ইসলাম একটি সার্বজনীন পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এতে কোন কিছু সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ নেই। এটা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় পূর্ণতা লাভ করেছে। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে ইসলাম পরিপূর্ণ রূপরেখা তুলে ধরেছে। সাথে সাথে তাবীয জাতীয় জিনিস ব্যবহার নিষেধ করেছে। বরং একে শিরক বলে আখ্যায়িত করেছে। রোগ মুক্তির আশায় তামার বালা অথবা অষ্টধাতুর আংটি ব্যবহার করাও শিরক। গাভীকে যে কোন ক্ষতি থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে গাভীর গলায় চামড়া ব্যবহার করা, বালা-মুছীবত থেকে বাঁচার জন্য সাদা কড়ি চুলে বেঁধে ব্যবহার করা, বাচ্চাকে শয়তানের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার আশায় কালো সূতায় গিরা দিয়ে ব্যবহার করা, বাচ্চা যেন না মরে এ আশায় কান ফুঁড়িয়ে রিং ব্যবহার করা এবং যে কোন উদ্দেশ্যে তাবীয ব্যবহার করা ইত্যাদি স্পষ্ট শিরক। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে ইসলামের দৃষ্টিতে তাবীয ও ঝাড়ফুঁক সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।-
তাবীযের সংজ্ঞা :
‘তাবীয’ (تَعْوِيْذٌ) আরবী শব্দ। ‘আউযুন’ (عَوْذٌ) মূলধাতু হ’তে উৎপন্ন। এটি একবচন। বহুবচনে ‘তা‘আবীয’ (تَعَاوِيْذٌ)। এর সমার্থক শব্দ হচ্ছে ‘তামীমা’ (تَمِيْمَة)। এর বহুবচন হচ্ছে ‘তামায়েম’ (تَمَائِمٌ)। ‘তাবীয’ বা ‘তামীমা’-এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- রক্ষাকবচ, মাদুলি ইত্যাদি। আবু মানছূর বলেছেন, তামীম দ্বারা তাবীয বুঝানো হয়েছে, যা মানুষ বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য ব্যবহার করে থাকে। এমনিভাবে বিষধর সাপ ইত্যাদি থেকে বাঁচার জন্য যে পুথি জাতীয় জিনিস সূতায় গেঁথে গলায় বেঁধে দেয়া হয়, তাকেও ‘তামীমা’ অর্থাৎ ‘তাবীয’ বলা হয়।[1]
ইবনে জোনাই (রহঃ) বলেন, অনেকের মতে তাবীয হচ্ছে ঐ জিনিস, যা তাগায় বেঁধে লটকানো হয়। যেমন বলা হয়, আমি শিশুর গলায় তাবীয ঝুলিয়ে দিয়েছি। এককথায় বলা যায় যে, মানুষের গলায় বা অন্যান্য অঙ্গে বিপদাপদ থেকে বাঁচার জন্য যেসব তাবীয ধারণ করা হয়, সেগুলিকেই ‘তামীমা’ বলা হয়।[2]
আল-কুরআনের দৃষ্টিতে তাবীয :
মানুষ অসুস্থ হ’লে তাকে সুস্থতা দান করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। এখানে কারো কোন এখতিয়ার নেই। ওষুধ, ডাক্তার বা চিকিৎসা ব্যবস্থা কেবলমাত্র অসীলা বা মাধ্যম। তাই সর্বাবস্থায় বান্দাকে আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে। স্রেফ ডাক্তার বা ওষুধের উপর আস্থাশীল হ’লে শিরক হবে। যা কাবীরাহ গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍّ فَلاَ كَاشِفَ لَهُ إِلاَّ هُوَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ ‘যদি আল্লাহ তোমাকে কষ্ট দেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী আর কেউ নেই; পক্ষান্তরে তিনি যদি তোমার কল্যাণ দান করেন তবে তিনিই তো সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান’ (আন‘আম ৬/১৭)। তিনি আরো বলেন, أَفَأَمِنُوْا أَنْ تَأْتِيَهُمْ غَاشِيَةٌ مِنْ عَذَابِ اللهِ أَوْ تَأْتِيَهُمْ السَّاعَةُ بَغْتَةً وَهُمْ لاَ يَشْعُرُوْنَ ‘আল্লাহ যদি তোমাকে কষ্ট দেন, তাহ’লে তিনি ব্যতীত তা মোচনকারী আর কেউ নেই; আর যদি আল্লাহ তোমার মঙ্গল চান তাহ’লে তাঁর অনুগ্রহ রদ করারও কেউ নেই। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি মঙ্গল দান করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (ইউনুস ১০/১০৭)। তিনি আরো বলেন,
قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُوْنَ مِنْ دُونِ اللهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ قُلْ حَسْبِي اللهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُونَ-
‘বল, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি আল্লাহ আমাকে কষ্ট দেয়ার ইচ্ছা করেন, তবে তোমরা আল্লাহ্কে ছেড়ে দিয়ে যাদেরকে ডাক তারা কি সে কষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি রহমত করার ইচ্ছা করলে তারা কি সে রহমত রোধ করতে পারবে? বল, আমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট। নির্ভরকারীরা তাঁরই উপর নির্ভর করে’ (যুমার ৩৯/৩৮)।
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘তোমরা যে সমস্ত অনুগ্রহ ভোগ কর তা তো আল্লাহরই নিকট হ’তে, আবার যখন দুঃখ-দৈন্য তোমাদের স্পর্শ করে তখন তোমরা তাঁকেই ব্যাকুলভাবে আহবান কর। আর যখন আল্লাহ তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূরীভূত করেন তখন তোমাদের একদল তাদের প্রতিপালকের সাথে শরীক করে’ (নাহাল ১৬/৫৩-৫৪)।
অতএব আল্লাহ তা‘আলা বান্দার কল্যাণ না করলে কেউ তা করতে পারবে না। আবার তিনি কারো ক্ষতি করলে কেউ তা রোধ করতে পারবে না। অতএব তাবীয বা শরী‘আত পরিপন্থী ঝাড়-ফুঁক মানুষের রোগ নিরাময়ের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নয়। বরং এর দ্বারা পরকালে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হ’তে হবে।
ছহীহ হাদীছের দৃষ্টিতে তাবীয :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাবীয ব্যবহার করা শিরক বলেছেন। তাবীয ও তাবীয জাতীয় সব কিছুকে একই শ্রেণীভূক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন-
عَنْ عُقْبَةَ بْنَ عَامِرٍ يَقُوْلُ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ مَنْ تَعَلَّقَ تَمِيْمَةً فَلاَ أَتَمَّ اللهُ لَهُ وَمَنْ تَعَلَّقَ وَدَعَةً فَلاَ وَدَعَ اللهُ لَه.ُ
উক্ববাহ ইবনু আমির (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তাবীয ব্যবহার করবে আল্লাহ তাকে পূর্ণতা দিবেন না। আর যে কড়ি ব্যবহার করবে আল্লাহ তাকে মঙ্গল দান করবেন না’।[3] কোন কিছুর দ্বারা তাবীয বা কড়ি ঝুলানো একই ধরনের অপরাধ।
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ الْجُهَنِيِّ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَقْبَلَ إِلَيْهِ رَهْطٌ فَبَايَعَ تِسْعَةً وَأَمْسَكَ عَنْ وَاحِدٍ فَقَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ بَايَعْتَ تِسْعَةً وَتَرَكْتَ هَذَا قَالَ إِنَّ عَلَيْهِ تَمِيْمَةً فَأَدْخَلَ يَدَهُ فَقَطَعَهَا فَبَايَعَهُ وَقَالَ مَنْ عَلَّقَ تَمِيْمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ
উক্ববাহ ইবনু আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খিদমতে একদল লোক উপস্থিত হ’ল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দলটির ৯ জনকে বায়‘আত করালেন এবং একজনকে বায়‘আত করালেন না। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি ৯ জনকে বায়‘আত করালেন আর একজনকে ছেড়ে দিলেন? রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তার সাথে একটি তাবীয রয়েছে। তখন লোকটি হাত ভিতরে ঢুকিয়ে তাবীয ছিড়ে ফেললেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাকেও বায়‘আত করালেন এবং বললেন, যে ব্যক্তি তাবীয ব্যবহার করল সে শিরক করল’।[4] এ থেকে বুঝা যায়, তাবীয ব্যবহার করা জঘন্য অপরাধ। এরূপ ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বায়‘আত করানো থেকে বিরত থেকেছেন। সেটা যে প্রকারের তাবীয হোক না কেন। তাহ’লে অপরাধের পরিধি কত বেশী তা সহজেই অনুমেয়। রুওয়াইফা ইবনু ছাবিত (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন,
يَا رُوَيْفِعُ لَعَلَّ الْحَيَاةَ سَتَطُولُ بِكَ بَعْدِى فَأَخْبِرِ النَّاسَ أَنَّهُ مَنْ عَقَدَ لِحْيَتَهُ أَوْ تَقَلَّدَ وَتَرًا أَوِ اسْتَنْجَى بِرَجِيعِ دَابَّةٍ أَوْ عَظْمٍ فَإِنَّ مُحَمَّدًا صلى الله عليه وسلم مِنْهُ بَرِىءٌ.
‘হে রুওয়ায়ফা! হয়ত তুমি আমার পরেও অনেক দিন বেঁচে থাকবে। সুতরাং তুমি লোকদেরকে এ কথা বলে দিও যে, যে ব্যক্তি দাড়িতে গিট দিল (জট পাকাল) অথবা তাবীয জাতীয় বেল্ট বা সূতা (ছেলে-মেয়ের বা প্রাণীর গলায়) পরাল কিংবা চতুষ্পদ জন্তুর গোবর অথবা হাড় দিয়ে ইসতেঞ্জা করল, নিশ্চয়ই তার সাথে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কোন সম্পর্ক নেই’।[5] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ الرُّقَى وَالتَّمَائِمُ وَالتِّوَلَة شِرْكٌ ‘নিশ্চয়ই ঝাড়-ফুঁক, তাবীয এবং ভালবাসা সৃষ্টি করার জন্য কোন কৌশল অবলম্বন করা শিরক’।[6] এতে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তাবীয ব্যবহার করা, বাচ্চাদের গলায় বা কোমরে কালো কিংবা সাদা সূতা বাঁধা শিরক।
ঈসা ইবনে হামযাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি আব্দুল্লাহ ইবনে উকাইমের নিকট গেলাম। তাঁর শরীরে লাল ফোস্কা পড়ে আছে। আমি বললাম, আপনি তাবীয ব্যবহার করবেন না? উত্তরে তিনি বললেন, তা হ’তে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ ‘যে ব্যক্তি কোন কিছু ঝুলায় তাকে তার প্রতি সোপর্দ করে দেয়া হয়’।[7]
একদা হুযায়ফা (রাঃ) এক রোগীকে দেখতে এসে তার বাহুতে একটি তাগা দেখতে পেলেন, অতঃপর তিনি তা কেটে ফেললেন বা ছিঁড়ে ফেললেন এবং বললেন, যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে, তাদের অনেকেই শিরক করছে। এত্থেকে প্রমাণিত হয়, হুযায়ফা (রাঃ)-এর মতে তাবীয ব্যবহার করা শিরক।[8]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ)-এর স্ত্রী যয়নব হ’তে বর্ণিত একদা (আমার স্বামী) আব্দুল্লাহ আমার গলায় একখানা তাগা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, (তোমার গলায়) এটা কী? বললাম, এটা একটি তাগা, এতে আমার জন্য মন্ত্র পড়া হয়েছে। যয়নব বললেন, তা শুনে তিনি তাগাটি ধরে ছিঁড়ে ফেললেন, অতঃপর বললেন, তোমরা আব্দুল্লাহর পরিবারবর্গ। তোমরা শিরকের মুখাপেক্ষী নও। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ঝাড়ফুঁক, তাবীয ও জাদুটোনা শিরকী কাজ’।[9]
তাবীয ব্যবহার করা শিরকুল আসবাব-এর অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের শিরক, শিরককারীর মনের অবস্থা ও তার ধ্যান-ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে কখনো বড় শিরক, আবার কখনো ছোট শিরক হয়ে যায়। সুতরাং তাবীয ব্যবহার করাকে সাধারণভাবে বড় শিরক বা ছোট শিরক বলে আখ্যায়িত করা যাবে না। বরং তাবীয ও তাবীয ব্যবহারকারীর প্রতি লক্ষ্য করতে হবে। তাবীয যদি কোন মূর্তির ছবি হয়, অথবা এমন শিরকী মন্ত্র তাবীযে লেখা থাকে, যেগুলির মাধ্যমে গায়রুল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া হয় কিংবা গায়রুল্লাহর কাছে শিফার জন্য প্রার্থনা করা হয়, কিংবা ক্রুশকে তাবীয হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাহ’লে নিঃসন্দেহে তা বড় শিরক। এভাবে যদি কেউ কড়ি বা সুতা ইত্যাদি গলায় ধারণ করে এবং এ ধারণা পোষণ করে যে, এগুলি বালা-মুছীবত দূর করার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ক্ষমতা রাখে, তাহ’লে তাও বড় শিরকের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর যদি এ ধরনের ধ্যান-ধারণা না থাকে তাহ’লে ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত হবে।[10]
ঝাড়-ফুঁক প্রসঙ্গ
প্রাচীন কাল হ’তে চলে আসা চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে ঝাড়-ফুঁক অন্যতম। যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আর্বিভাবের বহু পূর্ব হ’তে চালু রয়েছে। জাহেলী যুগে আরবরাও বিভিন্ন রোগ, বদ নযর ও অশুভ জিনিসের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য ঝাড়-ফুঁক করত। যখন ইসলামের প্রচার-প্রসার শুরু হ’ল তখন নবী করীম (ছাঃ) এ সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন হ’লেন। তাতে তিনি কতক ঝাড়-ফুঁককে বৈধ বলে স্বীকৃতি দিলেন, আবার কতক ঝাড়-ফুঁককে অবৈধ বলে ঘোষণা করলেন। বিধায় স্পষ্ট বুঝা যায়- ঝাড়-ফুঁক দু’প্রকার (ক) বৈধ ঝাড়-ফুঁক (খ) অবৈধ ঝাড়-ফুঁক।
(ক) বৈধ বা শরী‘আত সম্মত ঝাড়-ফুঁক :
যে সকল রোগে ইসলাম ঝাড়-ফুঁক করার সুযোগ দিয়েছে, তা শরী‘আত সম্মত ঝাড়-ফুঁক। আর এসব পদ্ধতি ছাহাবায়ে কেরামগণ স্বীয় জীবনে বাস্তবায়নও করেছেন। ক্ষেত্র বিশেষ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেই এরূপ চিকিৎসা গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
عَنْ عَوْفِ بْنِ مَالِكٍ الأَشْجَعِىِّ قَالَ كُنَّا نَرْقِى فِى الْجَاهِلِيَّةِ فَقُلْنَا يَا رَسُولَ اللهِ كَيْفَ تَرَى فِىْ ذَلِكَ فَقَالَ اعْرِضُوْا عَلَىَّ رُقَاكُمْ لاَ بَأْسَ بِالرُّقَى مَا لَمْ يَكُنْ فِيْهِ شِرْكٌ.
আওফ ইবনে মালেক আশজায়ী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাহেলী যুগে আমরা মন্ত্র পড়ে ঝাড়-ফুঁক করতাম। সুতরাং (ইসলাম গ্রহণের পর) আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ সমস্ত মন্ত্র সম্পর্কে আপনার মতামত কী? তখন তিনি বললেন, তোমাদের মন্ত্রগুলি আমাকে পড়ে শুনাও। মন্ত্র দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করতে কোন আপত্তি নেই, যদি তার মধ্যে শিরকী কিছু না থাকে’।[11] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ جَابِرٍ قَالَ نَهَى رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الرُّقَى فَجَاءَ آلُ عَمْرِو بْنِ حَزْمٍ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّهُ كَانَتْ عِنْدَنَا رُقْيَةٌ نَرْقِى بِهَا مِنَ الْعَقْرَبِ وَإِنَّكَ نَهَيْتَ عَنِ الرُّقَى قَالَ فَعَرَضُوْهَا عَلَيْهِ فَقَالَ مَا أَرَى بَأْسًا مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ أَنْ يَنْفَعَ أَخَاهُ فَلْيَنْفَعْهُ.
জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মন্ত্র তথা ঝাড়-ফুঁক করাতে নিষেধ করেছেন। (এই নিষেধের পর) আমর ইবনে হাযমের বংশের কয়েকজন লোক এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাদের কাছে এমন একটি মন্ত্র আছে, যার দ্বারা আমরা বিচ্ছুর দংশনে ঝাড়-ফুঁক করে থাকি। অথচ আপনি মন্ত্র (ঝাড়-ফুঁক) পড়া হ’তে নিষেধ করেছেন। অতঃপর তারা মন্ত্রটি নবী করীম (ছাঃ)-কে পড়ে শুনাল। তখন তিনি বললেন, আমি তো এর মধ্যে দোষের কিছু দেখছি না। অতএব তোমাদের যে কেউ নিজের কোন ভাইয়ের কোন উপকার করতে পারে, সে যেন অবশ্যই তার উপকার করে’।[12]
সুতরাং যে সব কথার দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা হবে তাতে শিরকী কোন কথা না থাকলে তা বৈধ। সাথে সাথে সত্যতা নিশ্চিত না হয়ে সবার কাছে ঝাড়-ফুঁক করাও শরী‘আত সম্মত নয়। পবিত্র কুরআনের আয়াত, ছহীহ হাদীছে বর্ণিত দো‘আ ও আল্লাহর পবিত্র নাম সমূহ দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করাতে কোন দোষ নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে ঝাড়-ফুঁক করতে নিদের্শ দিয়েছেন। যেমন-
১. বদ-নযর লাগলে : কোন ব্যক্তি বা শিশুর বদ-নযর লাগলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঝাড়-ফুঁক করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এর দ্বারা যেন তার বদ-নযর কেটে যায় এবং সে সুস্থতা লাভ করে।
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ رضى الله عنها أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم رَأَى فِىْ بَيْتِهَا جَارِيَةً فِىْ وَجْهِهَا سَفْعَةٌ فَقَالَ اسْتَرْقُوْا لَهَا فَإِنَّ بِهَا النَّظْرَةَ.
উম্মে সালমা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার (উম্মে সালমার) ঘরে একটি মেয়েকে দেখতে পেলেন, তার চেহারায় (বদ-নযরের) চিহ্ন ছিল। অর্থাৎ চেহারাটি হলুদ বর্ণ ধারণ করেছিল। তখন তিনি বললেন, ‘এর জন্য ঝাড়-ফুঁক কর, কেননা তার উপর নযর লেগেছে’।[13] অন্য হাদীছে এসেছে-
عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها قَالَتْ أَمَرَنِىْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَوْ أَمَرَ أَنْ يُسْتَرْقَى مِنَ الْعَيْنِ.
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘(কারো উপর) বদ-নযর লাগলে নবী করীম (ছাঃ) ঝাড়-ফুঁক করতে নির্দেশ দিয়েছেন’।[14]
আসমা বিনতে হুমায়স (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! জা‘ফর-এর সন্তানদের উপর দ্রুত বদ-নযর লেগে থাকে। সুতরাং আমি কি তাদের জন্য ঝাড়-ফুঁক করব। তিনি বললেন, হ্যাঁ। কেননা যদি কোন জিনিস তাকদীরের অগ্রগামী হ’তে পারত, তবে বদ-নযরই তার অগ্রগামী হ’ত’।[15]
২. বিষাক্ত প্রাণী দংশন করলে : কোন ব্যক্তিকে সাপ, বিচ্ছু, কুকুর বা যে কোন বিষাক্ত প্রাণী দংশন করলে সে ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে পারবে।
عَنْ أَنَسٍ قَالَ رَخَّصَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِى الرُّقْيَةِ مِنَ الْعَيْنِ وَالْحُمَةِ وَالنَّمْلَةِ.
আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘কারো উপর বদ-নযর লাগলে, কোন বিষাক্ত প্রাণী দংশন করলে এবং পাঁজরে খুজলি (পিপড়ার মত ছোট ছোট জিনিস শরীরে বের হওয়া) উঠলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঝাড়-ফুঁক করতে অনুমতি দিয়েছেন’।[16]
عَنْ عَلِيٍّ قَالَ بَيْنَمَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ذَاتَ لَيْلَةٍ يُصَلِّي فَوَضَعَ يَدَهُ عَلَى الأَرْضِ فَلَدَغَتْهُ عَقْرَبٌ فَتَنَاوَلَهَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِنَعْلِهِ فَقَتَلَهَا فَلَمَّا انْصَرَفَ قَالَ أَخْزَى اللهُ الْعَقْرَبَ مَا تَدَعُ مُصَلِّيًا وَلا غَيْرَهُ أَوْ مُؤْمِنًا وَلا غَيْرَهُ ثُمَّ دَعَا بِمِلْحٍ وَمَاءٍ فَجَعَلَهُ فِيْ إنَاءٍ وَجَعَلَ يَصُبُّهُ عَلَى إصْبَعِهِ حَيْثُ لَدَغَتْهُ وَيَمْسَحُهَا وَيُعَوِّذُهَا بِالْمُعَوِّذَتَيْنِ.
আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন এক রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত পড়ছিলেন, এমতাবস্থায় তিনি মাটিতে হাত রাখতেই একটি বিচ্ছু তাকে দংশন করল। তৎক্ষণাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জুতা দ্বারা বিচ্ছুটিকে মেরে ফেললেন। অতঃপর ছালাত শেষ করে বললেন, বিচ্ছুটির উপর আল্লাহর লা‘নত হোক। সে মুছল্লী-অমুছল্লী অথবা বলেছেন, নবী কিংবা অন্য কাউকেও ছাড়ে না। অতঃপর তিনি কিছু লবণ ও পানি চেয়ে নিলেন এবং তা একটি পাত্রে মিশালেন। অতঃপর আঙ্গুলের দংশিত স্থানে পানি ঢালতে এবং উক্ত স্থান মুছতে লাগলেন এবং মুয়াববাযাতাইন (সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস) দ্বারা ঝাড়তে লাগলেন।[17]
৩. কান বা শরীরের কোন অঙ্গ ব্যথা : কোন ব্যক্তির কান বা শরীরের কোন অঙ্গ ব্যথা করলে ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবে।
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ أَذِنَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لأَهْلِ بَيْتٍ مِنَ الأَنْصَارِ أَنْ يَرْقُوْا مِنَ الْحُمَةِ وَالأُذُنِ
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আনছারদের এক পরিবারের লোকদের বিষাক্ত দংশন ও কান
ব্যথার কারণে ঝাড়-ফুঁক গ্রহণ করার অনুমতি দেন।[18]
ঝাড়-ফুঁকের মন্ত্র শিক্ষা দিতে রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ
عَنِ الشِّفَاءِ بِنْتِ عَبْدِ اللهِ قَالَتْ دَخَلَ عَلَىَّ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَأَنَا عِنْدَ حَفْصَةَ فَقَالَ لِى أَلاَ تُعَلِّمِيْنَ هَذِهِ رُقْيَةَ النَّمْلَةِ كَمَا عَلَّمْتِيهَا الْكِتَابَةَ.
শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হাফছা (রাঃ)-এর নিকট বসা ছিলাম, এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেখানে প্রবেশ করলেন এবং (আমাকে লক্ষ্য করে) বললেন, ‘তুমি যেভাবে হাফছাকে হস্তলিপি শিখাচ্ছ, অনুরূপভাবে তাকে নামলা (এক প্রকার চর্মরোগ) রোগের মন্ত্র শিখাও না কেন’? [19]
শরী‘আত সম্মত ঝাড়-ফুঁকের কিছু নমুনা :
১. আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন অসুস্থ হ’তেন তখন সূরা নাস ও সূরা ফালাক্ব পড়ে নিজের শরীরে ফুঁ দিতেন। সাথে সাথে স্বীয় হাত দ্বারা শরীর মুছে ফেলতেন। যখন তিনি মৃত্যু রোগে আক্রান্ত হ’লেন, তখন আমি সূরা নাস ও ফালাক্ব পড়ে তাঁর শরীরে ফুঁ দিতাম। ছহীহ মুসলিমে এক বর্ণনায় আছে, যখন তাঁর পরিবারের কেউ রোগে আক্রান্ত হ’ত, তখন তিনি সূরা নাস ও ফালাক্ব পড়ে তার উপর ফুঁ দিতেন।[20]
২. আয়েশা (রাঃ) বলেন, যখন কোন ব্যক্তি তার কোন অঙ্গে ব্যথা অনুভব করত অথবা কোথাও ফোঁড়া বা যখম দেখা দিত, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঐ স্থানের উপর হাত বুলাতে বুলাতে বলতেন, بِسْمِ اللهِ تُرْبَةُ أَرْضِنَا بِرِيْقَةِ بَعْضِنَا يُشْفَى سَقِيْمُنَا بِإِذْنِ رَبِّنَا ‘আল্লাহর নামে, আমাদের যমীনের মাটি আমাদের কারো থুথুর সাথে মিশে আমাদের রোগীকে ভাল করবে, আমাদের রবের নির্দেশে’।[21]
৩. ওছমান ইবনে আবুল আছ (রাঃ) বলেন, একদা তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট স্বীয় শরীরে বেদনার অভিযোগ করলেন। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, তুমি তোমার ব্যথার জায়গায় হাত রাখ ও তিনবার ‘বিসমিল্লাহ’ বল এবং সাত বার বল, أَعُوْذُ بِعِزَّةِ اللهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّ مَا أَجِدُ وَأُحَاذِرُ ‘আমি আল্লাহর সম্মান ও তাঁর ক্ষমতার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি ঐ বস্ত্ত হ’তে, যা আমি অনুভব করছি ও আশংকা করছি, তার অনিষ্ট হ’তে’। ওছমান (রাঃ) বলেন, এর ফলে আমার শরীরে যা ছিল তা আল্লাহ ভাল করে দিলেন।[22]
৪. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একবার জিবরীল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ (ছাঃ)! আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। জিবরীল (আঃ) বললেন,
بِسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ مِنْ كُلِّ شَىْءٍ يُؤْذِيْكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنٍ أَوْ حَاسِدٍ اللهُ يَشْفِيْكَ بِسْمِ اللهِ أَرْقِيْكَ
‘আল্লাহর নামে আপনাকে ঝাড়ছি এমন প্রত্যেক বিষয় হ’তে যা আপনাকে কষ্ট দেয়, প্রত্যেক ব্যক্তির অকল্যাণ হ’তে অথবা প্রত্যেক বিদ্বেষী চক্ষুর অকল্যাণ হ’তে। আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য দান করুন। আল্লাহর নামে ঝাড়ছি’।[23]
৫. আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমাদের মধ্যে কারো যখন কোন অসুখ হ’ত তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আপন ডান হাত তার গায়ে বুলাতেন এবং বলতেন, أَذْهِبِ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ اشْفِ أَنْتَ الشَّافِى لاَ شِفَاءَ إِلاَّ شِفَاؤُكَ شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا ‘হে মানুষের রব! আপনি বিপদ দূর করে দিন এবং রোগ হ’তে নিরাময় দান করুন। আপনিই নিরাময়কারী। আপনার নিরাময় প্রদান ব্যতীত আরোগ্য লাভ করা সম্ভব নয়। এমন নিরাময় দান করুন, যেন কোন রোগই অবশিষ্ট না থাকে’।[24]
৬. সা‘দ (রাঃ) অসুস্থ হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে দেখতে গেলেন। সা‘দ (রাঃ) বলছেন, তিনি আমার কপালের উপর তাঁর হাত রাখলেন এবং আমার চেহারা ও পেটের উপর তাঁর হাত বুলিয়ে বললেন, اللَّهُمَّ اشْفِ سَعْدًا وَأَتْمِمْ لَهُ هِجْرَتَهُ ‘হে আল্লাহ! সা‘দকে তুমি আরোগ্য কর। তাঁর হিজরত পূর্ণ করে দাও’। আমি তাঁর হাতের শিতল স্পর্শ এখনও পাচ্ছি এবং আশা করি আমি তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত পাব।[25]
৭. সায়িব হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার খালা আমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে নিয়ে গেলেন। এরপর তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার বোনের ছেলে পীড়িত। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার মাথায় হাত বুলালেন এবং আমার জন্য বরকতের দো‘আ করলেন।[26]
৮. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একটি দল আরবের এক গোত্রের নিকট আসলেন। গোত্রের লোকেরা তাদের কোন আতিথেয়তা করল না। তাঁরা সেখানে থাকতেই হঠাৎ সে গোত্রের নেতাকে সাপে দংশন করল। তখন তারা এসে বলল, আপনাদের কাছে কী কোন ঔষধ আছে কিংবা আপনাদের মধ্যে ঝাড়-ফুঁককারী কোন লোক আছে কী? তাঁরা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। তবে তোমরা আমাদের কোন আতিথেয়তা করনি। কাজেই আমাদের জন্য কোন পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট না করা পর্যন্ত আমরা তা করব না। ফলে তারা তাদের জন্য এক পাল ছাগল পারিশ্রমিক দিতে সম্মত হ’ল। তখন একজন ছাহাবী ‘উম্মুল কুরআন’ (সূরা ফাতিহা) পড়তে লাগলেন এবং মুখে থুথু জমা করে সে ব্যক্তির গায়ে ছিটিয়ে দিলেন। ফলে সে রোগ মুক্ত হ’ল। এরপর তারা ছাগলগুলো নিয়ে এসে বলল, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করার পূর্বে এতে স্পর্শ করব না। অতঃপর তারা এ বিষয়ে নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা শুনে হাসলেন এবং বললেন, ‘তোমরা কিভাবে জানলে যে, এটি রোগ নিরাময় করে? ঠিক আছে ছাগলগুলো নিয়ে যাও এবং তাতে আমার জন্যও এক ভাগ রেখে দিও’।[27]
(খ) অবৈধ ঝাড়-ফুঁক :
শিরকী কথা, অস্পষ্ট বাক্য, কারো বানানো কোন মন্ত্র দ্বারা ঝড়-ফুঁক করা অবৈধ। ইসলাম পরিপন্থী কথা ও কার্যাবলীর মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করা নিষেধ। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ)-এর স্ত্রী যয়নাব হ’তে বর্ণিত যে, একদা (আমার স্বামী) আব্দুল্লাহ আমার গলায় একখানা তাগা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, (তোমার গলায়) এটা কী? বললাম, এটা একটি তাগা, এতে আমার জন্য মন্ত্র পড়া হয়েছে। যয়নাব বললেন, তা শুনে তিনি তাগাটি ধরে ছিঁড়ে ফেললেন, অতঃপর বললেন, তোমরা আব্দুল্লাহর পরিবারবর্গ। তোমরা শিরকের মুখাপেক্ষী নও। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ঝাড়ফুঁক, তাবীজ ও জাদুটোনা শিরকী কাজ। তখন আমি বললাম, আপনি কেন এরূপ কথা বলছেন? একবার আমার চোখে ব্যথা হচ্ছিল, যেন চোখটি বের হযে পড়বে। তখন আমি অমুক ইহুদীর কাছে যাওয়া আসা করতাম। যখন সে ইহুদী তাতে মন্ত্র পড়ল, তখনই তার ব্যথা চলে গেল। এ কথা শুনে আব্দুল্লাহ বললেন, এটা তো শয়তানেরই কাজ। সে নিজের হাতের দ্বারা তাতে আঘাত করছিল, আর যখন মন্ত্র পড়া হয়, তখন সে বিরত হয়ে যায়। বস্ত্তত তোমার পক্ষে এরূপ বলাই যথেষ্ট ছিল, যেভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَذْهِبِ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ اشْفِ أَنْتَ الشَّافِى لاَ شِفَاءَ إِلاَّ شِفَاؤُكَ شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا ‘হে মানুষের রব! আপনি বিপদ দূর করে দিন এবং রোগ হ’তে নিরাময় দান করুন। আপনিই নিরাময়কারী। আপনার নিরাময় প্রদান ব্যতীত আরোগ্য লাভ করা সম্ভব নয়। এমন নিরাময় দান করুন, যেন কোন রোগই অবশিষ্ট না থাকে’।[28]
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ سُئِلَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ النُّشْرَةِ فَقَالَ هُوَ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ.
জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘নুশরাহ’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, উত্তরে তিনি বললেন, এটা তো শয়তানের কাজ।[29] নুশরাহ এক প্রকারের মন্ত্র। জাহেলী যুগে কোন ব্যক্তি জিন-পরী দ্বারা প্রভাবিত হ’লে উক্ত বিশেষ মন্ত্র দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা হ’ত এবং তাতে স্বয়ং ক্রিয়াশীল বলে লোকেরা আক্বীদাহ পোষণ করত।[30]
পরিশেষে বলা যায়, যে কোন প্রকারের তাবীয ব্যবহার করা শিরক। আর পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় গুনাহ হ’ল শিরক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই শিরক বড় অপরাধ’ (লুক্বমান ৩১/১৩)। আর শিরককারীর জন্য জান্নাত হারাম। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করেছেন এবং তার বাসস্থান হচ্চে জাহান্নাম’ (মায়িদাহ ৫/৭২)। ঝাড়-ফুঁকের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করতে হবে তা শরী‘আত সম্মত কি-না। কেননা ঝাড়-ফুঁকের বিষয়ে বৈধ-অবৈধ দু’ই রয়েছে। সঠিক পন্থায় ঝাড়-ফুঁক গ্রহণ করলে কোন অসুবিধা নেই। পক্ষান্তরে বেঠিক পন্থায় ঝাড়-ফুঁক গ্রহণ করা বড় ধরনের পাপ। বিধায় ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে চিকিৎসা নেয়ার সময় তা বৈধতা নিশ্চিত হয়ে গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন-আমীন!
ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
আখিলা, নাচোল, চাঁপাই নবাবগঞ্জ।
[1]. আলী বিন নুফায়ী আল-উলাইয়ানী, অনুবাদ: ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ মুজিবুর রহমান, আক্বীদাহর মানদন্ডে তা’বীজ (ঢাকা : ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংস্থা, রামাযান, ১৪১৭ হিঃ, ১৯৯৭ ইং), পৃঃ ১১।
[2]. তদেব।
[3]. আহমাদ, হাদীছ হাসান হা/১৭৪৪০।
[4]. আহমাদ হা/১৭৪৫৮, সনদ ছহীহ ।
[5]. আবুদাঊদ হা/৩৬; নাসাঈ হা/৫০৬৭; মিশকাত হা/৩৫১, সনদ ছহীহ।
[6]. আবুদাঊদ হা/৩৮৮৫; ইবনে মাজাহ হা/৩৫৩০; আহমাদ হা/৩৬১৫; মিশকাত হা/৪৫৫২, সনদ ছহীহ।
[7]. তিরমিযী হা/২০৭২; আহামাদ হা/১৮৮০৩; মিশকাত হা/৪৫৫৬, সনদ হাসান।
[8]. আক্বীদাহর মানদন্ডে তাবীয, পৃঃ ২০।
[9]. আবুদাঊদ হা/৩৮৮৫; আহমাদ হা/৩৬১৫; সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৪৫৫২।
[10]. আক্বীদাহর মানদন্ডে তাবীজ, পৃঃ ৩৭।
[11]. মুসলিম হা/৫৮৬২; আবুদাঊদ হা/৩৮৮৬; মিশকাত হা/৪৫৩০।
[12]. মুসলিম হা/৫৮৬১; আহমাদ হা/১৪৪২২; মিশকাত হা/৪৫২৯।
[13]. বুখারী হা/৫৭৩৯; মুসলিম হা/৫৮৫৪; মিশকাত হা/৪৫২৮।
[14]. বুখারী হা/৫৭৩৮; মুসলিম হা/৫৮৫১; ইবনু মাজাহ হা/৩৫১২; আহমাদ হা/২৪৩৯০; মিশকাত হা/৪৫২৭।
[15]. তিরমিযী হা/২০৫৯; মিশকাত হা/৪৫৬০, সনদ ছহীহ।
[16]. মুসলিম হা/৫৮৫৩; মিশকাত হা/৪৫২৬, সনদ ছহীহ।
[17]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/২৩৪০; মিশকাত হা/৪৫৬৭, সনদ ছহীহ।
[18]. বুখারী হা/৫৭২০।
[19]. আবূদাঊদ হা/৩৮৮৭; মিশকাত হা/৪৫৬১, সনদ ছহীহ।
[20]. বুখারী হা/৪৪৩৯; মুসলিম হা/৫৮৪৪; ইবনে মাজাহ হা/৩৫২৯; মিশকাত হা/১৫৩২।
[21]. বুখারী হা/৫৭৪৫; মুসলিম হা/৫৮৪৮; ইবনে মাজাহ হা/৩৫২১; মিশকাত হা/১৫৩১।
[22]. মুসলিম হা/৫৮৬৭; ইবনে মাজাহ হা/৩৫২২; মিশকাত হা/১৫৩৩।
[23]. মুসলিম হা/৫৮২৯; ইবনে মাজাহ হা/৩৫২৩; মিশকাত হা/১৫৩৪।
[24]. বুখারী হা/৫৭৪৩; মুসলিম হা/৫৮৩৬; মিশকাত হা/১৫৩০।
[25]. বুখারী হা/৫৬৫৯; আবুদাঊদ হা/৩১০৪; আহমাদ হা/১৪৭৪।
[26]. বুখারী হা/৫৬৭০; মুসলিম হা/৬২৩৩; তিরমিযী হা/৩৬৪৩; মিশকাত হা/৪৭৬।
[27]. বুখারী হা/৫৭৩৬; মুসলিম হা/৫৮৬৩; তিরমিযী হা/৩৯০০।
[28]. আবুদাঊদ হা/৩৮৮৫; সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৪৫৫২।
[29]. আবুদাঊদ হা/৩৮৬৮; মিশকাত হা/৪৫৫৩, সনদ ছহীহ।
[30]. এমদাদিয়া লাইব্রেরী প্রকাশিত বাংলা মিশকাত, ৮/২৭৩ পৃঃ।