বাংলাদেশে
আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য
বয়ে বেড়াতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে যে
চুক্তি করেছে, সেখানে সম্ভব হ’লে দুই বছরের মধ্যে প্রত্যাবাসন শেষ করার কথা
ছিল। সেই সময়ের প্রায় দেড় বছর কেটে গেছে, কিন্তু ফলাফল শূন্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৯ই জুন রোববার সংবাদ সম্মেলনে কোন রাখঢাক না
রেখেই বলেছেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায় না।
রোহিঙ্গারা কবে ফিরতে পারবে বা আদৌ ফিরতে পারবে কি না, সেই ধারণা কারোরই নেই। বাংলাদেশ সরকারের নেই, জাতিসংঘ ও তাদের সহযোগীদেরও নেই। বাংলাদেশ তার এই গুরুতর সংকটে ভারত ও চীনের মতো বন্ধুদেশ দু’টিকে নিজেদের পক্ষে পাচ্ছে না। শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে তারা মিয়ানমারের ওপর চাপ দেবে-এমন কোন ইঙ্গিতও নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুতে রাশিয়া ও জাপান বাংলাদেশের পক্ষে নেই, আসিয়ানের মতো সংস্থাও নেই।
আর রোহিঙ্গাদের যেখানে ফেরার কথা, সেই মিয়ানমার তা ঠেকিয়ে রাখতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক এবং তারা সেই কাজটিই করে যাচ্ছে। ফিরিয়ে নেওয়ার কথা মাথায় রেখে নিশ্চয়ই তারা হত্যাযজ্ঞ ও বর্বরতা চালিয়ে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর থেকে উৎখাত করেনি। বোঝা যায়, বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েই প্রধানমন্ত্রী মন্তব্যটি করেছেন। এমন একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কি রোহিঙ্গা ইস্যুতে বর্তমান অবস্থান বদলাবে? ১লা জুন মক্কায় ওআইসি সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখে আমরা মিয়ানমারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (আইসিজে) মামলার প্রসঙ্গটি শুনলাম। এ ব্যাপারে তিনি ওআইসি দেশগুলোর কাছ থেকে তহবিল ও কারিগরি সহায়তা চেয়েছেন। এটা এখন মোটামুটি পরিষ্কার যে আন্তর্জাতিক চাপ থেকে বাঁচার কৌশল হিসাবে মিয়ানমার চুক্তিটি করেছিল। ঐ চুক্তি বাংলাদেশকে কিছু দেয়নি, কিন্তু মিয়ানমারের প্রাপ্তি অনেক। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ তখন যে মাত্রায় জোরালো হ’তে শুরু করেছিল, সেখানে তারা পানি ঢালতে পেরেছে। সময় নিয়ে মিয়ানমার এখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।
অনেক দিন নিজেকে গুটিয়ে রাখার পর মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি চলতি মাসের শুরুতে চেক প্রজাতন্ত্র ও হাঙ্গেরি সফর করে এসেছেন। তিনি ইউরোপের এমন দু’টি দেশ সফর করেছেন যেখানে অভিবাসনবিরোধী ও রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতায়। হাঙ্গেরির চরম ডান ও জাতীয়তাবাদী নেতা ভিক্টর ওরবানের সঙ্গে সুচির বৈঠকের পর যে সরকারী বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সেখানে বলা হয়েছে, দেশ দু’টি এবং অঞ্চল হিসাবে দক্ষিণ এশিয়া ও ইউরোপের এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ‘অভিবাসন’। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুই নেতা লক্ষ্য করেছে যে, ‘দুই অঞ্চলেই মুসলিম জনগোষ্ঠীর অব্যাহত সংখ্যা বৃদ্ধি’ এক বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে হাযির হয়েছে।
বোঝা যায়, সময় নিয়ে ও পরিস্থিতি শান্ত করে মিয়ানমার এখন মাঠে নেমেছে। এমনকি শরণার্থী প্রত্যাবাসনে যে কোন অগ্রগতি নেই, তার দোষ তারা বাংলাদেশের ওপর চাপাচ্ছে। দেশটির স্টেট কাউন্সিলরের মন্ত্রী চ টিন্ট সোয়ের অভিযোগ, সব রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন ও নাগরিকত্ব কার্ড দেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের উদ্যোগে বাংলাদেশ সহায়তা করছে না। জাপানে ২৫তম ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন ফিউচার অব এশিয়া’-এর অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। তাঁর কথার মূল দিক হচ্ছে- ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাস থেকে যে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল, তা বাংলাদেশের কারণে সম্ভব হচ্ছে না (এশিয়ান রিভিউ, ৩১ মে, ২০১৯)।
আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসিয়ানের যে প্রতিবেদনটি সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে, সেটিও পুরোপুরি মিয়ানমারের পক্ষে। সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, অত্যাচার ও নির্যাতন নিয়ে একটি শব্দও নেই। নেই ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিও। এর বদলে আছে ‘মুসলিম’ শব্দটি। মিয়ানমারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে শরণার্থীর সংখ্যা সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে ৫ লাখ। এই প্রতিবেদনেও শরণার্থী প্রত্যাবাসনে গাফিলতির জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করা হয়েছে। উল্টো শরণার্থীদের ‘সহজ ও সুশৃঙ্খলভাবে’ ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের উদ্যোগের প্রশংসা করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ যে চুক্তি করেছে, তা যে কোন কাজে দেবে না, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। প্রথমত, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করেছে একটি দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ হিসাবে। নিয়মিত তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করেছে এবং সময়-সুযোগমতো তাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে। তারপর ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে চুক্তি করেছে, কিন্তু নেয়নি। ২০১৭ সালের আগস্টে তারা তাদের আরাকান রাজ্যকে রোহিঙ্গাশূন্য করার চূড়ান্ত কাজটি সেরেছে।
দ্বিতীয়তঃ শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কিছু শর্ত থাকে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চুক্তিতেও তা আছে। স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও সম্মানজনকভাবে প্রত্যাবাসনের কাজটি হ’তে হবে। রোহিঙ্গারা যে দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দেশ ছেড়েছে, তাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও সম্মানজনকভাবে দেশে ফেরাতে যে পরিস্থিতি তৈরি করার দরকার, তা যে মিয়ানমার করবে না, সেটা না বোঝারও কোন কারণ নেই। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের এই চুক্তিটি করা কতটা যৌক্তিক ছিল, সে প্রশ্ন দিনে দিনে জোরালো হচ্ছে। হত্যা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া ও ধর্ষণের মতো নৃশংসতা চালিয়ে যে দেশটি ১১ লাখের বেশি মানুষকে উচ্ছেদ করল, সেই দেশটির সঙ্গে চুক্তি করতে গিয়ে বাংলাদেশ এত নমনীয় হ’ল কেন? মিয়ানমারের চাপে রোহিঙ্গা শব্দটি পর্যন্ত চুক্তিতে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে, এখন দীর্ঘ মেয়াদে তাদের থাকার ব্যবস্থা করছে। এই যদি হবে, তবে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরার কোন নিশ্চয়তা দেয় না-এমন একটি চুক্তি তড়িঘড়ি করার কী এমন দায় পড়েছিল বাংলাদেশের?
রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যে অবস্থান তুলে ধরেছিলেন, তা ছিল স্পষ্ট ও জোরালো। সেখানে মিয়ানমারের ভেতরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি সুরক্ষাবলয় (সেফ জোন) গড়ে তোলা ও রাখাইন রাজ্য থেকে জোর করে বিতাড়ন করা সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। অথচ বাংলাদেশ চুক্তি করল এসব বাদ দিয়ে। ফলে সম্ভব হলে যে প্রত্যাবাসন দুই বছরে বাস্তবায়ন করার কথা, তা কার্যত অসম্ভবে পরিণত হয়েছে।
রোহিঙ্গারা এখন যে শরণার্থী শিবিরগুলোতে আছে, তা অনেকটাই অরক্ষিত। এক হিসাব বলছে, শিবির থেকে পালাতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে সাড়ে ৫৮ হাযারের বেশি রোহিঙ্গা। এর ফাঁক গলে যারা বের হয়ে গেছে, তাদের কোন হিসাব কারও কাছে নেই। এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। তারা সংঘবদ্ধভাবে নানা অপরাধ-অপকর্ম শুরু করেছে। এসব থামাতে এখন বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে। ঈদের পরদিন গভীর রাতে টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী ও শিশু অপহরণকারী’ তিন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। বাড়ছে শরণার্থী শিবিরে জনসংখ্যা। সেভ দ্য চিলড্রেন এক বছরে (২০১৮ সালে) শিবিরগুলোতে ৪৮ হাযার শিশুর জন্ম নেওয়ার তথ্য দিয়েছিল।
রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে সত্যিই বড় বিপদে আছে বাংলাদেশ। চুক্তির পরও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাইছে না মিয়ানমার। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী এ ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের সহায়তাকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও সহায়তা করছে না। মক্কায় ওআইসি সম্মেলনে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়ার কথা বলেছেন। এ ধরনের উদ্যোগ মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি করবে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু শরণার্থীদের ফেরাতে এর কোন ভূমিকা নেই। আমাদের সামনে তবে পথ কী? রোহিঙ্গাদের ফেরাতে হ’লে মিয়ানমারের ওপর বহুপক্ষীয় আন্তর্জাতিক চাপ তৈরিই হচ্ছে একমাত্র পথ।
এমন বাস্তবতায় আমরা দেখছি মিয়ানমার ও সু চি মাঠে সক্রিয় আছেন এবং বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাকে নিজেদের পক্ষে আনতে পারছেন। আর আমরা কি এখনো রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করতে পেরেছি-এই ‘সাফল্যে’ খুশি থাকব? রোহিঙ্গাদের ফেরাতে হ’লে পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি চীন, ভারত, রাশিয়া ও জাপানের মতো বন্ধুদেশগুলো বা আসিয়ানের মতো সংস্থার সমর্থন আমাদের লাগবে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে এই দেশগুলো মিয়ানমারের পক্ষে থাকছে-এটা একটা যুক্তি বটে। কিন্তু পাল্টা যুক্তি হচ্ছে, এই দেশগুলোর সঙ্গে কি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ নেই? অথবা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ? এমন জটিল পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে শুধু দক্ষ ও কৌশলী কূটনীতি। এক্ষেত্রে আমাদের যে ঘাটতি আছে, তা এরই মধ্যে প্রমাণিত। এই ঘাটতি পূরণ করে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তা না পারলে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও এই সমস্যার ভার থেকে বাংলাদেশের মুক্তি নেই।
\ সংকলিত \