আল্লাহর সৃষ্ট বস্ত্ত সমূহ প্রধানত দু’ভাগে বিভক্ত (১) দৃশ্যমান ও (২) অদৃশ্য। দৃশ্যমান বস্ত্ত সমূহের মধ্যে আসমান-যমীন, সূর্য-চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র, তারকা প্রভৃতি। ক্ষুদ্র বস্ত্ত সমূহের মধ্যে মানুষ, পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ, উদ্ভিদরাজি, জলজপ্রাণী সমূহ প্রভৃতি। অদৃশ্য বস্ত্ত সমূহের মধ্যে আছে হাওয়া-বাতাস, প্রাণীর জীবন-মৃত্যু, জান্নাত-জাহান্নাম প্রভৃতি। এতদ্ব্যতীত আরও কত যে জানা-অজানা দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বস্ত্ত সমূহ রয়েছে, যার কোন ইয়ত্তা নেই।

ধ্বংস বা ধ্বংসলীলা একটি মারাত্মক আকষ্মিক অদৃশ্য শক্তি। এ শক্তির আক্রমণ সময় বা বাস্তবায়ন সম্পর্কে মানুষের কোন জ্ঞান নেই। তবে এর গতি প্রকৃতি ও আগমনের নমুনা সম্বন্ধে সামান্য অবগত। যেমন ভূমিকম্প, সুনামি, সিডর, আইলা, হ্যারিকেন, ঝড়-বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো প্রভৃতির আক্রমণ কখনো কখনো ব্যাপক ধ্বংস বয়ে আনে। আবার আকষ্মিকভাবে মারাত্মক দুর্ঘটনায় আকাশ পথে মাঝে মধ্যে ধ্বংস হয় অনেক যাত্রীবাহী বিমান। সড়ক পথেও যানবাহনে দুর্ঘটনায় বহু মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে। পানিপথেও নৌযানগুলোর মধ্যে অনুরূপ দুর্ঘটনার অন্ত নেই।

সুতরাং ধ্বংস বা ধ্বংসলীলা হ’ল একটি লোমহর্ষক বিষয়, যা সমস্ত সৃষ্টির জন্য হুমকী স্বরূপ। এ ধ্বংসলীলায় শুধু মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা নয়, বরং জীবজগতের অন্যান্য প্রাণী এবং বাড়ী-ঘর বা বাসস্থান সবই ধ্বংস হয়, পাশাপাশি ফলজ ও বনজ উদ্ভিদরাজিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এসব ধ্বংসযজ্ঞ সাধারণত কোন অঞ্চল বা দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এখন জানার বিষয় হ’ল, এসব ধ্বংসলীলার কারণ কী? এগুলো কেন হয়? কখন হয়? মহান আল্লাহই তো সব কিছুর স্রষ্টা। পবিত্র কুরআনে তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন,وَيَسْتَعْجِلُوْنَكَ بِالسَّيِّئَةِ قَبْلَ الْحَسَنَةِ وَقَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِمُ الْمَثُلَاتُ وَإِنَّ رَبَّكَ لَذُو مَغْفِرَةٍ لِلنَّاسِ عَلَى ظُلْمِهِمْ وَإِنَّ رَبَّكَ لَشَدِيْدُ الْعِقَابِ- ‘তারা (ঈমান আনার) কল্যাণের পূর্বেই তোমার কাছে শাস্তি ত্বরান্বিত করার দাবী জানায়। অথচ তাদের পূর্বে বহু ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির দৃষ্টান্ত গত হয়েছে। মানুষের যুলুম সত্ত্বেও তোমার পালনকর্তা তাদের প্রতি ক্ষমাশীল। আর নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক শাস্তিদানে কঠোর’ (রা‘দ ১৩/৬)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ- ‘আর আল্লাহর জন্যই আসমান ও যমীনের রাজত্ব। আল্লাহ সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাশালী’ (আলে ইমরান ৩/১৮৯)। তিনি আরো বলেন, فِيْ مَقْعَدِ صِدْقٍ عِنْدَ مَلِيْكٍ مُقْتَدِرٍ ‘আমি তো প্রত্যেক বস্ত্তকে যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছি’ (ক্বামার ৫৪/৫৯)

তাঁর মহাশক্তির বহিঃপ্রকাশ হ’ল, فَعَّالٌ لِمَا يُرِيْدُ ‘তিনি যা চান, তাই করেন’ (বুরূজ ৮৫/১৬)

মানুষের মধ্যে কোন কোন সম্প্রদায় আল্লাহর অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে, পরকালকে বিশ্বাস করে, আল্লাহকে মান্য করে, তাঁর হুকুম-আহকাম পালন করে, তাঁর পুরষ্কার ও শাস্তিকে বিশ্বাস করে এবং তাঁকে সর্বদা ভয় করে চলে। অপরদিকে কোন কোন সম্প্রদায় আল্লাহকে বিশ্বাস করে না, পরকালে বিশ্বাস করে না, তাঁর আদেশ-নিষেধও পালন করে না, বরং বিরোধিতা করে, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। এদের প্রতি আল্লাহ চরম অসন্তুষ্ট হন। তিনি তাঁর নবী-রাসূলদের দ্বারা সতর্কবাণী ও শাস্তির বর্ণনা পেশ করেন। কিন্তু আল্লাহদ্রোহী ঐসব লোকেরা মোটেও ভীতু না হয়ে বরং তারা তাদের নবীকেই নানারূপ ভয়-ভীতি এমনকি হত্যারও হুমকী দিত। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ভয়াবহ আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেন।

আসলে ধ্বংস বা ধ্বংসলীলা আল্লাহর সৃষ্ট একটি অবর্ণনীয় অলৌকিক শক্তি। শুধু মানব জাতির অহংকার চূর্ণ করার জন্য, আল্লাহর মহাজ্ঞানের নিদর্শনকে অবজ্ঞা করার জন্য, ধ্বংসের মত অকল্পনীয় বস্ত্ত সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ধ্বংসের প্রণালী কত প্রকারের হ’তে পারে তা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। তবে প্রাচীনকালের ঘটনাপ্রবাহ হ’তে ধ্বংসের কিছু নমুনা পাওয়া যায়। যা সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে তুলে ধরা হ’ল। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে প্রত্যাদেশ হয়েছে, بَلَاغٌ فَهَلْ يُهْلَكُ إِلَّا الْقَوْمُ الْفَاسِقُوْنَ ‘এ এক ঘোষণা সত্যত্যাগী সম্প্রদায় ছাড়া কাউকে ধ্বংস করা হবে না’ (আহকাফ ৪৬/৩৫)। অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন,وَمَا أَهْلَكْنَا مِنْ قَرْيَةٍ إِلَّا لَهَا مُنْذِرُوْنَ، ذِكْرَى وَمَا كُنَّا ظَالِمِيْنَ- ‘বস্ত্ততঃ আমরা এমন কোন জনপদ ধ্বংস করিনি, যেখানে সতর্ককারী ছিল না- স্মরণ করানোর জন্য। আর আমরা যালেম নই’ (শু‘আরা ২৬/২০৮-৯)। অতঃপর আল্লাহ বলেন, أَلَمْ نُهْلِكِ الْأَوَّلِيْنَ، ثُمَّ نُتْبِعُهُمُ الْآخِرِيْنَ- ‘আমরা কি পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করিনি? অতঃপর আমরা তাদের অনুগামী করব পরবর্তীদের। অপরাধীদের সাথে আমরা এরূপ আচরণই করে থাকি’ (মুরসালাত ৭৭/১৬-১৮)

মূলতঃ ধ্বংস বা ধ্বংসলীলা মানবজাতির সীমাহীন কুকর্মের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টির ইতিহাসে প্রাথমিক পর্যায়ে হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায় অন্যায়, অপরাধ ও সীমালংঘনে জড়িয়ে পড়েছিল। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَأَنَّهُ أَهْلَكَ عَادًا الْأُولَى، وَثَمُودَ فَمَا أَبْقَى، وَقَوْمَ نُوحٍ مِنْ قَبْلُ إِنَّهُمْ كَانُوا هُمْ أَظْلَمَ وَأَطْغَى ‘তিনিই প্রথম ‘আদ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছেন এবং ছামূদকেও, অতঃপর কাউকে অব্যাহতি দেননি এবং তাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়কে, তারা ছিল আরও যালেম ও অবাধ্য’ (নাজম ৫৩/৫০-৫২)। সুতরাং নূহের সম্প্রদায়ই আগে ধ্বংস হয়েছিল। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তারা মিথ্যারোপ করেছিল আমার বান্দা নূহের প্রতি এবং বলেছিল, এতো উন্মাদ! তারা তাঁকে হুমকী প্রদর্শন করেছিল। অতঃপর সে তার পালনকর্তাকে ডেকে বলল, আমি অক্ষম। অতএব আপনি প্রতিবিধান করুন। তখন আমি খুলে দিলাম আকাশের দ্বার প্রবল বারি বর্ষণের মাধ্যমে এবং ভূমি থেকে প্রবাহিত করলাম প্রস্রবন। অতঃপর সব পানি মিলিত হ’ল এক পরিকল্পিত কাজে। আমি নূহকে আরোহণ করালাম এক কাষ্ঠ ও পেরেক নির্মিত নৌযানে, যা চলত আমার দৃষ্টির সামনে। এটা তাঁর পক্ষ থেকে প্রতিরোধ ছিল, যাঁকে প্রত্যাখান করা হয়েছিল’ (কামার ৫৪/৯-১৪)

এ সম্পর্কে আল্লাহ আরো বলেন, ‘যখন আমরা কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন আমরা সেখানকার সমৃদ্ধশালী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নির্দেশ দেই। তখন তারা সেখানে পাপাচারে মেতে ওঠে। ফলে তার উপর শাস্তি অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমরা ওটাকে বিধ্বস্ত করে দেই। আর নূহের পরের যুগ সমূহে আমরা বহু জনপদকে ধ্বংস করেছি। বস্ত্ততঃ তোমার পালনকর্তাই তার বান্দাদের পাপাচার সমূহের খবর জানা ও দেখার জন্য যথেষ্ট’ (বনী ইসরাঈল ১৭/১৬-১৭)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘স্ব স্ব পাপের কারণে তাদের প্রত্যেককে আমরা পাকড়াও করেছি। তাদের কারু প্রতি আমরা ছোট পাথরসহ প্রবল ঝঞ্ঝাবায়ু প্রেরণ করেছি (যেমন লূত সম্প্রদায়ের উপর) কাউকে পাকড়াও করেছে প্রচন্ড নিনাদ বজ্রপাত (যেমন ছালেহ ও শু‘আইবের সম্প্রদায়)। কাউকে ধ্বসিয়ে দিয়েছি ভূগর্ভে (যেমন কারূণকে)। কাউকে আমরা ডুবিয়ে মেরেছি (যেমন নূহ ও ফেরাঊনের সম্প্রদায়কে)। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করতে চাননি (কেননা তাদের নিকট তিনি আগেই নবী পাঠিয়েছিলেন)। কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিল’ (আনকাবূত ২৯/৪০)। আল্লাহদ্রোহী ও নির্ভীক সম্প্রদায়ের প্রতি আল্লাহর অসন্তুষ্টি সীমাহীন। অনুরূপ এক সম্প্রদায়ের শাস্তির বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ বলেন,وَالْمُؤْتَفِكَةَ أَهْوَى ‘তিনিই (লূত সম্প্রদায়ের) এক বাসভূমি শূন্যে তুলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন’ (নাজম ৫৩/৫৩)

বস্ত্ততঃ ধ্বংস ধ্বংসই, বাহ্যিক দৃষ্টিতে ধ্বংসের তান্ডব অনেক কমবেশী মনে হ’লেও সব ধ্বংসের মধ্যেই নিদারুণ যন্ত্রণা রয়েছে। তাছাড়া পরাক্রমশালী আল্লাহ ধ্বংসলীলার মাধ্যমে মানুষকে সৎপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। আসলে উম্মতে মুহাম্মাদীর তথা আমাদের প্রকৃত উপকারার্থেই আল্লাহ তা‘আলা সুদূর অতীতের বাস্তব ঘটনাবলীর কিয়দাংশ কুরআনে উপস্থাপন করেছেন।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘আদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার তো এই যে, ওরা পৃথিবীতে অযথা অহংকার করত আর বলত, আমাদের চেয়ে শক্তিশালী কে আছে? ওরা কি তবে লক্ষ্য করেনি যে, আল্লাহ, যিনি ওদেরকে সৃষ্টি করেছেন তিনি ওদের চেয়েও শক্তিশালী? অথচ ওরা আমার নির্দেশগুলোকে অস্বীকার করত। তারপর আমি ওদেরকে পার্থিব জীবনে অপমানকর শাস্তি ভোগ করানোর জন্য দুর্ভোগের দিনে ওদের বিরুদ্ধে ঝড়ো হাওয়া পাঠিয়েছিলাম। পরকালের শাস্তি তো আরও অপমানকর, আর ওদের সাহায্য করার কেউ থাকবে না’ (হা-মীম-সাজদাহ ৪১/১৩-১৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো ‘আদের ভাই হূদের কথা, যার আগে ও পরে সতর্ককারী এসেছিল, সে তার আহকাফবাসী সম্প্রদায়কে (ইয়েমেনের আহকাফ মালভূমির বাসিন্দারা) এ বলে সতর্ক করেছিল যে, আল্লাহ ছাড়া কারও উপাসনা করো না। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের উপর এক ভয়াবহ দিনের আযাবের আশংকা করছি। তারা বলল, তুমি কি আমাদেরকে আমাদের উপাস্যদের থেকে নিবৃত্ত করতে আমাদের নিকটে এসেছ? যদি তুমি সত্যবাদী হও তাহ’লে আমাদেরকে যার ভয় দেখাচ্ছ তা নিয়ে এসো। সে বলল, এর জ্ঞান তো কেবল আল্লাহরই, আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি কেবল তা-ই তোমাদের কাছে প্রচার করি। কিন্তু আমি দেখছি, তোমরা এক মুর্খ সম্প্রদায়। অতঃপর যখন তারা দেখল উপত্যকার নিকটে মেঘমালা দেখল তখন ওরা বলতে লাগল, এ মেঘমালা আমাদের বৃষ্টি দিবে। না, বরং এটি তা-ই যা তোমরা তরান্বিত করতে চেয়েছিলে। এ এক ঝড়, যাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। এটা তার রবের নির্দেশে সব কিছু ধ্বংস করে দিবে।

ফলে তাদের পরিণাম এমন হ’ল যে, ওদের বসতগুলো ছাড়া আর কিছুই বাকী থাকল না। এভাবে আমি অপরাধী সম্প্রদায়কে প্রতিফল দিয়ে থাকি’ (আহকাফ ৪৬/২১-২৬)। ‘আর নিদর্শন রয়েছে তাদের ঘটনায়, যখন আমি তাদের বিরুদ্ধে পাঠিয়েছিলাম এক বিধ্বংসী ঝড়, তা যার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল তা-ই চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিল’ (যারিয়াত ৫১/৪১-৪২)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আদ ও ছামূদ সম্প্রদায় ক্বিয়ামতকে মিথ্যা বলেছিল। অতঃপর ছামূদ, তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল গগণবিদারী এক নিনাদ দ্বারা। আর ‘আদ সম্প্রদায়, তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল প্রচন্ড এক ঝঞ্ঝাবায়ু দ্বারা। যা তিনি প্রবাহিত করেছিলেন তাদের উপরে সাত রাত্রি ও আট দিবসব্যাপী অবিরামভাবে। তুমি (সেখানে থাকলে) তাদের দেখতে জীর্ণ খেজুর কান্ডের ন্যায় ভূপাতিত হয়ে পড়ে আছে। তুমি তাদের কাউকে অবশিষ্ট দেখতে পাও কি? (হাককা ৬৯/৪-৮)

মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব। নিকৃষ্টতম শয়তানের উদ্ভব হয় মানুষকে পরীক্ষার জন্য। শয়তান আল্লাহর নিকট কিছু ক্ষমতা প্রার্থনা করে নেয়, যাতে সে তার মিথ্যা ও কৃত্রিমতার দ্বারা মানুষকে সঠিক পথ হ’তে ভ্রান্ত পথে নিয়ে যেতে পারে। অতঃপর শয়তানের বিষয়টি আল্লাহ মানুষকে অবহিত করেন এবং তার (শয়তানের) মিথ্যা ফাঁদে না পড়ার জন্য মানুষকে হুঁক্বিয়ার করেন। এতে চিন্তাশীল ও বিবেকবান মানুষেরা উপকৃত হয় এবং আল্লাহর আদেশে ইবাদতের পথে অবিচল থাকে। ফলে তাদের ভবিষ্যত কল্যাণময় হয়। কিন্তু যারা চিন্তা ও বিবেচনার আশ্রয় না নিয়ে শয়তানের মিথ্যা লোভনীয় কথায় বিশ্বাস করে তারা আল্লাহর ইবাদতে সন্দেহ পোষণ করে অকল্যাণের মধ্যে নিপতিত হয় এবং তাদের ভবিষ্যত ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে চলে যায়। উপরের ঘটনাপ্রবাহ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

পৃথিবী সৃষ্টির পর হাযার হাযার বা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষ পৃথিবীতে ধর্ম ও অধর্মের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। অতঃপর এক সময় সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানুষের সীমালংঘনের কারণে ধ্বংসলীলার বিষয়টি মানুষের সম্মুখে উন্মোচন করেন। অবশ্য তার আগে আল্লাহ মানুষকে তাঁর অসীম সৃষ্টি ও ক্ষমতার বিষয় প্রত্যাদেশের মাধ্যমে জানিয়েছেন। ধ্বংসের বা শাস্তির মর্মান্তিক বর্ণনা দিয়েও আল্লাহ আয়াত নাযিল করেছেন।

মানুষ সৃষ্টির পর আল্লাহ মানুষকে সৎপথ প্রদর্শনের জন্য শিক্ষক হিসাবে যুগে যুগে বহু নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা দুনিয়াতে শয়তান ও তার সঙ্গী-সাথীর চক্রান্তে পড়ে নানারূপ দুঃখ-কষ্ট পেয়েছেন। আল্লাহ বলেন,وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِيْنَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوْحِيْ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُوْرًا- ‘এভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য মানুষ ও জিনের মধ্য থেকে বহু শয়তানকে শত্রুরূপে নিযুক্ত করেছি। তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে একে অপরকে চাকচিক্যপূর্ণ কথা দ্বারা প্ররোচনা দেয়’ (আন‘আম ৬/১১২)। অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন,وَعَادًا وَثَمُوْدَ وَقَدْ تَبَيَّنَ لَكُمْ مِنْ مَسَاكِنِهِمْ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَصَدَّهُمْ عَنِ السَّبِيْلِ وَكَانُوْا مُسْتَبْصِرِيْنَ- ‘আর আমরা ‘আদ ও ছামূদ জাতিকে ধ্বংস করেছি। তাদের পরিত্যক্ত বাড়ী-ঘরই তোমাদের জন্য এর সুস্পষ্ট প্রমাণ। তাদের অপকর্ম সমূহকে শয়তান তাদের নিকট শোভনীয় করেছিল। অতঃপর তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বাধা দিয়েছিল। অথচ তারা এর পরিণাম বুঝত’ (আনকাবূত ২৯/৩৮)

প্রাচীনকালের ঐসব ভয়ংকর ধ্বংসকাহিনী পবিত্র কুরআনে অবতীর্ণ হয়েছে। উদ্দেশ্য আল্লাহর প্রিয় নবীর উম্মত যেন সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত না হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের পূর্ব যুগের বহু জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছি যখন তারা সীমালংঘন করেছিল। আর তাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শন সমূহ নিয়ে তাদের রাসূলগণ এসেছিল। কিন্তু তারা ঈমান আনার মত লোক ছিল না। এভাবেই আমরা অপরাধী সম্প্রদায়কে বদলা দিয়ে থাকি। অতঃপর তাদের পরে আমরা তোমাদেরকে যমীনে প্রতিনিধিত্ব দান করলাম। যাতে  দেখতে পারি কিভাবে তোমরা কাজ কর’ (ইউনুস ১০/১৩-১৪)

অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যারা কাফের, তারা ঔদ্ধত্য ও বিরোধিতায় লিপ্ত। এদের পূর্বে আমরা কত জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছি। সে সময় তারা আর্তনাদ করেছে। কিন্তু তখন তাদের বাঁচার কোন উপায় ছিল না। তারা বিস্ময়বোধ করে যে, তাদের কাছে তাদের মধ্য থেকে একজন সতর্ককারী আগমন করেছে। ফলে কাফেররা বলে যে, এ ব্যক্তি একজন জাদুকর ও মহামিথ্যাবাদী’ (ছোয়াদ ৩৮/১-৪)

পবিত্র কুরআন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপরে অবতীর্ণ হয়েছে। কুরআনের উপদেশ ভান্ডার মানুষের জন্য চির কল্যাণকর বিষয়সমূহ দ্বারা পরিপূর্ণ। কিন্তু সে সময় এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী বান্দা ছিল না বললেই চলে। তারা বহু উপাস্যের উপাসনা করত এবং তারা ছিল শক্তিশালী সম্প্রদায়। এজন্য নবী করীম (ছাঃ) কুরআনের উপদেশ প্রচারে বাধাগ্রস্ত হন। অতঃপর আল্লাহ তাঁকে অতীত নবী-রাসূল ও তাঁদের সম্প্রদায়ের ঘৃণ্য কর্মকান্ডের পরিণতির বর্ণনা দিয়ে তাঁকে তা প্রচারের আদেশ দেন এবং সাবধানতা অবলম্বনের উপদেশ দেন।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন তুমি দেখবে যে, লোকেরা আমাদের আয়াত সমূহে ছিদ্রান্বেষণ করছে, তখন তুমি তাদের থেকে সরে যাও, যতক্ষণ না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়। আর যদি শয়তান তোমাকে এটা ভুলিয়ে দেয়, তাহ’লে স্মরণ হওয়ার পর আর যালেম সম্প্রদায়ের সাথে বসবে না। মুত্তাক্বীদের উপর ঐসব যালেমদের হিসাবের ব্যাপারে কোন দায়িত্ব নেই। তবে উপদেশ দেওয়া ব্যতীত, যাতে ওরা আল্লাহভীরু হয়’ (আন‘আম ৬/৬৮-৬৯)। একই উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা নিজেদের দ্বীনকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং নিজেরা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের ব্যাপারটি আল্লাহর উপর ন্যস্ত। অতঃপর তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন’ (আন‘আম ৬/১৫৯)

মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘আর তোমার পূর্বে আমরা লোকদের নিকট অহীসহ যাদেরকে পাঠিয়েছিলাম, তারা মানুষ ছিল। অতএব তোমরা জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর, যদি তোমরা না জানো। আমরা তাদেরকে এমন দেহবিশিষ্ট করিনি যে, তারা খাদ্য ভক্ষণ করত না। আর তারা চিরস্থায়ীও ছিল না। অতঃপর আমরা তাদেরকে (নবীদেরকে) দেয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করলাম। অতঃপর তাদের মুক্তি দিলাম এবং (তাদের অনুসারী) যাদেরকে আমরা ইচ্ছা করলাম। আর ধ্বংস করলাম যালেমদের। আমরা তোমাদের প্রতি কিতাব (কুরআন) নাযিল করেছি। যার মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উপদেশ। তবুও কি তোমরা বুঝবে না? (আম্বিয়া ২১/৭-১০)

ক্ষুদ্র হ’তে ক্ষুদ্রতম এবং বৃহৎ হ’তে বৃহত্তম ধ্বংসলীলার সংবাদও পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। ক্ষুদ্র বা ক্ষুদ্রতম ধ্বংস বলতে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বা আরও কিছু বড় ধ্বংসলীলার ঘটনাকে বুঝায়। এ বিষয়ে নানা প্রকারের ধ্বংসকাহিনীর উদাহরণ রয়েছে। যেমন একটি মোটর সাইকেলে এক বা দু’জন আরোহী পথিমধ্যে দুর্ঘটনায় পড়ে মর্মান্তিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত (মৃত্যু) হয়। আবার কোন কোন সময় ছোট ছোট যানবাহনে চলাচলের সময় স্বপরিবারে দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে গোটা পরিবারই নিদারুণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। এতদ্ব্যতীত আরও কিছু বৃহৎ ধ্বংসযজ্ঞ আছে, যেগুলো প্রায় সারাবছর পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সংঘটিত হয়। সেগুলো হ’ল ভূমিকম্প, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এগুলোর তান্ডব ও ক্ষয়ক্ষতিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

অতঃপর মানুষের অজানা অনেক ধ্বংসলীলাও আছে- যে সম্বন্ধে মানুষ চিন্তাই করে না। যেমন কোন ছোটখাট কারণে মানুষ মানুষকে আঘাতমূলক কথাবার্তা বলে, নানারূপ অসৎ আচরণে ভীষণভাবে কষ্ট দিয়ে থাকে, এতে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি আঘাতদাতাকে অভিশাপ দেয় এবং আল্লাহও তার প্রতি অভিশাপ বর্ষণ অতঃপর তা ধ্বংসরূপ ধারণ করে। যা কুরআন ও হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। এখানে নবী করীম (ছাঃ)-এর জীবদ্দশার একটি মর্মান্তিক ঘটনা বর্ণনা করা হ’ল।-

আব্দুল্লাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সিজদারত ছিলেন এই সময় কুরাইশদের কিছু লোক তাকে বেষ্টন করেছিল। এ সময় উকবা ইবনে আবু মুঈত একটি উটের নাড়ী-ভূড়ি নবী করীম (ছাঃ)-এর পিঠের উপর নিক্ষেপ করলো। তিনি মস্তক অবনত করে সিজদাতেই থাকলেন। এ সময়ে ফাতেমা (রাঃ) এসে তাঁর ঘাড়ের উপর হ’তে নাড়ী-ভূড়ি ফেলে দিলেন এবং যারা এরূপ দুর্ব্যবহার করেছে তাদের জন্য বদদো‘আ করলেন। নবী করীম (ছাঃ) বদদো‘আ করে বললেন, হে আল্লাহ কুরাইশ দলকে ধ্বংস করে দিন। হে আল্লাহ! আবু জাহল ইবনে হেশাম, উতবা ইবনে রাবী‘আ, শায়বাহ ইবনে রাবী‘আ, উকবা ইবনে আবু মুঈত এবং উমাইয়া ইবনে খালাফকে অথবা (বর্ণনাকারীর সন্দেহে) উবাই ইবনে খালাফকে ধ্বংস করুন। আব্দুল্লাহ বলেন, এদের অধিকাংশকে আমি বদরের যুদ্ধে নিহত হ’তে দেখেছি। উমাইয়া অথবা উবাই ছাড়া সবার লাশকে একটি কূপে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। উমাইয়া অথবা উবাইয়ের দেহ ছিল মাংসল ও মেদবহুল। কূপে নিক্ষেপের জন্য ছাহাবাগণ যখন তার লাশকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন সে সময় তার দেহের জোড়ায় জোড়ায় খুলে যায়। (বুখারী, ‘জিহাদ’ অধ্যায় হা/২৯৪৬)

অপর এক হাদীছে ইবনে আববাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘ভোরের (পূবালী বাতাস) হাওয়া দ্বারা আমাকে সাহায্য করা হয়েছে এবং দুপুর (এক প্রকার ধ্বংসাত্মক পশ্চিমা মরু বায়ু) দ্বারা আদ জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছে’ (বুখারী ‘জিহাদ’ অধ্যায় হা/৩০৯৬)

অপরদিকে বৃহত্তম ধ্বংসলীলা হ’ল ক্বিয়ামত, যা আমরা সবাই জানি। কিন্তু দুনিয়ার সব মানুষ এতে বিশ্বাসী নয়। পবিত্র কুরআনের বর্ণনায় ক্বিয়ামত দিবস হ’ল পৃথিবী ধ্বংসের দিবস। পক্ষান্তরে যারা কুরআনে বা আল্লাহতে বিশ্বাসী নয়, বড় বড় বিজ্ঞানীদের মতে সমস্ত সৃষ্টবস্ত্ত প্রকৃতির দান।

ক্বিয়ামত কখন সংঘটিত হবে এ সম্বন্ধে লোকেরা নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করত, এ সম্বন্ধে আল্লাহ নবী করীম (ছাঃ)-কে বলেন, ‘তারা তোমাকে প্রশ্ন করছে ক্বিয়ামত কখন হবে? বলে দাও, এর জ্ঞান কেবল আমার প্রতিপালকের কাছেই রয়েছে। তার নির্ধারিত সময় কেবল তিনিই প্রকাশ করে দিবেন। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে সেটি হবে একটি ভয়ংকর বিষয়। যা তোমাদের নিকটে আসবে আকস্মিকভাবে। তারা তোমাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করে যেন তুমি এ বিষয়ে পূর্ণ অবগত! বলে দাও, এর জ্ঞান কেবল আল্লাহর কাছেই রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’ (আ‘রাফ ৭/১৮৭)

ক্বিয়ামত হ’ল পৃথিবী ধ্বংসের দিবস, মহাদিবস, প্রতিফল দিবস ও শেষ দিবস। ঐ দিবস সমুদয় সৃষ্টির নির্দিষ্ট সময় পূর্ণ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে মহাপরাক্রমশালী, সর্বশক্তিমান, মহাজ্ঞানী আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। অর্থাৎ পৃথিবীর বুকে জিন ও মানবসহ আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই ধ্বংস হবে। একমাত্র মহামহিমান্বিত আল্লাহর সত্ত্বা সমুন্নত, অক্ষয়, চিরস্থায়ী ও চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সম্বন্ধে আল্লাহর ঘোষণা হ’ল, كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ، وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ- ‘ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র তোমার মহিমাময় ও মহানুভব পালনকর্তার সত্ত্বা ছাড়া’ (আর-রহমান ৫৫/২৬-২৭)

অন্যত্র তিনি বলেন,فَإِذَا نُقِرَ فِي النَّاقُوْرِ، فَذَلِكَ يَوْمَئِذٍ يَوْمٌ عَسِيْرٌ، عَلَى الْكَافِرِيْنَ غَيْرُ يَسِيْرٍ- ‘যেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে। সেদিন হবে খুব কঠিন দিন। যা কাফিরদের জন্য সহজ নয়’ (মুদ্দাছছির ৭৪/৮-১০)

তিনি আরো বলেন,فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّوْرِ نَفْخَةٌ وَاحِدَةٌ، وَحُمِلَتِ الْأَرْضُ وَالْجِبَالُ فَدُكَّتَا دَكَّةً وَاحِدَةً، فَيَوْمَئِذٍ وَقَعَتِ الْوَاقِعَةُ، وَانْشَقَّتِ السَّمَاءُ فَهِيَ يَوْمَئِذٍ وَاهِيَةٌ، وَالْمَلَكُ عَلَى أَرْجَائِهَا وَيَحْمِلُ عَرْشَ رَبِّكَ فَوْقَهُمْ يَوْمَئِذٍ ثَمَانِيَةٌ- ‘অতঃপর যেদিন শিংগায় ফুঁক দেওয়া হবে একটি মাত্র ফুঁক এবং পৃথিবী ও পর্বতমালা উত্তোলিত হবে। অতঃপর একই ধাক্কায় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। সেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। আকাশ সেদিন বিদীর্ণ হয়ে তুচ্ছ বস্ত্ততে পরিণত হবে। ফেরেশতাগণ আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে এবং আপনার প্রভুর আরশ আটজন ফেরেশতা তাদের উপরে বহন করবে’ (হাক্কা ৬৯/১৩-১৭)

আল্লাহ আরো বলেন,إِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ، وَإِذَا الْكَوَاكِبُ انْتَثَرَتْ، وَإِذَا الْبِحَارُ فُجِّرَتْ، وَإِذَا الْقُبُورُ بُعْثِرَتْ، عَلِمَتْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ وَأَخَّرَتْ- ‘যেদিন আকাশ বিদীর্ণ হবে,  যেদিন নক্ষত্রসমূহ ঝরে পড়বে, যেদিন সাগরসমূহ উত্তাল হবে, যেদিন কবরসমূহ উন্মুক্ত হবে, সেদিন প্রত্যেকে জানবে সে অগ্রে ও পশ্চাতে কি প্রেরণ করেছে’ (ইনফিতার ৮২/১-৫)

অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَإِذَا بَرِقَ الْبَصَرُ، وَخَسَفَ الْقَمَرُ، وَجُمِعَ الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ، يَقُولُ الْإِنْسَانُ يَوْمَئِذٍ أَيْنَ الْمَفَرُّ- ‘অতঃপর যখন তার চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। চাঁদ আলোহীন হয়ে পড়বে। সূর্য ও চন্দ্রকে একত্রিত করা হবে। সেদিন মানুষ বলবে, কোথায় পালাব? (ক্বিয়ামাহ ৭৫/৭-১০)

যারা ক্বিয়ামতে বিশ্বাস করে না বরং অস্বীকার করে তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেন, ‘বরং তারা ক্বিয়ামতকে অস্বীকার করে। আর যারা ক্বিয়ামতে মিথ্যারোপ করে, আমরা তাদের জন্য জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্ত্তত করে রেখেছি। দূর থেকে আগুন যখন তাদের দেখবে, তখন তারা শুনতে পাবে এর ক্রদ্ধ গর্জন ও হুংকার। আর যখন তাদেরকে বেড়ীবদ্ধ অবস্থায় ওর একটি সংকীর্ণ স্থানে ফেলে দেওয়া হবে, যেন তারা সেখানে নিজেদের ধ্বংসকে আহবান করবে। (বলা হবে) আজ তোমরা কেবল একবার ধ্বংস আহবান করো না, বরং বহুবার ধ্বংসকে আহবান করো’ (ফুরক্বান ২৫/১১-১৪)

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,بَلِ السَّاعَةُ مَوْعِدُهُمْ وَالسَّاعَةُ أَدْهَى وَأَمَرُّ، إِنَّ الْمُجْرِمِيْنَ فِيْ ضَلاَلٍ وَسُعُرٍ، يَوْمَ يُسْحَبُوْنَ فِي النَّارِ عَلَى وُجُوْهِهِمْ ذُوْقُوْا مَسَّ سَقَرَ- ‘ক্বিয়ামত ওদের শাস্তির নির্ধারিত কাল, আর সে ক্বিয়ামত হবে বড় কঠিন বড় তিক্ত। অপরাধীরা হবে বিভ্রান্ত ও বিকারগ্রস্ত। সেদিন ওদেরকে উপুড় করে ফেলে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে। বলা হবে, জাহান্নামের যন্ত্রণার স্বাদ আস্বাদন কর’ (কামার ৫৪/৪৬-৪৮)

সবশেষে যে ধ্বংসযজ্ঞ আগমন করবে তারই নাম ‘ক্বিয়ামত’। ক্বিয়ামত দিবসের দীর্ঘতা ৫০ পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান। ক্বিয়ামতের দিন সবকিছু আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তিনি প্রতিটি মানুষের বিচার করবেন এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাসী ও অনুগতদের পুরস্কৃত করবেন। পক্ষান্তরে তাঁর প্রতি অবিশ্বাসী ও অমান্যকারীদের ভয়াবহ ধ্বংসের দরিয়ায় নিক্ষেপ করবেন। মানব, জিন ও শয়তানের ধ্বংসের জন্য নির্মিত দরিয়ার প্রধান উপাদান আগুন। সে আগুন বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরী। পৃথিবীর আগুনের মত সাধারণ আগুন নয়?

ক্বিয়ামত দিবসের দীর্ঘতার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ বলেন,تَعْرُجُ الْمَلاَئِكَةُ وَالرُّوْحُ إِلَيْهِ فِيْ يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ ‘যে সিঁড়ি দিয়ে ফেরেশতাগণ ও জিব্রীল দৈনিক ঊর্ধ্বারোহন করে আল্লাহর দিকে। যে দিনের পরিমাণ তোমাদের পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান’ (মা‘আরিজ ৭০/৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন তারা কবর থেকে দ্রুতবেগে বের হবে, যেন তারা কোন এক লক্ষ্যস্থলের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তাদের দৃষ্টি থাকবে অবনত ও তারা হবে হীনতায় আচ্ছন্ন। সেটা হবে সেই দিন, যেদিনের ওয়াদা তাদেরকে (দুনিয়াতে) দেওয়া হ’ত’ (মা‘আরিজ ৭০/৪৩-৪৪)

ক্বিয়ামত দিবসই বিচার দিবস, এ বিষয়ে মহাবিচারক আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই বিচার দিবস সুনির্ধারিত। যেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, অতঃপর তোমরা দলে দলে সমাগত হবে আর আকাশ খুলে দেওয়া হবে। অতঃপর তা বহু দরজা বিশিষ্ট হবে আর পর্বতমালা চালিত হবে। অতঃপর তা মরীচিকা হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই জাহান্নাম ওঁৎ পেতে আছে। সীমালংঘনকারীদের ঠিকানা রূপে’ (নাবা ৭৮/১৭-২২)

ক্বিয়ামতে সন্দেহ পোষণকারীদের লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা  আমার আয়াত সমূহকে অবিশ্বাস করে, সত্বর আমরা তাদেরকে আগুনে প্রবেশ করাবো। যখন তাদের চামড়াগুলো দগ্ধ হয়ে যাবে, তখন আমরা তা পাল্টে দেব অন্য চামড়া দিয়ে। যাতে তারা শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (নিসা ৪/৫৬)

এই ক্বিয়ামত দিবসের ধ্বংসলীলার একটা অংশবিশেষ পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। মানুষের অবগতির জন্য তিনি যৎসামান্য বর্ণনা করেছেন। তবে মানুষকে বিশ্বাস করতেই হবে যে, যে যতখানি পাপ ও সীমালংঘন করেছে তাকে সেই পরিমাণ শাস্তি ভোগ করতে হবে।

অবিশ্বাসী ও অকৃতজ্ঞদের লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি তাদের দেখনি যারা আল্লাহর নে‘মতকে কুফরীতে পরিবর্ধন করেছে এবং তাদের সম্প্রদায়কে ধ্বংসের সম্মুখীন করেছে? আর তা হ’ল জাহান্নাম। সেখানে তারা প্রবেশ করবে। কতই না নিকৃষ্ট আবাস সেটি। আর তারা আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করে যাতে তাঁর পথ হ’তে লোকদের বিচ্যুত করতে পারে। বলে দাও, কিছুদিন মজা উপভোগ কর। কেননা তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল হ’ল জাহান্নাম’ (ইবরাহীম ১৪/২৮-৩০)

ক্বিয়ামত অস্বীকারকারীদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেন, ‘বরং তারা ক্বিয়ামতকে অস্বীকার করে। আর যারা ক্বিয়ামতে মিথ্যারোপ করে, আমরা তাদের জন্য জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্ত্তত করে রেখেছি। দূর থেকে আগুন যখন তাদের দেখবে, তখন তারা শুনতে পাবে এর ক্রদ্ধ গর্জন ও হুংকার’ (ফুরকান ২৫/১১-১২)

বিশ্বাসীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘জান্নাতকে উপস্থিত করা হবে আল্লাহভীরুদের অদূরে। তোমাদের প্রত্যেক অনুরাগী ও স্মরণকারীকে এরই প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। যে না দেখে দয়াময় আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করত এবং বিনীত অন্তরে উপস্থিত হ’ত। তোমরা এতে শান্তিতে প্রবেশ কর। এটাই অনন্তকাল বসবাসের জন্য প্রবেশ করার দিন’ (ক্বাফ ৫০/৩১-৩৪)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘পক্ষান্তরে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের প্রতিপালক তাদের সুপথ প্রদর্শন করেন তাদের ঈমানের মাধ্যমে। নে‘মতপূর্ণ জান্নাতে তাদের তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হবে। সেখানে তাদের প্রার্থনা হবে, ‘মহা পবিত্র তুমি হে আল্লাহ’ এবং পরস্পরের সম্ভাষণ হবে ‘সালাম’। আর তাদের প্রার্থনার সমাপ্তি হবে ‘সমস্ত প্রশংসা বিশ্বচরাচরের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য’ (ইউনুস ১০/৯-১০)

পৃথিবী ধ্বংসের কারণ হিসাবে ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে, তাছাড়া এটা আল্লাহর ওয়াদাও। এতে আল্লাহদ্রোহী পাপীরা ধ্বংস হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহভীরু পুণ্যবানরা পুরস্কৃত হবে। সেদিন মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে পৃথিবী জীবনের অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার প্রভৃতির অভিযোগ করতে পারবে বা বিচার চাইতে পারবে এবং ন্যায়বিচার পাবে। মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অর্থাৎ হাত, পা, চোখ, মুখ, কান, ত্বক প্রভৃতিও তাদের কর্মের সাক্ষ্য দিবে।

ক্বিয়ামতের বিচার শেষে পুণ্যবানদের জন্য জান্নাতের সুখ-শান্তি, ভোগবিলাস। অনুরূপভাবে পাপীষ্ঠদের জন্য জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি থাকবে। মানুষ, জিন ও শয়তান ব্যতীত আর কোন প্রাণী শাস্তির শিকার নয়। অতএব আল্লাহ আমাদের জাহান্নামের শাস্তিতে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করুন-আমীন!







আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে কতিপয় ভ্রান্ত আক্বীদা (২য় কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত (৭ম কিস্তি) - মুযাফফর বিন মুহসিন
মুহাসাবা - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ক্ষমা প্রার্থনা : এক অনন্য ইবাদত - ইহসান ইলাহী যহীর
দ্বীনী ইলমের গুরুত্ব ও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
বিশ্ব ভালবাসা দিবস - আত-তাহরীক ডেস্ক
ফৎওয়া : গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ (৫ম কিস্তি) - ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ, শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, রাজশাহী
নববী চিকিৎসা পদ্ধতি - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ছাদাক্বার ন্যায় ফযীলতপূর্ণ আমল - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
মানুষের দো‘আয় শামিল হওয়ার উপায় - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (৮ম কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
আরও
আরও
.