সময়
লেগেছে ২৮ বছর। ছিল সাড়ে আটশো সাক্ষী। দেখা হয়েছে সাত হাযারের বেশী
দলিলপত্র, ছবি আর ভিডিও টেপ। এত কিছুর পর ভারতের উক্তর প্রদেশের
লাক্ষেণŠ-এর বিশেষ আদালত ষোড়শ শতকের এই বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়ার
জন্য কাউকে দোষী বলে খুঁজে পায়নি। অযোধ্যায় এই মসজিদটিতে হামলা চালিয়েছিল
কিছু উচ্ছৃঙ্খল সমাজবিরোধী লোক। যে মামলায় ৩২ জন জীবিত অভিযুক্ত, তাদের
মধ্যে ছিলেন সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী এল কে আদভানী সহ অনেক সিনিয়র বিজেপি
নেতা। গত ৩০শে সেপ্টেম্বর প্রদত্ত রায়ে এদের সবাইকে খালাস দেয়া হয়েছে।
আদালত বলেছে, ১৯৯২ সালে এই মসজিদটি ধ্বংস করেছে অচেনা ‘সমাজ-বিরোধীরা’ এবং
এই হামলা পূর্ব-পরিকল্পিত ছিল না।
অথচ মসজিদটি ধ্বংস করা হয়েছিল মাত্র চার ঘন্টায় হাযার হাযার মানুষের চোখের সামনে। গত বছর ভারতের সুপ্রিম কোর্টও বলেছিল, এটি ছিল এক ‘সুপরিকল্পিত ঘটনা’ এবং ‘আইনের শাসনের এক গুরুতর লঙ্ঘন’। তারপরও আদালত এরকম রায় দিয়েছে।
এর ফলে দীর্ঘ ২৮ বছর পর বাবরী মসজিদ মামলার রায়ে বেকসুর খালাস পেয়ে গেলেন লালকৃষ্ণ আদভানী, মুরলি মনোহর যোশী, কল্যাণ সিং, উমা ভারতী সহ ৩২ জন অভিযুক্ত। রায়ের পর স্বাভাবিকভাবেই ভারতের শাসক দল বিজেপির পক্ষ থেকে রায়কে স্বাগত জানানো হয়েছে। তবে কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিরোধী নেতারা।
ভারতের তৃণমূল কংগ্রেস সংসদ সদস্য সৌগত রায় বলেন, ‘এখন তো আদালতের সব রায়ই শাসকদলের পক্ষে হচ্ছে। রাম জন্মভূমির ব্যাপারেও হয়েছে। আমি ভাবছিলাম এমনটাই হবে’।
কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই রায় প্রত্যাশিতই ছিল। বিজেপি বিরোধী দলগুলোকে বলব, ভারতের ঐক্য সংহতি বিসর্জন দিয়ে যারা ভারতে একটি বিশেষ ধর্মের দেশ বলে চিহ্নিত করতে চান, তাঁদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হন’। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, মোদী-শাহের রাজত্বে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সরকার যা চাইছে সেই পথেই রায় বেরোচ্ছে। এতে দেশের মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে যাচ্ছে।
কলকাতার দৈনিক ‘বর্তমান’ পত্রিকার সম্পাদক হিমাংশু সিংহ ‘বিচারের বাণী নীরবে নয়, আজ সশব্দে কাঁদছে’ শিরোনামে প্রকাশিত তার নিবন্ধে লিখেছেন, ‘রায় ঘোষণার সময় বাড়িতে আগাগোড়া কন্যা প্রতিভার হাত চেপে বসে থাকা আদভানীজির বয়স আজ ৯২। আর যোশিজির ৮৬। তিন দশক বড় কম সময় নয়। কথায় বলে, ‘জাস্টিস ডিলেড ইজ জাস্টিস ডিনায়েড’। একটা বিচার করতেই যদি এতটা সময় লাগে এবং শেষে সব অভিযুক্তই ছাড়া পেয়ে যায়, তাহলে নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা অটুট থাকবে তো? নাকি আস্থা হারিয়ে অন্ধকার জগতে হারিয়ে যাবে মানুষ?’
উল্লেখ্য উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে সেসময় যে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল তার প্রধান সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি লিবারহান এ রায়ের প্রেক্ষিতে বলেন, রিপোর্টে আমার সিদ্ধান্ত ছিল বাবরী ভাঙার পিছনে আদভানী, জোশী, উমা ভারতী সহ অন্যান্যদের চক্রান্ত কাজ করেছে। আমি এখনো তা বিশ্বাস করি। বিস্তারিত পরিকল্পনা করে বাবরী ভাঙা হয়েছিল। উমা ভারতী ভাঙার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কোনো অদৃশ্য শক্তি মসজিদ ভাঙেনি, মানুষই তা ভেঙেছিল।
লিবারহান বলেন, ‘আমার তদন্ত রিপোর্ট ঠিক ছিল। আমি সৎ থেকেছি। যা ঘটেছিল তার সত্য বিবরণ দিয়েছি। আমার কাছে উমা ভারতী দায় স্বীকার করেছিলেন। এখন যদি বিচারক বলেন, তিনি নির্দোষ, সেখানে আমি কী করব?
[বিচার ব্যবস্থার এই ভঙ্গুর দশা ভারতের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের বার্তা নিয়ে এসেছে। এ মুহূর্তে প্রয়োজন হুজুগে লোকদের হাত থেকে বিচক্ষণ লোকদের হাতে ভারতের শাসনব্যবস্থা অর্পণ করা। প্রচলিত গণতন্ত্রে সেটা সম্ভব হবে কি-না সন্দেহ। তবুও সেদেশের দূরদর্শী নেতাদের এগিয়ে আসা কর্তব্য। যাতে অন্ততঃ বিচার বিভাগটা রক্ষা পায় (স.স.)]