ভূমিকা :
খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভেজাল প্রদান করা হারাম। ১৯৬০ সালে উপমহাদেশের প্রাচীনতম দৈনিক ‘আজাদ’-এর ‘হুশিয়ারী’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, ‘খাদ্যে ভেজাল মিশান শুধু অপরাধই নহে, ইহা পাপ বলিয়াও আমাদের মনে হয়। বাহিরের দুশমন অপেক্ষাও খাদ্যে ভেজাল দানকারীরা দেশ ও জাতির অনেক বড় দুশমন। ইহাদের কাজের ফলে ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগের মত প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং জাতি ক্রমে জীবনী শক্তিহীন হইয়া উঠিতে থাকে’।[1] একজন খুনী গুলী করে কাউকে হত্যা করলে একজন ব্যক্তিই নিহত হয়। কিন্তু খাদ্যে ভেজাল কোটি কোটি মানুষকে অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। শিশুখাদ্যে ভেজাল সর্বনাশ করে গোটা একটা প্রজন্মের শরীর, জীবনীশক্তি, মেধা ও আয়ুর। স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভেজাল এবং এক বা একাধিক রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো খাবার খেলে মানুষের বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি ও স্মরণশক্তি হ্রাস পায়। মানুষ মেধাহীন হয়ে পড়ে। শরীরের জিনজাত স্নায়ুকোষগুলোর আয়ুও এসব ভেজাল ও রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত খাবার খাওয়ার ফলে কমে যায়। দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, স্বাদ গ্রহণের শক্তি, ঘ্রা্ণ নেয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়। শরীরে বাসা বাঁধে মরণব্যাধি ক্যান্সার সহ নানান রোগ-ব্যাধি। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হ’ল-
ভেজালের সংজ্ঞা :
আভিধানিক অর্থ :
ভেজাল শব্দের অর্থ : মিশ্রিত, মেকি; খাঁটি নয় এমন (ভেজাল দুধ, ভেজাল ঘি),
উৎকৃষ্ট দ্রব্যের সঙ্গে নিকৃষ্ট দ্রব্যের মিশ্রণ (ভেজাল দেওয়া)।[2] ভেজালের আরবী প্রতিশব্দ হ’ল اَلْغِشُّ، مُزَيَّفٌ، مَغْشُوْشٌ، مَمْذُوْقٌ তবে পণ্যে ভেজাল প্রদানের ক্ষেত্রে الغش শব্দটিই বেশী ব্যবহৃত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও এক্ষেত্রে غَشَّ শব্দ ব্যবহার করেছেন।[3]
أحكام الغش التجارى শীর্ষক অভিসন্দর্ভে বলা হয়েছে,وإنما
اشةهر اسم الغش فى مجال المعاملاة الةجارية لأنه الميدان الذى يتجلى فيه
الغش بوضوح ويكثر وقوعه فيه نتيجة الحرص على جمع المال وزيادة الثروة- ‘ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে الغش
বা প্রতারণা শব্দটি বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে
প্রতারণা মোটাদাগে ধরা পড়ে এবং সম্পদ জমা ও বৃদ্ধির লোভের ফলশ্রুতিতে
এক্ষেত্রে বেশী প্রতারণা সংঘটিত হয়’।[4]
ইবনু
ফারিস বলেন,(غَشَّ) الْغَيْنُ وَالشِّيْنُ أُصُولٌ تَدُلُّ عَلَى ضَعْفٍ
فِي الشَّيْءِ وَاسْتِعْجَالٍ فِيهِ، مِنْ ذَلِكَ الْغِشُّ- ‘(গাশ্শা) গাইন
ও শীন মূল অক্ষর। যা কোন জিনিসের মধ্যে কিছু বৃদ্ধি করা ও তাতে তাড়াহুড়া
করাকে বুঝায়। এখান থেকে এসেছে الغش ‘প্রতারণা’ বা ভেজাল’।[5]
ইবনু মানযূর বলেন,الغِشُّ: نَقِيضُ النُّصْح وَهُوَ مأْخوذٌ مِنَ الغَشَش
المَشْرَب الكدِر؛ وَمِنْ هَذَا الغِشُّ فِي الْبِيَاعَاتِ. ‘নছীহতের
বিপরীত হ’ল الغش। এটি الغَشَشَ থেকে গৃহীত। অর্থ: ঘোলা পানি। এ অর্থের উপর ভিত্তি করে ক্রয়-বিক্রয়ে ধোঁকা দেয়া বা ভেজাল প্রদানের ক্ষেত্রে الغش শব্দটি ব্যবহৃত হয়’।[6]
الغش শব্দটি অভিধানে কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর সবগুলোই একটি অর্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। সেটি হ’ল اَلْخِدَاعُ বা প্রতারণা।[7] এছাড়া অন্য আরো যেসব অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলি হল :-
১. المخالطة ‘সংমিশ্রণ’। الشّيْءُ المَغْشُوشُ أَى الغَيْرُ الخَالِصُ ‘মিশ্রিত/ভেজাল হল যা খাঁটি নয়’। কারণ এর সাথে অন্য কিছু মেশানো হয়েছে।[8] যেমন বলা হয়,لَبَنٌ مَغْشُوْشٌ أَىْ مَخْلُوْطٌ بِالْمَاءِ ‘পানিমিশ্রিত দুধ’, فِضّةٌ مَغْشُوشَةٌ أى مَخْلُوطَةٌ بالنُّحَاسِ ‘তামামিশ্রিত চাঁদি’।
২. الإفساد ‘নষ্ট করা’। এটিغشيش الْخُبْزِ إِذَا فَسَدَ অর্থাৎ রুটি বাসি হওয়া থেকে নেয়া হয়েছে।[9]
পারিভাষিক অর্থ : ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’-এর প্রথম অধ্যায়ের ২-এর ২৯ ধারায় ভেজালের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলা হয়েছে,
(২৯) ‘ভেজাল খাদ্য’ অর্থ এমন কোন খাদ্য বা খাদ্যদ্রব্যের অংশ,-
(ক) যাহাকে রঞ্জিত, স্বাদ-গন্ধযুক্ত, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ বা আকর্ষণীয় করিবার জন্য এইরূপ পরিমাণ উপাদান দ্বারা মিশ্রিত করা হইয়াছে, যে পরিমাণ উপাদান মিশ্রিত করা মানব-স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং যাহা কোন আইনের অধীন নিষিদ্ধ; বা
(খ) যাহাকে রঞ্জিতকরণ, আবরণ প্রদান বা আকার পরিবর্তন করিবার জন্য এমন কোন উপাদান মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে মিশ্রিত করা হইয়াছে যাহার ফলে মূল খাদ্যদ্রব্যের ক্ষতি সাধিত হইয়াছে এবং যাহার ফলে তার গুণাগুণ বা পুষ্টিমান হ্রাস পাইয়াছে; বা
(গ) যাহার মধ্য হইতে কোন স্বাভাবিক
উপাদানকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে অপসারণপূর্বক অপেক্ষাকৃত স্বল্প মূল্যের
ভিন্ন কোন উপাদান মিশ্রিত করিবার মাধ্যমে আপাতঃ ওজন বা পরিমাণ বৃদ্ধি বা
আকর্ষণীয় করিয়া খাদ্যক্রেতার আর্থিক বা স্বাস্থ্যগত ক্ষতি সাধন করা হয়’।[10]
উক্ত আইনের প্রথম অধ্যায়ের ২ (১৬) ধারায় বলা হয়েছে, ‘নকল খাদ্য’
অর্থ বিক্রয়ের জন্য অনুমোদিত কোন খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণের অনুকরণে
অননুমোদিতভাবে অনুরূপ খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রস্ত্তত বা লেবেলিং করা,
যাহার মধ্যে অনুমোদিত খাদ্যের উপাদান, উপকরণ, বিশুদ্ধতা ও গুণগত মান
বিদ্যমান থাকুক বা না থাকুক’।[11]
আল-মুনাবী (৯৫২-১০৩১ হিঃ) বলেন,الغش: ما يخلط من الرديء بالجيد ‘ভাল পণ্যের সাথে খারাপ বা নিম্নমানের পণ্য মিশ্রিত করাকে ভেজাল বলে’।[12]
মদীনা
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক চ্যান্সেলর শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ
(জন্ম: ১৩৫৩ হিঃ) বলেন,والغش هو الشيء فيه عيب فيخفيه البائع ويبيعه على
أساس أن ظاهره السلامة، ولكنه من الداخل على عكس الذي يراه الناس، مثل أن
تكون الأطعمة التي تباع ظاهرها جميل، ولكن إذا قُلِّبَتْ ونُكِسَتْ وُجِدَ
أسفلها يختلف عن أعلاها، فهذا من الغش، ‘বিক্রেতা কোন পণ্যের ত্রুটি গোপন
করে এমনভাবে তা বিক্রি করে যে, বাহ্যিকভাবে সেটাকে ভাল-নিরাপদ মনে হয়।
কিন্তু মানুষ যা দেখে ভেতরটা তার বিপরীত। যেমন বিক্রীত খাদ্যদ্রব্যের
বাহ্যিকটা দেখতে সুন্দর। কিন্তু উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখলে তার নিচেরটা উপরের
অংশের সম্পূর্ণ বিপরীত পাওয়া যায়। এটাই হ’ল প্রতারণা বা ভেজাল’।[13]
আধুনিক গবেষক মুহাম্মাদ আব্দুল করীম নাসমান খাদ্যে ভেজালের সংজ্ঞায় বলেন,ةقديم المواد الغذائية للمسةهلك علي خلاف المواصفاة والمقاييس الفنية للدولة ‘রাষ্ট্র নির্ধারিত গুণ ও মানের বিপরীত খাদ্যদ্রব্য ভোক্তাকে সরবরাহ করাকে ভেজাল খাদ্য বলে’।[14]
মোটকথা, ভেজাল বলতে কেবল পণ্যসামগ্রীতে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য বা পদার্থের মিশ্রণকেই বুঝায় না; বরং পণ্যের ত্রুটি গোপন করা, ভাল পণ্যের সাথে খারাপ বা নিম্নমানের পণ্য মিশ্রিত করা, দুধের সাথে পানি মেশানো, জাল মুদ্রার প্রচলন ঘটানো, মাপে ও ওযনে কম দেয়া, পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রদান, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করা, মিথ্যা বিজ্ঞাপন প্রচার এগুলি সবই ভেজাল ও প্রতারণার শামিল।[15] ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,والغش يدخل فى البيوع بكتمان العيوب وتدليس السلع، مثل أن يكون ظاهر المبيع خيرا من باطنه- ‘ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পণ্যের ত্রুটি গোপন করা ও তাতে ভেজাল প্রদান করা ধোঁকার শামিল। যেমন, পণ্যের উপরের অংশ নিচের অংশের চেয়ে ভাল হওয়া’।[16] তিনি আরো বলেন,
ويدخل فى الصناعات مثل الذين يصنعون المطعومات من الخبز والطبخ والعدس والشواء و غير ذلك، أو يصنعون الملبوسات كالنساجين والخياطين ونحوهم، أو يصنعون غير ذلك من الصناعات، فيجب نهيهم عن الغش والخيانة والكتمان. ومن هؤلاء الكيماوية الذين يغشون النقود والجواهر والعطر وغير ذلك-
‘পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ধোঁকা বা ভেজাল প্রদান করা হয়। যেমন যারা রুটি তৈরী করে, খাবার রান্না করে, ডাল, কাবাব প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্য প্রস্ত্তত করে অথবা যারা পোষাক তৈরী করে যেমন, তাঁতী, দর্জি প্রমুখ অথবা যারা অন্যান্য পণ্য উৎপাদন করে তাদের কর্তব্য হ’ল প্রতারণা, খিয়ানত ও পণ্যের ত্রুটি গোপন করা থেকে বিরত থাকা। এদের মধ্যে রয়েছে রসায়নবিদগণ যারা জাল মুদ্রা তৈরী করে এবং মণি-মুক্তা ও আতর প্রভৃতিতে ভেজাল প্রদান করে’।[17]
ইসলামের দৃষ্টিতে পণ্যে ভেজাল প্রদানের বিধান :
ইসলামে পণ্যে ভেজাল প্রদান সম্পূর্ণরূপে হারাম। এ মর্মে কুরআন ও সুন্নাহর দলীল সমূহ নিম্নে আলোচিত হ’ল :
ক. কুরআনের দলীল :
১. মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تُفْسِدُوْا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا ‘শৃংখলা স্থাপনের পর তোমরা পৃথিবীতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করো না’ (আ‘রাফ ৭/৫৬)।
উক্ত আয়াতে ‘আমভাবে যাবতীয় ফাসাদ থেকে নিষেধ করা হয়েছে।[18]
তন্মধ্যে খাদ্যদ্রব্য বা পণ্যে ভেজাল প্রদান অন্যতম। আধুনিক মুফাস্সির
ইবনু আশূর (১৮৭৯-১৯৭৩) বলেন, فالإفساد في الأرض منه تصيير الأشياء الصالحة
مضرة كالغش في الأطعمة، ‘পৃথিবীতে বিশৃংখলা সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে ভাল জিনিস
সমূহকে ক্ষতিকারকে পরিণত করা। যেমন খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল প্রদান করা’।[19]
২. আল্লাহ বলেন,وَإِذَا تَوَلَّى سَعَى فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا وَيُهْلِكَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَ وَاللهُ لَا يُحِبُّ الْفَسَادَ ‘যখন সে ফিরে যায় (অথবা নেতৃত্বে আসীন হয়), তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির এবং শস্য ও প্রাণী বিনাশের চেষ্টা করে। অথচ আল্লাহ অশান্তি পসন্দ করেন না’ (বাক্বারাহ ২/২০৫)।
উক্ত আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, পৃথিবীতে বিশৃংখলা সৃষ্টির অন্যতম রূপ হ’ল, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করা।[20] যার প্রভাব তাদের জীবন, সন্তান-সন্ততি, ফল-ফসল ও গবাদিপশুর উপর গিয়ে পড়ে। এর সবগুলিই খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল প্রদানের ফলে ঘটে থাকে।
৩. মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللهُ إِلَّا بِالْحَقِّ- ‘ন্যায্য কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করবে না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন’ (আন‘আম ৬/১৫১)।
এ আয়াতে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। যেভাবেই তা হোক না কেন। আর খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল প্রদান ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় বিধায় তা হারাম।
৪. মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوا فَرِيقًا مِنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالْإِثْمِ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘আর তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের সম্পদ ভক্ষণ করো না এবং অন্যের সম্পদ গর্হিত পন্থায় গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তোমরা জেনেশুনে তা বিচারকদের নিকট পেশ করো না’ (বাক্বারাহ ২/১৮৮)।
আয়াতটি দু’দিক থেকে খাদ্যে ভেজাল প্রদান হারাম হওয়ার প্রতি নির্দেশ করে। ক. অন্যায়ভাবে যেকোন পন্থায় মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করতে আয়াতে নিষেধ করা হয়েছে। তন্মধ্যে খাদ্যে ভেজাল অন্যতম। খ. ক্রেতা নির্ভেজাল ও নিরাপদ পণ্য ক্রয় এবং এর দ্বারা পরিপূর্ণরূপে উপকৃত হওয়ার জন্য বিক্রেতাকে সম্পূর্ণ মূল্য প্রদান করে। যদি পণ্যে ভেজাল থাকে তাহলে কখনো কখনো তা মূল্য কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে। এভাবে ভেজাল প্রদানের ফলে পণ্যের মূল্য যতটুকু কম হবে ততটুকু বিক্রেতা ক্রেতার মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে।
৫. মহান আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না, তোমাদের পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা ব্যতীত’ (নিসা ৪/২৯)।
দু’দিক থেকে উক্ত আয়াতটি ভেজাল হারাম হওয়ার দলীল বহন করে। ক. যেকোন পন্থায় অন্যায়ভাবে সম্পদ ভক্ষণ করা। পণ্যে ভেজাল প্রদান এর অন্যতম মাধ্যম। খ. ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হওয়ার অন্যতম শর্ত হ’ল সম্মতি। এমনকি কতিপয় মালেকী বিদ্বান একে প্রথম রুকন হিসাবে গণ্য করেছেন। আর এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, পণ্য ক্রয়কারী ভেজাল ছাড়াই তা ক্রয় করতে সম্মত হয়। কেননা ভেজালে প্রতারণা ও ক্ষতি রয়েছে। তাই কোন পণ্যে ভেজাল পরিদৃষ্ট হলে তা সম্মতিকে নষ্ট করে দেয়। অতএব প্রমাণিত হ’ল যে, পণ্যে ভেজাল প্রদান হারাম।
৬. আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَخُونُوا اللهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা (অবাধ্যতার মাধ্যমে) আল্লাহ ও রাসূলের সাথে খিয়ানত করো না এবং (এর অনিষ্টকারিতা) জেনে-শুনে তোমাদের পরস্পরের আমানত সমূহে খিয়ানত করো না’ (আনফাল ৮/২৭)।
যা কিছু মানুষ অন্যকে আদায় করে সে বিষয়ে আমানতের খিয়ানত হারাম হওয়ার ব্যাপারে আয়াতটি ‘আম (কুরতুবী)। তন্মধ্যে খাদ্যদ্রব্যও রয়েছে। আর মানুষ পণ্যের গুণাগুণ, কার্যকারিতা, মাপ ও ওযন প্রভৃতি বিষয়ে কাউকে বিশ্বস্ত মনে না করলে তার নিকট থেকে তা ক্রয় করে তার দ্বারা উপকৃত হতে চাইবে না। পণ্যে ভেজাল প্রদান এর বিপরীত। কাজেই প্রমাণিত হল যে, পণ্যে ভেজাল প্রদান হারাম।
৭. মহান আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّقُوْا اللهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তওবা ৯/১১৯)।
আল্লাহ তা‘আলা সর্বাবস্থায় এবং সকল কথা ও কাজে সত্যবাদিতা অবলম্বন করাকে আবশ্যক করেছেন। এটি এসব বিষয়ে মিথ্যা হারাম হওয়ার প্রমাণ বহন করে। পণ্যে ভেজাল প্রদানও এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ভেজাল জিনিস বাজারজাত করা হয়। এতে ক্রেতাকে ধোঁকা দিয়ে চড়ামূল্য হাতিয়ে নেয়া হয়।
৮. আল্লাহ বলেন,وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِيْنَ، الَّذِيْنَ إِذَا اكْتَالُوْا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَ، وَإِذَا كَالُوْهُمْ أَوْ وَزَنُوْهُمْ يُخْسِرُوْنَ، ‘দুর্ভোগ মাপে কম দানকারীদের জন্য। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদের মেপে দেয় বা ওযন করে দেয়, তখন কম দেয়’ (মুতাফফিফীন ৮৩/১-৩)।
উক্ত
আয়াতগুলি পণ্য আদান-প্রদানের সময় সঠিকভাবে তা মাপা ও ওযন করা আবশ্যক হওয়া
এবং মাপে ও ওযনে কম দেয়া হারাম হওয়ার প্রতি নির্দেশ করে। কারণ তা প্রতারণা।
মানুষের মনে এর দারুণ প্রভাব বিস্তার করে। কারণ বিক্রেতার কাছ থেকে তার
অসম্মতিতে বেশী নিলে যেমন সে কষ্ট পাবে, তেমনি ক্রেতাকে কম দিলে তারও একই
অবস্থা হবে (কুরতুবী)। এতে ক্রয়-বিক্রয়ে সম্মতির যে শর্ত রয়েছে তা ভঙ্গ হবে। তাছাড়া ওযনে কম দেয়া প্রতারণা বা ভেজালের অন্যতম মাধ্যম। কাজেই তা হারাম।[21]
খ. হাদীছের দলীল :
বেশ কিছু হাদীছে পণ্যে ভেজাল প্রদান হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হ’ল:
১.
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ حَمَلَ
عَلَيْنَا السِّلاَحَ فَلَيْسَ مِنَّا وَمَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا ‘যে
ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। যে
ব্যক্তি আমাদেরকে ধোঁকা দিবে সেও আমাদের দলভুক্ত নয়’।[22]
শামসুল হক আযীমাবাদী বলেন,وَالْحَدِيْثُ دَلِيلٌ عَلَى تَحْرِيْمِ الْغِشِّ وَهُوَ مُجْمَعٌ عَلَيْهِ ‘হাদীছটি প্রতারণা বা ভেজাল হারাম হওয়ার দলীল। এ বিষয়ে সবাই একমত’।[23] যে কোন ধরনের প্রতারণা এবং তার উপায় অবলম্বনকে এই হারাম হওয়া শামিল করে। তন্মধ্যে পণ্যে ভেজাল প্রদান অন্যতম।
২. عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَرَّ عَلَى صُبْرَةِ طَعَامٍ فَأَدْخَلَ يَدَهُ فِيهَا فَنَالَتْ أَصَابِعُهُ بَلَلاً فَقَالَ : مَا هَذَا يَا صَاحِبَ الطَّعَامِ؟ قَالَ أَصَابَتْهُ السَّمَاءُ يَا رَسُولَ اللهِ. قَالَ : أَفَلاَ جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ كَىْ يَرَاهُ النَّاسُ، مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّى- আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন একটি খাদ্যস্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় তিনি তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলে তাঁর হাত ভিজে গেল। তিনি বললেন, হে খাদ্যের মালিক! এটা কি? সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, তাহ’লে তুমি কেন ভিজা অংশটি উপরে রাখলে না? তাহলে লোকেরা দেখে নিতে পারতো। মনে রেখ, যে প্রতারণা করে, সে আমার দলভুক্ত নয়’।[24] পণ্যে ভেজাল প্রদান হারাম হওয়ার ব্যাপারে হাদীছটি দ্ব্যর্থহীন।
৩.
বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন,فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ
وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ ‘তোমাদের রক্ত,
তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সম্মান তোমাদের জন্য সম্মানিত’।[25]
জীবন, সম্পদ ও সম্মানের ক্ষেত্রে সীমালংঘন কঠিনভাবে হারাম হওয়ার ব্যাপারে হাদীছে জোরালো তাকীদ রয়েছে। সেটা যেভাবেই হোক না কেন।[26] খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল প্রদানের ক্ষতিকর প্রভাব এর সবগুলোর উপরেই প্রযোজ্য। কারণ খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল প্রদান মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এর মাধ্যমে অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করা হয় এবং সন্তানদের ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। যেটিকে সম্মান নিয়ে বাড়াবাড়ি বা সীমালংঘন হিসাবে গণ্য করা যায়।
৪. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ ضَرَرَ وَلاَ ضِرَارَ ‘ক্ষতিগ্রস্ত হয়ো না এবং কারো ক্ষতি করো না’।[27]
উক্ত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অন্যের ক্ষতিসাধন করতে নিষেধ করেছেন। এটি সাধারণ নিষেধ, যা সকল প্রকার ক্ষতিকে শামিল করে। আর পণ্যে ভেজাল প্রদানের ফলে ব্যক্তি ও সমষ্টি পর্যায়ে জীবন ও সম্পদের যে ক্ষতি সাধিত হয় তা বলাই বাহুল্য।
৫. আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, একজন ব্যক্তি নবী
(ছাঃ)-এর নিকট উল্লেখ করলেন যে, তাঁকে ক্রয়-বিক্রয়ে ধোঁকা দেয়া হয়। তখন
তিনি বললেন,إِذَا بَايَعْتَ فَقُلْ لاَ خِلاَبَةَ ‘যখন তুমি ক্রয়-বিক্রয়
করবে তখন বলে নিবে কোন প্রকার ধোঁকা ও প্রতারণা নেই’।[28]
উক্ত হাদীছ দ্বারা দু’ভাবে পণ্যে ভেজাল প্রদান হারাম হওয়া প্রমাণিত হয়। ক. বিক্রেতার জন্য ক্রেতাকে কোন পণ্যে ধোঁকা দেয়া জায়েয নেই। সেটা খাদ্যদ্রব্য হোক বা অন্য কিছু। খ. পণ্যের মূল্য বা পণ্যে প্রভাব বিস্তারকারী প্রতারণা হ’লে বিক্রয় সাব্যস্ত হবে না। যদি পণ্যে ভেজাল প্রদানের মাধ্যমে ধোঁকা দেয়া জায়েয হত তাহলে বিক্রয় সাব্যস্ত হওয়া আবশ্যক হত। নিম্নের হাদীছটি এ ব্যাখ্যাকে জোরালো করে।
৬. হাকীম বিন হিযাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি
বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ
يَتَفَرَّقَا- أَوْ قَالَ حَتَّى يَتَفَرَّقَا- فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا
بُورِكَ لَهُمَا فِى بَيْعِهِمَا، وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا مُحِقَتْ
بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا ‘ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের অবকাশ থাকবে (ক্রয়-বিক্রয়ের
চুক্তি ভঙ্গ করার), যতক্ষণ না তারা পরস্পর বিছিন্ন হয়। যদি তারা সততা
অবলম্বন করে ও পণ্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে, তাহলে তাদের দু’জনের
ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত দান করা হবে। আর যদি তারা পণ্যের দোষ গোপন করে এবং
মিথ্যার আশ্রয় নেয় তাহ’লে তাদের ক্রয়-বিক্রয় থেকে বরকত নির্মূল হয়ে যাবে’।[29]
উক্ত হাদীছটি তিন দিক থেকে ভেজাল হারাম হওয়ার প্রমাণ বহন করে। ক. কল্যাণ ও প্রয়োজনের দিকে খেয়াল করে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্য খিয়ার (ক্রয়-বিক্রয় কার্যকরকরণ বা বাতিলের স্বাধীনতা) বিধিসম্মত করা হয়েছে। আর তা হ’ল প্রতারণা প্রতিরোধ এবং উভয়কে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা।[30] যদি ভেজাল প্রদান করা জায়েয হত তাহ’লে খিয়ার বিধিসম্মত করা অনর্থক হয়ে যেত। অথচ শরী‘আতকে এ থেকে পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে।
খ. পণ্যের যে ত্রুটি সম্পর্কে বিক্রেতা জ্ঞাত তা বলে দেয়া এবং ক্রয়-বিক্রয়ে সততা অবলম্বন করাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওয়াজিব বা আবশ্যক করেছেন। এর উপর বিক্রয়ে বরকত ভিত্তিশীল সে কথাও তিনি বলেছেন। যদি ভেজাল প্রদান জায়েয হত তাহলে তিনি তা আবশ্যক করতেন না।
গ. মিথ্যার আশ্রয় নেয়া ও ত্রুটি গোপন করা খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল প্রদানের অন্যতম উপায়। এর ফলে বরকত নির্মূলের কথা উক্ত হাদীছে বলা হয়েছে। কাজেই প্রমাণিত হল যে, ভেজাল হারাম।
৭.
‘আদ্দা বিন খালেদের হাদীছে এসেছে, هَذَا مَا اشْتَرَى الْعَدَّاءُ بْنُ
خَالِدِ بْنِ هَوْذَةَ مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللهِ صلى اللهُ عليه وسلم،
اشْتَرَى مِنْهُ عَبْدًا أَوْ أَمَةً لاَ دَاءَ وَلاَ غَائِلَةَ وَلاَ
خِبْثَةَ بَيْعَ الْمُسْلِمِ الْمُسْلِمَ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট থেকে
‘আদ্দা বিন খালেদ বিন হাওযা একটি দাস বা দাসী ক্রয় করল। যার কোন অসুখ নেই,
যা পলায়নপর নয় এবং চরিত্রহীনও নয়। এটা হ’ল এক মুসলমানের সাথে অন্য
মুসলমানের ক্রয়-বিক্রয়’।[31]
উক্ত হাদীছে গুপ্ত দোষ লুকানো, কৌশল অবলম্বন করা এবং যার মধ্যে প্রতারণা ও হারাম রয়েছে তা বিক্রি করতে নিষেধ করা হয়েছে।[32] দাস-দাসীর ক্ষেত্রে যদি এ বিধান প্রযোজ্য হয় তাহলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তা ভেজালের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
৮. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّمَا الْبَيْعُ عَنْ تَرَاضٍ ‘ক্রয়-বিক্রয় কেবল পারস্পরিক সম্মতিতে অনুষ্ঠিত হয়’।[33]
উক্ত হাদীছে সম্মতির ভিত্তিতে পণ্যের বিক্রয় সংঘটিত হওয়াকে আবশ্যক ঘোষণা করা হয়েছে। ভেজাল এই শর্তের খেলাফ। কাজেই তা হারাম।
৯.
আবূ যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেছেন,ثَلاَثَةٌ لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ
يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلاَ يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ - قَالَ
فَقَرَأَهَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ثَلاَثَ مِرَارٍ. قَالَ
أَبُو ذَرٍّ خَابُوا وَخَسِرُوا مَنْ هُمْ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ
الْمُسْبِلُ وَالْمَنَّانُ وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ
الْكَاذِبِ ‘আল্লাহ কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর মানুষের সাথে কথা বলবেন না,
তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। বরং তাদের জন্য রয়েছে
ভয়ানক শাস্তি। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ কথাটি তিনবার বললেন।
আবু যার (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কারা ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
তিনি বললেন, (১) যে ব্যক্তি অহংকারবশত টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরে (২) যে
ব্যক্তি দান করে খোটা দেয় এবং (৩) যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ করে অধিক দামে
পণ্য বিক্রি করে ও তা চালু করার চেষ্টা করে’।[34]
বিক্রির জন্য ক্রেতার নিকট পণ্য উপস্থাপন করার সময় মিথ্যা বলা হারাম হওয়ার প্রতি হাদীছটি নির্দেশ করে। আর মিথ্যার আশ্রয় নেয়া পণ্যে ভেজাল প্রদানের অন্যতম মাধ্যম। অতএব প্রমাণিত হল যে, ভেজাল হারাম।
১০. আব্দুল্লাহ বিন ওমর
(রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের দিকে এগিয়ে এসে
বলেন,يَا مَعْشَرَ الْمُهَاجِرِينَ خَمْسٌ إِذَا ابْتُلِيتُمْ بِهِنَّ
وَأَعُوذُ بِاللهِ أَنْ تُدْرِكُوْهُنَّ ‘হে মুহাজিরগণ! তোমরা পাঁচটি
বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। তবে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি
যেন তোমরা তার সম্মুখীন না হও’। তন্মধ্যে তিনি উল্লেখ করেন,وَلَمْ
يَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ إِلاَّ أُخِذُوا بِالسِّنِينَ
وَشِدَّةِ الْمَؤُنَةِ وَجَوْرِ السُّلْطَانِ عَلَيْهِمْ. ‘যখন কোন জাতি
ওযন ও পরিমাপে কারচুপি করে তখন তাদের উপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, কঠিন
বিপদ-মুছীবত এবং শাসকদের যুলুম-অত্যাচার’।[35]
হাদীছটি মাপে ও ওযনে কম প্রদান হারাম হওয়ার দলীল। এটি পণ্যে ভেজাল প্রদানের অন্যতম মাধ্যম। এর ফলশ্রুতিতে দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি ও খাদ্য ঘাটতির সৃষ্টি হয় এবং সমাজের মানুষের উপর যালেম শাসকরা চেপে বসে।
১১. আবু হুরায়রা (রাঃ)
হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ تُصَرُّوا الْإِبِلَ وَالْغَنَمَ،
فَمَنِ ابْتَاعَهَا بَعْدُ فَإِنَّهُ بِخَيْرِ النَّظَرَيْنِ بَعْدَ أَنْ
يَحْتَلِبَهَا إِنْ شَاءَ أَمْسَكَ، وَإِنْ شَاءَ رَدَّهَا وَصَاعَ تَمْرٍ
‘তোমরা উটনী ও বকরীর দুধ (স্তনে) আটকিয়ে রেখো না। যে ব্যক্তি এরূপ পশু ক্রয়
করে, সে দুধ দোহনের পরে দু’টি অধিকারের যেটি তার পক্ষে ভাল মনে করবে তাই
করতে পারবে। যদি সে ইচ্ছা করে তবে ক্রীত পশুটি রেখে দিবে আর যদি ইচ্ছা করে
তবে তা ফেরৎ দিবে এবং এর সাথে এক ছা‘ পরিমাণ খেজুর দিবে।[36]
আলোচ্য
হাদীছটি পণ্যে ভেজাল প্রদান হারাম হওয়ার প্রমাণ বহন করে। কারণ ক্রেতাকে
ইচ্ছাকৃতভাবে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে পশুর স্তনে দুধ আটকিয়ে রাখা হয়েছে। যা
বিক্রেতা অবগত, কিন্তু ক্রেতা অনবগত। আর নিঃসন্দেহে প্রতারণা বা ধোঁকা দেয়া
হারাম।[37]
ভেজালের ব্যাপারে সালাফে ছালেহীনের সতর্কতা :
সালাফে ছালেহীন বা পূর্ববর্তী যুগের পুণ্যবান মুসলমানরা পণ্যদ্রব্যের দোষ-ত্রুটি স্পষ্টভাবে বলে দিতেন এবং ভেজাল প্রদান থেকে সর্বদা বিরত থাকতেন। তাঁরা লেনদেনে সর্বদা ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে বেঁচে থাকতেন এবং ব্যবসায় সততার পরিচয় দিতেন।
বিশিষ্ট ফকীহ ইবনু সিরীন একটি ছাগী বিক্রি করার সময়
ক্রেতাকে বললেন, তোমার নিকট ছাগীটির দোষ বর্ণনা করে আমি দায়িত্বমুক্ত হতে
চাই। সে পা দিয়ে ঘাস এদিক-ওদিক ছড়ায়। হাসান বিন ছালেহ একটি ক্রীতদাসী
বিক্রি করার সময় ক্রেতাকে বললেন, মেয়েটি একবার থুথুর সাথে রক্ত ফেলেছিল।
এটি মাত্র একবারের ঘটনা ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঈমানের তাগিদ হেতু তিনি তা
উল্লেখ না করে চুপ থাকতে পারেননি। যদিও তাতে মূল্য কম পাওয়ার আশংকা ছিল।[38]
তারা ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর নিম্নোক্ত বাণীর প্রতি আমলকারী। উকবা বিন আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ وَلاَ يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ بَاعَ مِنْ أَخِيهِ بَيْعًا فِيهِ عَيْبٌ إِلاَّ بَيَّنَهُ لَهُ ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। সুতরাং কোন মুসলমানের পক্ষে পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে নিজের ভাইয়ের কাছে তা বিক্রি করা বৈধ নয়’।[39]
বাংলাদেশে ভেজালের চিত্র :
বাংলাদেশে
ব্যবসায়ীরা ভেজাল প্রদানের বল্গাহীন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আমাদের দেশে
সম্ভবতঃ এমন কোন পণ্য বা খাদ্য নেই, যাতে ভেজাল দেয়া হচ্ছে না। এজন্যই
সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘কচু ছাড়া
সবকিছুতেই ফরমালিন। নির্ভেজাল খাবার পাওয়া এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে।
খাদ্যে ভেজালের কারণে ক্যান্সারসহ জটিল রোগ হচ্ছে। কিছু মানুষ দানব হয়ে
যাচ্ছে’।[40] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ার ওলিংগং বিশ্ববিদ্যালয়
যৌথভাবে গবেষণা জরিপ করে দেখেছে যে, দেশের মোট খাদ্যের ৩০ শতাংশে ভেজাল
রয়েছে।[41] সয়াবিন তেল, চিনি, মসলা, নুডুলস, সেমাই, বিস্কুট, পাউরুটি, দুধ,
শিশুখাদ্য, ঘি, মিষ্টি, মধু, পানীয়, ফলমূল, ঔষধ, সার, কীটনাশক ইত্যাদি
প্রায় সবকিছুতেই ভেজাল দেয়া হচ্ছে। গত ১০ই আগস্ট ২০১১ তারিখে ঢাকায় ‘জাতীয়
জীবনে ভেজাল খাদ্যের ঝুঁকিপূর্ণ প্রভাব’ শীর্ষক আলোচনা সভায়
‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ’
(আইসিডিডিআরবি)-এর জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী এস কে রয় এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেন,
মিষ্টি, সন্দেশ, দই, ঘি, ছানা, সস, ডালডা, সয়াবিন, আইসক্রীমসহ কিছু পণ্য
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ৭৬ দশমিক ৩২
শতাংশ খাবারেই ভেজাল। ঐ আলোচনায় বক্তারা বলেন, খাবারে প্রায় ২০০ ধরনের
বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে।[42] প্রায় সব ফলেই ফরমালিন, কার্বাইড
অথবা অন্য কোন রাসায়নিক স্প্রে করা হয়। একটি ইংরেজী দৈনিক লিখেছে, The
another name of carbide is cancer. There is no answer of cancer.[43]
‘কার্বাইডের অপর নাম ক্যান্সার। আর ক্যান্সারের পরিণাম নিশ্চত মৃত্যু’। এসব
ভেজাল খাবার খেয়ে মানুষ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। একটি গবেষণা থেকে
জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ হাযার কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে ভেজাল খাবার
খাওয়ার কারণে। কারণ ভেজাল খাবার খাওয়ার কারণে নানা রোগ হচ্ছে। আর এসব রোগ
নিরাময়ের জন্য ঔষধের পেছনে ১০ হাযার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।[44]
দুধে ভেজাল :
২০০৮ সালে গুঁড়োদুধে মেলামাইনের অস্তিত্ব পাওয়ার বিষয়টি গোটা বিশ্বে
ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। মেলামাইনযুক্ত গুঁড়োদুধ খেয়ে সে সময় চীনে প্রায়
তিন লাখ শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ৬ জন শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল।[45]
চীন সরকারের হিসাব অনুযায়ী দেশটির গুঁড়োদুধ উৎপাদনকারী ২২ প্রতিষ্ঠানের
৬৯টি আইটেমেই বিষাক্ত উপাদান মেলামাইন পাওয়া গিয়েছিল। মূলতঃ দুধে প্রোটিনের
পরিমাণ বেশী দেখানোর জন্যই মেশানো হয়েছিল এই রাসায়নিক পদার্থ। এ
কেলেঙ্কারির মূল হোতা সানলু কোম্পানীকে দেওলিয়া ঘোষণা করা হয়েছিল। সে সময়
বাংলাদেশের বাজারে প্রচলিত ইয়াশলি-১, ইয়াশলি-২ ও সুইট বেবী নামক তিনটি
ব্র্যান্ডের গুঁড়োদুধে মেলামাইনের অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়াই তা নিষিদ্ধ করা
হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, মেলামাইন কার্বন, হাইড্রোজেন ও নাইট্রোজেনের
সম্বন্বয়ে গঠিত এক ধরনের জৈব যৌগ। যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।[46]
সম্প্রতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের সাবেক পরিচালক এবং
ঔষধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ও তাঁর গবেষকদল দুধের ১০টি
নমুনা পরীক্ষা করে ১০টিতেই ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক পেয়েছেন।[47] এদিকে গত
২৪শে জুলাই’১৯ পাস্ত্তরিত তরল দুধে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ভারী ধাতব
পদার্থের উপস্থিতি প্রমাণিত হওয়ায় দেশের ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা
করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।[48]
ঔষধে ভেজাল :
নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ঔষধের ছড়াছড়িতে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ৯
জুলাই’১২ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক দেশে বর্তমানে ২৫৮টি
এলোপ্যাথী, ২২৪টি আয়ুর্বেদী, ২৯৫টি ইউনানী ও ৭৭টি হোমিওপ্যাথিসহ মোট ৮৫৪টি
ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ঔষধ কোম্পানীগুলোর মধ্যে বড় জোর ৪০টি
ছাড়া বাকী প্রতিষ্ঠানগুলো নকল ও নিম্নমানের ঔষধ তৈরী করে বলে অভিযোগ আছে।[49] এমনকি দু’টি ঔষধে ইয়াবার উপাদান পাওয়ার খবর পর্যন্ত সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।[50]
হলুদের গুঁড়ায় ভেজাল : স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এক গবেষণায় হলুদে সীসা শনাক্ত করা হয়েছে, যা মানবদেহের ক্ষতি করে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও তার শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। প্রতিষ্ঠানদ্বয় তাদের গবেষণায় বাংলাদেশের ৯টি যেলার বাজার থেকে গুঁড়ো করার আগে সংগ্রহ করা হলুদের নমুনার ২০ শতাংশে সীসা বা লেড ক্রোমেট শনাক্ত করেছে। যা বিক্রির আগে হলুদের গায়ে ঘষে সেটি উজ্জ্বল করা হয়।
এই গবেষণায় আরো দেখা গেছে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আমদানী করা ১৭টি ব্র্যান্ডের প্যাকেট-জাত হলুদের গুড়া যুক্তরাষ্ট্র নয়বার ফেরত দিয়েছে। এসব কোম্পানির বেশীরভাগই ভারত ও বাংলাদেশের।
আইসিডিডিআরবি’র
গবেষক ডঃ মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের মতে, এতে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ
বাধাগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও শিশুর ওযন কম হওয়া সহ অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে
পারে। মায়ের গর্ভকালীন জটিলতা হতে পারে। এটি মানবদেহে হৃদযন্ত্রের সমস্যা
তৈরি করতে পারে, রক্তের উচ্চচাপ দেখা দিতে পারে, মস্তিষ্কের স্নায়ুজনিত রোগ
দেখা দিতে পারে।[51]
কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটাতাজাকরণ : একশ্রেণীর অসাধু খামারী নিষিদ্ধ ঔষধ প্রয়োগ করে কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটাতাজা করে। তারা স্টেরয়েড গ্রুপের ঔষধ যেমন ডেকাসন, ওরাডেক্সন, প্রেডনিসোলন ইত্যাদি সেবন করিয়ে অথবা ডেকাসন, ওরাডেক্সন স্টেরয়েড ইনজেকশন দিয়ে গরুকে মোটাতাজা করে। এছাড়া হরমোন প্রয়োগ (যেমন ট্রেনবোলন, প্রোজেস্টিন, টেস্টোস্টেরন) করেও গরুকে মোটাতাজা করা হয়।
স্টেরয়েড দিয়ে মোটাতাজা করা গবাদিপশুর গোশত মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এজাতীয় ঔষধ অতিরিক্ত মাত্রায় দিলে গরুর কিডনি ও যকৃৎ অকার্যকর হয়ে যায়। এতে শরীর থেকে পানি বের হতে পারে না। ফলে পানি সরাসরি গরুর গোশতে চলে যায়। এতে গরুকে মোটা, তুলতুলে ও নাদুসনুদুস দেখায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটাতাজাকরণের এসব ঔষধের কার্যকারিতা নষ্ট হয় না। গরুর দেহের গোশতে থেকে যায়। এসব গোশত যখন মানুষ খায়, তখন ঔষধের প্রতিক্রিয়া মানুষের শরীরেও দেখা দেয়। স্টেরয়েড ঔষধ মানবদেহের কিডনি, ফুসফুস, লিভার, হৃৎপিন্ডকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অনিদ্রা, অস্থিরতাসহ নানা রোগের সৃষ্টি করে। এতে মানুষের শরীরে পানি জমে যাওয়া, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, মূত্রনালী ও যকৃতের বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা
বলছেন, এসব ক্ষতিকর ঔষধ মানবশরীরে জমা হয়ে টিউমার, ক্যানসার, কিডনি নষ্ট
করার মতো মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে নারীদের গর্ভধারণের ক্ষমতা
নষ্ট হয়ে যেতে পারে।[52]
নিম্নমানের ১১ পণ্যের লাইসেন্স বাতিল : ল্যাবে
পরীক্ষা করে নিম্নমান পাওয়ায় ৯ কোম্পানীর ১১ পণ্য উৎপাদনের লাইসেন্স বাতিল
করেছে ‘বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)।
একই সঙ্গে পণ্যগুলো উৎপাদন এবং বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে।
পণ্যগুলো হচ্ছে- একে খান ফুড এ্যান্ড বেভারেজের ফার্টিফাইড সয়াবিন তেল, জে
কে ফুডের মদিনা ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই, মডার্ণ কসমেটিক্সের মডার্ণ
ব্র্যান্ডের স্কিন ক্রীম, নিউ চট্রলার এরাবিয়ান স্পেশাল ব্র্যান্ডের ঘি,
রেভেন ফুডের রেভেন ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই, খাজানা মিঠাইয়ের খাজানা
ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই, ঘি ও চানাচুর, প্রমি এগ্রো ফুডের প্রমি
ব্র্যান্ডের হলুদের গুঁড়া এবং ইফাদ সল্ট অ্যান্ড কেমিক্যালের ইফাদ
ব্র্যান্ডের আয়োডিনযুক্ত লবণ।[53] ইতিপূর্বে গত ১২ই মে’১৯ প্রাণের হলুদ
গুঁড়া, পাউডার ও লাচ্ছা সেমাই সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৫২টি মানহীন ও ভেজাল
পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।[54]
সারকথা হ’ল, আমরা প্রতিনিয়ত যেসব খাদ্য খাচ্ছি তার অর্ধেকই ভেজাল। শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা পণ্যে ভেজাল। ভেজালের ভিড়ে আসলটা চেনাই দুষ্কর। বহু পূর্বে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য রচিত ‘ভেজাল’ কবিতাটি যেন আমাদের বর্তমান অবস্থার সাথে পুরোপুরি যায়। তাঁর ভাষায়,
ভেজাল, ভেজাল, ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়,
ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায়!
ভেজাল তেল আর ভেজাল চাল, ভেজাল ঘি আর ময়দা,
‘কৌন ছোড়ে গা ভেজাল ভেইয়া, ভেজালসে হায় ফয়দা’।
ভেজাল পোষাক, ভেজাল খাবার, ভেজাল লোকের ভাবনা,
ভেজালেরই রাজত্ব এ পাটনা থেকে পাবনা।
ভেজাল কথা-বাংলাতে ইংরেজী ভেজাল চলছে,
ভেজাল দেওয়া সত্যি কথা লোকেরা আজ বলছে।
‘খাঁটি জিনিস’ এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে,
‘ভেজাল’ নামটা খাঁটি কেবল আর সকলই মিথ্যে।
কলিতে ভাই ‘ভেজাল’ সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই,
ছড়াটাতেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নেই’\[55]
ভেজাল প্রতিরোধে করণীয় :
১. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ‘মা‘রূফ’ বা সুনীতির প্রতিষ্ঠা এবং ‘মুনকার’ বা দুর্নীতির প্রতিরোধ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অর্থনীতিতে সুনীতি প্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে যাবতীয় উপায়ে ইনছাফভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলা। আর দুর্নীতি প্রতিরোধের অর্থ হচ্ছে সব ধরনের অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও শোষণের পথ রুদ্ধ করা। এলক্ষ্যে রাষ্ট্র যে কোন ধরনের আইন রচনা করতে পারে। আর সেই আইন প্রয়োগ করে ভেজাল প্রতিরোধ করতে পারে দৃঢ়হস্তে।
২. খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশ্রণ
এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর খাদ্যসামগ্রী বিপণন রোধে স্থাপিত ‘বিশুদ্ধ
খাদ্য আদালত’-কে সক্রিয় ও কার্যকর করতে হবে।[56]
৩. খাদ্যে ভেজালের সর্বোচ্চ শাস্তি ১২ লক্ষ টাকা জরিমানা ও ৩ বছর কারাদন্ডের বিধান[57]
যথাযথভাবে প্রয়োগ করে খাদ্যে ভেজাল রোধ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে অবস্থা
বিবেচনা করে জরিমানা ও শাস্তির মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। এমনকি ভেজাল
প্রদানের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডও দেয়া যেতে পারে। গোটা বিশ্বে
শিশু-খাদ্যে ভেজালকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে।
সুতরাং শিশুরা যেহেতু জাতির ভবিষ্যত সেহেতু তাদের খাদ্যে ভেজাল প্রদানকে
সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এবং তা প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে
হবে। উল্লেখ্য যে, প্রতি বছর ভেজাল খাবার খেয়ে দেশের ১০ শতাংশ শিশু মারা
যায়।[58]
৪. ‘বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন’ (বিএসটিআই)-এর দায়িত্ব হচ্ছে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের মান নিশ্চিতকরণ। খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্যে ভেজাল রোধের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটিকে ঢেলে সাজিয়ে প্রয়োজনীয় লোকবল দিয়ে একে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে, যাতে তা সকল পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিতকরণ ও নিয়ন্ত্রণে সমর্থ্য হয়। তবে সর্ষের মধ্যে যেন ভূত না থাকে সেজন্য গোয়েন্দা নযরদারী বাড়াতে হবে।
৫. শুধু দেশে উৎপাদিত পণ্য নয়, বিদেশ থেকে আমদানীকৃত পণ্য স্বাস্থ্যসম্মত ও মানসম্মত কি-না তা পরীক্ষা করার জন্য উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় আমদানীকৃত পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য যাতে কোনভাবেই দেশে ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে।
৬. কোন প্রতিষ্ঠান পণ্যে ভেজাল প্রদান করছে প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ বা সীল করে দিতে হবে। সাথে সাথে তা মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কেউ ভেজাল সন্ত্রাস করার দুঃসাহস না দেখায়।
৭. অধুনা মানুষ সাধারণতঃ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখে তা কিনতে প্রলুব্ধ হয়। সুতরাং ভেজাল প্রতিরোধের জন্য এসব মাধ্যমে পণ্যের গুণগত মান যাচাই-বাছাই না করে বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ করতে হবে।
৮. বাজারে প্রচলিত কোন কোন খাবারে কোন কোন ক্ষতিকারক উপাদান ভেজাল দেয়া হচ্ছে এবং নির্ভেজাল খাদ্য কোনগুলো এবং সেগুলো কোথায় পাওয়া যায় এ বিষয়ে একটা গাইডবুক প্রণয়ন করা যেতে পারে। এতে প্রতিটি খাদ্যসামগ্রী সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতামত থাকলে তাতে ক্রেতা সাধারণ উপকৃত হবে।
৯. ক্রেতারা যাতে ভেজাল পণ্য সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে পারে সেজন্য একটি ‘ইনফরমেশন সেল’ গঠন করতে হবে।
১০. ঔষধে ভেজালের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনক্রমেই যেন ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ বাজারে ব্যবসায়ীরা চালান না দিতে পারে সেদিক সুতীক্ষ্ম নযর রাখতে হবে। প্রয়োজনে ভেজাল ও নকল ঔষধ তৈরীকারী কোম্পানী বন্ধ করে দিতে হবে।
১১. ‘মোবাইল কোর্ট’ বা ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এর
কার্যক্রম সবসময় চালু রাখার জন্য দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচী হাতে নিতে হবে।
রাজধানী থেকে শুরু করে উপযেলা পর্যন্ত এর কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিষ্ঠায় শারঈ কোন বাধা নেই। ইমাম বুখারী
(রহঃ) এর প্রমাণে তাঁর ছহীহ বুখারীর ‘আহকাম’ অধ্যায়ে باب الْقَضَاءِ
وَالْفُتْيَا فِى الطَّرِيقِ ‘রাস্তায় বিচারকার্য সম্পাদন ও ফৎওয়া দান’
মর্মে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন। এরপর তিনি উল্লেখ করেছেন,وَقَضَى يَحْيَى بْنُ
يَعْمَرَ فِى الطَّرِيقِ وَقَضَى الشَّعْبِىُّ عَلَى بَابِ دَارِهِ
‘ইয়াহ্ইয়া বিন ইয়া‘মার রাস্তায় বিচারকার্য সম্পাদন করেছেন এবং শা‘বী তাঁর
বাড়ীর দরজায় বিচার করেছেন’। অতঃপর তিনি আনাস বিন মালেক (রাঃ) বর্ণিত একটি
হাদীছ উল্লেখ করেছেন।[59]
১২. খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য পণ্যে বাস্তবিকই ভেজাল দেয়া হয়েছে কি-না বা তাতে ক্ষতিকারক কোন উপাদান মিশিয়েছে কি-না, তা নির্ণয়ের জন্য প্রত্যেক মোবাইল কোর্টের সাথে অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান ও প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি থাকতে হবে।
১৩. প্যাকেটজাত তেল, ঘি, চিনি, আটা, ময়দা, মসলা, বোতলজাত পানীয় ইত্যাদিতে ভেজালের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হোটেল, রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুডের দোকান ও বিপণী কেন্দ্রগুলোর মালিকদের বদলে পণ্য উৎপাদকে শাস্তি দিতে হবে।
১৪. কোন প্রতিষ্ঠান, উৎপাদক, পরিবেশক যেন অযথা হয়রানির শিকার না হন সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
১৫. ব্যবসায়ীরা বাজারে যাতে পচা মুরগী, পচা ডিম, পচা মাছ এবং এক গোশতের নাম করে আরেক গোশত চালিয়ে দিতে না পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৬. প্রত্যেক পাড়া-মহল্লায় ও ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে জনগণ ‘ভেজাল প্রতিরোধ কমিটি গঠন’ করে ভেজালের বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে জনমত গড়ে তুলতে পারে। সাধারণ মানুষ ভেজালের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেই ভেজাল প্রদানকারীরা ভেজাল পণ্য বিপণন করতে সাহস পাবে না।
১৭. সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ভেজাল সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি পাঠ্যসূচীভুক্ত করা যেতে পারে। তাছাড়া সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, সভা-সমাবেশ, জুম‘আর খুৎবা ও ওয়ায -মাহফিলে এ সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা যেতে পারে।
১৮. সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মসূচীতে ভেজাল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার কর্মসূচী অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
১৯. ভেজালমুক্ত পণ্য উৎপাদক ও পরিবেশকদেরকে বছরান্তে সরকারীভাবে পুরষ্কৃত করতে হবে এবং মিডিয়ায় তা ফলাও করে প্রচার করতে হবে।
২০. নির্ভেজাল পণ্য উৎপাদনের জন্য উৎপাদকদেরকে সরকারীভাবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।
২১. বাজারে কোন পণ্যে ভেজাল দেয়া হচ্ছে কি-না তা তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। ইসলামী শাসনামলে ‘মুহতাসিব’ এ দায়িত্ব পালন করতেন। মোল্লা আলী কারী হানাফী (রহঃ) মিশকাতের ২৮৬০ নং হাদীছের (فَوْقَ الطَّعَامِ حَتَّى يَرَاهُ النَّاسُ) এর ব্যাখ্যায় বলেন,فِيهِ إِيذَانٌ بِأَنَّ لِلْمُحْتَسِبِ أَنْ يَمْتَحِنَ بَضَائِعَ السُّوقَةِ لِيَعْرِفَ الْمُشْتَمِلَ مِنْهَا عَلَى الْغِشِّ مِنْ غَيْرِهِ. ‘এখানে নির্দেশ রয়েছে যে, মুহতাসিবকে জনসাধারণের পণ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে
হবে। যাতে তিনি ভেজাল ও খাঁটি পণ্য চিনতে পারেন’।[60]
২২. দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের এমন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যা বিষ মুক্তভাবে শস্য ও ফলমূল সংরক্ষণে সহায়ক হবে।
২৩.
চাষী ও ব্যবসায়ীদেরকে আল্লাহর উপরে ঈমান বৃদ্ধি ও তাক্বদীরে বিশ্বাসী
হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং তাদেরকে হালাল রূযী গ্রহণের প্রতি
উৎসাহিত করতে হবে।[61]
২৪. সর্বোপরি সাধারণ ভোক্তা বা জনগণকে সাধ্যপক্ষে ভেজাল খাদ্য ও পণ্য বর্জন করতে হবে, তাহলে ভেজালের কবল থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পেতে পারে।
উপসংহার :
মুনাফাখোরী,
মজুদদারী, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ভেজাল অক্টোপাসের ন্যায় আমাদেরকে
আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। মজুদদার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে দ্রব্যমূল্যের
পাগলা ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই। অন্যদিকে ভেজালের জয়জয়কার চলছে সর্বত্র। এমন
কোন খাদ্য নেই যাতে ভেজাল দেয়া হচ্ছে না। ভেজালের সমুদ্রে যেন আমরা
হাবুডুবু খাচ্ছি। ইসলামে এ ধরনের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ হ’লেও একশ্রেণীর
দুনিয়াদার মুনাফাখোর ব্যবসায়ী অত্যধিক মুনাফার নেশায় বুঁদ হয়ে তা করে
যাচ্ছে দিব্যি। তারা হালাল-হারামের কোন তোয়াক্কা করছে না। এ যেন কিয়ামতের
পূর্বলক্ষণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,يَأْتِى عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ، لاَ
يُبَالِى الْمَرْءُ مَا أَخَذَ مِنْهُ أَمِنَ الْحَلاَلِ أَمْ مِنَ
الْحَرَامِ ‘মানুষের নিকট এমন এক যুগ আসবে, যখন সে পরোয়া করবে না যে, সে
কোথা হতে সম্পদ উপার্জন করল, হালাল হতে না হারাম হতে’।[62]
আজকে মানুষের মধ্যে বড় অভাব তাক্বওয়ার। নৈতিক চেতনা তাদের মাঝে শূন্যের কোঠায়। সুতরাং ব্যবসায়ীদের মাঝে আল্লাহভীতি ও পরকালে প্রবল প্রতাপান্বিত প্রভুর কাছে জবাবদিহিতার মানসিকতা গড়ে না উঠলে এসব অর্থনৈতিক দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সুদূরপরাহত।
রাসূল (ছাঃ) তদানীন্তন অসভ্য-বর্বর জাহেলী সমাজের লোকদের মাঝে এমন নৈতিক বিপ্লবের আবহ সৃষ্টি করেছিলেন, যার ছোঁয়ায় অল্পদিনের ব্যবধানে মানুষগুলো সোনার মানুষে পরিণত হয়েছিল। ভীতু সারমেয়-এর মত লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল যতসব অন্যায়-অকর্ম। আজো সমাজে যদি সেই আবহ ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে উল্লেখিত অপকর্মগুলো মূলোৎপাটিত হবে। দেশ-জাতি ও মানবতা রক্ষা পাবে মজুদদার-মুনাফাখোরদের কবল থেকে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পিষ্ট হবে না সাধারণ জনগণ। ভেজালের বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত হবে না কেউ। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন! আমীন!!
[1]. ড.
রেজোয়ান সিদ্দিকী সম্পাদিত, আজাদ ও সমকালীন সমাজ (ঢাকা : বাংলাদেশ প্রেস
ইনস্টিটিউট, ১ম প্রকাশ, জুলাই ২০০৪), পৃ. ৩৯২। গৃহীত: দৈনিক আজাদ,
সম্পাদকীয়, ৬ই মার্চ ১৯৬০, পৃ. ২।
[2]. ড. মুহাম্মদ এনামুল হক সম্পাদিত, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, নভেম্বর ২০১২), পৃঃ ৯৩৬।
[3]. মুসলিম হা/১০২।
[4]. আব্দুল মুহসিন বিন নাদির আদ-দূসারী, আহকামুল গিশ্শ আত-তিজারী ফিল ফিক্বহি ওয়ান নিযাম, মাস্টার্স থিসিস, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সঊদ বিশ্ববিদ্যালয়, রিয়াদ, ১৪১৭ হিঃ, পৃঃ ১২।
[5]. মু‘জামু মাকায়ীসিল লুগাহ ৪/৩৮৩।
[6]. লিসানুল আরাব ৬/৩২৩।
[7]. আবূ হাবীব, আল-কামূসুল ফিকহী ১/২৭৪।
[8]. তাজুল আরূস ১৭/২৯০।
[9]. মুহাম্মাদ আব্দুল করীম নাসমান, জারীমাতুল গিশ্শ ফিল মাওয়াদ আল-গিযাইয়্যাহ ওয়াল আছার আল-মুতারাত্তাবাহ আলায়হা (দিরাসাতুন ফিক্বহিয়্যাহ), মাস্টার্স থিসিস, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, গাযা, ফিলিস্তীন, জানুয়ারী ২০১৯, পৃঃ ৮।
[10]. নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, প্রকাশকাল : বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ১০, ২০১৩, পৃঃ ৮৮২৭।
[11]. ঐ, পৃঃ ৮৮২৬।
[12]. আত-তাওকীফ আলা মুহিম্মাতিত তা‘আরীফ, পৃ. ২৫২।
[13]. শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ, শারহু সুনানে আবীদাঊদ ১৮/৬২।
[14]. জারীমাতুল গিশ্শ ফিল মাওয়াদ আল-গিযাইয়্যাহ, পৃ. ১১।
[15]. ড. মুহাম্মাদ বিন মূসা নাছর, জারীমাতুল গিশ্শ আহকামুহা ওয়া ছুওয়ারুহা ওয়া আছারুহা আল-মুদাম্মিরাহ (দুবাই : মাকতাবাতুল ফুরক্বান, ১৪২৯/২০০৮), পৃ. ৩২; জারীমাতুল গিশ্শ ফিল মাওয়াদ আল-গিযাইয়্যাহ, পৃ. ১৫-১৮।
[16]. আল-হিসবাহ, পৃ: ১৫।
[17]. ঐ।
[18]. তাফসীরে কুরতুবী ৭/২২৬।
[19]. আত-তাহরীর ওয়াত তানবীর ১/২৮৪।
[20]. ঐ ২/২৭০।
[21]. জারীমাতুল গিশ্শ ফিল মাওয়াদ আল-গিযাইয়্যাহ, পৃ. ১৯-২১।
[22]. মুসলিম হা/১০১।
[23]. আওনুল মা‘বূদ ৯/২৩১।
[24]. মুসলিম হা/১০২; মিশকাত হা/২৮৬০।
[25]. বুখারী হা/১৭৩৯; মুসলিম হা/১৬৭৯।
[26]. আল-মিনহাজ শারহু ছহীহ মুসলিম ১১/১৬৯।
[27]. ইবনু মাজাহ হা/২৩৪০; ছহীহা হা/২৫০।
[28]. বুখারী হা/২১১৭; মুসলিম হা/১৫৩৩।
[29]. বুখারী হা/২০৭৯; মুসলিম, হা/১৫৩২।
[30]. ইবনুল হুমাম, ফাতহুল কাদীর ৬/৩২৫।
[31]. তিরমিযী হা/১২১৬, হাদীছ হাসান।
[32]. ফাতহুল বারী ৪/৩১০।
[33]. ইবনু মাজাহ হা/২১৮৫।
[34]. মুসলিম হা/১০৬।
[35]. ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯, হাদীছ হাসান।
[36]. বুখারী হা/২১৪৮; মুসলিম হা/১৫১৫।
[37]. জারীমাতুল গিশ্শ ফিল মাওয়াদ আল-গিযাইয়্যাহ, পৃ. ২৩-২৭।
[38]. আল-হালালু ওয়াল হারামু ফিল ইসলাম, পৃ: ২২৮।
[39]. ইবনু মাজাহ হা/২২৪৬, হাদীছ ছহীহ।
[40]. যুগান্তর, ২রা ডিসেম্বর ২০১৯।
[41]. ইনকিলাব, ৮ই ডিসেম্বর’১৯, পৃ. ৭।
[42]. প্রথম আলো, ১১ই আগস্ট’১১, পৃঃ ৭।
[43]. হারুন-আর-রশিদ সংকলিত, খাদ্যে বিষক্রিয়া পরিত্রাণের উপায় (ঢাকা : পার্ল পাবলিকেশন্স, ২০১৫), পৃঃ ২৫।
[44]. কালের কণ্ঠ, ২৮শে এপ্রিল’১৮।
[45]. মশিউল আলম, আমাদের শিশুরা কী খাচ্ছে, প্রথম আলো, ২৬শে আগষ্ট ২০১০।
[46]. ড. এ.এস.এম. আযীযুল্লাহ, গুঁড়োদুধে মেলামাইন : আমাদের করণীয়, আত-তাহরীক, ডিসেম্বর ২০০৮, পৃঃ ২৪-২৬।
[47]. প্রথম আলো, ১৪ই জুলাই’১৯, পৃঃ ১ ও ৪।
[48]. ঐ, ২৫শে জুলাই’১৯, পৃঃ ১ ও ৪।
[49]. আত-তাহরীক, আগষ্ট ২০১২, পৃঃ ৮।
[50]. দুটি ওষুধে ইয়াবার উপাদান, কালের কণ্ঠ, ১০ই নভেম্বর’১৯, পৃঃ ২০ ও ৮।
[51]. https://www.bbc.com/bengali/news50293766?SThis FB&fbclid
=IwAR03hMOBwlP78eKhe8gjwxluGvN4ieoSDPLlEoKgn_ZzJzzLZJqsdZKuDA
[52]. ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির, সব ‘মোটাতাজা’ গরু মোটাতাজা নয়, প্রথম আলো, ২১শে জুলাই’১৯, পৃঃ ১১।
[53]. বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৪শে ডিসেম্বর’১৯, পৃ. ১ ও ২।
[54]. যুগান্তর, ১২ই মে’১৯।
[55]. সুকান্ত রচনা সমগ্র, মুহাম্মদ জমির হোসেন সম্পাদিত (ঢাকা : বিশ্বসাহিত্য ভবন, ১ম প্রকাশ, জুলাই ২০১২), পৃ. ১৪৪।
[56]. দ্রঃ নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, দশম অধ্যায়, ধারা ৬৪, পৃঃ ৮৮৫৭।
[57]. ঐ, পৃঃ ৮৮৬৫ দ্রঃ।
[58]. প্রথম আলো, ১৯ নভেম্বর’১৯।
[59]. বুখারী হা/৭১৫৩।
[60]. মিরকাতুল মাফাতীহ ৫/১৯৩৫।
[61]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, খাদ্যে ও ঔষধে ভেজাল, আত-তাহরীক, আগষ্ট’১২, পৃঃ ১১।
[62]. বুখারী হা/২০৫৯।