বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন
রাষ্ট্রপ্রধান, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ নোবেল
বিজয়ী প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা (১৯১৮-২০১৩ ইং) গত ৫
ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ
করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। ২০০৪ সালে রাজনীতি থেকে
আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরে যাওয়ার পর থেকে তিনি জনসমক্ষে কমই আসতেন। ২০১০ সালে
সর্বশেষ তিনি জনসমক্ষে বের হয়েছিলেন। এরপর থেকে কয়েকবার তিনি অসুস্থ হন।
অবশেষে ফুসফুসের সংক্রমণে বেশ কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর মৃত্যুবরণ করলেন।
এই অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী কুজ্ঝটিকা ও কুহেলিকা ভেদ করে ধূমকেতুর ন্যায় আবির্ভূত হন। আফ্রিকার বর্ণবাদী কুশাসন ও পরাধীনতার লৌহ জিঞ্জির ভেঙ্গে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মুক্তির আকুতিকে সংগ্রামে পরিণত করেছেন, দান করেছেন মুক্তির সংগ্রামে অকুতোভয় লড়াইয়ের দীক্ষা ।
আমৃত্যু ধর্ম-গোষ্ঠী, ভাষা-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত করার সংগ্রামে লিপ্ত এই কিংবদন্তী মানুষটির বর্ণাঢ্য জীবনের পুরোটাই কেটেছে মানবতার মুক্তির সংগ্রামে। প্রতিবাদ দিয়ে যে সংগ্রামী জীবনের সূচনা হয়েছিল, ঐক্য ও শান্তি স্থাপনের মধ্য দিয়ে তা পূর্ণতা লাভ করেছে।
বিশাল দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার ৮০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ হলেও এটি একটি বহু বর্ণভিত্তিক সমাজ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বহির্বাণিজ্যের সন্ধানে ইউরোপীয়রা ক্রমেই অধিকহারে দক্ষিণ আফ্রিকায় আসতে শুরু করে। ব্রিটিশরা দক্ষিণে কেপটাউনে কলোনী স্থাপন করে এবং বোয়াসরা (ওলন্দাজ, ফরাসী, জার্মান ও ফ্লেমিস) নাটালে অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটে বসতি স্থাপন করেছিল। তারপর ১৮৬৭ সালে হীরা এবং ১৮৮৪ সালে সোনা আবিষ্কৃত হলে ইউরোপীয় বিভিন্ন কোম্পানী দক্ষিণ আফ্রিকায় অধিক সংখ্যায় ভিড় জমায়। কেপটাউন ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল ১৮০৬ সালে। হীরা ও সোনাসহ অন্যান্য মূল্যবান ধাতু ও পণ্যসামগ্রীভিত্তিক বাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসতি স্থাপনকারী ইউরোপীয়দের জীবনের মান নিজ দেশের তুলনায়ও অনেক উন্নত হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল। অন্যদিকে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান সবদিক দিয়েই ছিল চরমভাবে পিছিয়ে। সেখানে ইউরোপীয়দের সংখ্যা পাঁচ শতাংশেরও নিচে থাকলেও তাদের হাতেই ছিল প্রশাসনিক কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার প্রশ্নাতীত ক্ষমতা। শ্বেতাঙ্গদের জন্য সব কিছুই পৃথক ছিল। তাদের প্রতিষ্ঠানে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। কোন বিষয়ে ন্যূনতম প্রতিবাদ হ’লেই কৃষ্ণাঙ্গদের গ্রেপ্তার করে জেলে ঢুকানো হ’ত। এমনকি গুলি করে হত্যা পর্যন্ত করা হ’ত।
এমন এক দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে ১৯১৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং সম্পূর্ণ এক বৈরী পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠেন নেলসন ম্যান্ডেলা। বাবা ছিলেন ইস্টার্ণ কেপ প্রদেশের থেম্বো রাজকীয় পরিবারের কাউন্সিলর। বাবা নাম রেখেছিলেন রোলিহ্লাহলা ডালিভুঙ্গা মানডেলা। স্কুলের এক শিক্ষক তার ইংরেজী নাম রাখলেন নেলসন। পারিপার্শ্বিক বর্ণবাদী কিংবা বর্ণবিদ্বেষী ঘটনাবলী ক্রমে তাঁকে প্রতিবাদী করে তোলে। স্কুলজীবনে বিভিন্ন বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহিষ্কৃত হন তিনি। কিশোর বয়সে পিতাকে হারিয়ে অতিকষ্টে শেষ পর্যন্ত তিনি প্রবেশিকা পাস করেন। পরে আইন (এলএলবি) পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু লেখাপড়ায় তাঁর মোটেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। বিভিন্ন প্রতিবাদ ও আন্দোলনগত কারণে তাঁকে অনেকবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত ও গ্রেফতার হ’তে হয়েছে। বন্দী অবস্থায় ১৯৪৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকা থেকে তিনি এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) যোগদান করেন ১৯৪৪ সালে এবং ক্ষমতাসীন শ্বেতাঙ্গ সংগঠন ন্যাশনাল পার্টির বর্ণবিদ্বেষী নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলেন ১৯৪৮ সাল থেকে। ১৯৬০ সালে শ্বেতাঙ্গ শাসকগোষ্ঠী এএনসিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। বিভিন্ন হামলা-মামলা ও গ্রেফতারী পরোয়ানার পর অসংখ্য কৃষ্ণাঙ্গ নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে এক প্রহসনমূলক অথচ কঠোর বিচারকাজ শুরু হয়েছিল উচ্চ আদালতে। অভিযুক্ত হয়েছিলেন সেদিনের তরুণ নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাও। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে মামলার শুনানি চলেছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯৬১ সালে উচ্চ আদালতের প্রদত্ত এক ঐতিহাসিক রায়ে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন।
বর্ণবাদ বিরোধী তার এ আন্দোলন অহিংসভাবে শুরু হলেও ১৯৬০ সালে বর্ণবাদী সরকার কর্তৃক শার্পভিলের কৃষ্ণাঙ্গ বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের গুলিতে ৬৯ জন নিহত হলে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। একই সাথে সরকার এএনসিকে নিষিদ্ধ করে এবং যরূরী অবস্থা ঘোষণা করে। ফলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আদৌ আর লাভ হবে কি-না সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে চতুর্দিক থেকে সমস্বরে। এসময় এক বক্তৃতায় নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, সরকার যখন নিরস্ত্র এবং প্রতিরোধবিহীন মানুষের ওপর পাশবিক আক্রমণ চালাচ্ছে, তখন সরকারের সঙ্গে শান্তি এবং আলোচনার কথা বলা নিষ্ফল। পরবর্তীতে ম্যান্ডেলা ও তার সহযোদ্ধারা অন্তর্ঘাতমূলক সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। তবে এক্ষেত্রে তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল আফ্রিকায় বিদেশী বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করার মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করা।
এএনসি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করলে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে নেলসন ম্যান্ডেলাকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে তার যাবজ্জীবন সাজা হয়। শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকার কুখ্যাত রোবেন দ্বীপে তার দীর্ঘ কারাজীবন। সশ্রম কারাদন্ডের অংশ হিসাবে একটি চুনাপাথরের খনিতে শ্রমিক হিসাবে তিনি কাজ করতে বাধ্য হন। কারাগারেও বর্ণবৈষম্য চালু ছিল। কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীদের সবচেয়ে কম খাবার দেওয়া হ’ত। সাধারণ আসামীদের থেকে রাজবন্দীদের অনেক কম সুযোগ-সুবিধা ছিল। তার মধ্যেও তাঁকে সবচেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত বন্দীদের তালিকায় রাখা হয়েছিল। প্রতি ৬ মাসে ১টি চিঠি ও একজন মাত্র দর্শনার্থীর সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দেয়া হ’ত তাঁকে। ‘ডি গ্রুপের’ বন্দী হিসাবে তিনি ছিলেন সেখানে সবচেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত। বন্দী থাকার সময়ে ছয়বার তাঁকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রত্যেকবারই তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। জনগণ মুক্ত নয়, তাই নিজের মুক্তি চাই না। জনগণের সংগঠন এএনসি যদি নিষিদ্ধ থাকে, তাহলে আমাকে কোন ধরনের মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে?... দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে জানিয়েছিলেন তিনি। ম্যান্ডেলা এবং এএনসির শীর্ষ নেতাদের কারাবন্দী করলেও দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ টাউনশিপগুলোতে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন অব্যাহত থাকে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান শত শত কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ। এদিকে ম্যান্ডেলার মুক্তির জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপও বাড়তে থাকে। অবশেষে তিনি দীর্ঘ ২৭ বছর কারাভোগের পর মুক্তি পান ১৯৯০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী।
সেদিন কারাগারের সামনে দেয়া বক্তৃতায় নেলসন ম্যান্ডেলা তার সমর্থকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘এক দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখেন তিনি, যেখানে সব জাতি ও সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে এক সঙ্গে থাকতে পারবে। এই আদর্শের জন্য তিনি মরতেও প্রস্তুত’।
মুক্তির পর দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের সঙ্গে নতুন এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আলোচনা শুরু হয়, যেখানে সব বর্ণ এবং সব জাতির সমানাধিকার থাকবে। এ পথ ধরেই ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নেলসন ম্যান্ডেলা।
পুরনো দক্ষিণ আফ্রিকাকে পেছনে ফেলে নতুন আফ্রিকা গড়ার কাজটা সহজ ছিল না। কিন্তু নেলসন ম্যান্ডেলা অতীতের তিক্ততার প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে তার সাবেক শ্বেতাঙ্গ নিপীড়কদের দিকে অবলীলায় বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন। শুরু হ’ল এক নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার পথ চলা। সূচনা হ’ল নবপ্রভাতের নতুন সূর্যোদয়।
সাম্যের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব তুলে দিলেন বর্ণবাদী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডি ক্লার্কের হাতে। নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিলেন একদল শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে। দায়িত্ব গ্রহণকালীন বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা শ্বেতাঙ্গ শাসনের পরিবর্তে কৃষ্ণাঙ্গদের শাসন কায়েম করতে চাই না। আমরা এমন শাসন কায়েম করতে চাই, যেখানে সাদা-কালোর মধ্যে ভেদাভেদ থাকবে না, সব নাগরিক সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে’।
১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর হাতেই মানুষে মানুষে ভেদাভেদমুক্ত এক নতুন আফ্রিকার জন্ম হয়। বৈরী প্রতিপক্ষের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়ার মতো উদারতা এবং বর্ণাঢ্য ও নাটকীয় জীবনের অধিকারী ম্যান্ডেলার চরিত্রের সবচেয়ে অনুকরণীয় দিক হ’ল, ক্ষমতার প্রতি নির্মোহ ও ক্ষমাশীলতা। ২৭ বছরের কারাজীবন থেকে মুক্তি পেয়ে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বিশেষ আদালত গঠন করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাতে পারতেন তাকে জেলখাটানো বর্ণবাদী নেতাদেরকে। কিন্তু বিভক্ত রাষ্ট্রকে আরও বিভক্ত করা ম্যান্ডেলার উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি হিংসার আগুন জ্বালাননি, বরং কালোদের পাশাপাশি সাদা মানুষেরও সমঅধিকার বহাল রেখেছেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। তিনি সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন। ‘মানুষকে যন্ত্রণা দেওয়ার মতো যন্ত্রণা হয়তো আর নেই’, কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি রাষ্ট্রশক্তিধারী শ্বেতাঙ্গদের সেই যন্ত্রণাও ঘুচিয়েছেন।
পাঁচ বছর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের পর তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করেন। বিপুল জনপ্রিয়তার মাঝেও বিদায়ের সময় তিনি বলেন, ‘আমি সজ্ঞানে দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম। আমি মনে করি, দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের প্রতি সামান্য দায়িত্বই আমি পালন করতে পেরেছি’। এরূপ বিনয়ের নমুনা অধুনা ইতিহাসে বিরল। অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হবার নিরংকুশ সম্ভাবনা থাকলেও ক্ষমতাকে তিনি অাঁকড়ে ধরে রাখেননি। অবসর জীবনে তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
ম্যান্ডেলাকে ইসলাম গ্রহণের আহবান : সঊদী আরবের প্রখ্যাত আলেম, ইসলাম প্রচারক, সুবক্তা ও জনপ্রিয় লেখক ড. আয়েয আল-ক্বারনী চিঠি ও একটি বই প্রেরণ করে মৃত্যুর মাসখানেক আগে নেলসন ম্যান্ডেলাকে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানান। চিঠিতে তিনি লিখেন-
‘হে মহান নেতা, আপনি পার্থিব শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। আন্তর্জাতিক পদক-সম্মাননা লাভ করেছেন। স্বাধীনতার মুকুট পরিধান করেছেন। আপনি এর সঙ্গে আরো যোগ করুন, এক আল্লাহতে বিশ্বাস এবং তাঁর রাসূলের অনুগমন ও আনুগত্যের সাফল্য। আর তা ইসলাম ছাড়া অসম্ভব। ইসলাম গ্রহণ করে পারলৌকিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। ইসলাম সাম্যের ধর্ম। এ ধর্ম আরবের শ্বেতাঙ্গ ওমর ও ইথিওপিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ বেলালের মধ্যে, পারস্যের সালমান ফারেসী ও রোমের ছুহাইবের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এ ধর্ম সকল প্রকারের অন্যায়কে প্রত্যাখ্যান করে আর স্বেচ্ছাচারিতাকে নিষিদ্ধ করে এবং বর্ণ-গোত্র ও ভাষার পার্থক্য ঘুচিয়ে দেয়।
আমার যখন মুসলিম দেশগুলোর বিজ্ঞানী, নেতা, শিল্পী-সাহিত্যিক ও আলেম-ওলামার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তারা বলেন, ম্যান্ডেলা মুসলিম নন। অতএব আমি আপনার কাছে একান্তই প্রত্যাশা রাখি এবং আন্তরিকভাবে আশা করি যে, আপনি দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করুন! ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। হে মহান নেতা! পৃথিবীর দুশো কোটি মুসলিম আপনাকে স্বাগত জানাবে। আপনি পৃথিবীর সব প্রান্তের মুসলিম পুরুষ-নারী, শিশু-বৃদ্ধ সবার সশ্রদ্ধ অভিবাদন গ্রহণ করুন এবং আমার শুভেচ্ছা নিন। মহান আল্লাহ ও আরশের মহান রবের কাছে প্রার্থনা করি তিনি আপনার বক্ষকে ইসলাম গ্রহণের জন্য প্রসারিত করে দিন- আমীন! (সংক্ষেপায়িত)।
ম্যান্ডেলার কিছু শিক্ষণীয় উক্তি :
১. পিছন থেকে নেতৃতব দাও। আর অন্যদের এ বিশ্বাস করতে দাও যে, তারাই সামনে রয়েছে।
২. নেতৃত্ব দানের জন্য তোমাকে থাকতে হবে পেছনে এবং অন্যদের রাখতে হবে সামনে। বিশেষ করে বিজয় উৎসব ও সুন্দর ঘটনার সময় তোমার পেছনে থাকাই সর্বোত্তম। তবে বিপজ্জনক মুহূর্তে তোমাকে অবশ্যই সামনে অবস্থান নিতে হবে।
৪. আমি সাধু নই। তবে যদি সাধুকে এমন এক পাপী হিসাবে বিবেচনা কর, যে সৎ হবার জন্য তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তাহলে আমি তাই।
৬. সাহসী মানুষ শান্তির জন্য ক্ষমা করতে কখনো ভীত হয় না।
৭. পৃথিবীতে প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে তুমি যতটা অর্জন করতে পারবে, তার চেয়ে ঢের বেশী অর্জন করতে পারবে ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে।
৮. সম্মান তাদের প্রাপ্য, যারা কখনো সত্যকে পরিত্যাগ করে না। এমনকি যখন পরিস্থিতি অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং বেদনাদায়ক হয়।
৯. সাহস অর্থ ভয়হীনতা নয়; বরং ভয়ের ওপর বিজয় লাভ। একজন সাহসী লোক মানে এই নয় যে, সে কখনো ভয় পায় না বা ভয়কে অনুভব করে না। সেই-ই প্রকৃত সাহসী যে ভয়কে উপলব্ধি করে এবং তা জয় করে।
১০. আপনি যদি শত্রুর সাথে শান্তিতে থাকতে চান, তবে তার সাথে আপনাকে মিশে যেতে হবে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। তবেই আপনার শত্রু আপনার সঙ্গীতে পরিণত হবে।
১১. একজন প্রকৃত এবং আদর্শ নেতাকে অবশ্যই নিজ জাতির জন্য সকল প্রকারের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নিজের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
১২. বাধা-বিপত্তি কিছু মানুষকে ভেঙ্গে দেয়, আবার কিছু মানুষকে গড়ে তোলে। সবকিছুর বিনিময়ে সাফল্য পেতে যিনি সংকল্পবদ্ধ, তার মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার মত কোন হাতিয়ার পৃথিবীতে তৈরী হয়নি।
১৩. স্বাধীনতা মানে কেবল শিকল ভাঙ্গার হিড়িক নয়। বরং এমনভাবে জীবন যাপন করা যাতে করে অন্যের স্বাধীনতা ও সম্মান বৃদ্ধি পায়।
১৪. কারো প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করা অনেকটা নিজে বিষপান করে শত্রুর মৃত্যু কামনা করার মত।
১৫. মানব মনের মহানুভবতা এমন একটি অগ্নিশিখা, যা আপনি কখনই নেভাতে পারবেন না।
১৬. ঘৃণা মনকে অন্ধকার করে দেয়। কৌশলের পথ রুদ্ধ করে দেয়। নেতাদের ঘৃণা করা সাজে না।
১৭. কেউ যদি নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকে তবে সে বিজয়ী হবেই।
১৮. আমি মৌলিকভাবেই একজন আশাবাদী ব্যক্তি। ঠিক বলতে পারব না এটি আমার মধ্যে সহজাতভাবেই এসেছে, নাকি সময়ের সাথে সাথে তৈরি হয়েছে। আশাবাদী হওয়ার একটি শর্ত হচ্ছে সবসময় সূর্য বরাবর মাথা উঁচু রেখে সামনের দিকে পথ চলা। এমন অনেক মুহূর্তই এসেছে যখন মানবতার প্রতি আমার আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আমি কখনই নিজেকে হতাশ হ’তে দেইনি। কারণ হতাশার হাত ধরেই প্রবেশ করে মৃত্যু এবং পরাজয়।
পরিশেষে বলব নেলসন ম্যান্ডেলা স্বীয় ব্যক্তিত্ব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সততা ও নৈতিকতা দিয়ে জনগণকে আকর্ষণ করেছিলেন প্রবলভাবে। তাঁর নির্লোভ জীবন নিজ দেশের গন্ডী ছাড়িয়ে তাঁকে বিশ্বনেতায় পরিণত করেছিল। বিশ্ববাসীর কাছ থেকে বিদায় নিলেন সমঝোতা ও ঐক্যের এক অবিসংবাদী প্রতীক হিসাবেই। রেখে গেলেন শান্তিপূর্ণভাবে আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে অধিকার আদায়ের এক আপোষহীন সংগ্রামের ইতিহাস। সঙ্গে মানুষকে ভালবাসার অমলিন ইতিহাসও। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন তিনি। তিনি মুসলিম হিসাবে মৃত্যুবরণ করেননি, কিন্তু ইসলামের মানবিক ও নৈতিক আদর্শগুলো তাঁর মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়েছিল।
তিনি মুসলমান হলে হয়ত পাশ্চাত্য বিশ্বের কাছে এত সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হতে পারতেন না, যেমনটি পারেননি তাঁরই সমসাময়িক ফিলিস্তীনী নেতা ইয়াসির আরাফাত। নেলসন ম্যান্ডেলার মত তিনিও ভাগ্যাহত ফিলিস্তীনীদের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, শেষ পর্যন্ত প্রাণও দিয়েছেন শক্রর হাতে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তিনি মুক্তির দূত হিসাবে নন, বরং বিবেচিত হয়েছেন ফিলিস্তীনী ‘জঙ্গী’দের মুখপাত্র হিসাবে।