বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক বা নির্দেশমূলক এবং মিশ্রঅর্থনীতি দেশের উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি করেছে। প্রচলিত অর্থব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হ’ল- দারিদ্র্য বিমোচনপূর্বক সর্বাধিক আর্থ-সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। কিন্তু এর বাস্তবতা তার সম্পূর্ণ বিপরীত আর তত্ত্বটি গলদপূর্ণ। পক্ষান্তরে ইসলামী অর্থব্যবস্থা একটি শাশ্বত ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার নাম। এ অর্থব্যবস্থায় উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগ কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। যাকাত ইসলামী রাষ্ট্রে সরকারী আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। গবাদী পশু, স্বর্ণ ও রৌপ্য, ব্যবসায়ী পণ্য, উৎপন্ন ফসল, নগদ অর্থ ও মওজুদ সম্পদ এর ইসলামী বিধি অনুযায়ী নিছাবের ভিত্তিতে যাকাত আদায় করা ফরয। অর্জিত এ যাকাতের অর্থ আল্লাহ আটটি খাতে ব্যয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। যাকাত প্রদানের ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনীতির বুনিয়াদ সুদৃঢ় হয়। দারিদ্র্য বিমোচন, আয় বৈষম্য হ্রাস, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন, উৎপাদন ও ভোগ বৃদ্ধি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীল কর্মকান্ডে সহায়তা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বণ্টন ব্যবস্থার উন্নতি ও সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়া রোধ করে। সেই সাথে ঋণমুক্তি, মৌলিক চাহিদা পূরণ, সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, সামাজিক নিরাপত্তা, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ বাস্তবায়ন, সৌহার্দ্য ও ঐক্যবোধ সৃষ্টি এবং সর্বাধিক সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করে। অপরদিকে প্রচলিত অর্থব্যবস্থা সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন করে না বিধায় সমাজে হ’ত দরিদ্র্য, নিমণ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম দেয়। একশ্রেণীর লোকের হাতে দেশের সম্পদ কুক্ষিগত হয়। তাদের নির্দেশিত অর্থব্যবস্থা সর্বদা দারিদ্রে্যর দুষ্টচক্রে আবদ্ধ অবস্থায় থাকে।

ইসলামী অর্থব্যবস্থায় যাকাত আদায় এবং গ্রহণের ফলে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয়। যাকাত প্রদানকারীর সম্পদ কমে না বরং বৃদ্ধি পায়, আর যাকাত গ্রহণকারীরা তাদের ন্যায্য প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। এতে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সমতা বিরাজ করে। একমাত্র সর্বোত্তম তথা ইসলামী অর্থব্যবস্থাই সক্ষম মানব সমাজে প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে মিলেমিশে বসবাস করে একটি সুন্দর পৃথিবী আবাদযোগ্য করতে।

যাকাত ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম এবং ইসলামী অর্থব্যবস্থার প্রধান ভিত্তি। যাকাত শব্দটি গুরুত্বের দিক থেকে কুরআনে প্রত্যক্ষভাবে ৩২ বার উল্লেখিত হয়েছে। এর মধ্যে ছালাত ও যাকাতের কথা একত্রে এসেছে ২৮ বার। ফুয়াদ আব্দুল বাকী বর্ণনা করেছেন, কুরআনে মোট ১৯টি সূরায় ২৯টি আয়াতে যাকাত শব্দটির উল্লেখ দেখা যায়।[1] যাকাত ছাড়া ইসলামী আদর্শে রাষ্ট্র পরিচালনা কখনো সম্ভব নয়। ব্যক্তি জীবনে যাকাত যেমন প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়ও তার বিকল্প নেই। আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও’ (বাক্বারাহ ২/৪৩, ৮৩, ১১০, ২৭৭; নিসা ৪/৭৭, ১৬২; নূর ২৪/৫৬; আহযাব ৩৩/৩৩; মুয্যাম্মিল ২০)। আধুনিক যুগে প্রত্যেক রাষ্ট্রের একমাত্র লক্ষ্য হ’ল কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বাস্তব জগতে হয় ঠিক তার উল্টো। কেননা, রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অর্থনীতিবিদগণ যেসব অর্থনীতির নিয়মাবলী বা বিধিমালা প্রদান করেছেন তা স্থির নয়, বরং কতগুলো শর্তের উপর নির্ভরশীল। এ অস্থির অর্থনীতির নিয়ম-কানূন দেশে সার্বিকভাবে স্থিতিশীল কোন সমাধান দিতে পারে না। আর ইসলামী বিধি-নিষেধ সম্পূর্ণভাবে ঐশ্বরিক। এর নিয়ম অনুযায়ী ইসলামী অর্থব্যবস্থা পরিচালিত হ’লে রাষ্ট্রে কোন প্রকার আর্থিক সমস্যা থাকবে না।

প্রচলিত অর্থব্যবস্থা জন্ম দেয়- সম্পদের বৈষম্য, শ্রমিক শোষণ, সামাজিক অকল্যাণ, শ্রমিক-মালিক সংঘর্ষ, অপরিকল্পিত উৎপাদন, বেকার সমস্যা ও সূদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। কিন্তু ইসলামী অর্থব্যবস্থায় এসবের ভিত্তি নেই, যা রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে। বর্তমানকালে অর্থনীতিকে বিজ্ঞানরূপে কেবল তার তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক দিক আলোচনা করে, নৈতিক দিক আলোচনা করে না। ফলে অর্থনীতিতে ভোগের প্রাধান্য পায় ঠিকই- তবে নিরন্ন ও অসহায় মানুষের কথা আলোচনায় আসে না। সম্পদ কুক্ষিগত করার যাবতীয় কৌশলের কথা বিশ্লেষিত হয় কিন্তু সদাচরণ, নৈতিক মূল্যবোধ, বিত্তহীনদের কথা আলোচনা হয় না। সম্পদই যেন মূখ্য, মানুষ নয়। কিন্তু ইসলাম সমষ্টিগত কল্যাণ চায়, কোন গোষ্ঠীর নয়। আধুনিক অর্থনীতির দর্শনে মূল্যবোধ বিবেচিত হয় না এবং ইহজগত ও পরজগতের দৃষ্টিকোণ থেকে সামগ্রিক কল্যাণের মূল লক্ষ্যও বিবেচিত হয় না।[2] ইসলামী অর্থনীতিতে যাকাতের মাধ্যমে দরিদ্র ও অসহায় লোকেরা অর্থ ব্যয়ের সামর্থ্য ছাড়াও প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী ভোগ করতে পারে। একমাত্র যাকাত দ্বারা উৎপাদন, ভোগ এবং বণ্টন ব্যবস্থায় সর্বাধিক সামষ্টিক কল্যাণ সাধন করা যায়।

প্রচলিত অর্থনীতির ধারণা মতে, বিনিময় মূল্য আছে এমন বস্ত্তর উপযোগ বা কাম্যতা সৃষ্টি করাকে উৎপাদন বলা হয়। এ অর্থে মদ, গাজা, ভাং, আফিম, হিরোইন প্রভৃভি দ্রব্যগুলোর অভাব পূরণের ক্ষমতা আছে। পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক (Capitalistic), সমাজতান্ত্রিক বা নির্দেশমূলক (Socialistic or Command) এবং মিশ্র (Mixed) অর্থব্যবস্থায় এ সমস্ত দ্রব্যগুলোকে ‘অর্থনৈতিক দ্রব্য’ বা সম্পদ বলে অভিহিত করেছে। কিন্তু ইসলামী অর্থব্যবস্থায় এগুলো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও পরিত্যাজ্য। স্রষ্টা মানুষ সৃষ্টি করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য একটি বিশেষ মূলনীতি বেঁধে দিয়েছেন। যে পথে চললে কখনো বিপদগামী হবে না। সম্পদ এবং তার ব্যবহার, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক, বাজার ব্যবস্থা পরিচালনা, উৎপাদন এবং তার মূল্য নির্ধারণ, দরিদ্রদের প্রতি ধনীদের অর্থনৈতিক দায়, হালাল ও হারামের বিধান, সামাজিক নিরাপত্তা, সূদমুক্ত অর্থনীতি, উত্তরাধিকার আইন, অপচয় হ্রাস, অপব্যয় এবং বিলাসিতার নিন্দা, সম্পদের সুষম বন্টন, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা, যাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন, মৌলিক প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা, রাষ্ট্রীয় কোষাগার পরিচালনা প্রভৃতি বিষয়ে ইসলামী অর্থনীতি স্পষ্ট মতামত দিয়েছে। ইসলাম ন্যায়শাস্ত্রের সাথে অর্থনীতিকে সম্পৃক্ত করে একটি কল্যাণকর শাস্ত্র হিসাবে অর্থনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে যাকাত-এর ভূমিকা :

ইসলামী অর্থনীতিতে উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে এমন কতিপয় উপায় রয়েছে, যা আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন ঘটাতে সহায়তা করে। যাকাতের মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য সম্পূর্ণভাবে দূরীভূত করা সম্ভব হয়। পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মে দান করা পুণ্যের কাজ। অথচ সেখানে দানের কোন মানদন্ড বা পরিসীমা বিবেচনা করা হয়নি। ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা গাণিতিক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে সঞ্চিত সম্পদের উপরে যাকাত নির্ধারণ করেছে।[3] একটি ইসলামী রাষ্ট্রে উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে যাকাত ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। নিমেণ তা ব্যাখ্যা করা হ’ল:

উৎপাদন ক্ষেত্রে যাকাতের প্রভাব :

আল্লাহ্ বলেন, ‘যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের ন্যায়। যা থেকে সাতটি শীষ জন্মে। প্রত্যেকটি শীষে একশ’টি দানা থাকে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন বহুগুণ বর্ধিত করে দেন। আর আল্লাহ প্রশস্ত দানশীল ও সর্বজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/২৬১)। অন্যত্র বর্ণিত আছে, ‘আল্লাহ সূদকে নিঃশেষ করেন ও ছাদাক্বায় প্রবৃদ্ধি দান করেন’ (বাক্বারাহ ২/২৭৬)। ধর্মীয় জীবন দর্শনেই মানুষের সামগ্রিকভাবে সফলতা আসে। আগামী ৫০ বছরের উন্নতি সমৃদ্ধি কোন ধরনের গবেষণার ওপর নির্ভরশীল এমন এক প্রশ্নের উত্তরে ড. চার্লস ষ্টেইনমেজ (Dr. Charles Stinmetz) বলেন, ‘‘I think that the greatest discoveries will be made along spiritual times. Some day People will learn that material things do not bring happiness and are of little use in making men and women creative and powerful. Then the Scientist of the world will turn their laboratories over to the study of god and the spiritual forces which as yet have been hardly scratched. When that they comes, the world will see more advancement in one generation in has the last four.”[4] ‘আমি মনে করি, সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হবে আধ্যাত্মিকতার পথ ধরে। একদিন মানুষ বুঝতে পারবে যে, বস্ত্তগত জিনিস মানুষের সুখ-শান্তি আনে না এবং এগুলো নর-নারীকে সৃজনশীল ও ক্ষমতাশালী করতে খুব কমই কাজে আসে। তখন বিশ্বের বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণাগারগুলোকে আল্লাহ্, প্রার্থনা ও আধ্যাত্মিক চেতনার দিকে ঘুরিয়ে নেবে, যার সম্পর্কে বর্তমানে খুব কমই আলোচিত হয়। তখন বিশ্ব এক প্রজন্মে অনেক সমৃদ্ধি দেখবে, যা বিগত চার প্রজন্ম দেখেনি’।

সামষ্টিক অর্থনীতির জনক এবং বিশিষ্ট পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ লর্ড কেইন্স বলেন, ‘পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ধনীরা কম ভোগ করে। অপরদিকে, গরীব শ্রেণীর কাছে ভোগ করার মতো অর্থ না থাকায় তারা ভোগ করতে পারে না। ফলে সামগ্রিক চাহিদা কম হয়। এর ফলশ্রুতিতে বিনিয়োগ কম হয়, নিয়োগ কম হয় এবং জাতীয় আয়ও কম হয়’।[5] যাকাত অর্থনীতির এরূপ বন্ধাবস্থাকে উদ্ধার করতে সক্ষম। যাকাত প্রাপ্তির ফলে গরীব শ্রেণীর লোকদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। ফলে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদার পরিমাণও বাড়ে। আর বিনিয়োগকারীরা অধিত মুনাফার আশায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। বিশিষ্ট ইসলামী অর্থনীতিবিদ ড. ওমর চাপড়ার মতে, ‘যাকাত অলস সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে, যা ধনাত্মক প্রবৃদ্ধির প্রভাব সৃষ্টি করে’।[6] বিশিষ্ট ইসলামী অর্থনীতিবিদ ড. এম.এ. মান্নান মনে করেন, যাকাত সম্পদ পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে ভোগে স্থানান্তর করে এবং সামগ্রিক চাহিদা বাড়ায়। যাকাতের ফলে অলস অর্থ উৎপাদনের কাজে আসে।[7] তাই উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা[8] ডান দিকে স্থানান্তরিত হয়। যাকাতের মাধ্যমে ধনীদের জন্য বিলাসজাত সামগ্রী উৎপাদনের তুলনায় গরীবের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনে সম্পদ বেশী নিয়োজিত হয়। তাছাড়া ধনী লোকেরা ভোগের জন্য আয়ের এক অংশ ব্যয় করে আর গরীবেরা ভোগের জন্য আয়ের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ ব্যয় করে থাকে। আল্লাহ বলেছেন, ‘লোকদের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে মনে করে তোমরা যে সূদ প্রদান করে থাক, আল্লাহর নিকটে তা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না। পক্ষান্তরে (জান্নাতে) আল্লাহর চেহারা অন্বেষণে তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক, তারা বহুগুণ লাভ করে থাকে’ (রূম ৩০/৩৯)। সুতরাং যাকাত উৎপাদনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

নিম্নে চিত্রের মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হ’ল:

উপরের চিত্রে ভূমি অক্ষে প্রকৃত জাতীয় আয় এবং লম্ব অক্ষে ভোগ ও বিনিয়োগ নির্দেশ করা হয়েছে। OA হচ্ছে 45° রেখা। যাকাত প্রাপ্তির পূর্বে ভোগ রেখা C1 এবং সামগ্রিক চাহিদা (AD) রেখা C1+I0। যাকাত প্রাপ্তির ফলে গরীব শ্রেণীর ভোগ রেখা পরিবর্তিত হয়ে C2 এবং সামগ্রিক চাহিদা (AD) রেখা C2+I0 হয়েছে। চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে, যাকাত প্রাপ্তির ফলে ভোগ ও বিনিয়োগ যেমন বেড়েছে, একই সাথে প্রকৃত জাতীয় আয় OY1 থেকে বৃদ্ধি পেয়ে OY2 হয়েছে। অর্থাৎ Y1 থেকে Y2 পরিমাণ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।

বণ্টনের ক্ষেত্রে যাকাতের প্রভাব :

রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় ও বণ্টনের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে ইঙ্গিত রয়েছে। সকল ইসলামী অর্থনীতিবিদ একথা স্বীকার করেছেন যে, যাকাত যদি যথাযথভাবে আদায় ও বণ্টন হয় তবে তা বর্তমানে বিদ্যমান আয় ও ধনবণ্টন বৈষম্য দূরীকরণে সক্ষম হবে। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক আল-তাহির দশ বছর মেয়াদের তথ্য ব্যবহার করে ধনী ও গরীবের মধ্যে আয়ের পার্থক্যে যাকাতের প্রভাব নির্ধারণের জন্য একটি সরল তুলনাধর্মী স্থির অবস্থা নির্মাণ করেন। তাঁর গৃহীত অনুমিতির ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আয়ের পার্থক্যে ৯ হ’তে ৬.৫ গুণ হ্রাস পায়। অন্য একজন গবেষক ড. আনাস জারকা দেখিয়েছেন যে, যাকাত প্রতি বছর সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র ১০% জনগণের আয়কে দ্বিগুণ করে দেয়। কারণ এ অর্থের প্রায় পুরোটাই ধনীদের কাছ থেকে এসেছে এবং দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।[9]

যাকাত কিভাবে সমাজের আয় বৈষম্য হ্রাস করে তা একটি কাল্পনিক তালিকায় দেখানো হ’ল :

ব্যক্তির নাম

                    সঞ্চয়

যাকাতের হার

  যাকাতের       পরিমাণ

যাকাত দানের পর সঞ্চয়

৫,০০,০০০/-

২.৫%

১২,৫০০/-

৪,৮৭,৫০০/-

১৫,০০,০০০/-

২.৫%

৩৭,৫০০/-

১৪,৬২,৫০০/-

২৫,০০,০০০/-

২.৫%

৬২,৫০০/-

২৪,৩৭,৫০০/-

৩৫,০০,০০০/-

২.৫%

৮৭,৫০০/-

৩৪,১২,৫০০/-

৪৫,০০,০০০/-

২.৫%

১,১২,৫০০/-

৪৩,৮৭,৫০০/-

৫৫,০০,০০০/-

২.৫%

১,৩৭,৫০০/-

৫৩,৬২,৫০০/-

উপরোক্ত তালিকায় দেখা যচ্ছে যে, ৬ জন ব্যক্তির কাছ থেকে মোট আদায়কৃত যাকাতের পরিমাণ ৪,৫০,০০০ টাকা। এ দেশে ১০০ জনেরও কম ব্যক্তি বছরে ১ কোটি টাকা বা তদুর্ধ্ব ব্যক্তিগত যাকাত প্রদান করেন। আমাদের হিসাবে বছরে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা বা তদুর্ধ্ব ব্যক্তিগত যাকাত দেয়ার যোগ্য মানুষের সংখ্যা হবেন কমপক্ষে ৫০,০০০ জন।[10] এভাবে ধনী লোকদের থেকে আদায়কৃত যাকাত গরীবদের মধ্যে বিতরণ করা হ’লে তাদের আয় বৃদ্ধি পাবে। ফলে সমাজে আয় বৈষম্য ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। এভাবে ক্রমাগত আয় বৈষম্য হ্রাস পেতে পেতে তা ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে আসবে। সর্বোপরি দারিদ্র বিমোচন হবে এবং দেশের আর্থ-সামাজিক কল্যাণ হবে।

ভোগের ক্ষেত্রে যাকাতের ভূমিকা :

ইসলামী অর্থনীতিতে ভোগের ক্ষেত্রে যাকাত কতিপয় সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। যাকাত গরীবের মাঝে ভোগের জন্য ব্যয় করা হ’লে গরীবের ভোগের সুযোগ বৃদ্ধি পায়। ফলে ভোগ প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়। অর্থনীতির বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ধনীদের তুলনায় গরীবদের প্রান্তিক ভোগ প্রবণতা (MPC)[11] বেশ উঁচু। বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ মুসলিম দেশে গরীবদের সংখ্যাই বেশী। যাকাত যেহেতু ধনীদের থেকে দরিদ্রদের কাছে হস্তান্তরিত আয়, সেহেতু এ বিষয়ের তাৎপর্য হ’ল- অর্থনীতিতে এ ধরনের ব্যয়ের ফলে সামাজিক ভোগব্যয় বহুগুণ বেড়ে যায়। এসব দেশে ভোগ প্রবণতা নিঃসন্দেহে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে অনুকূল প্রভাব বিস্তার করবে।[12]

যাকাত কিভাবে ভোগব্যয় বৃদ্ধি করে নিমেণ তা চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হ’ল :

উপরের চিত্রে OX অক্ষে আয় এবং OY অক্ষে ভোগ দেখানো হয়েছে। OA হচ্ছে 45° রেখা। যাকাত প্রাপ্তির পূর্বে ভোগ রেখা C0 এবং ভোগের পরিমাণ OC1। যাকাত প্রাপ্তির পর ভোগ রেখা C0+Z এবং ভোগের পরিমাণ OC2 হয়েছে। চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে, ভোগের পরিমাণ C1 থেকে C2 বৃদ্ধি পেয়েছে।

উপসংহার :

উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে যাকাত অতীব গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণধর্মী ভূমিকা পালন করে থাকে। যাকাত প্রাপ্তির ফলে গরীবের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ফলে ভোগব্যয় বাড়ে। ভোগব্যয়ের অবশিষ্ট অংশ সঞ্চয় হয়। এ সঞ্চয় মূলধন[13] গঠন করে, মূলধন বিনিয়োগ সৃষ্টি করে। বিনিয়োগ উৎপাদন সৃষ্টি করে, উৎপাদন আয় সৃষ্টি করে, এ আয় থেকে পুনরায় দরিদ্রদের যাকাত প্রাপ্তি হয়। এভাবে চক্রাকারে যাকাত প্রাপ্তির ফলে ক্রমান্বয়ে আয় বৈষম্য দূরীভূত হবে এবং ধনী-গরীবেব ব্যবধান কমে আসবে। বিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ আব্দালাতি বলেন, ‘‘Zakat mitjigates to a minimum the suffering of the ready and poor members of Society. It is a most comforting consltion to the les fortunate People. Yet it is a loud appealto

everybody to rool up his sulves and improve his lot.[14] অর্থাৎ যাকাত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুঃখ-কষ্ট নিবারণ করে। এটি অভাবীদের জন্য শান্তি ও ভাগ্যোন্নয়নের শ্রেষ্ঠ উপায়। দুস্থ অভাবগ্রস্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে যাকাতই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। যাকাত উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হ’লে, গরীব জনগণের ভাগ্যের চাকা যেমন ঘুরবে তেমনি সরকারের রাজস্ব ফান্ড সমৃদ্ধ হবে এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পরিধি হবে আরো বিস্তৃত। তবেই ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি দিতে পারে একটি সুন্দর, সুস্থ, সুষ্ঠু ও দীর্ঘস্থায়ী কল্যাণধর্মী শান্তি-শৃঙ্খলার সর্বোত্তম আর্থিক ব্যবস্থা।

বিকাশ কান্তি দে

প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, কক্সবাজার সিটি কলেজ, কক্সবাজার।


[1]. ফুয়াদ আবদুল বাকী, আল-মু‘জামূল মুফাহরাস লি আলফাযিল কুরআনিল কারীম (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৯৮৮খ্রী.), পৃ. ৪২০-৪২১।

[2]. হাওলাদার আবদুর রাজ্জাক, অর্থশাস্ত্রের কথা, পৃ. ৪৭।

[3]. অধ্যক্ষ মো. নাজমুল হুদা, ইসলামি অর্থনীতি, পৃ. ১৫৩।

[4]. মো. এনামূল হক, অর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা, priyo.lslam, ২০ জুলাই ২০১৪ইং।

[5]. এ. কে. এম. রফিক উদ্দিন আহ্মেদ, ইসলামি অর্থনীতি, পৃ. ৩৪৮।

[6]. মো. গোলাম মোস্তাফা, ইসলামি অর্থনীতি, পৃ. ৩১৮-৩১৯।

[7]. মো. হেদায়েত উল্লাহ্, ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং , পৃ. ৩৪২।

[8]. উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা হ’ল এমন একটি রেখা, যার বিভিন্ন বিন্দুতে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ ও চলতি প্রযুক্তি সাপেক্ষে দু’টি উৎপন্ন দ্রব্যের সম্ভাব্য বিভিন্ন সংমিশ্রণ নির্দেশ করা হয়। উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা ডানদিকে স্থানান্তর করলে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে দেশের সামগ্রিক কল্যাণ সাধিত হয়। বিস্তারিত দ্র. মনতোষ চক্রবর্তী, ব্যষ্টিক অর্থনীতি, ১ম খন্ড, পৃ. ১৭-২২।

[9]. ড. মুহাম্মাদ আব্দুল কাদের, অর্থনৈতিক উন্নয়নে যাকাত ব্যবস্থাপনার সুফল, পৃ. ৩৫-৩৬।

[10]. আবুল বারকাত ও জামাল উদ্দিন আহমেদ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বাজেট প্রস্তাবনা ২০১৯-২০, পৃ. ৫১।

[11]. প্রান্তিক ভোগ প্রবণতা হ’ল আয়ের পরিবর্তন হলে ভোগব্যয়ের যে পরিবর্তন হয় তার অনুপাত। অর্থাৎ এখানে, ভোগের পরিবর্তন;আয়ের পরিবর্তন। ধরি, আয় ২,০০০ টাকা থেকে ২,৫০০ টাকা হ’ল। ভোগ ব্যয় ১,০০০ টাকা থেকে ১,২০০ টাকা হ’ল। এক্ষেত্রে 

 

সুতরাং  আরও দেখুন, Dr. H. L. Ahuja, Macroeconomics Theory and Policy, 18th Revised Edition, পৃ. ১৪৬- ১৪৭।

[12]. ড. মো: মিজানুর রহমান, যাকাত অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার একটি উপায়, নয়া দিগন্ত, ১৪ মে ২০১৯।

[13]. মূলধন হ’ল মানুষের পরিশ্রমলব্ধ যে সম্পদ সরাসরি ভোগে ব্যবহৃত না হয়ে পুনঃউৎপাদন কাজে নিয়োগ করা হয়, তাকে বুঝানো হয়েছে। যেমন- যন্ত্রপাতি, কল-কারখানা, বিল্ডিং, কাঁচামাল, শস্যের বীজ ইত্যাদি।

[14]. D. Hammudah Abdalati, Islam of Focus.






পণ্যে ভেজাল প্রদান : ইসলামী দৃষ্টিকোণ - ড. নূরুল ইসলাম
ইসলামী ব্যাংকিং-এর অগ্রগতি : সমস্যা ও সম্ভাবনা - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ইসলামের দৃষ্টিতে মজুদদারী - ড. নূরুল ইসলাম
দুর্নীতি ও ঘুষ : কারণ ও প্রতিকার - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা - ড. মুহাম্মাদ আজিবার রহমান
বাংলাদেশের দারিদ্র্য সমস্যা : কারণ ও প্রতিকার (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ইসলামী দৃষ্টিকোণে ই-কমার্স : একটি পর্যালোচনা - আব্দুল্লাহ আল-মুছাদ্দিক
ইসলামী ব্যাংকিং-এর অগ্রগতি : সমস্যা ও সম্ভাবনা (পূর্বে প্রকাশিতের পর) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ইসলামের দৃষ্টিতে মজুদদারী (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. নূরুল ইসলাম
ইসলামী অর্থনীতি ও প্রচলিত অর্থনীতির মধ্যে তুলনামূলক পর্যালোচনা - বিকাশ কান্তি দে, কক্সবাজার সিটি কলেজ, কক্সবাজার
মাহে রামাযানের পূর্ব প্রস্ত্ততি - আব্দুল মুহাইমিন, ইসলামের ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী কলেজ
ঘুষের ভয়াবহ পরিণতি - আব্দুল মান্নান, সৈয়দপুর, নীলফামারী।
আরও
আরও
.