তাবলীগী ইজতেমা ২০১২
রাজশাহী ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতি ও শুক্রবার : ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর দু’দিন ব্যাপী ২২তম বার্ষিক তাবলীগী ইজতেমা রাজশাহী মহানগরীর নওদাপাড়া ট্রাক টার্মিনাল ময়দানে গত ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারী রোজ বৃহস্পতি ও শুক্রবার অত্যন্ত সাফল্যের সাথে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফালিল্লা-হিল হাম্দ। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এবারের তাবলীগী ইজতেমায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লাখো কর্মী ও সুধীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ইজতেমাকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
এবারের তাবলীগী ইজতেমায় উপস্থিতি সংখ্যা ছিল বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশী। ফলে প্যান্ডেল উপচে খোলা আকাশের নীচে বসে বক্তব্য শুনতে হয়েছে হাযার হাযার শ্রোতাকে। মহিলা প্যান্ডেলের অবস্থাও ছিল একই রকম। গত বছরের দ্বিগুণ আকৃতির প্যান্ডেলেও মহিলাদের স্থান সংকুলান হয়নি। এবারও মূল প্যান্ডেল থেকে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার দূরে ‘মহিলা সালাফিইয়াহ মাদরাসা’ ময়দানে মহিলা প্যান্ডেল করা হয় এবং প্রজেক্টরের মাধ্যমে সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। রাজনৈতিক স্বার্থদ্বন্দ্ব ও দুনিয়াবী হিসাব-নিকাশ ভুলে দু’দিনের জন্য হ’লেও মানুষ যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল ইজতেমা ময়দানে এসে। মানুষ পরকালীন মুক্তির পথ খুঁজতে ছুটে আসে এখানে বছরে একবার বিপুল আবেগ ও আকাংখা নিয়ে।
এবারের ইজতেমায় বিভিন্ন যেলা থেকে হাযার হাযার কর্মী ও সুধী রিজার্ভ বাস ও অন্যান্য যানবাহনে করে যোগদান করেন। এর মধ্যে বগুড়া হ’তে ৫৫টি, সাতক্ষীরা ৫০টি, মেহেরপুর ১৫টি, কুষ্টিয়া-পশ্চিম ১২টি, ঢাকা ১০টি, কুমিল্লা ৯টি, চাঁপাই নবাবগঞ্জ ৯টি, গাইবান্ধা-পশ্চিম ৮টি, নরসিংদী ৮টি, পাবনা ৮টি, নাটোর ৭টি, দিনাজপুর-পশ্চিম ৬টি, সিরাজগঞ্জ ৫টি, যশোর ৩টি, নওগাঁ ৩টি বাস ও ৩টি মাইক্রো, খুলনা ৩টি, বাগেরহাট ৩টি, রংপুর ৩টি, দিনাজপুর-পূর্ব ২টি, ঝিনাইদহ ২টি, কুষ্টিয়া-পূর্ব ২টি, জামালপুর-দক্ষিণ ২টি, টাঙ্গাইল ২টি, জয়পুরহাট ২টি, কুড়িগ্রাম-উত্তর ১টি, লালমণিরহাট ১টি, নীলফামারী ১টি, জামালপুর-উত্তর ১টি বাস ও ১টি পিকআপ, পঞ্চগড় ১টি, ফরিদপুর (আটরশি)-১টি, লাকসাম ১টি এবং কুড়িগ্রাম-দক্ষিণ হ’তে ২টি মাইক্রো বাস সহ মোট ২৩৮টি রিজার্ভ বাস, ৬টি মাইক্রো, ১টি পিকআপ যোগে এবং রাজশাহী ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক সুধী পাজেরো, প্রাইভেট কার, ভটভটি, ভ্যান, ইজিবাইক মোটর সাইকেল ও বাই সাইকেল যোগে ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া রাজধানী ঢাকা থেকে এবারই প্রথম রিজার্ভ বগি সহ দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক সুধী ট্রেন যোগে ইজতেমায় যোগদান করেন। এতদ্ব্যতীত সাতক্ষীরা থেকে বাইসাইকেল যোগে তাবলীগী ইজতেমার ছোট ফ্ল্যাগ লাগিয়ে তিনদিন পথ চলে ইজতেমার আগের দিন মারকাযে পৌঁছে যান কাওনডাঙ্গার যয়নুল আবেদীন (৬৫) ও গড়েরডাঙ্গার আব্দুল বারী (৫০)।
১ম দিন বাদ আছর (৪-১৫ মিঃ) মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের উদ্বোধনী ভাষণের মধ্য দিয়ে ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে অর্থসহ পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করেন আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী নওদাপাড়া, রাজশাহীর হেফয বিভাগের প্রধান হাফেয লুৎফর রহমান। স্বাগত ভাষণ পেশ করেন তাবলীগী ইজতেমা ব্যবস্থাপনা কমিটির আহবায়ক ও ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় গবেষণা ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল লতীফ।
উদ্বোধনী ভাষণ :
উদ্বোধনী ভাষণে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত বলেন, আল্লাহ রাববুল আলামীন যুগে যুগে পথহারা মানুষকে নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে পথের দিশা দিয়েছেন। অবশেষে মানবকুল শ্রেষ্ঠ ও শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে প্রচার মিশনের সর্বশেষ দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! আপনার নিকটে যা নাযিল করা হয়েছে, তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিন। আর যদি তা না করেন, তাহ’লে আপনি রিসালাত পৌঁছে দিলেন না’ (মায়েদাহ ৬৭)। অর্থাৎ আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করলেন না। আমীরে জামা‘আত বলেন, প্রচারের মাধ্যমেই দ্বীন টিকে থাকে এবং মানুষের মাঝে তা প্রসারিত হয়। আজকের এই তাবলীগী ইজতেমা জনগণের নিকট সঠিক দ্বীন পৌঁছে দেওয়ার একটি প্রধান মাধ্যম। তিনি বলেন, দু’দিন ব্যাপী তাবলীগী ইজতেমায় ৩২ জন বক্তা পূর্ব নির্ধারিত ৩২টি বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে বক্তব্য রাখবেন। এখানে সমবেত সকলকে উক্ত আলোচনা সমূহ মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করতে হবে এবং অনুপস্থিত ভাইদের নিকটে এ দাওয়াত পৌঁছে দিতে হবে।
পরিশেষে তিনি ইজতেমা ময়দানে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখা ও ইজতেমার পরিবেশ সুষ্ঠু ও সুন্দর রাখার জন্য সকলের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন এবং আল্লাহর নামে দু’দিন ব্যাপী ২২তম বার্ষিক তাবলীগী ইজতেমা-র শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের উদ্বোধনী ভাষণের পর দু’দিন ব্যাপী তাবলীগী ইজতেমায় পূর্বনির্ধারিত বিষয়বস্ত্ত সমূহের উপর একে একে বক্তব্য পেশ করেন ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মাদ নযরুল ইসলাম (সাতক্ষীরা), সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম (মেহেরপুর), সাংগঠনিক সম্পাদক ড. এ. এস. এম. আযীযুল্লাহ (সাতক্ষীরা), সাহিত্য ও পাঠাগার সম্পাদক অধ্যাপক মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম (যশোর), ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য অধ্যাপক শেখ রফীকুল ইসলাম (সাতক্ষীরা) ও মাওলানা জাহাঙ্গীর আলম (খুলনা), ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম (গোপালগঞ্জ), অধ্যাপক মুহাম্মাদ জালালুদ্দীন (কুমিল্লা), ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি মুযাফফর বিন মুহসিন (রাজশাহী), সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রশীদ আখতার (মেহেরপুর), ‘সোনামণি’ সংগঠনের কেন্দ্রীয় পরিচালক ইমামুদ্দীন (চাঁপাই নবাবগঞ্জ), আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহীর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও দারুল ইফতা-র সদস্য মাওলানা আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ (চাঁপাই নবাবগঞ্জ), ‘আন্দোলন’-এর ঢাকা যেলা সভাপতি আলহাজ্জ মুহাম্মাদ আহসান (ঢাকা), মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল (পাবনা), মাওলানা সাইফুল ইসলাম বিন হাবীব (ঢাকা), মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ (কুমিল্লা), মাওলানা আব্দুল মান্নান (সাতক্ষীরা), মাওলানা আলতাফ হোসাইন (সাতক্ষীরা), মাওলানা মুহাম্মাদ আবু তাহের (গাইবান্ধা), অধ্যাপক আকবার হোসাইন (যশোর), মাওলানা আব্দুস সাত্তার (নওগাঁ), আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী নওদাপাড়ার প্রধান মুহাদ্দিছ জনাব মাওলানা আব্দুল খালেক সালাফী ও শিক্ষক মাওলানা রুস্তম আলী (রাজশাহী), মাওলানা রফীকুল ইসলাম (রাজশাহী), মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী ও ঢাকা মোহাম্মাদপুর আল-আমীন জামে মসজিদের মুতাওয়াল্লী জনাব নযরুল ইসলাম, জনাব কেরামত আলী (পূর্বাচল, ঢাকা), শরীফুল ইসলাম (রাজশাহী), মাওলানা আবুবকর ছিদ্দীক (রাজশাহী)।
দু’দিন ব্যাপী তাবলীগী ইজতেমা বিভিন্ন পর্যায়ে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক মুহাম্মাদ জালালুদ্দীন (কুমিল্লা), ঢাকা যেলা ‘আন্দোলন’-এর অর্থ সম্পাদক কাযী হারূনুর রশীদ (ঢাকা) ও ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নূরুল ইসলাম (রাজশাহী) ও আলতাফ হোসাইন (সাতক্ষীরা)। তাবলীগী ইজতেমার বিভিন্ন অধিবেশনে কুরআন তেলাওয়াত করেন হাফেয মুকাররম, হাফেয আবদুল আলীম, আব্দুল্লাহ আল-মারূফ ও আহমাদ আব্দুল্লাহ শাকির। ইসলামী জাগরণী পরিবেশন করেন আল-হেরা শিল্পী গোষ্ঠীর প্রধান মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম (জয়পুরহাট) ও অন্যান্য সদস্যবৃন্দ। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থসহ নির্বাচিত আয়াত ও হাদীছ পাঠ করে শুনান আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহীর ছাত্র আব্দুল হাকীম, শাহ আলম, রবীউল ইসলাম, আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আব্দুল মুমিন, সাখাওয়াত, তালীমুল ইসলাম, ইউনুস ও ইলিয়াস হোসায়েন। এতদ্ব্যতীত দারুলহাদীছ আহমাদিয়া সালাফিইয়াহ, সাতক্ষীরা মারকাযের তিনজন ছাত্র বুরহানুদ্দীন (১০ম), ফরহাদ হোসায়েন (৯ম) ও মাস‘ঊদ রেযা (৯ম) ‘বুনিয়াল ইসলামু ‘আলা খামসিন’-এর আরবী কবিতাটি যৌথকণ্ঠে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে।
আমীরে জামা‘আতের অন্যান্য বক্তব্য :
১ম দিন : উদ্বোধনী ভাষণের পর প্রথম দিন বাদ এশা রাত ৯-টায় প্রদত্ত ভাষণে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত মানবজাতির ভাঙনচিত্র অংকন করে বলেন, আদম (আঃ) থেকে শুরু করে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকলেই এক দ্বীন ও এক ধর্মে অটুট থাকার জন্য মানবজাতিকে উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। তবুও বনী ইসরাঈলরা ৭২ দলে এবং উম্মতে মুহাম্মাদী ৭৩ দলে বিভক্ত হয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে বিশেষ করে ৩৭ হিজরীর পরবর্তী সময়ে খারেজী, শী‘আ, মুরজিয়া, মুতা‘যিলা প্রভৃতি নামে সৃষ্ট দলগুলি মুসলমানদেরকে শতধাবিভক্ত জাতিতে পরিণত করেছে। আর এই বিভক্তি ছিল মূলতঃ রাজনৈতিক ও আক্বীদাগত বিভ্রান্তির কুফল। পরিশেষে তিনি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মর্মমূলে জমায়েত হয়ে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে এক আল্লাহর বান্দা হিসাবে শক্তিশালী মহাজাতিতে পরিণত হওয়ার উদাত্ত আহবান জানান।
২য় দিন : ইজতেমার ২য় দিন রাত ১০-টায় প্রদত্ত ভাষণে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত সোনালী যুগ পরবর্তী মুসলমানদের পতনদশা আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ব্যক্তির মাথায় পচন ধরলে যে অবস্থা হয়, মুসলমানদের ভাগ্যেও একই দুর্দশার আবির্ভাব ঘটে। আর এই দুর্দশার জন্য তিনটি কারণ ছিল দায়ী। আলেমদের পদস্খলন, আল্লাহর কিতাবে মুনাফিকদের বিতর্ক এবং পথভ্রষ্ট নেতাদের শাসন। তিনি বলেন, ছাহাবীযুগ থেকে পরবর্তী সকল যুগে আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের প্রতিরোধ ও প্রচার কৌশলের মাধ্যমে তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহ অক্ষুণ্ণ থাকে। যদিও এজন্য তাঁদেরকে সর্বদা কঠিন মূল্য দিতে হয়েছে এবং বিদ‘আতপন্থীদের চক্রান্তে যুগে যুগে চরম নির্যাতনের সম্মুখীন হ’তে হয়েছে এবং আজও হ’তে হচ্ছে। তবুও আল্লাহর হাযার শোকর যে, শিরক ও বিদ‘আতের ঘন অন্ধকার এবং অতুলনীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখেও বাংলাদেশে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক জীবন গড়ার আন্দোলনের প্রতি দ্বীনদার মানুষের আকর্ষণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজকের এই তাবলীগী ইজতেমা তার একটি বড় দৃষ্টান্ত। পরিশেষে তিনি সকলকে দুনিয়ার বিনিময়ে দ্বীনকে বিক্রি না করে আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাত লাভের জন্য ঐক্যবদ্ধ জামা‘আতী যিন্দেগী গড়ে তোলার আহবান জানান।
মহিলা সমাবেশ :
ইজতেমার ২য় দিন শুক্রবার সকাল ১০-টায় মহিলা প্যান্ডেলে সমবেত মা-বোনদের উদ্দেশ্যে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত বলেন, নৈতিকতা সম্পন্ন জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন আদর্শ মাতা। কেননা মা হ’ল পরিবারের প্রথম শিক্ষিকা। তাই মাকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে নিজের জীবন গঠনের পাশাপাশি সন্তানদেরকেও সেভাবে গড়ে তুলতে হবে। মায়েরা যদি সন্তানের জন্য মডেল হ’তে পারেন, তাহ’লে তাদেরকে দেখেই সন্তানরা আদর্শ সন্তান হিসাবে গড়ে উঠবে। আর এসব আদর্শ সন্তানই দেশ ও জাতির কল্যাণে অবদান রাখতে সক্ষম হবে ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ এদেশে মানুষের আক্বীদা ও আমল সংশোধনের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের কাজ করে যাচ্ছে। স্রেফ পরকালীন স্বার্থে অহি-র বিধানের আলোকে পরিচালিত এ আন্দোলনে শরীক হয়ে মহিলাদের মাঝে ব্যাপকভাবে দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি উপস্থিত মা-বোনদের প্রতি আহবান জানান।
মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ : ইজতেমার ২য় দিন সকাল ১১-টায় দারুল ইমারতে আহলেহাদীছ ও সমমনা মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে এক মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশের ১৬টি যেলা থেকে মোট ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গাইবান্ধা-পশ্চিম যেলা ‘আন্দোলন’-এর প্রধান উপদেষ্টা প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা জনাব নূরুল ইসলাম প্রধান (গাইবান্ধা) ও ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর সাবেক শূরা সদস্য প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা জনাব রবীউল ইসলাম (পাবনা)। এতদ্ব্যতীত অনেকে সঠিক সময় অবগত হ’তে না পারায় ইজতেমায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও উক্ত অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারেননি। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বলেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য আপনাদের ত্যাগ ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম অনস্বীকার্য। কিন্তু বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য ‘ইসলাম’-এর কোন বিকল্প নেই। ইসলামী চেতনা হারিয়ে গেলে এদেশের স্বাধীনতাও বিলীন হয়ে যাবে। তিনি সকলকে ইসলামের আদিরূপ প্রতিষ্ঠার নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর পতাকা তলে সমবেত হয়ে বাকী জীবন উৎসর্গ করার আহবান জানান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকল মুক্তিযোদ্ধা ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-কে কালিমালিপ্ত করার জন্য বিগত সরকারের ঘৃণ্য অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানান এবং বর্তমান সরকার কর্তৃক আজও মিথ্যা মামলা সমূহ চালিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
যুবসমাবেশ :
ইজতেমার ২য় দিন বেলা সাড়ে ১১-টায় প্রস্তাবিত দারুল হাদীছ বিশ্ববিদ্যালয় (প্রাঃ) জামে মসজিদে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর উদ্যোগে ‘যুবসমাবেশ’ অনুষ্ঠিত হয়। ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি মুযাফফর বিন মুহসিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুলাহ আল-গালিব যুবসংঘের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা আমাকে ওয়াদা দাও আগামী দিনে তোমরা আহলেহাদীছ আন্দোলনকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিতে রাযী আছ কি-না? সকলে সমস্বরে আমীরে জামা‘আতের উক্ত আহবানে সাড়া দিয়ে ওয়াদাবদ্ধ হন।
সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য পেশ করেন ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় যুববিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক মুহাম্মাদ আমীনুল ইসলাম (রাজশাহী), কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য অধ্যাপক শেখ রফীকুল ইসলাম (সাতক্ষীরা), বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম (গাপালগঞ্জ), সহ-সভাপতি অধ্যাপক আকবার হোসাইন (যশোর), সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জালালুদ্দীন (কুমিল্লা) প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সঞ্চালক ছিলেন ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নূরুল ইসলাম (রাজশাহী)।
জুম‘আর খুৎবা :
এবারই প্রথম আমীরে জামা‘আত ইজতেমা প্যান্ডেলে জুম‘আর খুৎবা দেন ও ইমামতি করেন। খুৎবায় তিনি আমল কবুলের তিনটি শর্তের উপর আলোকপাত করেন। জুম‘আর ছালাতের পর রাজশাহী মহানগরীর মাননীয় মেয়র এ.এইচ.এম খায়রুযযামান লিটন মুছল্লীদের ধন্যবাদ জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।
ইজতেমার অন্যান্য রিপোর্ট
জাতীয় গ্রন্থপাঠ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ : এবারই সর্বপ্রথম ‘যুবসংঘে’র উদ্যোগে উক্ত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। যাতে ‘ক’ গ্রুপে (থিসিস) ৫০ জন এবং ‘খ’ গ্রুপে (নবীদের কাহিনী ১ ও ২) ৩১ জন অংশগ্রহণ করে। তন্মধ্যে ‘ক’ গ্রুপে শীর্ষস্থান অধিকারী তিনজন হ’ল যথাক্রমে আব্দুল হাসীব, আব্দুল মান্নান (রাজশাহী) ও শামীম আহমাদ (জয়পুরহাট) এবং ‘খ’ গ্রুপে আসাদুল্লাহ আল-গালিব (কুষ্টিয়া-পূর্ব), আব্দুল্লাহ আল-মাহমূদ (চাঁপাই নবাবগঞ্জ) ও আব্দুল্লাহ আল-মারূফ (বগুড়া)। এছাড়া উচ্চ নম্বর প্রাপ্তির হিসাবে প্রতি গ্রুপে ৫ জন করে ১০ জনকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়।
প্রতি গ্রুপের শীর্ষ তিনজনকে সম্মাননা ক্রেস্ট ও আর্থিক পুরস্কার এবং বিশেষ পুরস্কার প্রাপ্তদের জন্য সম্মাননা ও আর্থিক পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রাপকদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ও মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা। উল্লেখ্য যে, পুরস্কারের যাবতীয় খরচ বহন করেন ‘আন্দোলন’-এর সঊদী আরব শাখার প্রচার সম্পাদক জনাব সোহরাব হোসায়েন (পাবনা)।
দাওরা ফারেগ ছাত্রদের সনদ প্রদান :
এবারই প্রথম আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী থেকে তাফসীর ও কুতুবে সিত্তাহ পাঠ শেষে দাওরা ফারেগ ছাত্রদের সনদ প্রদান করা হয়। ২০১০ সালের ফারেগ ৫ জন ছাত্র হ’লেন যথাক্রমে (১) আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব (সাতক্ষীরা) (২). হাশেম আলী (গাইবান্ধা) (৩) আব্দুছ ছামাদ (সাতক্ষীরা) (৪) ইমামুদ্দীন (চাঁপাই নবাবগঞ্জ) (৫) আরীফুল ইসলাম (চাঁপাই নবাবগঞ্জ)।
২০১১ সালের ফারেগ ৭ জন ছাত্র হ’লেন যথাক্রমে- (১) আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব (সাতক্ষীরা) (২) হাফেয মুকাররম (রাজশাহী) (৩) মুখতারুল ইসলাম (রাজশাহী) (৪) মেছবাহুল ইসলাম (দিনাজপুর) (৫) আব্দুর রশীদ (সাতক্ষীরা), ৬. সাইফুল ইসলাম (লালমণিরহাট) (৭) রাশেদুল ইসলাম (মেহেরপুর)।
তাদের হাতে সনদ ও পুরস্কারের সেট (জামা-পাজামা-টুপী) তুলে দেন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত এবং মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জনাব আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ ও প্রধান মুহাদ্দিছ মাওলানা আব্দুল খালেক সালাফী।
হেফয ফারেগ ছাত্রদের সনদ প্রদান : এবারে আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী থেকে ৫ জন ছাত্র হেফয বিভাগ থেকে ফারেগ হয়। তারা হ’ল- (১) সরোয়ার হোসায়েন (রাজশাহী) (২) আব্দুল কাদের (চাঁপাই নবাবগঞ্জ) (৩) নাজমুল হক (নওগাঁ) (৪) শাহীন কবীর (চাঁপাই নবাবগঞ্জ) (৫) আছিফুর রহমান (চাঁপাই নবাবগঞ্জ)।
বিদায়ী ভাষণ ও দো‘আ :
৩য় দিন শনিবার ফজরের জামা‘আতে ইমামতি শেষে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ইজতেমায় আগত মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বিদায়ী ভাষণ দেন এবং তিনি সবাইকে ছহী-সালামতে স্ব স্ব গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার শুভ কামনা করে মজলিস ভঙ্গের সুন্নাতী দো‘আ পাঠের মাধ্যমে ইজতেমার সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বিদায়কালে উপস্থিত মুছল্লীবৃন্দ আবেগভরা মনে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে বিদায়ী মুছাফাহা করেন ও দো‘আ নিয়ে যান।
মৃত্যু সংবাদ
(১) ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ রাজবাড়ী যেলার তাবলীগ সম্পাদক জনাব বেলাল হোসাইন (৪০) গত ৫ই মার্চ সোমবার সকাল পৌনে ১০-টায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি‘ঊন। মৃত্যুকালে তিনি পিতা-মাতা, স্ত্রী, নাবালেগ ১ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। উল্লেখ্য, জনাব বেলাল বাইসাইকেল যোগে তার স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে সাথে নিয়ে নিজ দোকানে যাওয়ার পথে ভটভটির সাথে ধাক্কা লাগলে এই মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে তার ছেলেও আহত হয়। একই দিন বিকাল ৫-টায় মত্তিডাঙ্গীস্থ নিজ বাড়ীতে তার প্রথম জানাযার ছালাত অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর বিকাল সাড়ে ৫-টায় মৈশালা দাখিল মাদরাসা ময়দানে দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় জানাযায় ইমামতি করেন মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের পক্ষে যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি মাওলানা মকবুল হোসাইন।
জানাযায় কেন্দ্রীয় সাংগঠনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক জনাব বাহারুল ইসলাম। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, ‘যুবসংঘে’র রাজবাড়ী যেলা সভাপতি মুনীরুল ইসলাম, মৈশালা আহলেহাদীছ কবরস্থানের সেক্রেটারী হাজী আব্দুল খালেক, যেলা ‘আনেদালন’ ও ‘যুবসংঘে’র দায়িত্বশীলবৃন্দ এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। তাকে মৈশালা কবরস্থানে দাফন করা হয়।
(২) ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ঢাকা যেলার সহ-সভাপতি আলহাজ্জ মোশাররফ হোসাইনের বড় ভাই বেরাইদ-পূর্বপাড়া আহলেহাদীছ জামে মসজিদের মুতাওয়াল্লী জনাব আযহার হোসাইন (৮৫) গত ৮ই মার্চ সকাল সাড়ে ১০-টায় ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি‘ঊন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ৪ পুত্র ও ১০ কন্যা রেখে গেছেন। ঐ দিন বাদ মাগরিব ভূঁইয়াপাড়া আহলেহাদীছ জামে মসজিদে তার জানাযার ছালাত অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় ইমামতি করেন তার ছোট ভাই আলহাজ্জ মোশাররফ হোসাইন। জানাযায় যেলা ‘আন্দোলন’-এর অর্থ সম্পাদক কাযী হারূণুর রশীদ, স্থানীয় এম.পি. জনাব আলহাজ্জ রহমাতুল্লাহ ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সহ বিপুল সংখ্যক মুছল্লী যোগদান করেন। তাকে বড় বেরাইদ কবরস্থানে দাফন করা হয়।
[আমরা তাঁদের রূহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং তাঁদের শোকাহত পরিবার বর্গের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। -সম্পাদক]