
রহমত ও বরকতের পশরা নিয়ে, মাগফেরাত ও নাজাতের সুসংবাদ নিয়ে বছর ঘুরে রামাযান আমাদের দুয়ারে সমাগত। মুক্তি ও কল্যাণের অভিসারীগণ এ মাসকে তাদের পরকালীন মুক্তির অসীলা হিসাবে স্বাগত জানায়। তাই রামাযানের এক মাস পূর্বে শা‘বান মাস থেকেই তাদের প্রস্ত্ততি শুরু হয়ে যায়। শা‘বানের প্রথমার্ধেই তারা নফল ছিয়ামের অভ্যাস শুরু করে দেয়। অতঃপর রামাযানের আগমনে বিপুল উৎসাহে ও গভীর ভালবাসা নিয়ে ফরয ছিয়াম শুরু করে। সারাদিন সে কেবল খানাপিনা ও যৌন সম্ভোগ থেকেই বিরত থাকে না, বরং ছিয়ামকে ত্রুটিপূর্ণ করতে পারে এমন ছোট-বড় সকল কাজ থেকে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিরত রাখে। নিজের অন্তরকে যাবতীয় অসৎ চিন্তা থেকে দূরে রাখে। কারণ যে হাত-পা ও চক্ষু-কর্ণ এখন তার অনুগত রয়েছে, ক্বিয়ামতের দিন তা স্বাধীন হয়ে যাবে। যদি এদেরকে আমি আল্লাহর আনুগত্যে ব্যবহার না করে শয়তানের আনুগত্যে ব্যবহার করি, তাহ’লে ক্বিয়ামতের দিন এরাই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবে’ (ইয়াসীন ৩৬/৬৭)। অন্যদের চোখে ধূলা দেওয়া যাবে, কিন্তু এই সাক্ষীরা অবিচ্ছেদ্য। শয়নে-স্বপনে, চলনে-বলনে দিবা-রাত্রি এরা আমার একান্ত সাথী। এদের মাধ্যমেই আমি সবকিছু করি। এদেরকে লুকিয়ে কিছুই করার ক্ষমতা আমার নেই। তাই গোয়েন্দা পুলিশের চাইতে আমি এদেরকে বেশী ভয় করি। দুনিয়াবী আদালতের বিচারকদের চাইতে আমি মহা বিচারক আল্লাহর আদালতকে বেশী ভয় পাই। সেদিন যদি আমার দেহ-ত্বক ও জিহবা, আমার হাত-পা, চক্ষু-কর্ণ, আমার যৌনাঙ্গ, আমার হৃদয়, আমার সমস্ত দেহযন্ত্র একযোগে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়, সেদিন আর কে আছে, যে আমার পক্ষে ছাফাই সাক্ষী হবে।
হে যুবক! বার্ধক্য আসার আগে তোমার যৌবনকে, রোগ আসার আগে তোমার সুস্থতাকে, দরিদ্রতা আসার আগে তোমার সচ্ছলতাকে, ব্যস্ততা আসার আগে তোমার অবসরকে, মৃত্যু আসার আগে তোমার জীবনকে তোমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজে নিয়োজিত কর [1] তোমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাক্বওয়াশীল বান্দা ব্যতীত কারু আমল কবুল করেন না (মায়েদাহ ৫/২৭)। রামাযান তোমাকে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। অতএব এসো! আমরা জান্নাতের পথে চলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এসো! আমাদের জিহবাকে সর্বদা আল্লাহর যিকরে ব্যস্ত রাখি। দেহ-মন ঢেলে দিয়ে তাঁর ইবাদতে রত হই। রামাযানের রাত্রিগুলিকে আমরা ইবাদতের মাধ্যমে জীবন্ত রাখি। হে মুমিন পুরুষ ও নারী! একবার পিছন ফিরে দেখ, জীবনের ক’টি বসন্ত তুমি পার করে এসেছ? তোমার কাছে প্রেরিত আল্লাহর বাণী আল-কুরআনুল হাকীম তোমার ঘরের তাকে রক্ষিত আছে। ঐ মূল্যবান সম্পদ কি তুমি কখনো পড়ে দেখেছ? কখনো কি তা শেষ পর্যন্ত অর্থসহ পাঠ করেছ? হয়তবা করোনি। অতএব আর দেরী নয়। সিদ্ধান্ত নাও রামাযানেই তুমি কুরআন খতম করবে এবং সারা বছর সাধ্যমত দৈনিক কিছু অংশ অর্থসহ তেলাওয়াত করবে। আখেরাতের অমূল্য পাথেয় ছহীহ হাদীছের সংকলনগুলি খরীদ কর ও তা থেকে মুক্তা আহরণ করে পরকালের পাথেয় হাছিল কর। মনে রেখ, কুরআন তার পাঠক ও আমলকারীর জন্য ক্বিয়ামতের দিন সুফারিশকারী হবে।[2]
হে মুমিন! সর্বদা হালাল রূযী গ্রহণের সিদ্ধান্ত নাও। আর তোমার আয়ের একটি অংশ আল্লাহর বিশুদ্ধ দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে ব্যয় কর। নইলে সম্পদের মূল মালিক আল্লাহর কাছে তুমি কিভাবে জবাবদিহি করবে? তোমার সম্পদের একটি অংশ দুস্থ মানবতার সেবায় ব্যয় কর। আল্লাহ তার অনুগ্রহের হাত তোমার দিকে বাড়িয়ে দিবেন। হে শক্তিমান! তুমি শক্তিহীনের উপরে যুলুম করো না। যুলুম ক্বিয়ামতের দিন তোমার জন্য অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে।[3]
হে ব্যবসায়ী! রামাযানকে তুমি তোমার ব্যবসায়ের হাতিয়ারে পরিণত করো না। বরং রামাযানের বরকত হাছিলের স্বার্থে অন্য সময়ের চাইতে কিছু কম লাভ কর। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্রেতার উপরে যুলুম করে যে কয়টা পয়সা তুমি বেশী উপার্জন করবে, ঐ হারাম পয়সা ক্বিয়ামতের দিন বিষধর সর্পের আকারে তোমার গলায় বেড়ী দিয়ে দু’চোয়াল চেপে ধরে বলবে, আমিই তোমার মাল, আমিই তোমার সম্পদ’।[4]
হে সুউচ্চ প্রাসাদের অধিবাসী! অহংকার করো না। অতি সত্বর তোমাকে ভূগর্ভের অন্ধকার কবরে স্থান নিতে হবে। হে বিচারক! অবিচার করো না। তোমাকে বিচার করবেন যিনি, তিনি তোমার মাথার উপরে আছেন।
হে আলেম! তাক্বওয়া অর্জন করুন। তাক্বওয়াহীন আলেম মূর্খের চেয়েও ক্ষতিকর। হে নেতা! লাখো কোটি মানুষের ভাল-মন্দের দায়িত্ব আপনার উপরে। যদি আপনি দায়িত্ব পালনে খেয়ানত করেন, তাহ’লে আপনার জন্য জান্নাতকে হারাম করা হয়েছে (মুসলিম হা/১৪২)।
হে মসজিদের খাদেম ও ইমাম! সাহারী ও ইফতারের পূর্বে ও পরে মাইকবাজি করে গোনাহ কামাই করো না। তোমার ঐ সুরেলা কণ্ঠের তেলাওয়াত ও ইসলামী সঙ্গীত তোমার জন্য নেকীর বদলে গোনাহ বয়ে আনে। এর মাধ্যমে তুমি ইবাদতকারীর ইবাদত নষ্ট করছ, রোগীর, তেলাওয়াতকারীর ও নিদ্রিত ব্যক্তির প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছ এবং তুমি ‘রিয়া’র অপরাধে অপরাধী হচ্ছ। ‘রিয়া’ হল ছোট শিরক।[5] আর শিরকের গোনাহ তওবা ছাড়া মাফ হয় না। অতএব রিয়া ও শ্রুতি ছেড়ে আল্লাহভীরু হও।
হে প্রিয় বোনেরা! আল্লাহ তোমাদেরকে ‘শ্রেষ্ঠ সম্পদ’ রূপে (মুসলিম হা/১৪৬৭) পরীক্ষা হিসাবে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তাই সর্বদা নিজেকে সংযত রাখো। পর্দাহীন অবস্থায় কখনোই বের হবে না। গৃহকোণ তোমার জন্য সর্বাধিক নিরাপদ। শুধু রান্না-বান্না ঘরকন্না নিয়েই ব্যস্ত থেকো না। ইবাদত ও তেলাওয়াতের জন্য একটা সময় বের করে নাও। তোমার অতলান্তিক প্রেম ও স্নেহ দিয়ে তোমার স্বামী ও সন্তানদেরকে আল্লাহর পথে ধরে রাখো। তোমার গৃহকে জান্নাতী গৃহে পরিণত করো। আধুনিক শয়তানী মিডিয়া সমূহের হিংস্র ছোবল থেকে তোমার পবিত্র গৃহকে হেফাযত কর। ধর্মের নামে চালু হওয়া অসংখ্য শিরক ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ থেকে তোমার গৃহকে মুক্ত রাখো। মনে রেখ এগুলি তোমার জান্নাতের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। হে বোন! নিত্য নতুন পোষাক কেনার আগে নিজের কাফনের কথা চিন্তা কর। আখেরাতে হিসাব দেওয়ার আগে দুনিয়ায় নিজের হিসাব নাও।
হে মুমিন পুরুষ ও নারী! ঐ শোন রামাযানের প্রতি রাত্রির আহবান... ‘হে কল্যাণের অভিযাত্রীরা এগিয়ে এসো! হে অকল্যাণের অভিসারীরা বিরত হও! আল্লাহর হুকুমে রামাযানের প্রতি রাত্রিতে বহু ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রাপ্ত হয়ে থাকে’।[6] অতএব এসো যাবতীয় অন্যায় থেকে তওবা করি। এসো আমরা সেই মুক্তিপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন।[7]
[1]. হাকেম হা/৭৮৪৬; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩৩৫৫; মিশকাত হা/৫১৭৪ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়।
[2]. মুসলিম হা/৮০৪; মিশকাত হা/২১২০ ‘ফাযায়েলুল কুরআন’ অধ্যায়।
[3]. মুসলিম হা/২৫৭৮; মিশকাত হা/১৮৬৫ ‘যাকাত’ অধ্যায়।
[4]. বুখারী হা/১৪০৩; মিশকাত হা/১৭৭৪ ‘যাকাত’ অধ্যায়।
[5]. আহমাদ হা/২৩৬৮০; মিশকাত হা/৫৩৩৪ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়।
[6]. তিরমিযী হা/৬৮২; ইবনু মাজাহ হা/১৬৪২; মিশকাত হা/১৯৬০ ‘ছিয়াম’ অধ্যায়।
[7]. ৭ম বর্ষ ১ম সংখ্যা অক্টোবর ২০০৩।