ভূমিকা :
আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ এলাহী সংবিধান হচ্ছে পবিত্র কুরআন এবং তার ব্যাখ্যা হচ্ছে হাদীছ। বিদায় হজ্জের দিনে বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) সকল প্রকার বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা থেকে বাঁচার জন্য এ দু’টি বস্ত্তকে মজবুতভাবে ধারণ করার জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন।[1] সেদিন তিনি উপস্থিত ছাহাবীদের নিকট থেকে তাঁর উপর অর্পিত রিসালাতের দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে পালনের স্বীকৃতি গ্রহণ পূর্বক অনুপস্থিতদের নিকটে তার এই দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার আহবান জানান।[2] তিনি উম্মাহর উপরে দ্বীনি দাওয়াতের গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেন। এ প্রসঙ্গে তাকীদ দিয়ে অন্যত্র তিনি বলেন, بَلِّغُوا عَنِّى وَلَوْ آيَةً ‘আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হ’লেও তা পেঁŠছে দাও’।[3]
এই তাবলীগ বা পৌঁছে দেওয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ওয়ায-মাহফিল। সমাজ সংস্কারে যার অবদান অনস্বীকার্য। ভারত উপমহাদেশে আবহমানকাল থেকে এ প্রথা সুপরিচিত। শীত মৌসুমে উৎসবের সাথে আয়োজন করা হয় ওয়ায-মাহফিলের। পাড়ায়-মহল্লায়, শহরে-বন্দরে সর্বত্র যুগযুগ ধরে চলে আসা এই আয়োজন এখন আরো অনেক ব্যাপকতা লাভ করেছে। পেয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতির ফলে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে ওয়ায-মাহফিল। হাতে থাকা এনড্রয়েড মোবাইল সেট অন করলেই ভেসে আসে পৃথিবীর নানা প্রান্তের ওয়ায-মাহফিলের চিত্র। এ থেকে জ্ঞান আহরণ করা যায় খুব সহজে। কিন্তু ইদানীং কিছু অসাধু আয়োজক, চটকদার আলোচক, রাজনৈতিক প্রভাব, পারস্পরিক কাঁদা ছুড়াছুড়ি, আলোচকদের উচ্চ চাহিদা বা চুক্তিভিত্তিক বক্তৃতা, প্রশাসনিক বাধা ও উদ্ভট শর্তারোপ প্রভৃতি কারণে দাওয়াতের এই অনন্য মাধ্যমটি অনেকক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আলোচ্য নিবন্ধে পাঠকদের উদ্দেশ্যে আমরা দ্বীন প্রচারে ওয়ায মাহফিলের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এবং হালযামানায় এর বাস্তব চিত্র ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।-
ওয়ায-মাহফিল অর্থ :
‘ওয়ায’ (وعظ) আরবী শব্দ। এর অর্থ উপদেশ, নছীহত, বক্তব্য। যেমন-وعظ: الْوَعْظُ وَالْعِظَةُ وَالْعَظَةُ وَالْمَوْعِظَةُ: النُّصْحُ وَالتَّذْكِيرُ بِالْعَوَاقِبِ (লিসানুল মীযান, ৭/৪৬৬ পৃ.)। আল্লাহ বলেন,ادْعُ إِلَى سَبيلِ رَبِّكَ بالحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে’ (নাহল ১৬/১২৫)। আলোচ্য আয়াতে ‘দাওয়াহ ইলাল্লাহ’র মাধ্যম হিসাবে আল্লাহ ‘ওয়ায’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। লোকমান কর্তৃক স্বীয় সন্তানকে প্রদত্ত উপদেশকে আল্লাহ ‘ওয়ায’ বলেছেন। যেমন তিনি বলেন,وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَابُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ، ‘আর স্মরণ কর, যখন লোকমান তার পুত্রকে ওয়ায (উপদেশ) করতে গিয়ে বলল, ‘হে বৎস! আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না। নিশ্চয়ই শিরক সবচেয়ে বড় পাপ’ (লোকমান ৩১/১৩)। অনুরূপভাবে অবাধ্য স্ত্রীদের উপদেশ দানের ক্ষেত্রেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ ‘আর যদি তোমরা তাদের অবাধ্যতার আশংকা কর, তাহ’লে তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের বিছানা পৃথক করে দাও এবং (প্রয়োজনে) তাদের প্রহার কর’ (নিসা ৪/৩৪)।
আর ‘মাহফিল’ (محفل) শব্দটি حفل শব্দ থেকে নির্গত। এটি একবচন। বহুবচনে محافل এর অর্থ হচ্ছে مَكَان الِاجْتِمَاع والمجلس ‘সভা ও সমাবেশের স্থান’ (মু‘জামুল ওয়াসীত্ব)। যে সভা-সমাবেশে ওলামায়ে কেরাম ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে উপদেশ বা নছীহত পেশ করেন সে সমাবেশকে ওয়ায-মাহফিল বলা হয়।
গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :
দ্বীনের পথে মানুষকে ডাকা একটি মর্যাদাপূর্ণ কাজ। এই পথের দাঈদের কথাকে আল্লাহ সর্বাধিক সুন্দর বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ، ‘ঐ ব্যক্তির চাইতে কথায় উত্তম আর কে আছে, যে (মানুষকে) আল্লাহর দিকে ডাকে ও নিজে সৎকর্ম করে এবং বলে যে, নিশ্চয়ই আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ (হামীম সাজদা ৪১/৩৩)। নবী-রাসূলগণের মিশন ছিল আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকা ও তাগূত্ব থেকে বিরত রাখা। আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ، ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট আমরা রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে দূরে থাক’ (নাহল ১৬/৩৬)। শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) এবং তাঁর ছাহাবীগণ শত প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দাওয়াতী ময়দানে অবিচল ছিলেন। আল্লাহ বলেন,قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘বলুন! এটাই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আল্লাহ পবিত্র। আর আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (ইউসুফ ১২/১০৮)। অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ সকলে দাঈ ইলাল্লাহ ছিলেন। জাহেলিয়াতের ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে অহীর আলোয় আলোকিত করার জন্য তারা নিরন্তরভাবে দাওয়াতী কাজ করে গেছেন এবং উম্মাতে মুহাম্মাদীর উপর এই গুরু দায়িত্ব অর্পণ করে গেছেন। ওয়ায-মাহফিল সেই দাওয়াতেরই একটি অন্যতম মাধ্যম। মানবসমাজের উন্নতি ও সংশোধনের জন্য এটি অতুলনীয় পন্থা। এর মাধ্যমে জনগণকে একত্রিত করে আল্লাহর দিকে আহবান জানানোর সুযোগ তৈরি হয়।
এদেশে যুগ যুগ ধরে শীত মৌসুমে ওয়ায-মাহফিলের আয়োজন হয়ে থাকে। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী প্রায় পাঁচ মাসব্যাপী দেশের আনাচে-কানাচে এই উৎসবমুখর আয়োজন চলে। দূর-দূরান্তের নামী-দামী আলেম-ওলামাগণ বিভিন্ন বিষয়ের উপর দীর্ঘ সময় যাবত নছীহত করেন। এতে মানুষের মধ্যে দ্বীনি জাযবা তৈরী হয় এবং ইসলামের বিধান পালনে কিছু মানুষ আগ্রহী হয়ে ওঠে। অনেকে হালাল গ্রহণ ও হারাম বর্জনে দৃঢ় প্রত্যয়ী হন। এভাবে ক্রমান্বয়ে সমাজে দ্বীনি আবহ সৃষ্টি হয়।
নিকট অতীতে গ্রামে-গঞ্জে যেভানে নাচ-গান-যাত্রা ইত্যাদি অশালীন অনুষ্ঠানের আয়োজন হ’ত ইদানীং তা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এমনকি এলাকা বিশেষে একেবারে উঠে গেছে। সে জায়গাটা দখল করেছে ওয়ায-মাহফিলের মত ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো। যারা এক সময় পালাগানের আসর বসাতো তারাই এখন ধর্মের প্রতি অনুরাগী হয়ে দ্বীনী অনুষ্ঠান আয়োজনে আগ্রহী হয়ে উঠছে। সুতরাং কুসংস্কারাচ্ছন্ন একটি সমাজকে সংস্কার করতে ওয়ায-মাহফিল, দাওয়াতী সভা-সমাবেশ, ইসলামী জালসা-সম্মেলন, তাবলীগী ইজতেমা ইত্যাদি প্রকাশ্য ধর্মীয় জনসমাবেশের গুরুত্ব অপরিসীম।
ওয়ায-মাহফিলের হালচিত্র :
ওয়ায-মাহফিলের ব্যাপক প্রসারের পাশাপাশি হালে কিছু কিছু কারণে এর নেতিবাচক প্রভাবও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একশ্রেণীর দ্বীন জ্ঞানহীন আলোচকের কারণে ওয়াযের মঞ্চকে অনেকে বিনোদন মঞ্চ হিসাবেও আখ্যা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আবার অনেকে রাজনৈতিক স্বার্থে এই মঞ্চ ব্যবহার করছে। অনেক আলোচক মিথ্যা বানাওয়াট কিচ্ছা-কাহিনীর মাধ্যমে, কেউ যিকরের নামে গর্হিত লাফালাফি ও অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে, কেউ পারস্পরিক অশ্রাব্য গালাগালি ও গীবত-তোহমদের মাধ্যমে এই মঞ্চটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দ্বীনের আলো বিতরণের এই মঞ্চটি যেন পাঁচমিশালী মঞ্চে পরিণত হয়েছে। এ সম্পর্কিত কতিপয় আপত্তিকর বিষয় এখানে তুলে ধরা হ’ল, যেগুলো থেকে ওয়ায মাহফিলকে নিরাপদ রাখা খুবই যরূরী।-
উদ্ভট কিচ্ছা-কাহিনী পরিবেশন :
দেশের নামী-দামী অনেক আলোচক আছেন, যাদের আলোচনায় কুরআন-হাদীছের চাইতে বানাওয়াট কিচ্ছা-কাহিনীই বেশী শুনা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তব্য দিলেও এদের কারো কারো মুখ থেকে কুরআন-হাদীছ তেমন শুনা যায় না।
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। রামাযান মাস। ঢাকা থেকে দাওয়াতী সফরে কুমিল্লা যাওয়ার জন্য বাসে চড়েছি। বাসের সুপারভাইজার হয়ত রামাযানের বরকতে গান চালু না করে ওয়ায চালু করেছেন। জনৈক কোকিল কণ্ঠী বক্তার কবরের আযাব বিষয়ে বক্তব্য শুনতে লাগলাম। ‘ত’ আদ্যাক্ষরের ঐ বক্তার দেড় ঘণ্টার বক্তব্যে আমি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপরে একটি আয়াত বা হাদীছও শুনতে পেলাম না। উপরন্তু এক পীরের মর্যাদা ও ক্ষমতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলছেন, ঐ পীরবাবার মৃত্যুর পর যখন তাকে দাফন করা হয় তখন মুনকার-নাকীর ফেরেশতা তার কবরে ঢুকতেই তিনি জোরে তাদেরকে থাপ্পড় লাগিয়ে দেন। মুনকার-নাকীর তখন আল্লাহর নিকট নালিশ করেন যে, হে পরওয়ারদেগার! তোমার কোন্ বান্দার নিকটে আমাদের পাঠালে যে, প্রশ্ন করার আগেই আমাদেরকে থাপ্পড় মেরে দিল। আল্লাহ তখন জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি কবরে ঢুকার সময় তাকে সালাম দিয়েছিলে? ফেরেশতারা বলল, না। আল্লাহ বললেন, থাপ্পড় মেরে ঠিকই করেছে। আগে আমার এই বুজুর্গ বান্দাকে সালাম দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নাও, তারপর তাকে প্রশ্ন কর। নাঊযুবিল্লাহ।
আবার কেউ জাল-যঈফ হাদীছ ও ভিত্তিহীন কথা দ্বারা ওয়ায করেন। নিজেদের আচরিত মাযহাব, মতবাদ ও তরীকার বিপক্ষে ছহীহ হাদীছ জানলেও তারা বলেন না। রাসূল (ছাঃ)-এর নামে বানানো জাল বা মিথ্যা হাদীছ দ্বারা দ্বীন প্রচার করছেন। পরিণামে তারা নিজেদের আখেরাত বিনষ্ট করছেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ تَكْذِبُوْا عَلَىَّ فَإِنَّهُ مَنْ كَذَبَ عَلَىَّ فَلْيَلِجِ النَّارَ، ‘তোমরা আমার উপর মিথ্যারোপ কর না। কেননা যে ব্যক্তি আমার উপর মিথ্যারোপ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’।[4] অন্যত্র তিনি বলেন, مَنْ كَذَبَ عَلَىَّ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ، ‘যে ব্যক্তি আমার উপরে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যারোপ করে, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়’।[5] সেকারণ বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। যিনি প্রকৃতপক্ষে কুরআন-হাদীছের জ্ঞান রাখেন এবং দলীলভিত্তিক কথা বলেন কেবলমাত্র সেই আলেমকেই দাওয়াত দেওয়া উচিত।
আলোচকদের অঙ্গভঙ্গি ও অশালীন ভাষা প্রয়োগ :
কোন কোন আলোচকের অঙ্গভঙ্গি ও ভাষা প্রয়োগ খুবই আপত্তিজনক। সিনেমার অভিনেতা ও গায়ক-গায়িকাদের নকল করে তারা শ্রোতাদের মাত করে রাখেন। অর্থহীন ও অশালীন সঙ্গীত পরিবেশন করেন, লজ্জাকর অঙ্গভঙ্গি করেন। দৃশ্যত মনে হয় যেন এটা কোন ওয়াযের মঞ্চ নয়, বরং কোন নাট্যমঞ্চ। কুরআনের ভাষায় এরা ‘লাহওয়াল হাদীছ’ বা বাজে কথা খরীদকারী। আল্লাহ বলেন,وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِيْنٌ، ‘লোকদের মধ্যে কেউ কেউ আছে, তারা তাদের অজ্ঞতাবশে বাজে কথা খরিদ করে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুৎ করার জন্য এবং তারা আল্লাহর পথকে বিদ্রূপ করে। এদের জন্য রয়েছে হীনকর শাস্তি’ (লোকমান ৩১/৬)। এখানে ‘বাজে কথা’ অর্থ গান-বাজনা। যা মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে বিমুখ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতকে সাবধান করে বলেন,نَهَيْتُ عَنْ صَوْتَيْنِ أَحْمَقَيْنِ فَاجِرَيْنِ صَوْتٍ عِنْدَ مُصِيبَةٍ خَمْشِ وُجُوهٍ وَشَقِّ جُيُوبٍ وَرَنَّةِ شَيْطَانٍ- ‘দু’টি অভিশপ্ত ও পাপিষ্ঠ শব্দ থেকে আমি তোমাদের নিষেধ করে যাচ্ছি। (১) বাজনার শব্দ ও নাচ-গানের সময় শয়তানের সুরধ্বনি (২) বিপদের সময় মুখ ও বুক চাপড়ানোর ক্রন্দন ধ্বনি’।[6] সুতরাং কুরআন হাদীছ বাদ দিয়ে এসব অভিনয়, সংগীত ও কমেডি আলোচনা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে সন্দেহ নেই। তাই অন্তসারশূন্য এসমস্ত আলোচনা থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে ফিরে আসা উচিত।
পরচর্চা ও পরনিন্দা : পরচর্চা বা পরনিন্দা একটি জঘন্য কর্ম। আরবীতে যাকে ‘গীবত’ বলা হয়। যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যাকে আল্লাহ মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণের সাথে তুলনা করেছেন (হুজুরাত ৪৯/১২)। গীবতের পরিচয় সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَتَدْرُونَ مَا الْغِيبَةُ؟ قَالُوا: اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِي أَخِي مَا أَقُولُ؟ قَالَ: إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ، فَقَدِ اغْتَبْتَهُ، وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّه ‘তোমরা কি জান ‘গীবত’ কী? তাঁরা বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেন, তোমার ভাই যে কথা অপসন্দ করে তার সম্পর্কে সে কথা বলার নাম গীবত। জিজ্ঞেস করা হ’ল, আমি যা বলছি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি যা বলছ তা যদি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবেই তুমি তার ‘গীবত’ করলে। আর যদি না থাকে তাহ’লে তুমি তাকে অপবাদ দিলে’।[7]
ইদানীং একশ্রেণীর আলোচক ওয়াযের মঞ্চকে এই ন্যক্কারজনক কাজেও ব্যবহার করছে। হাযার হাযার জনতার সামনে অন্য একজন আলেম সম্পর্ক দেদারছে গীবত করা হচ্ছে। অন্যকে অপদস্ত করে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির কোশেশ করা হচ্ছে। এটা এতটাই জঘন্য যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ক্ষমা ব্যতীত আল্লাহও তাকে ক্ষমা করবেন না। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ كَانَتْ لَهُ مَظْلَمَةٌ لِأَخِيهِ مِنْ عِرْضِهِ أَوْ شَيْءٍ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهُ الْيَوْمَ قَبْلَ أَنْ لَا يَكُونَ دِينَارٌ وَلَا دِرْهَمٌ إِنْ كَانَ لَهُ عَمَلٌ صَالِحٌ أُخِذَ مِنْهُ بِقَدْرِ مَظْلَمَتِهِ وَإِنْ لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ صَاحِبِهِ فَحُمِلَ عَلَيْهِ- ‘যে ব্যাক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানী বা অন্য কোন বিষয়ে যুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয়, সেদিন আসার পূর্বে যেদিন তার কোন দ্বীনার বা দিরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোন সৎকর্ম থাকলে তার যুলুমের পরিমাণ তা তার নিকট থেকে নেওয়া হবে আর তার কোন সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ থেকে নিয়ে তা তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে’।[8]
পোষ্টারে দলীয় নেতা-কর্মীদের নামের ফিরিস্তি : আজকাল ওয়ায-মাহফিলের পোষ্টারের দিকে তাকালে দেখা যায় বিশাল নামের ফিরিস্তি। দলীয় নেতা-কর্মীদের নামের তালিকার ভিড়ে মূল আলোচকের নামই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কোন কোন মাহফিলে একচেটিয়া ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নাম। আবার কোথাও উভয় দলকে সন্তুষ্ট করতে ধারাবাহিকভাবে উভয়দলের নেতাদের নাম স্থান পায় পোষ্টারে। মাহফিল কর্তৃপক্ষ কাউকেই যেন অসন্তুষ্ট করতে চান না। পাশাপাশি আর্থিক সুবিধা পেতে বাদ দেওয়া হয় না স্থানীয় ও পরিচিত ব্যবসায়ীদের নামও। পুরো পোষ্টার জুড়ে শুধুই নামের তালিকা। এ যেন নাম ও পদবীর এক প্রদর্শনী। তাছাড়া নামের অবস্থান নিয়েও চলে গোলমাল, রাগ-অনুরাগ ও অভিমান। তিনি এত বড় মাপের নেতা কেন তার নামটা অমুকের নামের আগে দেওয়া হ’ল না? এ নিয়ে চলে চাপা ক্ষোভ, অসন্তোষ এবং পরিণামে মাহফিল বয়কট। কোন কোন ক্ষেত্রে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করে অনুষ্ঠান বাঞ্চালেরও অপচেষ্টা চালানো হয়। দ্বীনি দাওয়াতের এই স্বচ্ছ মজলিসটিকে করা হয় কালিমাযুক্ত। বর্তমানে আরেকটি অঘোষিত নিয়ম চালু হয়েছে যে, যে এলাকায় মাহফিল হবে সে এলাকার এমপিকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রধান অতিথি করতে হবে। চাই তিনি উপস্থিত থাকুন বা না থাকুন, জানুন বা না জানুন। নাম পোষ্টারে দৃশ্যমান হ’লেই হ’ল। এলাকার অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন কোন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিকে উক্ত চেয়ার দেওয়া যাবে না। অন্যথায় মাহফিলের অনুমতি মিলবে না।
রাজনৈতিক প্রচারণার ক্ষেত্র ওয়ায-মাহফিল : গ্রাম-গঞ্জের ওয়ায-মাহফিল আজকাল রাজনৈতিক নেতাদের প্রচারণার মঞ্চে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার ও দলীয় নেতারা অথবা সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাহফিলগুলোকে তাদের দলীয় প্রচারণার কেন্দ্রে পরিণত করেছেন। এমনকি এরা এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে, বক্তৃতা চলাবস্থায় মঞ্চে আসলে চলমান বক্তৃতা থামিয়ে দিয়ে তাদেরকে বক্তব্য দিতে সময় দিতে হয়। এতে আলোচকের আলোচনায় ছন্দপতন হয়। শ্রোতাদের মনোযোগ বিনষ্ট হয়। সময়ের অপচয় হয়। সর্বোপরি এটি দাওয়াতের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। তারপরও বাধ্য হয়েই কর্তৃপক্ষ এমন সুযোগ দিয়ে থাকেন। উল্লেখ্য, এই নেতারা যদি কিছু সময় বসে বক্তৃতা শ্রবণ করতেন, তাহ’লে কতই না সুন্দর হ’ত এবং তাদের উপকারে আসতো। কিন্তু আদৌ তারা বক্তৃতা শুনতে আসে না।
হাদিয়া না বিনিময়? ওয়ায-মাহফিলে বক্তাদের হাদিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এ নিয়ে আজকাল অনেক বাতচিত হচ্ছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যেন ইসলামিক আলোচকদের দরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কোন কোন বক্তার ডিমান্ড লাখ টাকাও ছাড়িয়েছে। দূর অতীতে দ্বীনের দাঈগণ পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। নিকট অতীতেও রিক্সা, ভ্যান, মোটর সাইকেল, ঘোড়ার গাড়ী, মহিষের গাড়ী, নৌকা ইত্যাদিতে চড়ে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। অথচ আজকাল আমরা প্রাইভেটকার, মাইক্রো, বিমান এমনকি হেলিকপ্টারে চড়ে দাওয়াতী কাজ করছি। তারপরও তাদের সেই খুলূছিয়াত আমাদের মধ্যে নেই। তাদের সেই নিঃস্বার্থ দাওয়াত এখন শুধুই স্মৃতি। আমাদের সবকিছুর মধ্যে কেন যেন স্বার্থপরতা জড়িয়ে আছে। হয় তা আর্থিক বা মার্যাদাগত অথবা অন্য কোন বিষয়ে। অগ্রিম বায়না না হ’লে আমরা মাহফিলের তারিখ দেই না। কাঙ্ক্ষিত হাদিয়া পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে বলি ডেইট ফাঁকা নেই। আমাদের প্রাইভেট সেক্রেটারী প্রয়োজন হয়। নিজে না চাইতে পারলেও পিএস বা গাড়ীর ড্রাইভারের মাধ্যমে উদ্দেশ্য হাছিল করা হয়। আমরা এতটাই নিচে নেমেছি যে, বিকাশে হাদিয়া পাঠালে বিকাশ খরচটাও চাইতে আমাদের বাধে না। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া খুবই যরূরী।
হাদিয়া অর্থ উপহার বা উপঢৌকন। হাদিয়া ইসলামে সিদ্ধ। রাসূল (ছাঃ) হাদিয়া বিনিময়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, تَهَادُوا تَحَابُّوا ‘তোমরা পরস্পর হাদিয়া বিনিময় কর, তাহ’লে তোমাদের মধ্যে মুহাববত সৃষ্টি হবে’।[9] মা আয়েশা (রাঃ) বলেন,كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقْبَلُ الْهَدِيَّةَ وَيُثِيبُ عَلَيْهَا، ‘রাসূল (ছাঃ) হাদিয়া গ্রহণ করতেন এবং তার প্রতিদানও দিতেন’।[10] আবূ সালামা বলেন, كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَأْكُلُ الْهَدِيَّةَ، وَلَا يَقْبَلُ الصَّدَقَةَ، ‘রাসূল (ছাঃ) হাদিয়া খেতেন, কিন্তু ছাদাক্বা খেতেন না’।[11] সুতরাং এন্তেজামিয়া কমিটির পক্ষ থেকে বক্তাকে স্বেচ্ছায় প্রদত্ত হাদিয়া অথবা পাথেয় গ্রহণ করা জায়েয। তবে এটি যদি বক্তার ডিমান্ড বা চাওয়া হয় বা দরকষাকষি করে নির্ধারণ করা হয়, তবে তা আদৌ সিদ্ধ নয়। তখন এটি আর হাদিয়া থাকে না, বিনিময় হয়ে যায়। নবী-রাসূলগণ এমনকি ছাহাবীগণের কেউ দ্বীনী দাওয়াতের বিনিময় গ্রহণ করতেন না। যেমন নূহ (আঃ) বলেছিলেন,وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، ‘আমি তোমাদের নিকটে এজন্য (দ্বীন প্রচারের জন্য) কোন প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান তো কেবল বিশ্বপালকের নিকটেই রয়েছে’ (শু‘আরা ২৬/১০৯)। হূদ (আঃ) স্বীয় কওমের লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, يَاقَوْمِ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى الَّذِي فَطَرَنِي أَفَلَا تَعْقِلُوْنَ، ‘হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের কাছে এর কোন বিনিময় চাই না। এর বিনিময় তো কেবল তাঁর কাছেই রয়েছে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তবুও কি তোমরা বুঝ না?’ (হূদ ১১/৫১)। রাসূল (ছাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন, قُلْ مَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُتَكَلِّفِينَ ‘তুমি ওদের বলে দাও, আমি তোমাদের কাছে কোনরূপ বিনিময় চাই না এবং আমি এতে ভানকারীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (ছোয়াদ ৩৮/৮৬)। অন্যত্র তিনি বলেন,قُلْ مَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِلَّا مَنْ شَاءَ أَنْ يَتَّخِذَ إِلَى رَبِّهِ سَبِيلًا ‘তুমি বল, আমি তোমাদের নিকট এই দাওয়াতের বিনিময়ে কোন প্রতিদান চাই না। কিন্তু যে ব্যক্তি চায় আল্লাহর পথে ব্যয়ের মাধ্যমে তার প্রতিপালকের (সন্তুষ্টির) পথ অবলম্বন করতে পারে’ (ফুরকান ২৫/৫৭)। তিনি বলেন,قُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرَى لِلْعَالَمِينَ ‘বলে দাও যে, এর (অর্থাৎ কুরআন বা দ্বীন প্রচারের) বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না। বস্ত্ততঃ এই কুরআন বিশ্ববাসীর জন্য উপদেশ মাত্র’ (আন‘আম ৬/৯০)। আল্লাহ আরো বলেন, اتَّبِعُوا مَنْ لَا يَسْأَلُكُمْ أَجْرًا وَهُمْ مُهْتَدُونَ ‘তোমরা অনুসরণ কর তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চায় না এবং তারা সুপথ প্রাপ্ত’ (ইয়াসীন ৩৬/২১)। উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে এ কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয় যে, দ্বীন প্রচারের কোন দুনিয়াবী পারিশ্রমিক বা বিনিময় হয় না। কেননা এর বিনিময় একমাত্র মহান আল্লাহই দিবেন।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আয়োজকদের গাফেলতীও ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। মাহফিল শেষ হওয়ার পর আয়োজকদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সঠিকভাবে পাথেয় দেওয়া হয় না। বক্তার অবস্থান, থাকা-খাওয়া অথবা ফিরে যাওয়া কোনটারই উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকে না। যতটা না মাহফিলের আগে বক্তার কদর থাকে মাহফিল শেষ হ’লে এর কানাকড়িও আর অবশিষ্ট থাকে না। এই আচরণ চরমভাবে নিন্দনীয়।
ফেইসবুক ও ইউটিউবারদের চটকদার হেডলাইন :
একশ্রেণীর ফেইসবুকার ও ইউটিউবার আছেন, যারা নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে ওয়ায-মাহফিল আপলোড করে থাকেন। ফলে ভিউআর বা দর্শক বৃদ্ধির জন্য তারা এমন সব অংশ কাটপিচ করে চটকদার হেডলাইন করে পেইজে ছেড়ে দেন, যা দেখলে যে কেউ ভিডিওটি দেখতে বাধ্য হবে। আর ভিউআর বেশী হ’লে ইউটিউব থেকে তার আয়ও বেশী হবে। এই ক্ষেত্রে ক্ষতি হচ্ছে বক্তৃতার কোন অংশে নেগেটিভ বা সমালোচনামূলক কথা থাকলে সেটিই বেশী প্রচার পায়। এরচেয়ে বহুলাংশে বেশী পরিমাণ পজেটিভ কথা থাকলেও তা প্রচার পায় না। এক পর্যায়ে বিরোধী পক্ষও পাল্টা জওয়াব দেয়। ফলে কাঁদা ছোড়াছুড়ি লেগেই থাকে। মাঝখানে ফায়েদা হাছিল করে ইউটিউবার। এমনই একজন পেশাদার ভিডিওম্যানের সাথে ৩/৪ বছর আগে বাসে পাশাপাশি সিটে বসে ঢাকা থেকে রাজশাহী ফিরছিলাম। রাজশাহীতে তার ভিডিওর দোকান আছে। পূর্বপরিচিত ও অমুসলিম। জিজ্ঞেস করলাম, দাদা ঢাকা কবে এসেছিলেন? বললেন, ঢাকা নয়, অমুক বক্তার বক্তব্য ভিডিও করার জন্য ময়মনসিংহে এক মাহফিলে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ঢাকা হয়ে রাজশাহী ফিরছি। বিষয়টি সেসময় ভাল না বুঝলেও এখন ঠিকই এর কারণ বুঝতে পারছি।
সংখ্যা কখনো সফলতার মানদন্ড নয় :
ওয়ায-মাহফিলের সফলতা বলতে আমরা সুন্দর প্যান্ডেল, আকর্ষণীয় মঞ্চ, জাকজমকপূর্ণ লাইটিং, উন্নত সাউন্ড সিস্টেম, নামি-দামী আলোচকের বক্তব্য ও উপচেপড়া শ্রোতার উপস্থিতকেই বুঝি। কিন্তু আসলেই কি দ্বীনী মাহফিলের সফলতা অধিক পরিমাণ শ্রোতার অংশগ্রহণের ওপর নির্ভর করে?
প্রকৃতপক্ষে ওয়ায-মাহফিলের সফলতা কিসে তা চিন্তা করতে হ’লে সর্বাগ্রে এর উদ্দেশ্য কি তা ভাবতে হবে। মূলতঃ শ্রোতাদেরকে দ্বীনের পথে নিয়ে আসাই হচ্ছে এর মূল উদ্দেশ্য। সেকারণ স্বল্প সংখ্যক উপস্থিতির মাহফিলেও যদি এই উদ্দেশ্যে সাধন হয়, তবে সেটিই হবে সফল মাহফিল। পক্ষান্তরে মাঠভর্তি শ্রোতার মাহফিলের আলোচনা যদি শ্রোতাদের মনে কোন রেখাপাত না করে, তাদেরকে হেদায়াতের রাজপথে চালিত করতে না পারে তবে তা কখনো সফল মাহফিল নয়। কেননা সংখ্যা কখনো সফলতার মানদন্ড নয়। মাত্র একজন শ্রোতার হেদায়াতই সর্বোচ্চ মূল্যবান লাল উট কুরবানীর চেয়ে বেশী ছওয়াবের। যেমনটি নায়েম দূর্গ বিজয়াভিযানে প্রেরিত সেনাপতি আলী (রাঃ)-এর উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন যে,فَوَاللهِ لأَنْ يُهْدَى بِكَ رَجُلٌ وَاحِدٌ خَيْرٌ لَكَ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ ‘আল্লাহর কসম তোমার দ্বারা যদি একজন ব্যক্তিও হোদায়াত লাভ করে তবে সেটি তোমার জন্য লাল উট কুরবানীল চাইতেও উত্তম’।[12] তাই কেবল জনসাধারণের মন জয় করা লক্ষ্য নয় বরং সামনে থাকা উচিত তাদের জীবন পরিবর্তনের লক্ষ্য। মাহফিলের সফলতা নির্ণয় করা উচিত এ মানদন্ডকে সামনে রেখে, উপস্থিত শ্রোতাদের সংখ্যা দিয়ে নয়।
সরকারী প্রতিবন্ধকতা :
ইতিপূর্বে ওয়ায-মাহফিলের জন্য কোন অনুমতির প্রয়োজন হ’ত না। যতদূর মনে পড়ে ২০০৫ সালের পর থেকে ওয়ায-মাহফিল বা ইসলামী জালসার জন্য সরকারী অনুমতির নিয়ম চালু করা হয়। ফলে দ্বীন প্রচারে আরো একধাপ জটিলতা বৃদ্ধি পায় এবং ওয়ায-মাহফিল দলীয় নেতাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার হাতিয়ারে পরিণত হয়। যিনি যেখানে ক্ষমতাসীন বা প্রভাবশালী সেখানে তার ইশারায়ই চলে সবকিছু। তিনি চাইলে অনুমতি মিলে, না চাইলে মিলে না। প্রথমে সংশ্লিষ্ট যেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত আবেদন করতে হয়। যেলা প্রশাসক তখন তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করার জন্য যেলা পুলিশ সুপার বরাবরে চিঠি দেন। পুলিশ সুপার সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইন চার্জকে (ওসি) এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন পেশ করার জন্য লিখেন। থানার ওসি তখন একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে দায়িত্ব দেন তদন্ত করার জন্য। অতঃপর এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় একইভাবে তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রতিবেদন থানা ওসি হয়ে এসপি এবং এসপি হয়ে ডিসির দফতরে পৌঁছার পর ইতিবাচক প্রতিবেদন হ’লে মাহফিলের অনুমতি পাওয়া যায়, আর নেতিবাচক হ’লে অনুমতি পাওয়া যায় না। এ হ’ল সাদা চোখের বিবরণ। কিন্তু অন্তরালে থাকে অনেক কিছু। যদি দেখা যায়, মাহফিলের আয়োজক, আলোচক কেউ ভিন্নমতাবলম্বী তখন নেগেটিভ ইশারায় সবকিছু হয়। তবে কোথাও কোথাও প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের বাড়াবাড়িও চরমে পৌঁছে। ইসলামী কোন অনুষ্ঠানের কথা শুনলে তাদের যেন গাত্রদাহ শুরু হয়। অথচ গান-বাজনা, যাত্রা বা যেকোন ধরনের কনসার্ট-এর আয়োজনে শুধু অনুমিত কেন সহযোগিতা করতেও তাদের কোন আপত্তি থাকে না। দুর্ভাগ্য আমাদের, মুসলমানদের দেশে জন্ম নিয়ে আজ ইসলামের কথা বলতে এত বাধা। যেখানে মহান আল্লাহ দ্বীন প্রচারের কথা বলেছেন, বারবার তাকীদ দিয়েছেন, তাঁর নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) দ্বীন প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন সেখানে মুসলিম দেশের এই মুসলিম দায়িত্বশীলরা দ্বীন প্রচারের জন্য অনুমতির প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে প্রকারান্তরে নিজেদেরই ক্ষতি করছেন। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দা করুন!
শেষ কথা : একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও দ্বীনি সমাজ গড়ে তোলার জন্য দাওয়াতের কোন বিকল্প নেই। আর ওয়ায-মাহফিল দাওয়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। উপমহাদেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই স্বচ্ছ মাধ্যমটি যেন কখনো অস্বচ্ছ না হয়, সুবিধাভোগী ও স্বার্থপর শ্রেণী কর্তৃক কালিমালিপ্ত না হয়, সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আলেম ও বক্তাদেরকেও এ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কথা বলায় হ’তে হবে আরো শালীন। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীলভিত্তিক বাণী নিঃস্বার্থভাবে পৌঁছে দেওয়ার জন্য হ’তে হবে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তবেই নেমে আসবে এলাহী মদদ। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন!
[1]. মুওয়াত্তা, মিশকাত হা/১৮৬।
[2]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৬৫৯।
[3]. বুখারী হা/৩৪৬১; মিশকাত হা/১৯৮।
[4]. বুখারী হা/১০৬।
[5]. বুখারী হা/১০৭।
[6]. তিরমিযী হা/১০০৫; ছহীহাহ হা/২১৫৭; কুরতুবী হা/৪৯২১।
[7]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৮২৮।
[8]. বুখারী হা/২৪৪৯; মিশকাত হা/৫১২৬।
[9]. বুখারী, আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯৪।
[10]. বুখারী হা/২৫৮৫।
[11]. দারেমী হা/৬৮ সনদ হাসান।
[12]. বুখারী হা/২৯৪২।