ভারত
সরকার বহুল আলোচিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে নতুন উদ্যমে কাজ
শুরু করেছে। ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রী সানোয়ার লাল জাট গুরুত্বপূর্ণ এই
প্রকল্পের কাজ শুরু করতে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার সরকারের সাথে আলোচনা
করবেন বলে জানিয়েছেন। প্রথম পর্যায়ে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের মধ্যকার
তিস্তা-গঙ্গা-মানস-সঙ্কোষ নদী সংযোগ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলে বিভিন্ন
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
বলাবাহুল্য গঙ্গা ও তিস্তাসহ ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের অধিকাংশই বাংলাদেশের সাথে যৌথ বা অভিন্ন নদী হিসেবে স্বীকৃত। ফলে আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও নদী আইন অনুসারে ভাটির দেশ বাংলাদেশের সাথে আলোচনা বা সমঝোতা ছাড়া উজানের ভারত এককভাবে এসব নদীর পানি প্রত্যাহার বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। অথচ এক্ষেত্রে ভারত বরাবরই আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশন লঙ্ঘন করে একতরফাভাবে নদীতে বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আর এবার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হ’লে বাংলাদেশ আরো ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হবে।
ভারতে আন্তঃনদী সংযোগের চিন্তা নতুন নয়। ২০০২ সালে তৎকালীন বিজেপি সরকার এ সম্পর্কে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন ভারত আরেক মরণফাঁদ ফারাক্কার প্রভাবে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া গঙ্গার প্রবাহ বৃদ্ধির উপায় হিসেবে ব্রহ্মপুত্রের পানি খাল কেটে গঙ্গায় আনার প্রস্তাব দেয়। অথচ বাংলাদেশে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ পানিই আসে ব্রহ্মপুত্রের মাধ্যমে। যা প্রত্যাহারে সম্মত হ’লে দেশকে শুকিয়ে মারার আরেকটি পথ খুলে যাবে। তাই সঙ্গতকারণেই তখন বাংলাদেশ সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
ভারতীয় প্রস্তাবের বিপরীত বাংলাদেশ তখন একটি প্রস্তাব দেয়, যা যেকোনো বিচারে গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশের প্রস্তাব ছিল, নেপালে ত্রিদেশীয় উদ্যোগে রিজার্ভার নির্মাণ করে বর্ষার পানি ধরে রাখা এবং শুকনো মওসুমে তা ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে গঙ্গার প্রবাহ বৃদ্ধি করা। এছাড়া নেপালে রিজার্ভারকেন্দ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা, যাতে হাযার হাযার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে এবং যা তিন দেশ ভাগাভাগি করে নিয়ে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করতে পারবে। এই প্রস্তাবে নেপালেরও সানন্দ সম্মতি ছিল। কিন্তু ভারত সরকার তা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে। প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে হয়ত আগামী বহুদিন পানির কোনো সমস্যা হ’ত না। প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিও ঠিক থাকত।
উল্লেখ্য, আলোচ্য আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে ভারতেও তুমুল বিতর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞগণ এ প্রকল্পের পক্ষে নন। ২০০৪ সালে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে বাংলাদেশসহ অববাহিকা অঞ্চলের সম্ভাব্য প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ৮০ জন ভারতীয় পানি বিশেষজ্ঞের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত তিন দিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক সেমিনারে বিশেষজ্ঞগণ এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের জন্য সমূহ বিপর্যয়ের আশঙ্কার পাশাপাশি ভারতের অন্তত ৯টি প্রদেশে এই প্রকল্পের বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনবে বলে মত দিয়েছিলেন। তাদের মতে, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা কিংবা প্রবাহ পরিবর্তন করা অথবা পানি ব্যাপকভাবে স্থানান্তর করার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ, উৎপাদন ব্যবস্থা ও জীবন-জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া পড়বে। সুতরাং প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী নদীগুলিকে স্বাভাবিক অবস্থায়, প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যেই রাখতে হবে।
প্রসঙ্গত স্মরণযোগ্য যে আন্তঃনদী সংযোগের যেসব উদ্যোগ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নেয়া হয়েছে তা এত ব্যাপকভিত্তিক নয়। অথচ সে সবের কোনটির ফলাফল ভালো হয়নি।
পদ্মার উজানে ভারতের ফারাক্কা এবং তিস্তার উজানে গজলডোবা বাঁধের পরিণতিতে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী ও শাখা নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে। দেশের বিশাল অংশে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অন্যদিকে সিলেটের বিপরীতে টিপাইমুখ বাঁধের নির্মাণ প্রক্রিয়াও জোরেশোরে চলছে। যা বাস্তবায়িত হলে সুরমা-কুশিয়ারা পানি প্রবাহ মারাত্মক সংকটে পড়বে। ফলে মেঘনা অববাহিকাকে পানি সংকটের আবর্তে নিক্ষেপ করবে। এর কারণে ভূমিকম্প ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশংকাও বাড়বে। সেই সাথে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকাকে শুকিয়ে মারবে। এই তিন-চারটি মূল অববাহিকা পানি শূন্য হয়ে পড়লে বাংলাদেশের কি পরিণতি হবে, তা বিশদ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।
এভাবে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের প্রশ্নে বাংলাদেশের সাথে কোনরূপ সমঝোতা বা চুক্তি ছাড়াই ভারত এখন গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্থায়ীভাবে পানিবঞ্চিত করতে চাইছে।
অথচ সরকার ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ‘বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না’ এমন অসার প্রতিশ্রুতিতে তুষ্ট হয়ে দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ নিয়েও একের পর এক আপস করেই চলেছে।
[আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতের কৌশলী ভূমিকার বিপরীতে সরকারের নীরব ভূমিকায় দেশের সচেতন মহল হতাশ ও ক্ষুব্ধ। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে বাংলাদেশের কাছে তাদের প্রত্যাশিত সবকিছুই বিনা বাক্য ব্যয়ে ত্বরিত উদ্যোগে দিয়ে দেয়া হলেও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির মত বিষয় ছিল আলোচনার বাইরে। অথচ তিস্তা, গঙ্গা, টিপাইমুখ, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পসহ অভিন্ন নদীর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার প্রশ্নে বাংলাদেশের দাবীকে অগ্রাহ্য করার কোন উপায় ভারতের নেই। তাই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় যাওয়ার পাশাপাশি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়টি সরকারকে সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নিতে হবে (স.স.)]।