নবীগণের মাধ্যমে আল্লাহ প্রেরিত বিধানকে বলা হয় অহি-র বিধান। পক্ষান্তরে মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত বিধানকে বলা হয় মানব রচিত বিধান। দু’টি আইনের উৎস হ’ল দু’টি : আল্লাহ এবং মানুষ। এক্ষণে আমরা দু’টি আইনের মৌলিক পার্থক্য তুলে ধরব।-

১ম : মানব রচিত আইনের নীতিমালা সমসাময়িক সমাজের প্রভাবশালী লোকদের দ্বারা লিপিবদ্ধ হয়। এই আইন সমাজের প্রয়োজনের অনুবর্তী ও বশবর্তী হয়। এভাবে মানব রচিত আইন সমূহকে প্রথম যুগ থেকে এযাবৎ বড় বড় কয়েকটি পর্ব অতিক্রম করতে হয়েছে এবং বর্তমানে তা একটি দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার অস্তিত্ব ইতিপূর্বে ছিল না। যদিও এই দর্শন স্রেফ মানবীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রসূত, যা অপূর্ণ। পক্ষান্তরে অহি-র বিধান হ’ল এমন এক সত্তার নাযিলকৃত বিধান যার জ্ঞান পরিপূর্ণ এবং যা অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যত কালের গন্ডীভূত নয়। যেখানে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা বা অন্য কোন জ্ঞান সূত্রের প্রয়োজন নেই।

২য় : মানবীয় বিধান ও অহি-র বিধান উভয়ের উদ্দেশ্য সামাজিক শান্তি, অগ্রগতি ও কল্যাণ নিশ্চিত করা। কিন্তু উভয়ের মধ্যে পার্থক্য এই যে, মানবীয় বিধান ভবিষ্যত ধারণার ভিত্তিতে রচিত হয় এবং যা বার বার পরিবর্তনশীল। ফলে তা চিরন্তন হয় না এবং এই সমাজে শান্তি, অগ্রগতি ও কল্যাণ সর্বদা অনিশ্চিত থাকে। পক্ষান্তরে অহি-র বিধান অভ্রান্ত জ্ঞানসত্তার পক্ষ হ’তে প্রেরিত হওয়ায় তা চিরন্তন হয় এবং এই সমাজে শান্তি ও অগ্রগতি সর্বদা নিশ্চিত থাকে।

৩য় : মানবীয় বিধান মানবীয় আবিষ্কার সমূহ এবং তার অভূতপূর্ব প্রত্যুৎপন্ন মতিত্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে অক্ষম হয়। ফলে তাকে ঘন ঘন হোচট খেতে হয় ও বারবার বিধান ও উপ-বিধান সমূহ রচনা করতে হয়। পক্ষান্তরে অহি-র বিধান সমূহ এমনামন মৌলিকত্বে সমৃদ্ধ, যার আবেদন ও ব্যাপ্তি সার্বজনীন ও সর্বযুগীয়। যেমন বলা হয়েছে ‘তোমরা পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ কর’ (আলে ইমরান ৯)। ‘তোমরা নেকী ও আল্লাহভীরুতার কাজে পরস্পরকে সাহায্য কর, পাপ ও সীমালংঘনের কাজে সাহায্য করো না’ (মায়েদা ২)। ‘কারু ক্ষতি করো না ও নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ো না’ (ইবনু মাজাহ)। ‘অত্যাচার করো না ও অত্যাচারিত হয়ো না’ (বাক্বারাহ ২৭৯)। ‘সম্পদ যেন কেবল তোমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়’ (হাশর ৭)। ‘ধনীদের নিকট থেকে নাও এবং দরিদ্রদের মধ্যে তা ফিরিয়ে দাও’ (বুখারী, মুসলিম)। ‘আল্লাহর জন্যই সৃষ্টি ও শাসন’ (আ‘রাফ ৫৪)। ‘সকল ক্ষমতার মালিক আল্লাহ’ (বাক্বারাহ ১৬৫)। ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন ও সূদকে হারাম করেছেন’ (বাক্বারাহ ২৭৫)। ‘মদ, জুয়া, তীর্থবেদী, ভাগ্যতীর শয়তানী কর্ম’। এসব হ’তে বিরত থাকো’ (মায়েদা ৯০)। ‘যাবতীয় মাদকদ্রব্য হারাম’ (মুসলিম)। ‘যে প্রতারণা করে সে মুসলমান নয়’ (মুসলিম)। ‘তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বদা ন্যায় বিচারের উপর দন্ডায়মান থাকো, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে যায়’ (নিসা ১৩৫)। ‘বড়কে সম্মান কর ও ছোটকে স্নেহ কর’ (আবুদাঊদ)। উপরোক্ত বিশ্বজনীন মূলনীতি সমূহ যদি মানুষ সর্বদা মেনে চলে, তবে সামাজিক শান্তি ও অগ্রগতি সর্বদা অটুট থাকবে।

৪র্থ : মানবীয় বিধান সমূহ নিজেদের স্বার্থদুষ্ট লোকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে, যা অনেক সময় সামাজিক অশান্তি ও সমাজ ধ্বংসের কারণ হয়। পক্ষান্তরে অহি-র বিধান সর্বদা অন্যায়ের প্রতিরোধ করে এবং ন্যায়পরায়ণ লোকদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। যা সমাজ উন্নয়নের গ্যারান্টি হয়।

৫ম : অহি-র বিধান সকল মানুষ ও সৃষ্টিজগতের জন্য কল্যাণকর। মানবীয় বিধান সকলের জন্য সমভাবে কল্যাণকর নয়।

৬ষ্ঠ : অহি-র বিধান সমাজে সর্বদা একদল মহৎ, পুণ্যবান ও সৎকর্মশীল আধ্যাত্মিক মানুষ তৈরী করে। যুগে যুগে এরাই হলেন সমাজের আদর্শ ও সকল মানুষের অনুসরণীয় ও পূজনীয়। পক্ষান্তরে মানবীয় বিধান স্বার্থপর ও বস্ত্তবাদী মানুষ তৈরী করে। যাদের নিকটে নিঃস্বার্থপরতা নিতান্তই দুর্লভ বস্ত্ত।

উপরোক্ত আলোচনায় অহি-র বিধানের ছয়টি মৌলিক দিক উদ্ভাসিত হয়। ১. পূর্ণতা ২. চিরন্তনতা ৩. বিশ্বজনীনতা ৪. ন্যায়পরায়ণতা ৫. কল্যাণকারিতা এবং ৬. মহত্ত্ব। কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, ইসলামের এইসব মহান নীতিমালা মওজুদ থাকতে ইসলামী দেশসমূহে পাশ্চাত্য ও মানবীয় আইন সমূহ কিভাবে শাসকের মর্যাদায় স্থান নিল? একটু চিন্তা করলেই এর জবাব পাওয়া যাবে। আর তা হ’ল- ১. এই দেশগুলির সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য বিদেশীদের নিরন্তর ষড়যন্ত্র ২. তাদের পদলেহী দেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দ ৩. চাকচিক্য সর্বস্ব তথাকথিত সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতি মোহগ্রস্ততা। ৪. ইসলামী আইন ও বিধান সম্পর্কে নেতৃবৃন্দের অজ্ঞতা ৫. দেশের আলেম সমাজের অধিকাংশের মধ্যে অনুদারতা এবং অহি-র বিধান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অপ্রতুলতা।

উক্ত কারণগুলি দূর করার জন্য আমাদের করণীয় ছিল মূলতঃ দু’ধরনের। এক- প্রশাসনিক ও দুই- সামাজিক। প্রথমোক্ত বিষয়টির ব্যাপারে ইংরেজ চলে যাওয়ার পর হ’তে বিগত ৬৪ বছরেও আমাদের কোন পরিবর্তন আসেনি। কেবল নেতা ও মানচিত্রের পরিবর্তন হয়েছে। নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি। বৃটিশের রেখে যাওয়া রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচারনীতি সবই প্রায় বহাল আছে শতভাগ। দ্বিতীয়টিতে কিছু আশা এখনো ধিকি ধিকি জ্বলছে। তাই বেসরকারী উদ্যোগে শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজ সংশোধন ও গণজাগৃতির কিছু প্রয়াস বিভিন্নভাবে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক অনীহা বা কোন কোন ক্ষেত্রে অন্যায় শ্যেনদৃষ্টির ফলে এবং দুনিয়াবী সুযোগ-সুবিধার অভাবের কারণে এই উদ্যোগগুলি আশানুরূপ সাড়া জাগাতে সক্ষম হচ্ছে না। ফলে দেশ ও সমাজ অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে।

বিশ্বের অবনতির কারণ হ’ল অহি-র বিধানের পরিত্যাগ। যে জাতি যত বেশী অহি-র বিধানের অনুসারী হবে, সে জাতি তত বেশী উন্নত ও সমৃদ্ধ হবে। পক্ষান্তরে যে জাতি যত বেশী এই বিধান থেকে দূরে যাবে, সে জাতি তত বেশী অবনত ও অপদস্ত হবে। কারণ এলাহী বিধানে অবর্তমানে কেবল শয়তানী বিধান অবশিষ্ট থাকে। তখন মানুষ আল্লাহর আনুগত্য করে না। বরং তার নফসের আনুগত্য করে। এ দু’টির মধ্যবর্তী অন্য কিছু নেই, যার আনুগত্য করা যায়। আর নফসের অপর নাম হ’ল শয়তান। যা মানুষের রগ-রেশায় চলমান। শয়তান কখনোই মানুষের মঙ্গল চায় না। সে প্রলোভন দিয়ে মানুষকে জাহান্নামের পথে ধাবিত করে। সে সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণীর স্কন্ধে সওয়ার হয়ে কাজ করে এবং দ্রুত সমাজকে ধ্বংসের কিনারে নিয়ে যায়। অথচ নেতারা ভাবেন, তারা সমাজকে কল্যাণের পথে নিয়ে যাচ্ছেন। যেমন ফেরাঊন তার জনগণকে বলেছিল, ‘আমি তোমাদের কল্যাণের পথ বৈ অন্যপথে নিয়ে যাই না’ (মুমিন ২৯)। ফেরাঊন মূসা (আঃ)-এর আনীত অহি-র বিধান মানেনি। বরং মানুষকে নিজের অত্যাচার ও দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ রেখেছিল। সে তার অতুলনীয় যুলুমকেই তার দেশ ও সমাজের জন্য কল্যাণকর ভেবেছিল। মক্কার কুরায়েশ নেতারা একইভাবে শেষনবী (ছাঃ)-এর উপর যুলুম করেছিল এবং একেই সমাজের জন্য কল্যাণ ভেবেছিল। শয়তানী প্রবৃত্তি তাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল এবং আল্লাহ প্রেরিত অহি-র বিধানকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, ‘আর যদি তারা আপনার দাওয়াত কবুল না করে, তাহ’লে জেনে রাখুন যে, তারা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করছে। আর যারা আল্লাহ প্রেরিত হেদায়াত ছেড়ে স্ব স্ব প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তাদের চাইতে বড় গোমরাহ আর কে আছে? (ক্বাছাছ ৫০)। তিনি তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আপনি তাদের আনুগত্য করবেন না, যাদের অন্তর আমার স্মরণ থেকে গাফেল এবং যাদের কর্মকান্ড সীমা লংঘিত (কাহফ ২৮)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মূলনীতি আকারে বলেন, ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির প্রতি কোন আনুগত্য নেই’ (আহমাদ)

অতএব মানুষকে বেছে নিতে হবে দু’টি পথের যেকোন একটি। হয় মানবীয় বিধানের পথ, নয়তো অহি-র বিধানের পথ। যুগে যুগে সকল নবী-রাসূল মানুষকে শয়তানের পথ ছেড়ে আল্লাহর পথে আহবান জানিয়েছেন। বস্ত্ততঃ শান্তি কেবল সেপথেই নিহিত রয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সকল রাষ্ট্রই মানুষকে তার স্বভাবধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত করছে। এমনকি যে ৪০টি দেশে ‘ইসলাম’ রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে রয়েছে, সেখানেও রয়েছে চরম রাষ্ট্রীয় প্রতারণা। ‘এটাও ঠিক, ওটাও ঠিক’ বলে কুফরীর সঙ্গে ইসলামকে মিলাতে গিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলি এখন তাদের পরিচয় হারাতে বসেছে। সূদ-ঘুষ, যেনা-ব্যভিচার, জুয়া-লটারী, মাদকতা, হত্যা-সন্ত্রাস সহ প্রায় সবধরনের শয়তানী কাজ এইসব রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় অবাধে চলছে। প্রশ্ন হ’ল, এভাবেই কি চলতে থাকবে? মানব রচিত বিধানের কাছে অহি-র বিধান এভাবেই কি সর্বদা পদদলিত হবে?...। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!! [স.স.]






বিষয়সমূহ: সংগঠন
ঈদুল আযহা সমাগত - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আহলেহাদীছ আন্দোলন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সিলেবাস থেকে বিবর্তনবাদ ছাঁটাই করুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মূর্তি অপসারণ ও পুনঃস্থাপন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ভারত ভাগ হয়ে যাচ্ছে - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পর্ণোগ্রাফী নিষিদ্ধ করুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
১. মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী! মূর্তিটা নামিয়ে দিন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নষ্ট সংস্কৃতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ক্ষেত-খামার
রক্তঝরা কাশ্মীর, নিষ্পিষ্ট গুজরাট ও জেনিন : মুসলিম বিশ্বের নীরবতা ও অমুসলিম বিশ্বের কপটতার মাঝখানে - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পর্দা নারীর অঙ্গভূষণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মূল্যবোধের অবক্ষয় ও আসন্ন রামাযান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.