ভূমিকা : আল্লাহ মানুষের জীবন ধারণের জন্য রিযিক বা জীবিকা দান করে থাকেন। এটার ভোগ-ব্যবহারের অধিকার মানুষকে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই সম্পদের প্রতি মানুষের লোভ সীমাহীন। এর প্রতি তাদের ভালবাসা ও আকর্ষণ অত্যধিক। আল্লাহ বলেন,زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِيْنَ وَالْقَنَاطِيْرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْمَآبِ- ‘মানুষের জন্য শোভনীয় করা হয়েছে তার আসক্তি সমূহকে স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি, স্বর্ণ ও রৌপ্যের রাশিকৃত সঞ্চয় সমূহের প্রতি, চিহ্নিত অশ্ব, গবাদি-পশু ও শস্য-ক্ষেত সমূহের প্রতি। এসবই কেবল পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্ত্ত। বস্ত্ততঃ আল্লাহর নিকটেই রয়েছে সুন্দরতম প্রত্যাবর্তনস্থল’ (আলে ইমরান ৩/১৪)। তিনি আরো বলেন,الْمَالُ وَالْبَنُوْنَ زِيْنَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَّخَيْرٌ أَمَلًا- ‘ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য মাত্র। অথচ আখেরাতে চিরস্থায়ী ফলদায়ক সৎকর্মসমূহ তোমার প্রভুর নিকটে উত্তম হ’ল প্রতিদান হিসাবে এবং উত্তম হ’ল আকাঙ্ক্ষা হিসাবে’ (কাহাফ ১৮/৪৬)। রাসূল (ছাঃ)ও সম্পদকে শ্যামল সুমিষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন।[1] সম্পদ বা জীবিকা অধিক হ’লেও তাতে বরকত না থাকলে তা মালিকের জন্য তেমন কোন কল্যাণ বয়ে আনে না। আবার সম্পদ বা জীবিকার অধিকারীদের বিভিন্ন কর্মকান্ডের কারণেও বরকত দূরীভূত হয়ে যায়। নিম্নে জীবিকা থেকে বরকত দূরীভূত হওয়ার কতিপয় কারণ উল্লেখ করা হ’ল।-

১. পাপাচার : পাপাচারের কারণে জীবিকার বরকত চলে যায়। মহান আল্লাহ বলেন,فَكُلًّا أَخَذْنَا بِذَنْبِهِ فَمِنْهُمْ مَنْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِ حَاصِبًا وَمِنْهُمْ مَنْ أَخَذَتْهُ الصَّيْحَةُ وَمِنْهُمْ مَنْ خَسَفْنَا بِهِ الْأَرْضَ وَمِنْهُمْ مَنْ أَغْرَقْنَا وَمَا كَانَ اللهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَكِنْ كَانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُوْنَ- ‘স্ব স্ব পাপের কারণে তাদের প্রত্যেককে আমরা পাকড়াও করেছি। তাদের কারু প্রতি আমরা ছোট পাথরসহ প্রবল ঝঞ্ঝাবায়ু প্রেরণ করেছি (যেমন লূত সম্প্রদায়ের উপর), কাউকে পাকড়াও করেছে প্রচন্ড নিনাদ বজ্রপাত (যেমন ছালেহ ও শু‘আইবের সম্প্রদায়)। কাউকে ধ্বসিয়ে দিয়েছি ভূগর্ভে (যেমন কারূণকে)। কাউকে আমরা ডুবিয়ে মেরেছি (যেমন নূহ ও ফেরাঊনের সম্প্রদায়কে)। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করতে চাননি (কেননা তাদের নিকট তিনি আগেই নবী পাঠিয়েছিলেন)। কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিল’ (আনকাবূত ২৯/৪০)। সুতরাং গোনাহের কারণে যেমন মানুষের আযাব-গযব নাযিল হয়, তেমনি জীবিকার বরকত দূরীভূত হয়ে যায়।

২. প্রতারণা ও ধোঁকা : মানুষের সাথে প্রতারণা করলে এবং তাদেরকে ধোঁকা দিলে সম্পদের বরকত চলে যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,الْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا أَوْ قَالَ حَتَّى يَتَفَرَّقَا فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُورِكَ لَهُمَا فِى بَيْعِهِمَا، وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا- ‘ক্রেতা-বিক্রেতা যতক্ষণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হয়, ততক্ষণ তাদের ইখতিয়ার থাকবে (ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করা বা বাতিল করা)। যদি তারা সত্য বলে এবং (পণ্যের) অবস্থা ব্যক্ত করে তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি মিথ্যা বলে এবং (পন্যের) দোষ গোপন করে তাহ’লে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত মুছে ফেলা হয়’।[2] পণ্যের দোষ-ত্রুটি গোপন করে তা বিক্রি করা ক্রেতাকে ধোঁকা দেওয়ার শামিল। যার কারণে সম্পদের বরকত উঠে যায়।

৩. অধিক কসম খাওয়া : মানুষ নিজের কথাকে অন্যের কাছে বিশ্বস্ত করে তোলার জন্য কসম খেয়ে থাকে। প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে অধিক কসম খাওয়া উচিত নয়। মিথ্যা কসম খাওয়া বড় ধরনের পাপ, যার কারণে সম্পদের বরকত চলে যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِيَّاكُمْ وَكَثْرَةَ الْحَلْفِ فِي الْبَيْعِ فَإِنَّهُ يُنَفِّقُ ثُمَّ يَمْحَقُ، ‘তোমরা ক্রয়-বিক্রয়ে অধিক কসম করা হ’তে সাবধান থাক। কেননা নিশ্চয়ই তাতে (মিথ্যা কসমে) বিক্রি বেশী হয় কিন্তু পরে (বরকত) ধ্বংস করে’।[3] তিনি আরো বলেন,الْحَلِفُ مَنْفَقَةٌ لِلسِّلْعَةِ مَمْحَقَةٌ لِلبَرَكَةِ، ‘মিথ্যা কসমে পণ্য বেশী বিক্রি হয়, কিন্তু বরকত ধ্বংস করে’।[4]

৪. সূদের আদান-প্রদান করা : সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মানুষ সূদ গ্রহণ করে। অথচ সূদের আদান-প্রদানে জীবিকার বরকত দূর হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,وَمَا آتَيْتُمْ مِنْ رِبًا لِيَرْبُوَ فِيْ أَمْوَالِ النَّاسِ فَلاَ يَرْبُو عِنْدَ اللهِ وَمَا آتَيْتُمْ مِنْ زَكَاةٍ تُرِيْدُوْنَ وَجْهَ اللهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُوْنَ- ‘লোকদের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে মনে করে তোমরা যে সূদ প্রদান করে থাক, আল্লাহর নিকটে তা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না। পক্ষান্তরে (জান্নাতে) আল্লাহর চেহারা অন্বেষণে তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক, তারা বহুগুণ লাভ করে থাকে’ (রূম ৩০/৩৯)। তিনি আরো বলেন,يَمْحَقُ اللهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيْمٍ، ‘আল্লাহ সূদকে নিঃশেষ করেন ও ছাদাক্বায় প্রবৃদ্ধি দান করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ কোন অবিশ্বাসী পাপীকে পসন্দ করেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৭৬)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,الرِّبَا وَإِنْ كَثُرَ فَإِنَّ عَاقِبَتَهُ تَصِيْرُ إِلَى قُلٍّ،  ‘সূদ যতই বৃদ্ধি পাক, তার পরিণতি হ’ল নিঃস্বতা’।[5]

৫. অংশীদারদের সাথে মিথ্যা বলা ও খেয়ানত করা : যৌথ ব্যবসায়ে অংশীদারদের সাথে মিথ্যা বলা এবং তাদের সাথে প্রতারণা করা ও আমানতের খেয়ানত করা বরকত দূরীভূত হওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু মানুষ নগদ লাভের বিবেচনায় অংশীদারকে ঠকিয়ে নিজে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে। অথচ পরিণামে সে নিজের অকল্যাণ ডেকে আনে।

৬. নে‘মতের শুকরিয়া আদায় না করা : মহান আল্লাহ তাঁর অশেষ নে‘মত দ্বারা আমাদের চতুর্দিক ঘিরে রেখেছেন। রিযিক তাঁর অন্যতম নে‘মত। এসব নে‘মতের শুকরিয়া আদায় না করলে বরকত ও কল্যাণ লাভ করা যায় না। আল্লাহ বলেন,لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيْدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيْدٌ، ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তাহ’লে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে বেশী বেশী করে দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহ’লে (মনে রেখ) নিশ্চয়ই আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর’ (ইবরাহীম ১৪/৭)। তিনি আরো বলেন,وَضَرَبَ اللهُ مَثَلًا قَرْيَةً كَانَتْ آمِنَةً مُطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللهِ فَأَذَاقَهَا اللهُ لِبَاسَ الْجُوْعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُوْا يَصْنَعُوْنَ- ‘আল্লাহ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন একটি জনপদের, যা ছিল নিরাপদ ও শান্ত। যেখানে প্রত্যেক স্থান থেকে আসত প্রচুর জীবনোপকরণ। অতঃপর তারা আল্লাহর নে‘মত সমূহের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। তখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ ক্ষুধা ও ভীতির স্বাদ আস্বাদন করালেন’ (নাহল ১৬/১১২)

৭. দুনিয়ার প্রতি সীমাহীন লোভ : পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট। তারা দুনিয়াকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। তারা কেবল দুনিয়ার জন্য কাজ করে। দুনিয়াকে কেন্দ্র করেই তাদের সার্বিক চিন্তা-ভাবনা। পরকালের বিষয়ে তাদের কোন চিন্তা-চেতনা নেই। পার্থিব সম্পদের প্রতি তাদের লোভ অপরিসীম। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ هَذَا الْمَالَ خَضِرَةٌ حُلْوَةٌ، فَمَنْ أَخَذَهُ بِسَخَاوَةِ نَفْسٍ بُوْرِكَ لَهُ فِيْهِ، وَمَنْ أَخَذَهُ بِإِشْرَافِ نَفْسٍ لَمْ يُبَارَكْ لَهُ فِيْهِ كَالَّذِى يَأْكُلُ وَلاَ يَشْبَعُ، ‘এই সম্পদ শ্যামল সুমিষ্ট। যে ব্যক্তি প্রশস্ত অন্তরে (লোভ ব্যতীত) তা গ্রহণ করে তার জন্য তা বরকতময় হয়। আর যে ব্যক্তি অন্তরের লোভসহ তা গ্রহণ করে তার জন্য তা বরকতময় করা হয় না। যেন সে এমন ব্যক্তির মত, যে খায় কিন্তু তার ক্ষুধা মেটে না’।[6] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ أَكْثَرَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ مَا يُخْرِجُ اللهُ لَكُمْ مِنْ بَرَكَاتِ الأَرْضِ. قِيلَ وَمَا بَرَكَاتُ الأَرْضِ قَالَ زَهْرَةُ الدُّنْيَا. ‘আমি তোমাদের জন্য এ ব্যাপারেই সর্বাধিক আশংকা করছি যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য যমীনের বরকতসমূহ প্রকাশিত করে দিবেন। জিজ্ঞেস করা হ’ল, যমীনের বরকতসমূহ কী? তিনি বললেন, দুনিয়ার চাকচিক্য’।[7] সুতরাং দুনিয়ার প্রতি সীমাহীন লোভে সম্পদের বরকত দূর হয়ে যায়।

৮. কৃপণতা ও ব্যয়কুণ্ঠতা : কৃপণতা মানুষকে পাপাচারে লিপ্ত করে। যা ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ। নবী করীম (ছাঃ) বলেন,إِيَّاكُمْ وَالشُّحَّ فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِالشُّحِّ أَمَرَهُمْ بِالْبُخْلِ فَبَخَلُوْا وَأَمَرَهُمْ بِالْقَطِيْعَةِ فَقَطَعُوْا وَأَمَرَهُمْ بِالْفُجُوْرِ فَفَجَرُوْا- ‘তোমরা কৃপণতার ব্যাপারে সাবধান হও। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা কৃপণতার কারণে ধ্বংস হয়েছে। অর্থলোভ তাদেরকে কৃপণতার নির্দেশ দিয়েছে, ফলে তারা কৃপণতা করেছে। তাদেরকে আত্মীয়তা ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছে, তখন তারা তাই করেছে এবং তাদেরকে পাপাচারে প্ররোচিত করেছে, তখন তারা তাতে লিপ্ত হয়েছে’।[8]

কৃপণতা ও ব্যয়কুণ্ঠতার কারণে ফেরেশতাগণ বদদো‘আ করে থাকেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَا مِنْ يَوْمٍ يُصْبِحُ العِبَادُ فِيْهِ، إِلَّا مَلَكَانِ يَنْزِلاَنِ، فَيَقُوْلُ أَحَدُهُمَا: اللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا، وَيَقُوْلُ الآخَرُ: اللَّهُمَّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا- ‘প্রতিদিন বান্দা যখন সকাল করে দু’জন ফিরিশতা অবতরণ করেন। তাঁদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের উত্তম প্রতিদান দিন আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন’।[9]

৯. প্রাপ্ত রিযক ও তাক্বদীরের প্রতি সন্তুষ্ট না থাকা : আল্লাহ বান্দাদের জন্য রিযক বণ্টন করে থাকেন। মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত রিযকের প্রতি সন্তুষ্ট থাকলে তার জীবিকায় বরকত লাভ হয়। পক্ষান্তরে ঐ রিযকের উপরে সন্তুষ্ট না হ’লে জীবিকার বরকত চলে যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَنَّ اللهَ يَبْتَلِي عَبْدَهُ بِمَا أَعْطَاهُ، فَمَنْ رَضِيَ بِمَا قَسَمَ اللهُ لَهُ، بَارَكَ اللهُ لَهُ فِيْهِ، وَوَسَّعَهُ، وَمَنْ لَمْ يَرْضَ لَمْ يُبَارِكْ لَهُ- ‘আল্লাহ বান্দাকে প্রদত্ত জিনিসের মাধ্যমে পরীক্ষা করে থাকেন। আল্লাহ তার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, তাতে যদি সে সন্তুষ্ট থাকে, তাহ’লে আল্লাহ তাতে বরকত দান করেন এবং তাকে বৃদ্ধি করে দেন। আর যদি সন্তুষ্ট না থাকে তাহ’লে তাতে বরকত দেন না’।[10]

১০. অপচয় ও অপব্যয় : বাজে কাজে বা অপ্রয়োজনে খরচ করা হচ্ছে অপব্যয়। এটা মানুষের এক নিন্দনীয় স্বভাব, যার কারণে তার মধ্যে চৌর্যবৃত্তি, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ, উৎকোচ গ্রহণ ইত্যাদি দুশ্চরিত্রতা বিস্তার লাভ করে। এজন্য ইসলাম এত্থেকে নিষেধ করেছে। আল্লাহ বলেন,وَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا وَلَا تُسْرِفُوْا إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُسْرِفِيْنَ- ‘তোমরা খাও ও পান কর। কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালবাসেন না’ (আ‘রাফ ৭/৩১)। তিনি আরো বলেন,وَالَّذِيْنَ إِذَا أَنْفَقُوْا لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يَقْتُرُوْا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا- ‘তারা যখন ব্যয় করে, তখন অপব্যয় করে না বা কৃপণতা করে না। বরং তারা এতদুভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থায় থাকে’ (ফুরক্বান ২৫/৬৭)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا، إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُوْرًا- ‘আর তুমি মোটেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় কৃতজ্ঞ’ (ইসরা ১৭/২৬-২৭)

রাসূল (ছাঃ) বলেন,كُلُوْا وَاشْرَبُوا وَالْبَسُوْا وَتَصَدَّقُوْا، فِىْ غَيْرِ إِسْرَافٍ وَلاَ مَخِيلَةٍ، ‘তোমরা খাও, পান কর, পরিধান কর এবং দান কর, তবে অপচয় ও অহংকার পরিহার করে’।[11] ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,كُلْ مَا شِئْتَ وَالْبَسْ مَا شِئْتَ، مَا أَخْطَأَتْكَ اثْنَتَانِ سَرَفٌ أَوْ مَخِيلَةٌ، ‘যা ইচ্ছা খাও, যা ইচ্ছা পরিধান কর, যতক্ষণ না দু’টো জিনিস তোমাকে বিভ্রান্ত করে- অপব্যয় ও অহংকার’।[12] সুতরাং আয়-ব্যয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে পরিমিত খরচ করাই ইসলামের শিক্ষা। পক্ষান্তরে অপচয় ও অপব্যয় করলে সম্পদের বরকত দূর হয়ে যায়।

১১. পরশ্রীকাতরতা : সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে যারা পরের ভাল দেখতে পারে না। অন্যের কল্যাণে চোখ জ্বালা করা হচ্ছে পরশ্রীকাতরতার নিদর্শন। যাদের মধ্যে এ স্বভাব থাকে তারা কখনও মানসিক শান্তি ও স্বস্তি লাভ করতে পারে না। বরং অন্যের উন্নতি দেখে নিজে জ্বলে-পুড়ে মরে। সাহল ইবনে সা‘দ আস-সাঈদী (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল,دُلَّنِى عَلَى عَمَلٍ إِذَا أَنَا عَمِلْتُهُ أَحَبَّنِىَ اللهُ وَأَحَبَّنِىَ النَّاسُ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ازْهَدْ فِى الدُّنْيَا يُحِبَّكَ اللهُ، وَازْهَدْ فِيمَا فِى أَيْدِى النَّاسِ يُحِبُّوْكَ النَّاسُ- ‘আমাকে এমন একটি কাজের কথা বলে দিন, যা করলে আল্লাহ আমাকে ভালবাসবেন এবং লোকেরাও আমাকে ভালবাসবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তুমি দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি অবলন্বন করো। তাহ’লে আল্লাহ তোমাকে ভালবাসবেন। মানুষের নিকট যা আছে, তুমি তার প্রতি অনাসক্ত হও, তাহ’লে মানুষও তোমাকে ভালবাসবে’।[13]

১২. যাকাত প্রদান না করা : যাকাত আদায় করা ফরয। অনেকে এটা জানা সত্ত্বেও তা আদায় করে না। ফলে ইহকালীন ও পরকালীন আযাব-গযব আপতিত হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَلَمْ يَمْنَعُوْا زَكَاةَ أَمْوَالِهِمْ إِلاَّ مُنِعُوا الْقَطْرَ مِنَ السَّمَاءِ وَلَوْلاَ الْبَهَائِمُ لَمْ يُمْطَرُوْا- ‘যখন কোন জাতি যাকাত আদায় করে না তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে চতুস্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকত তাহ’লে আর কখনো বৃষ্টিপাত হ’ত না’।[14] অন্যত্র তিনি বলেন,مَا مَنَعَ قَوْمٌ الزَّكَاةَ إِلاَّ ابْتَلَاهُمُ اللهُ بِالسِّنِيْنَ، ‘যখনই কোন সম্প্রদায় যাকাত প্রদানে বিরত থাকে, আল্লাহ তাদেরকে দুর্ভিক্ষে নিপতিত করেন’।[15] সম্পদের হক হচ্ছে যাকাত প্রদান করা। এ হক প্রদান করলে সম্পদে বরকত হয় অন্যথা বরকত দূরীভূত হয়ে যায়।

১৩. অন্যায় পথে সম্পদ আহরণ করা : হারাম উপায়ে সম্পদ অর্জন করলে তার বকরত দূরীভূত হয়ে যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,فَمَنْ يَأْخُذْ مَالاً بِحَقِّهِ يُبَارَكْ لَهُ فِيهِ وَمَنْ يَأْخُذْ مَالاً بِغَيْرِ حَقِّهِ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ الَّذِى يَأْكُلُ وَلاَ يَشْبَعُ ‘যে ব্যক্তি সঙ্গত পন্থায় সম্পদ অর্জন করে তাকে বরকত দান করা হয়। আর যে ব্যক্তি অসঙ্গত পন্থায় সম্পদ অর্জন করে সে এমন ব্যক্তির ন্যায় যে আহার করে কিন্তু তৃপ্ত হয় না’।[16]

উপসংহার : জীবিকায় বরকত বৃদ্ধি এবং অব্যাহত থাকার জন্য উপরোক্ত কাজগুলি পরিহার করা যরূরী। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রিযক ও সম্পদে বরকত লাভের জন্য উক্ত ত্রুটিগুলি পরিহার করার তওফীক দান করুন-আমীন!


[1]. বুখারী হা/১৪৭২; মুসলিম হা/১০৩৫।  

[2]. বুখারী হা/২০৭৯. ২০৮২, ২১০৮, ২১১০, ২১১৪; মুসলিম ২১/১০, হা/১৫৩২; মিশকাত হা/২৮০২।  

[3]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৭৯৩।  

[4]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৭৯৪।

[5]. ইবনু মাজাহ হা/২২৭৯; আহমাদ, হাকেম, মিশকাত হা/২৮২৭।

[6]. বুখারী হা/১৪৭২; মুসলিম হা/১০৩৫।  

[7]. বুখারী হা/৬৪২৭; মুসলিম হা/১০৫২।

[8]. আবু দাউদ হা/১৬৯৮; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪৭০, সনদ ছহীহ।  

[9]. বুখারী হা/১৪৪২; মুসলিম হা/১০১০।  

[10]. আহমাদ হা/২০২৭৯; ছহীহুল জামে হা/১৮৬৯।  

[11]. বুখারী তরজমাতুল বাব, পরিচ্ছেদ ২৩৩০; ইবনু মাজাহ হা/৩৬০৫; মিশকাত হা/৪৩৮১।  

[12]. বুখারী তরজমাতুল বাব, পরিচ্ছেদ ২৩৩০।  

[13]. ইবনু মাজাহ হা/৪১০২; ছহীহাহ হা/৯৪৪; ছহীহুত তারগীব হা/৩২১৩।  

[14]. ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯; ছহীহাহ হা/৪০০৯; ছহীহুত তারগীব হা/১৭৬১।  

[15]. তাবারণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৪৫৭৭; ছহীহুত তারগীব হা/৭৬৩; ছহীহাহ হা/১০৭-এর অধীনে।

[16]. মুসলিম হা/১০৫২; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯৫।






ইসলামের দৃষ্টিতে মজুদদারী - ড. নূরুল ইসলাম
মাহে রামাযানের পূর্ব প্রস্ত্ততি - আব্দুল মুহাইমিন, ইসলামের ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী কলেজ
ইসলামের দৃষ্টিতে মজুদদারী (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. নূরুল ইসলাম
দুর্নীতি ও ঘুষ : কারণ ও প্রতিকার (পূর্ব প্রকাশিতের) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ইসলামী ব্যাংকিং-এর অগ্রগতি : সমস্যা ও সম্ভাবনা (পূর্বে প্রকাশিতের পর) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ঘুষের ভয়াবহ পরিণতি - আব্দুল মান্নান, সৈয়দপুর, নীলফামারী।
ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা - ড. মুহাম্মাদ আজিবার রহমান
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: ইসলামী দৃষ্টিকোণ - ড. নূরুল ইসলাম
ইসলামী দৃষ্টিকোণে ই-কমার্স : একটি পর্যালোচনা - আব্দুল্লাহ আল-মুছাদ্দিক
বাংলাদেশের দারিদ্র্য সমস্যা : কারণ ও প্রতিকার - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : ইসলামী দৃষ্টিকোণ (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. নূরুল ইসলাম
পণ্যে ভেজাল প্রদান : ইসলামী দৃষ্টিকোণ - ড. নূরুল ইসলাম
আরও
আরও
.