জনপ্রিয়তা শুদ্ধতার দলীল নয়। কোন মানুষের প্রতি মুগ্ধতা বরাবরই অন্ধ অনুকরণের দিকে ধাবিত করে। জীবিত ব্যক্তির প্রতি অন্ধ ভক্তি কাম্য নয়। কারণ কোন সেলিব্রেটি বক্তা যখন রাসূল (ছাঃ) প্রসঙ্গে বলেন, তিনি ‘কাউবয়’ ছিলেন, খাদীজাতুল কুবরার ‘কর্মচারী’ ছিলেন। এসব তিনি ভুলই বলেছেন। কিন্তু জনপ্রিয় মানুষের ভুলের সমস্যা হ’ল এ ভুল ব্যাপক পরিচিতি পায়। আর মানুষ সেটাকে ভুল বলে মানতে চায় না। ‘কাউবয়’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘রাখাল’। ‘রাখাল’ শব্দ বললে অন্তরে হীন দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে যদি কেউ ‘কাউবয়’ বলে, তাহ’লে দৃশ্যপটে সেই হীন অবয়বটিই ফুটে ওঠে। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শানে এরূপ শব্দ প্রয়োগ মুমিনের জন্য কখনোই শোভনীয় নয়।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সহ সব আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম বকরী চরিয়েছেন। বকরী চরিয়েছেন বলেই কি তাদেরকে ‘কাউবয়’ বা ‘রাখাল’ বলা যাবে? এর উত্তর হ’ল, না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘কাউবয়’ বলার সুযোগ নেই। এটা তাঁকে হীন করার শামিল।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবনী অধ্যয়নে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর দুধ ভাইয়ের সাথে বকরী চরাতে গিয়েছেন। তবে নিয়মিত যাওয়ার কথা বলা হয়নি। ‘রাখাল’ বা ‘কাউবয়’ এই পেশার সাথে সম্পৃক্তদের বলা যেতে পারে। অর্থাৎ যারা পেশাগতভাবে গরু-ছাগল চরায়। কিন্তু যারা মাঝে-মধ্যে বা সাময়িক এ কাজ করে, তাদেরকে ‘কাউবয়’ বলার প্রশ্নই আসে না। সেজন্য নবীজিকে ‘কাউবয়’ বলা অযেŠক্তিক এবং গর্হিত। এছাড়া যে গরু চরানোর পেশায় নিয়োজিত, তাকে কাউবয় বলা হয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) গরু চরিয়েছেন বলে হাদীছ বা সীরাতের কিতাবগুলোতে উলেলখ নেই। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘কাউবয়’ বলা বাস্তবতার বিপরীত।
সবচেয়ে বড় কথা হ’ল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শানে এমন শব্দ ব্যবহার করার অনুমতি নেই, যার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে খাটো করে দেখার সুযোগ তৈরি হয়। যেমন ইহূদীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে খাটো করে বলত ‘রা‘এনা’। এর অর্থ লক্ষ্য করা, তত্ত্বাবধান করা। কিন্তু সেদিকে লক্ষ্য না করে এবং ইহূদীদের উদ্দেশ্য না জেনে কোন কোন ছাহাবী শব্দটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শানে প্রয়োগ করতে শুরু করেন। তখন আললাহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করে এ বিষয়ে সতর্ক করেন এবং শব্দটি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এ থেকে বুঝা যায়, অর্থ সঠিক হ’লেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শানে শব্দ প্রয়োগে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেন কোনভাবে তাঁর প্রতি অসম্মানের সুযোগ তৈরি না হয়। এক্ষেত্রে দাঈদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। আললাহ তা‘আলা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন -আমীন!
‘বিশবনবীর কিন্তু টাকা-পয়সা ছিল না। ছাগল চরাতো, কাউবয় ... এরপর খাদীজাতুল কুবরার স্টাফ (কর্মচারী) হিসাবে ক্যারিয়ার শুরু করলেন...’। প্রিয় পাঠক! এত আধুনিকতা কতটুকু শোভনীয়? তিনি আমাদের রাসূল, তাঁর শানে এমন শব্দ ব্যবহার শালীনতার সীমা বহির্ভূত। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَا بَعَثَ اللهُ نَبِيًّا إِلاَّ رَعَى الْغَنَمَ فَقَالَ أَصْحَابُهُ وَأَنْتَ فَقَالَ نَعَمْ كُنْتُ أَرْعَاهَا عَلَى قَرَارِيطَ لأَهْلِ مَكَّةَ، ‘আললাহ তা‘আলা এমন কোন রাসূল প্রেরণ করেননি, যিনি বকরী চরাননি। তখন তাঁর ছাহাবীগণ বলেন, আপনিও? তিনি বলেন, হ্যাঁ; আমি কয়েক ক্বিরাতের (মুদ্রা) বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল চরাতাম’।[1] এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূলুললাহ সহ সকল নবী (সাময়িক সময়ের জন্য হ’লেও) মেষ চরানোর কাজ করেছেন। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পবিত্র জীবনী বা তাঁর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে মেষ চরিয়েছেন এটা বলা যেতে পারে। কিন্তু তাঁর সম্মানহানি হয়- এমন অশোভন শব্দ উচ্চারণ করা বা ইঙ্গিত করা হারাম।
‘কাউবয়’ শব্দটা কানে আসলে চোখে কি ভাসে? ওয়েস্টার্ন মুভির দৃশ্য। যাযাবর উচ্ছৃংখল একদল লোক যারা সারা বছর গরু চরিয়ে যখন শহরে ফেরে তখন বিশৃঙখলা, অনাচারে লিপ্ত হয়। ম্যানার বলে কিছু থাকে না। অথচ নবীগণের মেষ চরানোর কারণ হ’ল আললাহ তাঁদেরকে ধৈর্যশীল করতে চেয়েছেন, যেন তাঁরা স্বীয় উম্মাতের ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করতে পারেন। নবী মূসা (আঃ)-এর সাথে তাঁর উম্মতের লোকেরা যা করেছিল, তা ছিল রীতিমতো অসহনীয়। উম্মতকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে-এই শিক্ষাই তাঁদের মধ্যে প্রোথিত করেছেন। গরু চরানোর মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জিত হয় না। আমাদের রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কখনোই গরু চরাননি। সুতরাং তিনি কখনও Cowboy ছিলেন না। যিনিই বলে থাকুন তিনি ভুল বলেছেন। যেখানে নবীর নাম শুনলেই দরূদ পড়তে হয়, সেখানে তাঁকে Cowboy ডাকা কতটা ঔদ্ধত্য তা বলাই বাহুল্য।
মহান আললাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقُولُوا رَاعِنَا وَقُولُوا انْظُرْنَا وَاسْمَعُوا وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٌ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা রা‘এনা বলো না বরং ‘উনযুরনা’ বল এবং (তাঁর) কথা শোন। আর (মনে রেখ) কাফেরদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (বাক্বারাহ ২/১০৪)। এখানে رَاعِنَا -এর অর্থ আমাদের দিকে খেয়াল করুন! কোন কথা বুঝা না গেলে এই শব্দ ব্যবহার করে শ্রোতা নিজের প্রতি বক্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করত। কিন্তু ইহূদীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি বিদ্বেষ ও অবাধ্যতাবশতঃ এই শব্দ ব্যবহার করত, যাতে তার অর্থের পরিবর্তন ঘটতো এবং তাদের অবাধ্যতার উদ্দেশ্যে মিষ্ট-মধুর স্বাদ পেত। যেমন তারা বলত, رَاعِيْنَا ‘রাঈনা’ অথবা رَاعِنَا ‘রা‘এনা’ (নির্বোধ)। অনুরূপভাবে তারা السَّلاَمُ عَلَيْكَ-এর পরিবর্তে السَّامُ عَلَيْكَ (আপনার মৃত্যু হোক!) বলত।[2] তাই মহান আললাহ বললেন, তোমরা اُنْظُرْنَا বল। এই আয়াত থেকে জানা গেল, যে শব্দসমূহের মধ্যে অপমানজনক অর্থের আভাস থাকবে, আদব ও সম্মানার্থে তা ব্যবহার ঠিক নয়। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে গরুর রাখাল বা cowboy ডাকাও নিষিদ্ধ।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বয়স যখন আট বছর তখন তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিব চলে গেলেন পরপারে। তাঁর ঠাঁই হ’ল চাচা আবু তালিবের ঘরে। সেখানেই শৈশব ও কৈশোর পাড়ি দিলেন। প্রচন্ড টানা-পোড়েন ছিল চাচার সংসারে। তাই বিশবনবী (ছাঃ) সহযোগিতার লক্ষ্যে মাঝে মধ্যে ছাগল চরাতেন। তিনি ছাগল-ভেড়া চরাতে উৎসাহ দিয়েছেন। কারণ ছাগল লালন-পালনে আললাহর পক্ষ থেকে বরকত রয়েছে। উম্মে হানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) তাঁকে বলেন, اتَّخِذِي غَنَمًا فَإِنَّ فِيهَا بَرَكَةً ‘তুমি ছাগল-ভেড়া লালন-পালন কর। কারণ তাতে বরকত রয়েছে’।[3]
অপরদিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কখনোই খাদীজা (রাঃ)-এর কর্মচারী ছিলেন না। তাঁর সাথে ব্যবসা ছিল মুযারাবা ভিত্তিতে। মূলধন ছিল খাদীজার আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সে ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। তাঁরা লভ্যাংশ ভাগ করে নিয়েছেন।[4] খাদীজা (রাঃ)-এর একাধিক ব্যবসা ছিল। কিন্তু মক্কাবাসীদের ব্যবসা যেহেতু আমদানী-রফতানী ভিত্তিক ছিল, ফলে তার নিজের পক্ষে এই ব্যবসা পরিচালনা সম্ভব ছিল না। প্রায় সব সীরাতবিদগণ এমনটি বলেছেন। ১২ বছর বয়সে পিতৃব্য আবু তবালিবের সাথে সর্বপ্রথম ব্যবসা উপলক্ষে শাম বা সিরিয়া সফর করেছিলেন। কিন্তু বাহীরা রাহেবের কথা শুনে চাচা তাকে সাথে সাথেই মক্কায় ফেরৎ পাঠিয়ে দেন।[5]
কুরায়েশ বংশে অনেকে ছিলেন, যারা নির্দিষ্ট লভ্যাংশের বিনিময়ে ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগ করতেন। কিন্তু নিজেরা সরাসরি ব্যবসায়িক সফরে যেতেন না। এজন্য তারা সর্বদা বিশবস্ত ও আমানতদার লোক তালাশ করতেন। খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ ছিলেন এমনই একজন বিদুষী ব্যবসায়ী মহিলা। মুহাম্মাদের সততা ও আমানতদারীর কথা শুনে তিনি তার নিকটে অন্যদের চেয়ে অধিক লভ্যাংশ দেওয়ার অঙ্গীকারে ব্যবসার প্রস্তাব পাঠান। চাচার সাথে পরামর্শক্রমে তিনি এতে রাযী হয়ে যান। অতঃপর খাদীজার গোলাম মায়সারাকে সাথে নিয়ে প্রথম ব্যবসায়িক সফরে তিনি সিরিয়া গমন করেন। ব্যবসা শেষে মক্কায় ফিরে আসার পরে হিসাব-নিকাশ করে মূল পুঁজি সহ এত বেশী লাভ হস্তগত হয় যে, খাদীজা ইতিপূর্বে কারু কাছ থেকে এত লাভ পাননি।[6]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সৃষ্টিজগতে এতটাই সম্মানের পাত্র যে, তাঁর শান ও মান রক্ষা করা উম্মতের জন্য অবশ্য কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শানে কি কি কথা বলা যাবে; আর কি কি বলা যাবে না- সবই বর্ণিত আছে কুরআন-হাদীছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শান ও মান সম্পর্কে প্রণীত একটি মূল্যবান গ্রন্থ হ’ল কাযী ইয়ায (রহ.)-এর ‘আশ-শিফা ফঅ তা‘রীফি হুকূকিল মুছত্বফা’। এটির বঙ্গানুবাদও রয়েছে। আনদালুসের (স্পেন) টলেডোতে ইবনু হাতীম মুতাফাক্কিহ তুলাইতালী নামে একজন আলেম ছিলেন। একবার বিতর্কের সময় তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘ইয়াতীম’ বলে অভিহিত করেন। কিন্তু এই শব্দচয়নকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শানের খেলাফ হিসাবে উল্লেখ করেন আনদালুসের সকল আলেম। তারা ঐ আলেমকে হত্যার ফৎওয়া প্রদান করেন! দেখুন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাস্তবেই ইয়াতীম ছিলেন যা কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু বিতর্কের সময় এই বাস্তব সত্য কথাটাকেই আনদালুসের সকল আলেম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শানের খেলাফ হিসাবে অভিহিত করেছেন। অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে Cowboy বলা ও নিঃসনেদহে তাঁর শান ও মানের খেলাফ। সুতরাং আমাদের সকলের উচিত রাসূল (ছাঃ)-এর শানে শালীন শব্দ ব্যবহার করা। আল্লাহ আমাদেরকে বুঝার তাওফীক দান করুন-আমীন!
মুহাম্মাদ জুয়েল রানা
* সহকারী শিক্ষক, উৎকর্ষ ইসলামিক স্কুল, চিরিরবনদর, দিনাজপুর।
[1]. বুখারী হা/২২৬২; মিশকাত হা/২৯৮৩।
[2]. বুখারী হা/৬২৫৬।
[3]. ইবনু মাজাহ হা/২৩০৪; ছহীহাহ হা/৭৭৩।
[4]. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ, ১৪৩৭ হি./২০১৫ খ্রি.), পৃ. ৭৬।
[5]. হাকেম হা/৪২২৯; তিরমিযী হা/৩৬২০।
[6]. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ. ৭৬।