মহান আল্লাহর পক্ষ হ’তে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মতের উপর পবিত্র মাহে রামাযান রহমতের ডালি নিয়ে আগমন করে বারে বারে। রামাযান উপলক্ষে সকল মুসলমান পাপ হ’তে ফিরে আসে পুণ্যময় জীবনের পথে। সকলে ছিয়াম পালনের মাধ্যমে জীবনের সকল গুনাহ হ’তে মুক্ত হয়ে মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে। পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলা এ মাসকে করেছেন পবিত্র ও মহিমান্বিত। এ মাসে ইবাদত-বন্দেগীর ফযীলত অনেক। এ মাসের বিশেষ কতিপয় ইবাদত আলোচ্য নিবন্ধে উল্লেখ করা হ’ল।
ছিয়াম পালন : রামাযানের ছিয়াম সকল মুসলমানের উপর ফরয। আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর। যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হ’তে পার’ (বাক্বারাহ ১৮৩)।
অন্যত্র তিনি আরো বলেন, شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ، فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ- ‘রামাযান সেই মাস, যাতে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে মানুষের হিদায়াত স্বরূপ এবং সুস্পষ্ট পথনির্দেশ ও হক্ব বাতিলের পার্থক্যকারী হিসাবে। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে সে যেন ছিয়াম রাখে’ (বাক্বারাহ ১৮৫)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ- ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রামাযানের ছিয়াম পালন করে, তার বিগত সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়’।[1]
তিনি আরো বলেন, الصِّيَامُ جُنَّةٌ، فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَجْهَلْ، وَإِنِ امْرُؤٌ قَاتَلَهُ أَوْ شَاتَمَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّى صَائِمٌ- ‘ছিয়াম ঢাল স্বরূপ, তাই তোমাদের যে কেউ ছিয়াম রাখবে সে যেন অশ্লীলতা, পাপাচার এবং মূর্খতা প্রদর্শন না করে। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করে বা তাকে গালি দেয়, সে যেন বলে আমি ছিয়াম পালনকারী’।[2] এভাবে আল্লাহর বান্দা হিসাবে ছিয়াম পালনকারীকে চোখ, কান, জিহবাসহ সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা রামাযান মাসকে অনেক ফযীলত ও বৈশিষ্ট্য দ্বারা বিশেষিত করেছেন। তার কয়েকটি নিম্নরূপ-
১। ছায়েমের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকে আম্বরের চেয়েও বেশী সুগন্ধময়।
২। ফিরিশতাগণ ছিয়াম পালনকারীর জন্য ইফতারের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকেন।
৩। আল্লাহ রামাযানে প্রত্যহ তাঁর জান্নাতকে সুসজ্জিত করেন।
৪। এ মাসে শয়তানকে শৃংখলাবদ্ধ করা হয়।
৫। এ মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দ্বারগুলি বন্ধ করে রাখা হয়।
৬। এ মাসে ক্বদরের রাত্রি রয়েছে, যা হাযার মাস অপেক্ষা উত্তম।
নৈশকালীন নফল ইবাদত : রামাযানে রাত্রিকালীন ইবাদত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের প্রত্যাশায় রামাযানে রাতে নফল ছালাত (তারাবীহ) আদায় করবে, তার পূর্বকৃত সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’।[3]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَعِبَادُ الرَّحْمٰنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْناً وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُوْنَ قَالُوْا سَلاَماً، وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّداً وَقِيَامًا-
‘রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রতার সাথে চলে এবং তাদের সাথে যখন মূর্খরা কথা বলে তখন তারা বলে সালাম। আর যারা রাত্রি যাপন করে স্বীয় প্রভুর জন্য সিজদাবনত ও দন্ডায়মান অবস্থায়’ (ফুরক্বান ৬৩-৬৪)।
ছালাতুত তারাবীহ : ছালাতুত তারাবীহ বা রাসূল (ছাঃ)-এর রাতের ছালাত বিতর সহ ১১ রাক‘আত ছিল। রাতের ছালাত বলতে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ দু’টোকেই বুঝানো হয়। তবে রামাযান মাসে তারাবীহ পড়লে আর তাহাজ্জুদ পড়তে হয় না।
(১) একদা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল রামাযান মাসে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত কেমন ছিল? তিনি বললেন, রামাযান ও রামাযান ব্যতীত অন্য মাসে রাসূল (ছাঃ)-এর রাতের ছালাত ১১ রাকাতের বেশী ছিল না।[4]
(২) জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রামাযান মাসে আমাদেরকে ৮ (আট) রাকা‘আত তারাবীহ ও বিতর ছালাত পড়ান।[5] তিনি প্রতি দু’রাক‘আত অন্তর সালাম ফিরিয়ে ৮ রাক‘আত তারাবীহ শেষে কখনও এক, কখনও তিন, কখনও পাঁচ রাক‘আত বিতর এক সালামে পড়তেন। কিন্তু মাঝে বসতেন না।[6]
(৩) জামা‘আতের সাথে রাতের ছালাত (তারাবীহ) আদায় করা রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত এবং দৈনিক নিয়মিত জামা‘আতে (তারাবীহ) আদায় করা ইজমায়ে ছাহাবা হিসাবে প্রমাণিত।[7] অতএব তা বিদ‘আত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
লাইলাতুল ক্বদর অন্বেষণ করা : এক শ্রেণীর মুসলমান মহিমান্বিত রজনী তথা ক্বদরের রাত হিসাবে ২৭শে রামাযানের রাতকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে এবং এই রাতে প্রতি মসজিদে মুছল্লীদের ঢল নামে। সারারাত্রি ছালাত আদায় করা হয়। এক শ্রেণীর আলেম সাধারণ মুসলমানের মধ্যে এ তারিখে ইবাদত করার বিষয়টি প্রচার করে থাকে এবং কেবল এই একটি রাতেই ছালাত আদায় ও কুরআন তেলাওয়াতের নির্দেশ দেয়, যা সঠিক নয়।
عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِى الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ-
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা শবে ক্বদর তালাশ করবে রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিতে’।[8]
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضى الله عنهما أَنَّ رِجَالاً مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أُرُوا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِى الْمَنَامِ فِى السَّبْعِ الأَوَاخِرِ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَرَى رُؤْيَاكُمْ قَدْ تَوَاطَأَتْ فِى السَّبْعِ الأَوَاخِرِ، فَمَنْ كَانَ مُتَحَرِّيَهَا فَلْيَتَحَرَّهَا فِى السَّبْعِ الأَوَاخِرِ-
ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের কয়েকজনকে স্বপ্নে দেখানো হ’ল, শবে ক্বদর (রামাযানের) শেষের সাত রাত্রির মধ্যে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমি দেখেছি তোমাদের সকলের স্বপ্নই একইরূপ শেষ সাত রাত্রিতে সীমাবদ্ধ। সুতরাং যে তা অন্বেষণ করে সে যেন শেষ সাত রাত্রিত অন্বেষণ করে’।[9]
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضى الله عنهما أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ الْتَمِسُوهَا فِى الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِى تَاسِعَةٍ تَبْقَى، فِى سَابِعَةٍ تَبْقَى، فِى خَامِسَةٍ تَبْقَى-
ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা তালাশ করবে তা (শবে ক্বদর) রামাযানের শেষ দশকে মাসের নয় দিন বাকি থাকতে, সাত দিন বাকি থাকতে, পাঁচ দিন বাকি থাকতে’।[10]
লাইলাতুল ক্বদরের ফযীলত : লাইলাতুল ক্বদরে ইবাদত হাযার মাস ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ، وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ، لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ، تَنَزَّلُ الْمَلاَئِكَةُ وَالرُّوْحُ فِيْهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّنْ كُلِّ أَمْرٍ، سَلاَمٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ-
‘নিশ্চয়ই আমি একে (কুরআনকে) মহিমান্বিত রজনীতে নাযিল করেছি। মহিমান্বিত রজনী কি, তা কি আপনি অবগত আছেন? মহিমান্বিত রজনী হাযার মাস অপেক্ষাও উত্তম। সে রাত্রিতে ফেরেশতাগণ ও রূহ তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে প্রতিটি কাজের জন্য অবতীর্ণ হয়ে থাকেন। শান্তিপূর্ণ সেই রজনী; তা ফজরের উদয়কাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে’ (ক্বদর ১-৫)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে ও ছওয়াবের আশায় ক্বদরের রাত্রিতে জেগে নফল ইবাদত করবে তার পূর্বকৃত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে’।[11]
লাইলাতুল ক্বদরের দো‘আ :
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّى ‘হে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা পসন্দ কর। অতএব আমাকে তুমি ক্ষমা কর’।[12]
ছিয়াম ভঙ্গের কারণ সমূহ :
(ক) ছিয়াম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় এবং তার কাযা আদায় করতে হয়।
(খ) যৌন সম্ভোগ করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় এবং তার কাফফারা স্বরূপ একটানা দু’মাস ছিয়াম পালন করা অথবা ৬০জন মিসকীন খাওয়াতে হয় (নিসা ৯২; মুজাদালাহ ৪)।
(গ) ছিয়াম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে ক্বাযা আদায় করতে হয়। তবে অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি হ’লে বা সহবাস জনিত নাপাকী অবস্থায় সকাল হয়ে গেলে, চোখে সুর্মা লাগালে বা মিসওয়াক করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় না।[13]
(ঘ) অতি বৃদ্ধ যারা ছিয়াম পালনে অক্ষম, তারা ছিয়ামের ফিদইয়া হিসাবে দৈনিক একজন করে মিসকীন খাওয়াবেন। ছাহাবী আনাস (রাঃ) গোস্ত-রুটি বানিয়ে একদিন ৩০ (ত্রিশ) জন মিসকীন খাইয়েছিলেন।[14] ইবনু আববাস (রাঃ) গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিনী মহিলাকে ছিয়ামের ফিদইয়া আদায় করতে বলতেন।[15]
(ঙ) মৃত ব্যক্তির ছিয়ামের কাযা তার উত্তরাধিকারীগণ আদায় করবেন অথবা তার বিনিময়ে ফিদইয়া দিবেন।[16]
আল্লাহ তা‘আলা সকল মুসলমানকে তাঁর দেওয়া বিধান ছিয়ামকে যথার্থভাবে পালন করে তাঁকে রাযী-খুশি করার তাওফীক্ব দিন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের উপর তাঁর রহমত আরো বাড়িয়ে দিন। আল্লাহ আমাদের সকলের ছিয়াম সুন্দরভাবে পালন করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
কে. এম নাছিরুদ্দীন
[1]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত (আলবানী) হা/১৯৮৫।
[2]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৯৫৯।
[3]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৯৮৫।
[4]. বুখারী ১/১৫৪ পৃঃ; মুসলিম ১/২৫৪ পৃঃ।
[5]. আবু ইয়ালা, ত্বারাবানী, আওসাত্ব, সনদ হাসান, মির‘আত ২/২৩০ পৃঃ।
[6]. বুখারী ১/১৬৯ পৃঃ; মুসলিম ১/২৫৪ পৃঃ।
[7]. মুসলিম ১/২৫৪ পৃঃ; ঐ (বৈরূত ছাপা), হা/৭৩৬, ৩৭-৩৮।
[8]. বুখারী হা/২০১৭; মিশকাত হা/২০৮৩।
[9]. বুখারী হা/২০১৫; মিশকাত হা/২০৮৪।
[10]. বুখারী হা/২০২১; মিশকাত হা/২০৮৫।
[11]. বুখারী হা/৩৫; মুসলিম হা/৭৬০।
[12]. আহমাদ, ইবনু মাজাহ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২০৯১।
[13]. নায়ল ৫/২৭১-৭৫, ২৮৩. ১/১৬২ পৃঃ।
[14]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/২২১।
[15]. নায়ল ৫/৩০৮-১১ পৃঃ।
[16]. নায়ল ৫/৩১৫-১৭ পৃঃ।