ইয়াহ্‌ইয়া ইবনু বুকায়র (রহঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর সহধর্মিণী আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি আমার মাতাপিতাকে কখনো ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন পালন করতে দেখিনি এবং এমন কোন দিন অতিবাহিত হয়নি যেদিন সকালে কিংবা সন্ধ্যায় রাসূল (ছাঃ) আমাদের বাড়ীতে আসেননি। যখন মুসলমানগণ (মুশরিকদের নির্যাতনে) অতিষ্ঠ হয়ে পড়লেন, তখন আবুবকর (রাঃ) হিজরত করে আবিসিনিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হ’লেন। অবশেষে ‘বারকুল গিমাদ’ নামক স্থানে পৌঁছলে ইবনু দাগিনার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সে ছিল তার গোত্রের নেতা। সে বলল, হে আবুবকর! কোথায় যাচ্ছেন? উত্তরে আবুবকর (রাঃ) বললেন, আমার স্ব-জাতি আমাকে বের করে দিয়েছে। তাই আমি মনে করছি পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াব এবং আমার প্রতিপালকের ইবাদত করব। ইবনু দাগিনা বলল, হে আবুবকর (রাঃ)! আপনার মত ব্যক্তি (দেশ থেকে) বের হ’তে পারে না। আপনি তো নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করে দেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অক্ষমদের বোঝা নিজে বহন করেন, মেহমানদের মেহমানদারী করে থাকেন এবং সত্য পথের পথিকদের বিপদ-আপদে সাহায্য করেন। সুতরাং আমি আপনাকে আশ্রয় দিচ্ছি, আপনাকে সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতার অঙ্গীকার করছি। আপনি ফিরে যান এবং নিজ শহরে আপনার রবের ইবাদত করুন। আবুবকর (রাঃ) ফিরে আসলেন। তাঁর সঙ্গে ইবনু দাগিনাও আসল। ইবনু দাগিনা বিকেল বেলা কুরাইশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের নিকট গেল এবং তাদের বলল, আবুবকরের মত লোক দেশ থেকে বের হ’তে পারে না এবং তাকে বের করে দেওয়া যায় না। আপনারা কি এমন ব্যক্তিকে বের করবেন, যিনি নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অক্ষমদের বোঝা নিজে বহন করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং ন্যায়ের উপর থাকার দরুণ বিপদ এলে সাহায্য করেন। ইবনু দাগিনার আশ্রয়দান কুরাইশরা মেনে নিল এবং তারা ইবনু দাগিনাকে বলল, তুমি আবুবকরকে বলে দাও, তিনি যেন ঘরের মধ্যে তাঁর রবের ইবাদত করেন। ছালাত সেখানে আদায় করেন ও ইচ্ছামাফিক কুরআন তিলাওয়াত করেন। কিন্তু এর দ্বারা আমাদের যেন তিনি কষ্ট না দেন। এসব যেন প্রকাশ্যে না করেন। কেননা আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের ফিৎনায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছি। ইবনু দাগিনা আবুবকর (রাঃ)-কে এসব কথা বলে দিলেন। সে মতে কিছুদিন আবুবকর (রাঃ) নিজের ঘরে ইবাদত করতে লাগলেন। তিনি প্রকাশ্যে ছালাত আদায় করতেন না এবং ঘরেই কুরআন তিলাওয়াত করতেন। এরপর আবুবকর (রাঃ)-এর মনে (একটি মসজিদ নির্মাণের কথা) উদিত হ’ল। তাই তিনি তাঁর ঘরের পাশেই একটি মসজিদ নির্মাণ করলেন। সেখানে তিনি ছালাত আদায় করতেন এবং কুরআন তিলাওয়াত করতেন। ফলে তাঁর কাছে মুশরিক মহিলা ও যুবকরা ভীড় জমাতে লাগল। তারা আবুবকর (রাঃ)-এর এ কাজে বিস্মিত হ’ত এবং তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত। আবুবকর (রাঃ) ছিলেন একজন ক্রন্দনশীল ব্যক্তি, তিনি যখন কুরআন তিলাওয়াত করতেন তখন তাঁর চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারতেন না। এ ব্যাপারটি কুরাইশ নেতৃস্থানীয়দের আতঙ্কিত করে তুলল। তারা ইবনু দাগিনাকে ডেকে পাঠাল এবং বলল, তোমার আশ্রয় প্রদানের কারণে আমরাও আবুবকরকে আশ্রয় দিয়েছিলাম এই শর্তে যে, তিনি তাঁর রবের ইবাদত তাঁর ঘরে করবেন। কিন্তু সে শর্ত তিনি লংঘন করেছেন। আমাদের ভয় হচ্ছে, আমাদের নারী ও সন্তানরা ফিৎনায় পড়ে যাবে। কাজেই তুমি তাঁকে নিষেধ করে দাও। তিনি তাঁর  রবের ইবাদত তাঁর গৃহে সীমাবদ্ধ রাখতে পসন্দ করলে তা করতে পারেন। আর যদি তিনি তা অস্বীকার করে প্রকাশ্যে করতে চান তবে তাঁকে তোমার আশ্রয় প্রদান ও দায়-দায়িত্বকে প্রত্যার্পণ করতে বল। আমরা তোমার আশ্রয় প্রদানের ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতা করাকে অত্যন্ত অপসন্দ করি, আবার আবুবকরকেও এভাবে প্রকাশ্যে ইবাদত করার জন্য ছেড়ে দিতে পারি না। আয়েশা (রাঃ) বলেন, ইবনু দাগিনা এসে আবুবকর (রাঃ)-কে বলল, আপনি অবশ্যই জানেন যে, কোন্ শর্তে আমি আপনার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলাম। আপনি হয় তাতে সীমিত থাকবেন, অন্যথা আমার যিম্মাদারী আমাকে ফেরৎ দিবেন। আমি এ কথা আদৌ পসন্দ করি না যে, আমার সাথে চুক্তিবদ্ধ এবং আমার আশ্রয়প্রাপ্ত ব্যক্তির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অপবাদ আরববাসীর নিকট প্রকাশিত হোক। আবুবকর (রাঃ) তাকে বললেন, আমি তোমার আশ্রয় তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। আমি আমার আল্লাহর আশ্রয়ের উপরই সন্তুষ্ট আছি। এসময় নবী করীম (ছাঃ) মক্কায় ছিলেন। তিনি মুসলমানদের বললেন, আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান (স্বপ্নে) দেখানো হয়েছে। সে স্থানে খেজুর বাগান রয়েছে এবং তা দু’টি প্রস্তরময় প্রান্তরে অবস্থিত। এরপর যারা আবিসিনিয়ায় চলে গিয়েছিলেন, তাদেরও অধিকাংশ সেখান থেকে ফিরে মদীনার চলে আসলেন। আবুবকর (রাঃ)ও মদীনায় দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁকে বললেন, তুমি অপেক্ষা কর। আশা করছি আমাকেও অনুমতি দেওয়া হবে। আবুবকর (রাঃ) বললেন, আমার পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক! আপনিও কি হিজরতের আশা করছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন আবুবকর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর সাহচর্য লাভের জন্য নিজেকে হিজরত থেকে বিরত রাখলেন এবং তাঁর নিকট যে দু’টি উট ছিল এ দু’টি চার মাস পর্যন্ত (ঘরে রেখে) বাবলা গাছের পাতা (ইত্যাদি) খাওয়াতে থাকলেন। ইবনু শিহাব উরওয়া (রাঃ)-এর সূত্রে আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, ইতিমধ্যে একদিন আমরা ঠিক দুপুর বেলায় আবুবকর (রাঃ)-এর ঘরে বসা ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে আবুবকর (রাঃ)-কে সংবাদ দিল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাথা ঢাকা অবস্থায় আসছেন। তা এমন সময় ছিল যে, সে সময় তিনি পূর্বে কখনো আমাদের এখানে আসেননি। আবুবকর (রাঃ) তাঁর আগমন বার্তা শুনে বললেন, আমার মাতাপিতা তাঁর প্রতি কুরবান হউক। আল্লাহর কসম! তিনি এ সময় নিশ্চয়ই কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনেই আসছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পৌঁছে (প্রবেশের) অনুমতি চাইলেন। তাঁকে অনুমতি দেওয়া হ’ল। প্রবেশ করে নবী করীম (ছাঃ) আবুবকর (রাঃ)-কে বললেন, এখানে অন্য যারা আছে তাদের বের করে দাও। আবুবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল  (ছাঃ)! আমার পিতামাতা আপনার প্রতি কুরবান হউক! এখানে তো আপনারই পরিবার। তখন তিনি বললেন, আমাকেও হিজরতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আবুবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হউক! আমি আপনার সফরসঙ্গী হ’তে ইচ্ছুক। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ঠিক আছে। আবুবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার পিতামাতা কুরবান হউক! আমার এ দু’টি উট থেকে আপনি  যে কোন একটি গ্রহণ করুন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, (ঠিক আছে) তবে মূল্যের বিনিময়ে। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমরা তাঁদের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করলাম এবং একটি থলের মধ্যে তাঁদের জন্য খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত করে দিলাম। আমার বোন আসমা বিনতু আবুবকর (রাঃ) তার কোমর বন্ধের কিছু অংশ কেটে সে থলের মুখ বেঁধে দিল। এ কারণেই তাঁকে ‘জাতুন নেতাক’ (কোমর বন্ধ বিশিষ্ট) বলা হ’ত।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) (রওয়ানা হয়ে) ছাওর পর্বতের একটি গুহায় আশ্রয় নিলেন। তাঁরা সেখানে তিন রাত অবস্থান করলেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আবুবকর (রাঃ) তাঁদের পাশেই রাত যাপন করতেন। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন তরুণ। তিনি শেষ রাতে ওখান থেকে বেরিয়ে মক্কায় রাত্রি যাপনকারী কুরাইশদের সাথে ভোর বেলায় মিলিত হ’তেন এবং তাঁদের দু’জনের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র করা হ’ত তা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন ও স্মরণ রাখতেন। যখন অাঁধার ঘনিয়ে আসত তখন তিনি সংবাদ নিয়ে তাঁদের উভয়ের কাছে যেতেন। আবুবকর (রাঃ)-এর গোলাম আমের ইবনু ফুহায়রা তাঁদের কাছেই দুধালো বকরীর পাল চরিয়ে বেড়াত। রাত্রের কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সে বকরীর পাল নিয়ে তাঁদের নিকটে যেত এবং তাঁরা দু’জন দুধ পান করে আরামে রাত যাপন করতেন। তাঁরা বকরীর দুধ দোহন করে সাথে সাথেই পান করতেন। তারপর শেষ রাতে আমের ইবনু ফুহায়রা বকরীগুলো হাঁকিয়ে নিয়ে যেত। এ তিনটি রাতের প্রত্যেক রাতে সে এরূপই করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবুবকর (রাঃ) বনী আবদ ইবনু আদী গোত্রের এক ব্যক্তিকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ‘খি‌র্রীত’ (পথ প্রদর্শক) হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। আদী গোত্রের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। সে ছিল কাফির কুরাইশের ধর্মাবলম্বী। তাঁরা উভয়ে তাকে বিশ্বস্ত মনে করে  তাঁদের উট দু’টি তার হাতে দিয়ে দিলেন এবং তৃতীয় রাতের পরে সকালে উট দু’টি ছাওর গুহার নিকট নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলেন। সে যথাসময়ে তা পৌঁছে দিল। আর আমের ইবনু ফুহায়রা ও পথ প্রদর্শক  তাঁদের উভয়ের সঙ্গে চলল। প্রদর্শক  তাঁদের নিয়ে উপকূল পথ ধরে চলতে লাগল।

ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, আব্দুর রহমান ইবনু মালেক মুদলেজী আমাকে বলেছেন, তিনি সুরাকা ইবনু মালেকের ভ্রাতুষ্পুত্র। তার পিতা তাকে বলেছেন, তিনি সুরাকা ইবনু জু‘শুমকে বলতে শুনেছেন যে, আমাদের নিকট কুরাইশ কাফিরদের দূত আসল এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) এ দু’জনের যে কোন একজনকে যে হত্যা অথবা বন্দী করতে পারবে তাকে (একশ’ উট) পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিল। আমি আমার কওম বনু মুদলীজের এক মজলিসে বসা ছিলাম। তখন তাদের নিকট থেকে এক ব্যক্তি এসে আমাদের নিকটে দাঁড়াল। আমরা বসাই ছিলাম। সে বলল, হে সুরাকা, আমি এই মাত্র উপকুলের পথে কয়েকজন মানুষকে যেতে দেখলাম। আমার ধারণা এরা মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীগণ হবেন। সুরাকা বললেন, আমি বুঝতে পারলাম যে, এঁরা তাঁরাই হবেন। কিন্তু তাকে বললাম, এরা তারা নয়, বরং তুমি অমুক অমুককে দেখেছ। এরা এই মাত্র আমাদের সম্মুখ দিয়ে চলে গেল। তারপর আমি কিছুক্ষণ মজলিসে অবস্থান করে (বাড়ী) চলে আসলাম এবং আমার দাসীকে আদেশ করলাম, তুমি আমার ঘোড়াটি বের করে নিয়ে যাও এবং অমুক টিলার আড়ালে ঘোড়াটি ধরে দাঁড়িয়ে থাক। আমি বর্শা হাতে নিলাম এবং বাড়ির পিছন দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বর্শাটির এক প্রান্ত হাতে ধরে অন্য প্রান্ত মাটি সংলগ্ন অবস্থায় আমি টেনে নিয়ে চলছিলাম ঐ অবস্থায় মাটি সংলগ্ন অংশ দ্বারা মাটির উপর রেখাপাত করতে করতে আমার ঘোড়ার নিকট গিয়ে পৌঁছলাম এবং ঘোড়ায় আরোহণ করে তাঁকে খুব দ্রুত ছুটালাম। সে আমাকে নিয়ে ছুটে চলল। আমি প্রায়  তাঁদের নিকট পৌঁছে গেলাম, এমন সময় আমার ঘোড়াটি হোঁচট খেয়ে আমাকে নিয়ে পড়ে গেল। আমিও তাঁর পিঠ থেকে ছিটকে পড়লাম। তারপর আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং তূনীরের দিকে হাত বাড়ালাম। তূনীর থেকে তীরগুলো বের করলাম ও তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে ভাগ্য পরীক্ষা করে নিলাম যে, আমি তাঁদের কোন ক্ষতি করতে পারব কি-না। তখন তীরগুলো দুর্ভাগ্যবশতঃ এমনভাবে বেরিয়ে এল যে, ভাগ্য নির্ধারণের বেলায় এমনটি হওয়া পসন্দ করি না। আমি পুনরায় ভাগ্য পরীক্ষার ফলাফল অমান্য করে অশ্বারোহণ করে সম্মুখ দিকে অগ্রসর হ’তে লাগলাম। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এত নিকটবর্তী হয়ে গেলাম যে, তাঁর তিলাওয়াতের আওয়ায শুনতে পাচ্ছিলাম। তিনি (আমার দিকে) ফিরে তাকাচ্ছিলেন। আবুবকর (রাঃ) বার বার তাকিয়ে দেখছিলেন। এমন সময় আমার ঘোড়ার সামনের পা দু’টি হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে গেড়ে গেল এবং আমি তার উপর থেকে পড়ে গেলাম। তখন আমি ঘোড়াকে ধমক দিলাম, সে দাঁড়াতে ইচ্ছা করল। কিন্তু পা দু’টি বের করতে পারছিল না। অবশেষে যখন ঘোড়াটি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল, তখন হঠাৎ তার সামনের পা দু’টি যে স্থানে গেড়েছিল সে স্থান থেকে ধোঁয়ার ন্যায় ধূলি আকাশের দিকে উঠতে লাগল। তখন আমি তীর দিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করলাম। এবারও যা আমার অপসন্দনীয় তা-ই প্রকাশ পেল। তখন আমি উচ্চৈঃস্বরে তাঁদের নিরাপত্তা চাইলাম। এতে তাঁরা থেমে গেলেন এবং আমি আমার ঘোড়ায় আরোহণ করে আসলাম। আমি যখন ইত্যাকার অবস্থায় বার বার বাধাপ্রাপ্ত ও বিপদে পতিত হচ্ছিলাম, তখনই আমার অন্তরে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এ মিশনটি অচিরেই প্রভাব বিস্তার করবে। তখন আমি তাঁকে বললাম, আপনার কওম আপনাকে ধরে দিতে পারলে একশ’ উট পুরস্কার ঘোষণা করেছে। মক্কায় কাফিররা তাঁর সম্পর্কে যে ইচ্ছা করেছে তা তাঁকে জানালাম। অতঃপর আমি তাঁদের জন্য কিছু খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী পেশ করলাম। তাঁরা তা থেকে কিছুই নিলেন না। আর আমার কাছে এ কথা ছাড়া কিছুই চাইলেন না যে, আমাদের সংবাদটি গোপন রেখ। এরপর আমি আমাকে একটি নিরাপত্তালিপি লিখে দেওয়ার জন্য তাঁকে অনুরোধ করলাম। তখন তিনি আমের ইবনু ফুহায়রাকে আদেশ করলেন। তিনি একখন্ড চামড়ায় তা লিখে দিলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রওয়ানা দিলেন।

ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, উরওয়া ইবনু যুবায়ের (রাঃ) আমাকে বলেছেন, পথিমধ্যে যুবায়েরের সঙ্গে নবী করীম (ছাঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়। তিনি মুসলমানদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে সিরিয়া থেকে ফিরছিলেন। তখন যুবায়ের (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ)-কে সাদা রঙের পোশাক দান করলেন। এদিকে মদীনায় মুসলমানগণ শুনলেন যে, নবী করীম  (ছাঃ) মক্কা থেকে মদীনার পথে রওয়ানা হয়েছেন। তাই তাঁরা প্রত্যহ সকালে মদীনার বাইরে গিয়ে‌ দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। দুপুরের রোদ প্রখর হ’লে তাঁরা ঘরে ফিরে আসতেন। একদিন তাঁরা পূর্বাপেক্ষা অধিক সময় অপেক্ষা করার পর নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেলেন। এমন সময় একজন ইহূদী তার নিজ প্রয়োজনে একটি টিলায় আরোহণ করে এদিক-ওদিক কি যেন দেখছিল। তখন নবী করীম  (ছাঃ) ও তাঁর সাথী-সঙ্গীদেরকে সাদা পোশাক পরিহিত অবস্থায় মরীচিকাময় মরুভূমির উপর দিয়ে আগমন করতে দেখতে পেল। ইহূদী তখন নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বলে উঠল, হে আরব সম্প্রদায়! এই-তো সে ভাগ্যবান ব্যক্তি, যাঁর জন্য তোমরা অপেক্ষা করছ। মুসলমানগণ তাড়াতাড়ি হাতিয়ার তুলে নিয়ে এবং মদীনার হাররার উপকন্ঠে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে মিলিত হ’লেন। তিনি সকলকে নিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে বনু আমর ইবনু আউফ গোত্রে অবতরণ করলেন। এ দিনটি ছিল রবীউল আউয়াল মাসের সোমবার। আবুবকর (রাঃ) দাঁড়িয়ে লোকদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। আর রাসূল (ছাঃ) নীরব থাকলেন। আনছারদের মধ্য থেকে যাঁরা এ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখেননি তাঁরা আবুবকর (রাঃ)-এর কাছে সমবেত হ’তে লাগলেন, তারপর যখন রৌদ্রত্তাপ নবী করীম (ছাঃ)-এর উপর পড়তে লাগল এবং আবুবকর (রাঃ) অগ্রসর হয়ে তাঁর চাদর দিয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর উপর ছায়া করে দিলেন। তখন লোকেরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে চিনতে পারল। নবী করীম (ছাঃ) আমর ইবনু আউফ গোত্রে দশদিনের চেয়ে কিছু বেশী সময় অতিবাহিত করলেন এবং সে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা (কুরআনের ভাষায়) তাক্বওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতে ছালাত আদায় করলেন। তারপর তিনি তাঁর বাহনের পিঠে আরোহণ করে রওয়ানা হ’লেন। লোকেরাও তাঁর সঙ্গে চলতে লাগল। মদীনায় (বর্তমান) মসজিদে নববীর স্থানে পৌঁছে উটটি বসে পড়ল। সে সময় ঐ স্থানে কপিতয় মুসলিম ছালাত আদায় করতেন। এ জায়গাটি ছিল আস‘আদ ইবনু যুরারার আশ্রয়ে পালিত সাহল ও সুহায়েল নামক দু’জন ইয়াতীম বালকের খেজুর শুকাবার স্থান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিয়ে উটটি যখন এ স্থানে বসে পড়ল, তখন তিনি বললেন, ইনশাল্লাহ এ স্থানটিই হবে মনযীল। তারপর তিনি (ছাঃ) সেই বালক দু’টিকে ডেকে পাঠালেন এবং মসজিদ নির্মাণের জন্য তাদের নিকট জায়গাটি মূল্যের বিনিময়ে ক্রয়ের আলোচনা করলেন। তাঁরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! বরং এটি আমরা আপনার জন্য বিনামূল্যে দিচ্ছি। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) তাদের কাছ থেকে বিনামূল্যে গ্রহণে অসম্মতি জানালেন। অবশেষে স্থানটি তাদের থেকে ক্রয় করে নিলেন। তারপর সেই স্থানে তিনি মসজিদ নির্মাণ করলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদ নির্মাণ কালে ছাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে ইট বহন করছিলেন এবং ইট বহনের সময় তিনি আবৃত্তি করছিলেন, এ বোঝা খায়বারের (খাদ্যদ্রব্য) বোঝা নয়। হে রব! এর বোঝা অত্যন্ত পুণ্যময় ও পবিত্রের। তিনি আরো বলছিলেন, হে আল্লাহ! পরকালের প্রতিদানই প্রকৃত প্রতিদান। সুতরাং আনছার ও মুহাজিরদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। নবী করীম (ছাঃ) জনৈক মুসলিম কবির কবিতা আবৃত্তি করেন, যার নাম আমাকে বলা হয়নি। ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ কবিতাটি ছাড়া অপর কোন পূর্ণাঙ্গ কবিতা পাঠ করেছেন বলে কোন বর্ণনা আমার কাছে পৌঁছেনি (বুখারী হা/৩৯০৫, ৩৯০৬; আহমাদ হা/১৭৬২৭; শারহুস সুন্নাহ ১/৮৯৭)






ইয়াহ্য়াহ বিন যাকারিয়া (আঃ) ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পাঁচ উপদেশ - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
রাসূল (ছাঃ)-এর ঈলার ঘটনা - আত-তাহরীক ডেস্ক
রাসূল (ছাঃ) ও মুজাহিদদের সম্পদে বরকত - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
কবরে মানুষের পরীক্ষা - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
হাদীছের উপরে আবূ বকর (রাঃ)-এর দৃঢ়তা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
জান্নাত-জাহান্নামের সৃষ্টি ও জাহান্নামের কতিপয় শাস্তি - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
উপকারীকে প্রতিদান দেওয়া - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
লি‘আনের বিধান প্রবর্তনের ঘটনা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
যু-ক্বারাদ ও খায়বার যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর মু‘জেযা এবং ছাহাবীগণের অতুলনীয় বীরত্ব - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
যু-কারদ ও খায়বার যুদ্ধে ছাহাবীগণের বীরত্বের কিছু ঘটনা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
ছালাত-ছিয়াম ও দান-ছাদাক্বার উপমা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
আবু নাজীহ (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
আরও
আরও
.