস্যালিস্ট, হবসন ও বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো গিল্ড সোসালিস্ট ও পিগুর মতো গণদ্রব্য সরবরাহ করার প্রবক্তাদের আলোচনা ও লেখালেখির ফলে বিদগ্ধ মহলে সমাজতন্ত্র নিয়ে বেশ উত্তেজনা ছিল। এই পটভূমিতেই কার্লমার্কস দেখলেন শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট শ্রমিকদের বেদনাবিধুর বিপর্যস্ত মানবেতর জীবন যাপন। আর এরই সমাধানের জন্যে তিনি গ্রহণ করলেন দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদ তত্ত্ব, ডাক দিলেন শ্রেণী সংগ্রামের। তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ Das Kapital (১৮৬৭) এই সময়েই রচিত। তাঁর Theory of Surplus Value এই পটভূমিতেই উদ্ভাবিত। তাঁর প্রস্তাবিত শ্রেণী সগ্রামের পথ ধরে পরবর্তীকালে রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টির মাধ্যমে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার সময়ে শ্রেণীশত্রু উৎখাত ও নির্মূলের নামে কত লক্ষ বনি আদম যে বন্দুকের নলের শিকার হয়েছিল, কত লক্ষ লোক ভিটেমাটি হ’তে উৎখাত হয়ে সুদূর সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হয়েছিল তার হদিস মিলবে না কোন দিনই। সমাজতন্ত্র যখন একটা সংগঠিত শক্তির রূপ নেওয়া শুরু করে তখন তার কার্যাবলীর মধ্যে প্রধান হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তি মালিকানা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার উচ্ছেদ, সর্বহারার একনায়কত্বের (Dictatorship of the Proletariat) নামে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, জনগণের মালিকানার নামে উৎপাদনের উপায়-উপকরণে রাষ্ট্রীয় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার এবং ধর্মের আমূল উচ্ছেদ।

রাশিয়ার প্ররোচনায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানো হয়েছিল পূর্ব ইউরোপীয় দেশ পোল্যান্ড, হাঙ্গেরী, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া ও যুগোস্লাভিয়ায়। এজন্যে অনেক ক্ষেত্রে রাশিয়া সরাসরি সামরিক মদদ যুগিয়েছে, ট্যাংকের বহর পাঠিয়েছে। একই চেষ্টা চলল কিউবায়, আফ্রিকার কঙ্গো, এ্যাঙ্গোলা, নামিবিয়া ও ইথিওপিয়ায়। এ ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল চীনেও। কিন্তু তাত্ত্বিক নীতি ও আদর্শ পরিবর্তিত হ’তে শুরু করল বাস্তবের কঠিন পরিস্থিতি মুকাবিলা করতে গিয়ে। শতাব্দী প্রাচীন কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো (১৮৪৮) ততদিনে লক্ষ লক্ষ লোককে কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে। আরও লক্ষ লক্ষ বনি আদমকে ভিটেমাটি ছাড়া করেছে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বা বাধ্যতামূলক শ্রমশিবিরে যে কত লোক লাপাত্তা হয়েছে তার কোন লেখাজোখা নেই। যাহোক বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে চলার বাসনায় সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদী দেশগুলো তাদের পূর্বঘোষিত আদর্শের পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে পুঁজিবাদের সাথে অপোষরফার নীতি গ্রহণ করে। এ উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যুগোশ্লাভিয়া। পরবর্তীকালে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর সোস্যালিস্ট বা কম্যুনিস্ট পার্টি কর্তৃক গৃহীত সোস্যালিজম বা কম্যুনিজমের নতুন ব্যাখ্যা তাই বহু ক্ষেত্রেই ছিল মার্কসবাদের সাথে দারুণ অসংগতিপূর্ণ।

চীনও এর ব্যতিক্রম নয়। কমরেড মাওসেতুং লং মার্চের মাধ্যমে চীনে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার ডাক দেন। রেড গার্ড আন্দোলনের নামে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে বিরোধী মনোভাবাপন্ন বুদ্ধিজীবীদের মেথরের স্তরে নামিয়ে আনেন। মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের হত্যা ও পাইকারী হারে বন্দী করেন। উইঘুরদের (চীনে মুসলমানদের উইঘুর ও হুই বলা হয়) নাম-নিশানা মুছে ফেলার সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হয়। সমাজতন্ত্রের ইতিহাস সীমাহীন রক্তপাত, ধ্বংসযজ্ঞ, নির্যাতন, প্রতারণা ও ছলনার ইতিহাস। চীন তার ব্যতিক্রম হবে কি?[9]

সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যাবলী :

১. দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ২. ধর্মের উৎখাত ৩. ব্যক্তি স্বাধীনতার উচ্ছেদ ৪. নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি ৫. রাষ্ট্রীয় নিরংকুশ মালিকানা ৬. চিন্তার পরাধীনতা ৭. সর্বহারার নামে একদলীয় শাসন ৮. তাত্ত্বিকভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হ’লেও বাস্তবে সাম্রাজ্যবাদী।[10]

সমাজতন্ত্রের ত্রুটি সমূহ :

১. সম্পদের ভুল মালিকানা ও অসম বণ্টন ২. প্রকৃত চাহিদা নির্ধারণ ও সঠিক মূল্য নিরূপণে ব্যর্থ ৩. ব্যক্তিস্বার্থ পূরণের সুযোগ না থাকায় প্রেষণা অকার্যকর ৪. ভোক্তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরণ ৫. কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যর্থ এবং ৬. নৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ।[11]

সমাজতন্ত্রের বর্তমান অবস্থান :

১. সমাজতন্ত্রের বর্তমান গতি ক্রমাগত সংশোধনবাদের দিকে।

২. পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলো ক্রমাগত গ্রহণ (সূদ, ব্যক্তি মালিকানা, বাজার ব্যবস্থা, মুনাফা ইত্যাদি)।

৩. শিল্প উৎপাদনে পুঁজিবাদী বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা কৌশল গ্রহণ।

৪. পার্টি এলিট ও জনসাধারণের মধ্যে শোষণমূলক সম্পর্ক।

৫. পীড়নমূলক, ধোঁকাপূর্ণ, গোজামিলের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পর্যবসিত।

৬. রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণীর সৃষ্টি।

৭. অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য বিলুপ্ত করতে ব্যর্থ।

৮. পুঁজিবাদের সাথে সহঅবস্থানের নীতি গ্রহণ।

৯. ইসলামের মুকাবিলায় পুঁজিবাদের সাথে অভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ।[12]

ইসলামী অর্থনীতির পরিচয় :

আল্লাহর বিশ্ব-প্রতিপালন নীতির অনুসরণে সৃষ্টির লালন-পালনের জন্য সমুদয় জাগতিক সম্পদের সামগ্রিক এবং কল্যাণধর্মী ব্যবস্থাপনাই ইসলামী অর্থনীতি। সৃষ্টজীবের কল্যাণের জন্য সম্পদের সর্বাধিক উৎপাদন, সুষ্ঠু বণ্টন, ন্যায়সংগত ভোগ বিশ্লেষণই হ’ল ইসলামী অর্থনীতি।[13]

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. এস.এম. হাসানুজ্জামান বলেন, Islamic Economics is the knowledge and application of injunctions and rules of the Shariah that prevent injustice in the acquisition and disposal of material resources in order to provide satisfaction to human beings and enable them to perform their obligations to Allah and the society.

অর্থাৎ ইসলামী অর্থনীতি হচ্ছে শরী‘আতের বিধি-নির্দেশ সম্বন্ধীয় জ্ঞান ও তার প্রয়োগ যা বস্ত্তগত সম্পদ আহরণ ও বিতরণের ক্ষেত্রে অবিচার প্রতিরোধে সমর্থ যেন এর ফলে মানবমন্ডলীর সন্তুষ্টি বিধান করা যায়। ফলে আল্লাহ ও সমাজের প্রতি তারা দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সক্ষম হবে।[14]

ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য :

ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিম্নরূপ-

(১) অর্থনীতিতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা : ইসলামী অর্থনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে ‘আদল ও ইহসান’ ক্বায়েম করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ  ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং অশ্লীলতা, অন্যায় কাজ ও অবাধ্যতা হ’তে নিষেধ করেন’ (নাহল ১৬/৯০)

(২) অর্থনীতিতে সুনীতি প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি উৎখাত করা : এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা যে সাধারণ নীতি, তা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,الَّذِيْنَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوْا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُوْرِ ‘তারা এমন লোক, আমরা যদি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি, তাহ’লে তারা ছালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, সৎকাজের আদেশ দেয় ও অসৎকাজে নিষেধ করে। আর সকল কাজের পরিণাম আল্লাহর ইচ্ছাধীন’ (হজ্জ ২২/৪১)

(৩) নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা : ইসলামী অর্থনীতিতে নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়েছে। মানুষ তার সম্পদের একচেটিয়া মালিক নয়। বরং সম্পদশালীদের সম্পদে দুঃস্থ-গরীব, নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ ‘তাদের সম্পদে সাহায্যপ্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে’ (যারিয়াত ৫১/১৯)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,وَنُرِيْدُ أَنْ نَمُنَّ عَلَى الَّذِيْنَ اسْتُضْعِفُوْا فِي الْأَرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِيْنَ- ‘আর আমরা ইচ্ছা করলাম তাদের প্রতি অনুগ্রহ করব যাদেরকে দেশে দুর্বল করা হয়েছে। তাদেরকে নেতা বানানো ও তাদেরকে দেশের উত্তরাধিকারী বানানো’ (ক্বাছাছ ২৮/৫)

(৪) কল্যাণকর দ্রব্যের উৎপাদনে উৎসাহিতকরণ ও অকল্যাণকর দ্রব্যের উৎপাদন নিষিদ্ধ করণ : ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের স্বার্থে স্বাস্থ্যসম্মত দ্রব্যের পর্যাপ্ত উৎপাদন নিশ্চিত করা ও সব অকল্যাণকর, অস্বাস্থ্যকর দ্রব্যের উৎপাদন, আমদানী-রফতানী ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ-  ‘নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, বেদী ও শুভাশুভ নির্ণয়ের তীর সমূহ নাপাক ও শয়তানী কাজ। অতএব তোমরা এসব থেকে বিরত থাকো যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও’ (মায়েদাহ ৫/৯০-৯১)

আল্লাহ তা‘আলা আরোও বলেন, حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَنْ تَسْتَقْسِمُوا بِالْأَزْلَامِ ذَلِكُمْ فِسْقٌ ‘তোমাদের উপর হারাম করা হ’ল মৃত, রক্ত, শূকরের গোশত, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে উৎসর্গীত পশু, শ্বাসরোধে হত্যা করা পশু, প্রহারে মৃত পশু, পতনে মৃত পশু, শিংয়ের আঘাতে মৃত পশু, হিংস্র জন্তুতে খাওয়া পশু, তবে যা তোমরা যবেহ দ্বারা হালাল করেছ, তা ব্যতীত এবং যে পশু পূজার বেদীতে বলি দেওয়া হয়েছে। আর জুয়ার তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করা তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে। কেননা এসবই পাপের কাজ’ (মায়েদাহ ৫/৩)

উল্লিখিত খাদ্যগুলো অকল্যাণকর তথা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিধায় এগুলোকে হারাম তথা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّيَ بِالْحَرَامِ ‘হারাম খাদ্যে গঠিত শরীর জান্নাতে যাবে না’।[15]

সম্পদের সুষম বণ্টন :

ইসলাম সম্পদের সুষম বণ্টনের উপর গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,كَيْ لَا يَكُوْنَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ ‘ধনৈশ্বর্য যেন কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়’ (হাশর ৫৯/৭)। এ আয়াতের আলোকে ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে আইন ও পলিসির মাধ্যমে সম্পদের বিস্তার ও সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ،  ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন। যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করে তাদের গরীবদের মধ্যে বণ্টন করা হবে’।[16]

সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার :

ইসলাম জনকল্যাণের জন্য সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার চায়। এজন্যই ইসলাম পতিত জমি ফেলে রাখা সমর্থন করেনি। মালিকানাবিহীন জমিতে যিনি ফসল উৎপন্ন করবেন, তিনিই তা ভোগ করবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এমন জমি চাষাবাদ করেছে, যা কারো মালিকানা নয়, সে-ই উহার হকদার’। উরওয়া ইবনে যুবায়র তাবেঈ বলেন, ওমর (রাঃ)ও তাঁর খেলাফত কালে এই হুকুম দিয়েছিলেন’।[17]  একই  নীতি

অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে গণ্য করতে হবে।

এছাড়া সূদ-ঘুষ, শোষণ-যুলুম, মজুদদারী ইত্যাদি রহিতকরণ; যাকাত-ওশর, জিজিয়া, কর্যে হাসানাহ ইত্যাদি ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং সর্বোপরি সকল প্রকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ইসলামী শরী‘আতের পূর্ণ বাস্তবায়নই হচ্ছে ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। এসব মূলনীতি কার্যকরী করা ইসলামী সরকারের কর্তব্য। এসবের কার্যকরী করার ওপরই মুসলিম বিশ্বের প্রকৃত শান্তি ও কল্যাণ নির্ভরশীল।

সূদ-ঘুষ, ধোঁকামুক্ত অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা :

সূদ পুঁজিবাদের জীয়নকাঠি। এটা সমাজ শোষণের অন্যতম হাতিয়ার এবং মানব সভ্যতার সবচেয়ে নিষ্ঠুর শত্রু। সূদী কারবারের ফলে সমাজের বিত্তশালীরা অসহায়, নিঃস্ব, দরিদ্র, বনু আদমের সম্পদ জোঁকের মত চুষে চুষে খেয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে। অন্যদিকে সমাজের হতভাগ্য হতদরিদ্র মানুষগুলো দিন দিন অর্থশূন্য হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে। তাই ইসলাম এ চির অভিশপ্ত সূদকে চিরতরে নিষিদ্ধ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, যাকাত, দান-ছাদাক্বা ও কর্যে হাসানা ভিত্তিক অর্থনীতি প্রবর্তন করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ وَذَرُوْا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ، فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوْا فَأْذَنُوْا بِحَرْبٍ مِنَ اللهِ وَرَسُوْلِهِ وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوْسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُوْنَ وَلَا تُظْلَمُوْنَ- ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সূদের পাওনা যা বাকী রয়েছে, তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা সত্যিকারের মুমিন হয়ে থাক। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর, তাহ’লে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে যাও। আর যদি তোমরা তওবা কর, তাহ’লে তোমরা তোমাদের মূলধনটুকু পাবে। তোমরা অত্যাচার করো না এবং অত্যাচারিত হয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/২৭৮-২৭৯)। তিনি আরো বলেন, اَلَّذِيْنَ يَأْكُلُوْنَ الرِّبَا لَا يَقُوْمُوْنَ إِلَّا كَمَا يَقُوْمُ الَّذِيْ يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوْا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا فَمَنْ جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَانْتَهَى فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ وَمَنْ عَادَ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ- ‘যারা সূদ ভক্ষণ করে, তারা (ক্বিয়ামতের দিন) দাঁড়াতে পারবে না জিনে ধরা রোগীর ন্যায় ব্যতীত। এর কারণ এই যে, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় তো সূদের মতই। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন ও সূদকে হারাম করেছেন। অতঃপর যার নিকটে তার প্রভুর পক্ষ থেকে উপদেশ এসে গেছে এবং সে বিরত হয়েছে, তার জন্য পিছনের সব গোনাহ মাফ। তার (তওবা কবুলের) বিষয়টি আল্লাহর উপর ন্যস্ত। কিন্তু যে ব্যক্তি পুনরায় সূদ খাবে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الرِّبَا سَبْعُوْنَ جُزْءًًا أَيْسَرُهَا أَنْ يَنْكِحَ الرَّجُلُ أُمَّهُ ‘সূদের ৭০টি গোনাহের স্তর রয়েছে। তার মধ্যে নিম্নতম স্তর হচ্ছে আপন মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া’।[18] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেছেন,دِرْهَمُ رِباً يَأْكُلُهُ الرَّجُلُ وَهُوَ يَعْلَمُ أَشَدُّ مِنْ سِتَّةٍ وَّثَلاَثِيْنَ زَنْيَةً  ‘কোন ব্যক্তি যদি এক দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) সূদ জ্ঞাতসারে গ্রহণ করে, তাতে ছত্রিশবার ব্যভিচারের চেয়েও অনেক বেশী গোনাহ হবে’।[19]

ঘুষের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা হুঁশিয়ারী দিয়ে বলেন,لاَ تَأْكُلُوْا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ ‘তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না’ (নিসা ৪/২৯)

মানুষ মানুষকে ঠকানোর জন্য যেসব পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করে থাকে তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল প্রতারণা-ধোঁকা। এটি একটি জঘন্য অপরাধ। এর দ্বারা মানব সমাজে সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ধোঁকা দিয়ে অর্থোপার্জন নিষিদ্ধ করেছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, مَرَّ عَلَى صُبْرَةٍ مِنْ طَعَامٍ فَأَدْخَلَ يَدَهُ فِيهَا فَنَالَتْ أَصَابِعُهُ بَلَلاً فَقَالَ يَا صَاحِبَ الطَّعَامِ مَا هَذَا. قَالَ أَصَابَتْهُ السَّمَاءُ يَا رَسُولَ اللهِ. قَالَ أَفَلاَ جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ حَتَّى يَرَاهُ النَّاسُ. ثُمَّ قَالَ مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنَّا. ‘একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি খাদ্য স্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্য স্তূপের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে তাঁর আঙ্গুল ভিজা পেলেন। তখন তিনি বললেন, হে খাদ্যের মালিক! ব্যাপার কি? উত্তরে সে (খাদ্যের মালিক) বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! বৃষ্টির পানি লেগে গেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, তাহ’লে ভিজা অংশটা শস্যের উপরে রাখলে না কেন? যাতে ক্রেতা তা দেখে ক্রয় করতে পারে। যে প্রতারণা করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[20]

ব্যবসা-বাণিজ্য ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা প্রবর্তন :

মানব সভ্যতা বিধ্বংসী হাতিয়ার সূদ-ঘুষ, জুয়া, লটারীকে তিরোহিত করে ইসলাম মানব কল্যাণকামী ব্যবসা ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল ও সূদকে হারাম করেছেন’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَطْيَبُ الْكَسْبِ عَمَلُ الرَّجُلِ بِيَدِهِ وَكُلُّ بَيْعٍ مَبْرُورٍ ‘নিজ হাতে কাজ করা এবং হালাল পথে ব্যবসা করে যে উপার্জন করা হয় তাই সর্বোত্তম’।[21]

[ক্রমশঃ]


[1]. মাওলানা আব্দুর রহীম, ইসলামের অর্থনীতি (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী, ষষ্ঠ প্রকাশ ১৪১৭ হিঃ/১৯৯৭ ইং), পৃঃ ২৭-২৮।

[2]. সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী, ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ (ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী, ৭ম সংস্করণ, ১৪১৮ হি/১৯৯৭ইং), পৃঃ ৬।

[3]. মাওলানা হিফজুর রহমান, ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় প্রকাশ, ১৪১৮ হিঃ/১৯৯৮ইং), পৃঃ ৩৩৪-৩৩৫।

[4]. শাহ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান, ইসলামী অর্থনীতি : নির্বাচিত প্রবন্ধ (রাজশাহী : দি রাজশাহী স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, ৪র্থ সংস্করণ ২০০৫), পৃঃ ২৯১।

[5]. ঐ, পৃঃ ২৯৪।

[6]. ইসলামী অর্থনীতি : নির্বাচিত, প্রবন্ধ, পৃঃ ৩১৭ ও ৩১৯।

[7]. ইসলামের অর্থনীতি, পৃঃ ৩০-৩১।

[8]. ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, পৃঃ ৩৩৮-৩৩৯ ।

[9]. ইসলামী অর্থনীতি : নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃঃ ২৯১-২৯৩।

[10]. ঐ, পৃঃ ২৯৪।

[11]. ঐ, পৃঃ ৩১৯।

[12]. ঐ, পৃঃ ৩১৮।

[13]. ড. মুহাম্মাদ জামাল উদ্দিন, ইসলামী অর্থনীতি ও ইসলামী ব্যাংকিং : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ (প্রবন্ধ) ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ-এর একুশ বছর পূর্তি সংখ্যা, পৃঃ ১৫৯।

[14]. ইসলামী অর্থনীতি : নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃঃ ৮।

[15]. মিশকাত হা/২৭৮৭।

[16]. বুখারী, মুসলিম, আবুদাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, ছহীহ ইবনে খুযাইমা, মিশকাত হা/১৭৭২ ‘যাকাত’ অধ্যায়।

[17]. বুখারী, মিশকাত হা/২৯৯১ ‘অনাবাদী ভূমি আবাদ করা, সেচের পালা ও সরকারী ভূমি দান করা’ অধ্যায়।

[18]. ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৮২৬, সনদ ছহীহ।

[19]. আহমাদ, মিশকাত হা/২৮২৫, সনদ ছহীহ।

[20]. মুসলিম হা/১০২; তিরমিযী হা/১৩১৫; মিশকাত হা/২৮৬০।

[21]. তাফসীর কুরতুবী ১৯/৫৬।





উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে যাকাত-এর ভূমিকা - বিকাশ কান্তি দে, কক্সবাজার সিটি কলেজ, কক্সবাজার
জীবিকা থেকে বরকত দূরীভূত হওয়ার কারণ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ইসলামের আলোকে হালাল রূযী - মুহাম্মাদ আতাউর রহমান
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: ইসলামী দৃষ্টিকোণ - ড. নূরুল ইসলাম
পণ্যে ভেজাল প্রদান : ইসলামী দৃষ্টিকোণ - ড. নূরুল ইসলাম
দুর্নীতি ও ঘুষ : কারণ ও প্রতিকার (পূর্ব প্রকাশিতের) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
বাংলাদেশের দারিদ্র্য সমস্যা : কারণ ও প্রতিকার - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ইসলামে হালাল ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ইসলামের দৃষ্টিতে মুনাফাখোরী - ড. নূরুল ইসলাম
ইসলামে হালাল ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
মাহে রামাযানের পূর্ব প্রস্ত্ততি - আব্দুল মুহাইমিন, ইসলামের ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী কলেজ
ইসলামী ব্যাংকিং-এর অগ্রগতি : সমস্যা ও সম্ভাবনা (পূর্বে প্রকাশিতের পর) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আরও
আরও
.