এলাহী তাওফীক্ব লাভ করবেন কিভাবে?

ভূমিকা :

তাওফীক্ব হচ্ছে বান্দার জন্য এক ধরনের গায়েবী সাহায্য, যা সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়। তাওফীক্বের মাধ্যমে বান্দা বিবিধ কল্যাণকর কাজের সক্ষমতা অর্জন করে। দ্বীনের পথে ও আল্লাহর অনুগত্যে অবিচল থাকার জন্য তাওফীক্বের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। এলাহী তাওফীক্ব ব্যতীত পাপ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয় না, শয়তানের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করা যায় না, আয়-রূযীতে বরকত লাভ করা যায় না, ইবাদতের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে বলীয়ান হওয়া যায় না। সেজন্য জীবনের প্রতি পদে এলাহী তাওফীক্বের প্রয়োজন। তবে তাওফীক্ব এমনিতেই আসে না; বরং এর জন্য কিছু করণীয় রয়েছে। যার মাধ্যমে মহান আল্লাহ বান্দাকে তাওফীক্ব দানে ধন্য করেন। নিমেণ তাওফীক্ব লাভের কতিপয় উপায় আলোকপাত করা হ’ল।-

এলাহী তাওফীক্ব লাভের উপায়সমূহ

১. সার্বিক জীবনে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা ও খুলূছিয়াত বজায় রাখা :

জীবনের সকল ক্ষেত্রে সফলতা, রহমত ও তাওফীক্ব লাভের প্রধান হাতিয়ার হ’ল তাওহীদ ও ইখলাছ। আক্বীদা ও ইবাদতকে শিরক ও বিদ‘আতের পঙ্কিলতা থেকে পরিস্কার না করতে পারলে নাজাত লাভের তাওফীক্ব অর্জিত হয় না। ইবাদত-বন্দেগী, দান-ছাদাক্বাহ, পিতা-মাতার খেদমত, স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, পড়াশোনা, চাকুরী-বাকুরী সহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইখলাছ বজায় রাখা যরূরী। আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ آمَنُوا ‌وَلَمْ ‌يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ، ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানের সাথে শিরককে মিশ্রিত করেনি, তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই হেদায়াত প্রাপ্ত’ (আন‘আম ৬/৮২)। অর্থাৎ যারা ছোট-বড় সব ধরনের শিরক থেকে বিরত থেকে নির্ভেজাল তাওহীদের অনুসারী হয়, মহান আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতের সার্বিক নিরাপত্তা ও হেদায়াত লাভের তাওফীক্ব দান করেন। মুহাম্মাদ মুখতার শানক্বীতী (রহঃ) বলেন,فمن كمل إخلاصه لله، فإن الله ‌يوفقه ويسدده ويرحمه، ويجعل عمله نفعاً له في دينه ودنياه وآخرته، ‘আল্লাহর জন্য যার খুলূছিয়াত পূর্ণতা পাবে, আল্লাহ তাকে তাওফীক্ব দান করেন, সঠিক পথ দেখান, রহমত দান করেন এবং দ্বীন-দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য তার আমলকে তার জন্য উপকারী বানিয়ে দেন’।[1]

বান্দার হৃদয়ে যখন তাওহীদ স্থান নেয়, তখন সে অল্প আমল করেও অনেক বেশী নেকী পেয়ে যায় এবং উত্তম মৃত্যুর তাওফীক্ব লাভ করে। এক যুদ্ধে এক কাফের ব্যক্তি লৌহ বর্মে আবৃত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি যুদ্ধে শরীক হব, না ইসলাম গ্রহণ করব?’ তিনি বললেন, আগে ইসলাম গ্রহণ কর, তারপর যুদ্ধে যাও। এরপর সেই ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে যুদ্ধে গেল এবং শাহাদত বরণ করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, عَمِلَ قَلِيلاً وَأُجِرَ كَثِيرًا، ‘সে অল্প আমল করে বেশী পুরস্কার পেল’।[2]

আমর ইবনে ছাবিত আল-উয়ায়রিম এবং আমর ইবনে উক্বাইশ (রাঃ)-এর ব্যাপারেও এমন বর্ণনা এসেছে, যারা জীবনে এক ওয়াক্ত ছালাত আদায় না করেও জান্নাত লাভের তাওফীক্ব পেয়েছেন।[3] আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ يَهْدِيهِمْ رَبُّهُمْ ‌بِإِيْمَانِهِمْ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ، ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তাদের প্রতিপালক তাদেরকে তাদের ঈমানের মাধ্যমে নে‘মতপূর্ণ জান্নাত সমূহের দিকে পথ প্রদর্শন করেন। যেসবের তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়’ (ইউনুস ১০/৯)। অর্থাৎ যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতের দিকে পরিচালিত করেন এবং জান্নাত লাভ করার জন্য নেক আমল করার তাওফীক্ব দান করেন।[4]

যারা ইখলাছের সাথে কাজ করবে, শয়তান তাদের পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। আল্লাহ যখন ইবলীসকে অভিশপ্ত করে জান্নাত থেকে বের করে দেন, তখন ইবলীস আল্লাহ্কে বলেছিল, رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ، إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ، قَالَ هَذَا صِرَاطٌ عَلَيَّ مُسْتَقِيمٌ، إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ ‌عَلَيْهِمْ ‌سُلْطَانٌ إِلَّا مَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْغَاوِينَ- ‘হে আমার পালনকর্তা। যেহেতু তুমি আমাকে বিপথগামী করেছ, সেহেতু আমিও পৃথিবীতে তাদের নিকট পাপকর্মকে শোভনীয় করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করব। তবে তাদের মধ্য থেকে তোমার খঁাটি বান্দারা ব্যতীত। আল্লাহ বললেন, এটাই আমার নিকট পেঁŠছার সরল পথ। নিশ্চয়ই আমার বানদাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। তবে বিপথগামীদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে তারা ব্যতীত’ (হিজর ১৫/৩৯-৪২)। এ আয়াতের মাধ্যমে বোঝা গেল, আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দার উপরে শয়তান প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। আর যে ব্যক্তি শয়তানের উপর বিজয়ী হ’তে পারে, তার জন্য জান্নাতের অর্ধেক রাস্তা সহজ হয়ে যায়। ফলে তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে পাপ বর্জনের সক্ষমতা অর্জন করেন এবং নেক আমলের তাওফীক্ব লাভ করতে পারেন। এভাবে নিয়ত খালেছ করার মাধ্যমে বান্দা তার ঘুম, খাওয়া-দাওয়া, চাকুরী, কৃষি কাজ প্রভৃতি দুনিয়াবী কাজ করার মাধ্যমে ছওয়াব লাভ করতে পারে।

সুতরাং সর্তক থাকতে হবে যেন সকল কাজে ইখলাছ বজায় থাকে এবং নেক আমলগুলো লৌকিকতাপূর্ণ না হয়ে যায়। আবূ বকর আল-ওয়াসেত্বী (রহঃ) বলেন,حِفْظُ الطَّاعَةِ أَشَدُّ مِنْ فِعْلِهَا؛ لِأَنَّ مَثَلَهَا كَمَثَلِ الزُّجَاجِ سَرِيعُ الْكَسْرِ، وَلَا يَقْبَلُ الْجَبْرَ، كَذَلِكَ الْعَمَلُ إِنْ مَسَّهُ الرِّيَاءُ كَسَرَهُ، وَإِذَا مَسَّهُ الْعُجْبُ كَسَرَهُ، وَإِذَا أَرَادَ الرَّجُلُ أَنْ يَعْمَلَ عَمَلًا وَخَافَ الرِّيَاءَ مِنْ نَفْسِهِ فَإِنْ أَمْكَنَهُ أَنْ يُخْرِجَ الرِّيَاءَ مِنْ قَلْبِهِ فَيَنْبَغِي لَهُ أَنْ يَجْتَهِدَ فِي ذَلِكَ وَإِنْ لَمْ يُمْكِنْهُ فَيَنْبَغِي أَنْ يَعْمَلَ وَلَا يَتْرُكَ الْعَمَلَ لِأَجْلِ الرِّيَاءِ، ثُمَّ يَسْتَغْفِرَ اللَّهَ تَعَالَى مِمَّا فَعَلَ فِيهِ مِنَ الرِّيَاءِ فَلَعَلَّ اللَّهَ تَعَالَى أَنْ ‌يُوَفِّقَهُ لِلْإِخْلَاصِ فِي عَمَلٍ آخَرَ، ‘সাধারণভাবে আল্লাহর অনুগত্য করার চেয়ে সেটার হেফাযত করা বা গুরুত্বের সাথে নিয়মিত আদায় করা বেশী কঠিন। কেননা নেক আমল হচ্ছে কঁাচের মত; যা খুব দ্রুত ভেঙ্গে যায়, একটুও চাপ সহ্য করতে পারে না। অনুরূপভাবে নেক আমলে যদি লৌকিকতা ও আত্মতুষ্টির স্পর্শ লাগে, আমলটা সাথে সাথে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি সৎ আমল করতে চায়; কিন্তু মনের মধ্যে রিয়ার আশংকাবোধ করে, তবে সে হৃদয় থেকে রিয়া বের করে দেওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। সেটা যদি সম্ভব না হয়, তবে আমল অব্যাহত রাখবে, রিয়া বা লৌকিকতার ভয়ে আমলটা পরিত্যাগ করবে না। অতঃপর রিয়ার আশঙ্কাবোধের কারণে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবে। তাহ’লে আশা করা যায়, আল্লাহ তাকে অপর আমল সম্পাদনে খুলূছিয়াত বজায় রাখার তাওফীক্ব দান করবেন’।[5]

২. পাপ ও প্রবৃত্তি পূজা থেকে বিরত থাকা :

বান্দার জীবনে যত দুর্গতি আসে, সবকিছুর মূল করণ হ’ল প্রবৃত্তিপূজা ও পাপাচার। পাপের কারণে তাওফীক্বের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। জীবনজুড়ে নেমে আসে অশান্তির ঘোর অমানিশা। নেক আমল সম্পাদন, ইবাদতের স্বাদ আস্বাদন ও বরকত লাভের তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত হ’তে হয়। এজন্য পার্থিব শান্তি ও পরকালীন মুক্তি লাভের জন্য সর্বাগ্রে ছোট-বড় সব ধরনের পাপের রাস্তা বন্ধ করে দিতে হবে। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, أنَّ اتباع الهوى يغلقُ عن العبد أبوابَ التَّوفيق، ويفتح عليه أبوابَ الخِذْلان، فتراه يَلْهج بأنَّ الله لو وفَّق لكان كذا وكذا، وقد سدَّ على نفسه طُرُق التوفيق باتباعه هواه، ‘প্রবৃত্তির অনুসরণ বান্দার জন্য তাওফীক্বের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয় এবং তার সামনে ব্যর্থতার বিভিন্ন দরজা খুলে দেয়। আর তখন আপনি দেখবেন সে অবিরতভাবে বলতে থাকবে, যদি আল্লাহ তাওফীক্ব দিতেন, তবে এমন এমন হ’ত। মূলতঃ তার প্রবৃত্তিপরায়ণতার কারণে আল্লাহ তার জন্য তাওফীক্বের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন’।[6]

ফুযাইল ইবনে ইয়ায (রহঃ) বলেন,‌مَنْ ‌اسْتَحْوَذَ ‌عَلَيْهِ ‌الْهَـوَى وَاتِّبَاعُ الشَّهَوَاتِ انْقَطَعَتْ عَنْهُ مَوَادُّ التَّوْفِيقِ، ‘কৃপ্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনা যার উপর বিজয়ী হয়। তার থেকে তাওফীক্বের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়’।[7] আব্দুল আযীয সালমান (রহঃ) বলেন,من أفضل نعم الله على العبد أن يجيب إليه العدل ‌يوفقه للعمل به ويجيب إليه الحق وإيثاره والعمل به، ومن قلة توفيق العبد وخذلانه أن يطبع على الجور واستسهاله وعلى الظلم واستخفافه، ‘বান্দার প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় নে‘মত হ’ল, তিনি তাকে ন্যায়পরায়ণতা দান করেন এবং তাকে সেই অনুযায়ী আমল করার তাওফীক্ব দান করেন। তাকে সঠিক বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক্ব দেন। আর বান্দার তাওফীক্ব কমে যাওয়া ও ব্যর্থতার আলামত হ’ল সে অন্যায়-অপকর্মকে হালকা মনে করে এবং যুলুম-নিপীড়নকে ছোট করে দেখে’।[8]

বিশেষ করে কাবীরা গুনাহ থেকে সবচেয়ে বেশী সতর্ক-সাবধান থাকা যরূরী। কেননা বান্দার ঈমান-আমলের জন্য সবচেয়ে বেশী ক্ষতিকর ও ভয়ংকর হ’ল কাবীরা গুনাহ, যা বান্দার দ্বীন-দুনিয়া উভয়টাকে বরবাদ করে দেয়। কারো যদি কবীরা গুনাহ না থাকে এবং সে যদি ফরয বিধানগুলো ভালোভাবে পালন করে, তবে আল্লাহ তার ছগীরা গুনাহগুলো এমনিতেই ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ বলেন,إِنْ تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ ‌نُكَفِّرْ ‌عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُدْخَلًا كَرِيمًا، ‘যদি তোমরা কবীরা গোনাহসমূহ হ’তে বিরত থাক, যা থেকে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে, তাহ’লে আমরা তোমাদের (ছগীরা) গোনাহসমূহ মার্জনা করে দেব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে (জান্নাতে) প্রবেশ করাবো’ (নিসা ৪/৩১)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الصَّلَوَاتُ الْخَمْسُ، وَالْجُمْعَةُ إِلَى الْجُمْعَةِ، وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ، مُكَفِّرَاتٌ مَا بَيْنَهُنَّ إِذَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ، ‘পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত, এক জুম‘আ থেকে আরেক জুম‘আ এবং এক রামযান থেকে অপর রমযান, এসব তাদের মধ্যবর্তী ছগীরা গুনাহের জন্য কাফ্ফারা হয়ে যাবে, যদি সে কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকে’।[9]

৩. তওবা ও ইস্তিগফার :

তওবা হচ্ছে কোন পাপ থেকে বিরত থেকে আল্লাহর আনুগত্যে ফিরে আসা। আর ইস্তিগফার হচ্ছে নিজের কৃত পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে বারংবার ক্ষমাভিক্ষা চাওয়া। ছোট-বড় সব ধরনের পাপ থেকে নিজেকে পবিত্র করার প্রধান মাধ্যম হ’ল তওবা-ইস্তিগফার। শিরক, বিদ‘আত, প্রবৃত্তিপূজা, গান-বাজনা, মিথ্যা, অহংকার, কৃপণতা, গাফলতি, হিংসা-বিদ্বেষ, গীবত-তোহমত, চোগলখুরী, যিনা-ব্যভিচার, খেয়ানত সহ যাবতীয় কবীরা গুনাহ থেকে হৃদয়কে পরিস্কার করার জন্য আল্লাহর কাছে বেশী বেশী তওবা-ইস্তিগফার করা অপরিহার্য। ছোট-বড় সব ধরনের পাপ থেকে তওবা করা প্রত্যেকের উপর ফরয।[10] আর খালেছভাবে তওবা করা একটি বড় ধরনের ইবাদত, যার মাধ্যমে জান্নাত লাভ করা যায়।[11] সুতরাং নিজেদের ভুল-ত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে বেশী বেশী ক্ষমাপ্রার্থনা করা কর্তব্য।

ইবনুছ ছুবাইহ্ (রহঃ) বলেন, একবার হাসান বাছরী (রহঃ)-এর কাছে এক ব্যক্তি এসে প্রচন্ড খরা ও অনাবৃষ্টির কথা ব্যক্ত করল। তিনি তাকে বললেন, তুমি আল্লাহর কাছে বেশী বেশী ক্ষমাপ্রার্থনা কর, তাহ’লে বৃষ্টি বর্ষণ হবে। আরেক দিন এক ব্যক্তি তার কাছে দরিদ্রতার অভিযোগ পেশ করল। তিনি তাকে বললেন, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও, তাহ’লে তিনি তোমাকে সচ্ছলতা দান করবেন। আরেক দিন এক মহিলা তার নিকটে এসে বললেন, ‘আমার জন্য দো‘আ করবেন, যেন আল্লাহ আমাকে সন্তান দান করেন। তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার কর, ক্ষমা চাও, তাহ’লে তিনি তোমাকে সন্তান দান করবেন। আরেক লোক তার কাছে বাগানের অনুর্বরতার কথা ব্যক্ত করলে, তাকেও ক্ষমাপ্রার্থনা করা পরামর্শ দেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা একদিন তাকে বলেই ফেললাম, আপনি সব অনুযোগকারীকে ক্ষমাপ্রার্থনা করার পরামর্শ দেন কেন? তখন হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, এটা তো আমি নিজের পক্ষ থেকে বলিনি; বরং আল্লাহই বলেছেন। তুমি কি কুরআনের সেই আয়াতগুলো পড়নি? যেখানে আল্লাহ বলেছেন,اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا، يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِدْرَارًا، وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَلْ لَكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَلْ لَكُمْ أَنْهَارًا- ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি অতীব ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর মুষলধারে বারি বর্ষণকারী মেঘমালা প্রেরণ করবেন। তিনি তোমাদের সম্পদ ও সন্তানাদি বৃদ্ধি করে দিবেন এবং তোমাদের জন্য বাগিচাসমূহ সৃষ্টি করবেন ও নদীসমূহ প্রবাহিত করবেন’ (নূহ ৭১/১০-১২)

অন্যত্র তিনি বলেন,وَأَنِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُمْ مَتَاعًا حَسَنًا إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى وَيُؤْتِ كُلَّ ذِي فَضْلٍ فَضْلَهُ، ‘এবং এই মর্মে যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর ও তাঁর দিকে ফিরে যাও। তিনি তোমাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ দান করবেন নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত এবং প্রত্যেক সৎকর্মশীলকে তার প্রতিদান দিবেন’ (হূদ ১১/৩)

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, এতে দলীল রয়েছে যে, ক্ষমাপ্রার্থনার মাধ্যমে রিযিক নেমে আসে এবং বৃষ্টি বর্ষিত হয়’।[12] ইবনে কাছীর (রহঃ) বলেন, অত্র আয়াতের মর্মার্থ হ’ল-إِذَا تُبْتُمْ إِلَى اللهِ وَاسْتَغْفَرْتُمُوهُ وَأَطَعْتُمُوهُ، كَثُرَ الرِّزْقُ عَلَيْكُمْ، ‘যখন তোমরা আল্লাহর নিকটে তওবা করবে, তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং তাঁর অনুগত্য করে চলবে, তখন তোমাদের রিযিক বৃদ্ধি পাবে’।[13]

বোঝা গেল, তওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে দুনিয়ার সার্বিক কল্যাণ লাভের তাওফীক্ব অর্জিত হয়। সুতরাং ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবনে সুখী-সমৃদ্ধ হ’তে চাইলে এবং আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি পেতে চাইলে সকাল-সন্ধ্যা বেশী বেশী তওবা-ইস্তিগফার করার উচিত। হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, إن بين العبد وبين الله عزّوجلّ حداً محدوداً من الذنوب فإذا بلغه العبد طبع على قلبه فلم ‌يوفقه للخير أبداً فبادر أيها المجاوز للحدود بالتوبة والرجوع قبل أن تبلغ الحد- ‘আল্লাহ ও বান্দার মাঝে গুনাহের একটি নির্দিষ্ট সীমানা থাকে। বান্দা যখন সেই সীমানার কাছে উপনীত হয়, তখন তার অন্তরে মোহর মেরে দেওয়া হয়। ফলে তাকে আর কল্যাণের তাওফীক্ব দেওয়া হয় না। সুতরাং ওহে যারা সীমালঙ্ঘন করছে! চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছার আগেই তওবা করে (আল্লাহর দিকে) ফিরে এসো’।[14]

৪. জামা‘আতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করা :

দ্বীন-দুনিয়ার তাওফীক্ব লাভের অন্যতম বড় মাধ্যম হ’ল পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত। পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করা যেমন প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয, তদ্রূপ পুরুষের জন্য এই ছালাত সমূহ জামা‘আতের সাথে আদায় করার অপরিহার্য কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَا مِنْ ثَلَاثَةٍ فِي قَرْيَةٍ وَلَا بَدْوٍ لَا تُقَامُ فِيهِمُ الصَّلَاةُ إِلَّا قَدِ اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ، فَعَلَيْكَ بِالْجَمَاعَةِ فَإِنَّمَا يَأْكُلُ الذِّئْبُ الْقَاصِيَةَ، ‘কোন জনপদে বা বন-জঙ্গলে তিনজন লোক একত্রে বসবাস করা সত্ত্বেও যদি তারা জামা‘আতে ছালাত আদয় না করে, তবে তাদের উপর শয়তান আধিপত্য বিস্তার করে। অতএব তোমরা জামা‘আতকে আকঁড়ে ধর। কারণ নেকড়ে (বাঘ) দলচ্যুত বকরীকেই খেয়ে থাকে’। সায়িব (রহঃ) বলেছেন, এখানে জামা‘আত বলতে ছালাতের জামা‘আতকে বুঝানো হয়েছে।[15]

অত্র হাদীছ দ্বারা বোঝা গেল, যারা জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায় করে না, শয়তান তাদের উপর বিজয়ী হয়। আর শয়তান যার উপর বিজয়ী হ’তে পারে, তার সর্বনাশ হওয়ার আর কিছু বাকী থাকে না। শয়তান তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। বাঘ যেমন পাল ছাড়া ছাগলের উপর আক্রমণ করে তাকে ধরাশায়ী করে ফেলে, শয়তান অনুরূপভাবে সেই বান্দার দ্বীনদারীর উপরে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায় এবং তাকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করে ফেলে। ফলে সার্বিক জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি ও বরকত লাভের তাওফীক্ব থেকে বান্দা বঞ্চিত হয়ে যায়। সুতরাং জীবনকে শয়তানের প্রভাবমুক্ত করতে হ’লে বান্দাকে পঁাচ ওয়াক্ত ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করা অপরিহার্য। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বাভাবিকভাবে দ্বীন-ধর্ম পালন করার পরেও অশান্তি ও মানসিক কষ্ট তাদের পিছু ছাড়ে না। এমন ব্যক্তির ব্যাপারে খেঁাজ নিলে দেখা যাবে যে, তিনি জামা‘আতে ছালাত আদায়ের ব্যাপারে চরমভাবে গাফলতি করেন।

৫. আল্লাহর উপর ভরসা করা ও তাঁর অভিমুখী হওয়া :

আল্লাহর উপর ভরসা করা অন্তরের ইবাদত। এই ইবাদতের পরকালীন পুরস্কারের পাশাপাশি পার্থিব পুরস্কারও রয়েছে। বান্দা যখন কোন কাজে আল্লাহর উপর ভরসা করে, তখন আল্লাহ তাকে সেই কাজ করার তাওফীক্ব দান করেন। শুআইব (আঃ)-এর কওম যখন তাঁর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছিল, তখন তিনি বলেছিলেন,‌إِنْ ‌أُرِيدُ إِلَّا الْإِصْلَاحَ مَا اسْتَطَعْتُ وَمَا تَوْفِيقِي إِلَّا بِاللهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ، ‘বরং আমি আমার সাধ্যমত তোমাদের সংশোধন চাই মাত্র। আর আমার কোনই ক্ষমতা নেই আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত। আমি তাঁর উপরেই নির্ভর করি এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাই’ (হূদ ১১/৮৮)। অত্র আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়, আল্লাহর উপর ভরসা করলে এবং তাঁর অভিমুখী হ’লে, তিনি বান্দাকে কল্যাণের তাওফীক্ব ও সক্ষমতা দান করেন। আর আল্লাহর অভিমুখী হওয়ার বা তার দিকে যাওয়ার অর্থ হ’ল তাঁর কাছে দো‘আ করা।[16]

মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ، ‘অতঃপর যখন তুমি সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)। অর্থাৎ কোন কাজ করার ইচ্ছা হ’লে, আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে। কারণ পরামর্শের ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা হয়, তখন আল্লাহ সেই কাজটি সফলভাবে সম্পাদন করার তাওফীক্ব দান করেন।[17]

ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন,من سره أَن يكون أقوى النَّاس فَليَتَوَكَّل على الله، ‘যে ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী মানুষ হ’তে চায়, সে যেন আল্লাহর উপর ভরসা করে’।[18] ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,لَوْ تَوَكَّلَ الْعَبْدُ عَلَى اللهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ فِي إِزَالَةِ جَبَلٍ عَنْ مَكَانِهِ وَكَانَ مَأْمُوْرًا بِإِزَالَتِهِ لَأَزَالَهُ، ‘বান্দা যদি কোন পাহাড়কে সরাতে আদিষ্ট হয়। আর সে যদি এই কাজে আল্লাহ তা‘আলার উপর যথার্থভাবে ভরসা করতে পারে, তবে সে পাহাড়কেও সরিয়ে দিতে সক্ষম হবে’।[19] অর্থাৎ আল্লাহর উপর ভরসা করার কারণে সে শারীরিক ও মানসিক এমন তাওফীক্ব অর্জন করবে যে, সে একাই একটা পাহাড়কে স্থানান্তর করতে সক্ষম হবে।

৬. আখেরাতের চিন্তা নিয়ে দিন যাপন করা :

যারা সর্বদা আখেরাতের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় এবং পরাকালের চিন্তা মাথায় রেখে দিন যাপন করে, মহান আল্লাহ তাদের পার্থিব জীবন সহজ করে দেন এবং তাদেরকে পরকালীন পাথেয় সঞ্চয়ের তাওফীক্ব দান করেন। আল্লাহ বলেন, مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ ‌فِي ‌حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ، ‘যে ব্যক্তি আখেরাতের ফসল কামনা করে আমরা তার জন্য তার ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার ফসল কামনা করে, আমরা তাকে তা থেকে কিছু দিয়ে থাকি। কিন্তু আখেরাতে তার কোন অংশ থাকে না’ (শূরা ৪২/২০)। অত্র আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, ‘আমি তার জন্য ফসল বাড়িয়ে দেব’- একথার অর্থ হচ্ছে,نوفقه للعبادة ونسهلها عليه، ‘আমি তাকে ইবাদত-বন্দেগী করার তাওফীক্ব দিব এবং এটা তার জন্য সহজসাধ্য করে দেব’।[20] ক্বাসেমী (রহঃ) বলেন,من عمل للآخرة، وفّق في عمله وضوعفت حسناته، ‘যে ব্যক্তি আখেরাতের জন্য কাজ করবে, তাকে নেক আমলের তাওফীক্ব দেওয়া হয় এবং তার আমলের নেকী বহু গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়’।[21]

কিন্তু যাদের চিন্তা-ভাবনা দুনিয়া কেন্দ্রিক, মহান আল্লাহ তাদেরকে পরকালের প্রস্ত্ততির জন্য নেক আমল করার তাওফীক্ব দেন না। তারা দুনিয়ায় কিছু অর্থ-সম্পদ লাভ করতে পারলেও আখেরাতের জন্য তাদের কোন অংশ থাকে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ كَانَتِ الآخِرَةُ هَمَّهُ جَعَلَ اللهُ غِنَاهُ فِي قَلْبِهِ وَجَمَعَ لَهُ شَمْلَهُ، وَأَتَتْهُ الدُّنْيَا وَهِيَ رَاغِمَةٌ، وَمَنْ كَانَتِ الدُّنْيَا هَمَّهُ جَعَلَ اللهُ فَقْرَهُ بَيْنَ عَيْنَيْهِ، وَفَرَّقَ عَلَيْهِ شَمْلَهُ، وَلَمْ يَأْتِهِ مِنَ الدُّنْيَا إِلَّا مَا قُدِّرَ لَهُ، ‘আখেরাত যার একমাত্র চিন্তা-ভাবনা, আল্লাহ তার হৃদয়কে অভামুক্ত করে দেন এবং তার যাবতীয় বিচ্ছিন্ন কাজ সুসংহত করে দেন। ফলে দুনিয়াটা তার কাছে নগণ্য হয়ে দেখা দেয়। পক্ষান্তরে যার চিন্তা-ভাবনা হয় দুনিয়া- আল্লাহ তার দু’চোখের সামনে অভাব-অনটন তুলে ধরেন এবং তার কাজগুলো এলোমেলো ও ছিন্নভিন্ন করে দেন। আর তার তাক্বদীরে যতটুকু নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে এর অতিরিক্ত দুনিয়া সে পায় না’।[22] সুতরাং চাকুরী-বাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষেত-খামার প্রভৃতি দুনিয়াবী কাজে অবশ্যই আখেরাতকে প্রাধান্য দিতে হবে। সকল কাজের উপরে আল্লাহর ইবাদত ও রাসূলের নির্দেশনা যেন অগ্রাধিকার পায়, পার্থিব কাজে জড়িয়ে পড়লেও পরকালীন নাজাতের চিন্তা যেন মাথায় থাকে, আল্লাহর আযাব ও জাহান্নামের ভয় যেন সর্বদা মনে জাগরুক থাকে। যদি আমরা এই বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা দিতে পারি, তবে আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়া ও আখেরাতের সার্বিক কল্যাণের তাওফীক্ব হাছিল করতে পারব ইনশাআল্লাহ।

৭. দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করা :

শরী‘আতের জ্ঞান ছাড়া দ্বীনের পথে চলা সম্ভব নয়। সঠিকভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে হ’লে সেই ইবাদতের বিধি-বিধান জানা অপরিহার্য। অন্যথা বান্দা আল্লাহর আনুগত্য করতে গিয়ে ভুল করে বসবে, সুন্নাত আদায় করতে গিয়ে বিদ‘আত করে ফেলবে। সেজন্য ফরয ইবাদতের বিধি-বিধান ও মাসায়েলের জ্ঞান অর্জন করা ফরয। দ্বীনের বিশুদ্ধ জ্ঞান ব্যতিরেকে একনিষ্ঠভাবে এবং সঠিক পদ্ধতিতে ইবাদত-বন্দেগী করার তাওফীক্ব অর্জিত হয় না। এজন্য আল্লাহ যে বান্দার কল্যাণ চান, কেবল তাকে দ্বীনের বুঝ দান করেন। তিনি বলেন,يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ ‌أُوتِيَ ‌خَيْرًا ‌كَثِيرًا، ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিশেষ প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে উক্ত প্রজ্ঞা দান করা হয়, তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়। বস্ত্ততঃ জ্ঞানী লোকেরা ব্যতীত কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না’ (বাক্বারাহ ২/২৬৯)। অর্থাৎ ‘আল্লাহ যাকে উপকারী জ্ঞান হাছিলের তাওফীক্ব দেন, তার বোধশক্তিকে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করেন’।[23]

মু‘আবিয়া (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ وَإِنَّمَا أَنَا قَاسِمٌ وَاللهِ يُعْطِي، ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন। আল্লাহই (সেই জ্ঞান) প্রদানকারী, আমি কেবল বন্টনকারী’।[24] এই হাদীছের ব্যাখ্যায় আব্দুল করীম খুযাইর বলেন,لا يستطيع الإنسان إذا لم ‌يوفقه الله للحصول عليها ما استطاع بجهده ولو كان من أبرع الناس وأذكاهم، ‘আল্লাহ যদি তাওফীক্ব না দেন, তবে কোন মানুষ নিজের পরিশ্রম দিয়ে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করতে পারবে না। যদি সে মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দক্ষ ও মেধাবী হয়, তবুও সক্ষম হবে না’।[25]

স্মর্তব্য যে, দ্বীনের জ্ঞান হাছিলের মূল উদ্দেশ্য হ’তে হবে- সার্বিক জীবনে সেই জ্ঞানের বাস্তবায়ন। নতুবা সেই জ্ঞানের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার তাওফীক্ব লাভ করা সম্ভব নয়।

মালেক ইবনে দীনার (রহঃ) বলেন, مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِلْعَمَلِ وَفَّقَه الله وَمَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِغَيْرِ الْعَمَلِ يَزْدَادُ بِالْعِلْمِ فَخْرًا، ‘যে ব্যক্তি আমল করার জন্য জ্ঞান অন্বেষণ করে, আল্লাহ তাকে সেই জ্ঞানের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার তাওফীক্ব দান করেন। আর যে ব্যক্তি আমল করার উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে অন্য কোন কারণে ইলম তালাশ করে, সেই জ্ঞানের মাধ্যমে তার অংহকার বৃদ্ধি পায়’।[26] ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, এমন কত আলেম আছে, আল্লাহ যাকে তার অর্জিত ইলমের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার তাওফীক্ব দেননি, ফলে স্বীয় জ্ঞান অনুযায়ী সে আমল করতে পারেনি। আবার এমন কত সাধারণ লোক আছে, আল্লাহ যাকে নেক আমল করার তাওফীক্ব দিয়ে সম্মানিত করেছেন।[27]

তাছাড়া হৃদয়ে পাপের ময়লা জমলে এলাহী তাওফীক্বের সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেজন্য ছোট-বড় সব ধরনের পাপ থেকে নিজেকে পবিত্র রাখা বাঞ্ছনীয়। বান্দা যখন তাক্বওয়ার নির্মল শিশিরে অন্তরকে সিক্ত করে জ্ঞান সাধনায় ব্রতী হয়, তখন আল্লাহ পাক তার হৃদয়ে ইলমের নূর ঢেলে দেন। ফলে সে উপকারী জ্ঞানের ময়দানে বিচরণ করতে সক্ষম হয়। সাঈদ ইবনে ওয়াহাফ আল-ক্বাহত্বানী (রহঃ) বলেন,من ثمرات التقوى التوفيق لنيل العلم النافع وتحصيله، ‘জ্ঞান হাছিলের তাওফীক্ব লাভ করা হ’ল আল্লাহভীরুতার অন্যতম আলামত। কেননা আল্লাহ বলেন,وَاتَّقُواْ الله وَيُعَلِّمُكُمُ الله وَالله بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ، ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ তোমাদেরকে (দ্বীনের বিধি-বিধান) শিক্ষা দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সকল বিষয়ে অবগত’ (বাক্বারাহ ২/২৮২)[28]

৮. নিজেকে নেক আমলে ব্যস্ত রাখা :

নেক আমলে ব্যস্ত থাকতে পারা এলাহী তাওফীক্ব লাভের একটি বড় আলামত। কারণ সৎ আমল যত বেশী হয়, জীবনে তত বেশী বরকতের ধারা বর্ষিত হয় এবং জীবনটা তাওফীক্বের পাক শিশিরে সিক্ত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَمَّا أَهْلُ السَّعَادَةِ فَيُيَسَّرُونَ لِعَمَلِ السَّعَادَةِ، وَأَمَّا أَهْلُ الشَّقَاوَةِ فَيُيَسَّرُونَ لِعَمَلِ الشَّقَاوَةِ، ‘যারা সৌভাগ্যবান, তাদের জন্য সৌভাগ্যের আমল সহজ করে দেওয়া হয়। আর ভাগ্যাহতদের জন্য দুর্ভাগ্যের আমল সহজ করে দেওয়া হয়। এরপর তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন, فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى، وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَى، فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى، وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى، وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى، فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى- ‘অতঃপর যে ব্যক্তি দান করে ও আল্লাহভীরু হয় এবং উত্তম বিষয়কে সত্য বলে বিশ্বাস করে, অচিরেই আমরা তাকে সরল পথের জন্য সহজ করে দেব। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয় এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে, অচিরেই আমরা তাকে কঠিন পথের জন্য সহজ করে দেব’ (লায়ল ৯২/৫-১০)[29]

ইমাম ইবনু রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেন, إِشَارَةٌ إِلَى أَنَّ ‌التَّوْفِيقَ كُلَّهُ بِيَدِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، فَمَنْ يَّسَّرَ اللهُ عَلَيْهِ الْهُدَى اهْتَدَى، وَمَنْ لَمْ يُيَسِّرْهُ عَلَيْهِ، لَمْ يُيَسَّرْ لَهُ ذَلِكَ، ‘অত্র আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, তাওফীক্বের ব্যাপার পুরোটাই আল্লাহর হাতে ন্যাস্ত। তিনি যার জন্য হেদায়াত সহজ করে দেন, সে হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর যার জন্য তিনি সহজ করবেন না, তার জন্য হেদায়াত লাভ করা সহজ হবে না’।[30]

শয়তান সর্বদা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ ও ইবাদত থেকে গাফেল রাখতে চায়, যাতে বান্দা এলাহী তাওফীক্ব লাভে ব্যর্থ হয়। কিন্তু বান্দা যখন শয়তানী ওয়াসওসার জাল ছিন্ন করে সৎ আমলে আত্মনিয়োগ করে, তখন তাকে সেই সৎ আমলের বিনিময়ে আরেকটি সৎ আমল করার তাওফীক্ব দেওয়া হয়। হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন,إن من جزاء الحسنة الحسنة بعدها، ومن عقوبة السيئة السيئةُ بعدها، فإذا قبل الله العبد فإنه يوفقه إلى الطاعة، ويصرفه عن المعصية، ‘নেক আমলের প্রতিদান হ’ল সেই আমলের পরে আরেকটি ভালো আমল করতে পারা। আর পাপের পরিণাম হ’ল সেই পাপের পরে আরেকটি পাপ করে ফেলা। কারণ আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে কবুল করে নেন, তখন তাকে তাঁর আনুগত্য করার তাওফীক্ব দেন এবং তাকে পাপ থেকে দূরে রাখেন’।[31]

প্রখ্যাত তাবেঈ ‘উরওয়া ইবনু যুবাইর (রহঃ) বলেন,إِذَا رَأَيْتَ الرَّجُلَ يَعْمَلُ الْحَسَنَةَ فَاعْلَمْ أَنَّ لَهَا عِنْدَهُ أَخَوَاتٍ فَإِذَا رَأَيْتَهُ يَعْمَلُ السَّيِّئَةَ فَاعْلَمْ أَنَّ لَهَا عِنْدَهُ أَخَوَاتٍ فَإِنَّ الْحَسَنَةَ تَدُلُّ عَلَى أَخَوَاتِهَا وَإِنَّ السَّيِّئَةَ تَدُلُّ عَلَى أَخَوَاتِهَا، ‘তুমি যদি কোন ব্যক্তিকে নেক আমল করতে দেখ, তবে জেনে রেখ- তার আরো নেক আমল রয়েছে। আর যদি কোন ব্যক্তিকে পাপ করতে দেখ, তবে বুঝে নিও, তার আরো অনেক পাপ রয়েছে। কেননা একটি নেক আমল তার সমপর্যায়ের অন্য নেক আমলের প্রতি নির্দেশ করে এবং একটি পাপ অন্যান্য পাপের দিকে নির্দেশ করে’।[32]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ سَرَّتْهُ حَسَنَتُهُ وَسَاءَتْهُ سَيِّئَتُهُ فَذَلِكَ الْمُؤْمِنُ، ‘যার নেক আমল তাকে আনন্দিত করে এবং তার পাপ কাজ তাকে ব্যথিত করে, সে-ই প্রকৃত মুমিন’।[33] আল্লামা শাওকানী (রহঃ) বলেন, নেক আমলের কারণে আনন্দিত হওয়া এবং পাপের কারণে পেরেশান হওয়া ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য। যে মুমিনের জীবন এই ধারায় পরিচালিত হয়, মহান আল্লাহ তাকে ‘হুসনুল খাতিমাহ’ তথা ঈমানের সাথে উত্তমভাবে মৃত্যুবরণ করার তাওফীক্ব দান করেন।[34] একবার হুসাইন (রহঃ)-কে বলা হ’ল, ‘আল্লাহর অলীদের নিদর্শন কি? তিনি বলেন,يُوَفِّقُهُمْ فِي دَارِ الدُّنْيَا لِلْأَعْمَالِ الَّتِي يَرْضَى بِهَا عَنْهُمْ، ‘আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়াতে এমন নেক আমল করার তাওফীক্ব দান করে, যে আমলের কারণে তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান’।[35]

মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রহঃ) বলেন,مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا ‌يُوَفِّقْهُ لِطَاعَتِهِ وَمَحَابِّهِ مِنَ الأَعْمَالِ. وَمَنْ يُرِدْ بِهِ غَيْرَ ذَلِكَ يُعَذِّبْهُ غَيْرَ ظَالِمٍ، ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে তঁার আনুগত্য এবং তাঁর সন্তুষ্টিমূলক কাজের তাওফীক্ব দান করেন। আর যার ব্যাপারে অন্য কিছু চান, কোন অন্যায় করা ছাড়াই তাকে শাস্তি দেন’।[36] সুতরাং গাফলতির চাদর ছুড়ে ফেলে নিজের হৃদয়, জিহবা, হাত, পা, কান, চোখ সহ প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর ইবাদতে ব্যস্ত রাখা যরূরী এবং ছোট-বড় যাবতীয় গুনাহ থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। তাহ’লে আমরা পার্থিব জীবনে আরো বেশী নেক আমলের তাওফীক্ব লাভ করতে পারব। পরকালে এর বিনিময়ে আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি পাব এবং জান্নাত লাভ করতে পারব ইনশাআল্লাহ।

৯. আল্লাহর যিক্র বেশী বেশী করা :

শারীরিক ও মানসিকভাবে তাওফীক্ব লাভ করার একটি বড় মাধ্যম হ’ল যিক্র। কারণ বান্দার হৃদয় ও জিহবা যখন আল্লাহর স্মরণে ব্যস্ত থাকে, তখন শয়তান তার ধারে-কাছে আসতে পারে না এবং তাওফীক্ব লাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। হারেছ আল-আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,آمُرُكُمْ أَنْ تَذْكُرُوا اللهَ، فَإِنَّ مَثَلَ ذَلِكَ كَمَثَلِ رَجُلٍ خَرَجَ العَدُوُّ فِي أَثَرِهِ سِرَاعًا حَتَّى إِذَا أَتَى عَلَى حِصْنٍ حَصِينٍ فَأَحْرَزَ نَفْسَهُ مِنْهُمْ، كَذَلِكَ العَبْدُ لَا يُحْرِزُ نَفْسَهُ مِنَ الشَّيْطَانِ إِلَّا بِذِكْرِ اللهِ، ‘আমি তোমাদের আল্লাহর যিক্র করার নির্দেশ দিচ্ছি। এর উদাহরণ হ’ল সেই ব্যক্তির মত যাকে তার দুশমন দ্রুতবেগে পিছু ধাওয়া করল। অতঃপর সে একটি সুরক্ষিত দুর্গের ভিতরে ঢুকল এবং নিজেকে শত্রুদের থেকে রক্ষা করে নিল। এমনিভাবে বান্দা আল্লাহর যিক্র ছাড়া নিজেকে শয়তান থেকে রক্ষা করতে পারে না’।[37]

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন,الشيطان جاثم على قلب أبن آدم، فإذا سها وغفل وسوس، فإذا ذكر الله تعالى خنس، ‘শয়তান আদম সন্তানের হৃদয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। যখন সে উদাসীন ও গাফেল হয়ে যায়, তখন ওয়াসওয়াসা দেয়। আর যখন আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন দূরে সরে যায়’।[38] সুতরাং বোঝা গেল যিকর থেকে গাফেল থাকলে, তাওফীক্বের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। আর যিকরে নিয়োজিত থাকার মাধ্যমে তাওফীক্বের দুয়ার খুলে যায়।

হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ বলেছেন,أَنَا مَعَ عَبْدِي إِذَا هُوَ ذَكَرَنِي وَتَحَرَّكَتْ بِي شَفَتَاهُ، ‘আমি আমার বান্দার সঙ্গে থাকি, যখন সে আমাকে স্মরণ করে এবং আমার যিকরে তার ঠোঁট দুটো নড়াচড়া করে’।[39] সুতরাং দৈনন্দিন পঠিতব্য দো‘আ ও যিকরে নিজেকে অভ্যস্ত করে নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে ফরয ছালাতের পরবর্তী ও সকাল-সন্ধ্যার যিকর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া ঘুম, সফর, বাথরুমের প্রবেশর সময়, বাড়িতে ঢোকা ও বাহির হওয়ার সময়, খাওয়ার শুরুতে ও শেষে প্রভৃতি সময় ও স্থানে যে মাসনূন দো‘আগুলো পড়তে হয় সেগুলোর ব্যাপারে যত্মশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। অবসর সময়গুলোতেও হৃদয় ও জিহবাকে যিকরে লিপ্ত রাখা কর্তব্য।

যিকরের মাধ্যমে যে তাওফীক্ব অর্জিত হয়, তার একটি নমুনা পেশ করা যেতে পারে। একবার ফাতেমা (রাঃ) তার স্বামী আলী (রাঃ)-এর কাছে আটা পেষার কষ্টের কথা ব্যক্ত করেন। এমন সময় তিনি সংবাদ পান যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট কয়েকজন বন্দী আনা হয়েছে। তখন ফাতেমা (রাঃ) একজন খাদেমের জন্য আল্লাহর রাসূলের নিকট গমন করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বাসায় না পেয়ে ফিরে আসেন। পরে আল্লাহর রাসূল বাসায় এলে আয়েশা (রাঃ) তঁাকে ফাতেমার ব্যাপারটা অবহিত করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখনই মেয়ের বাড়ির দিকে রওনা হন। আলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন আমাদের নিকট এলেন, তখন আমরা শুয়ে পড়েছিলাম। আমরা উঠতে চাইলাম। তিনি বললেন, তোমরা নিজ নিজ জায়গায় থাক। আমি তাঁর পায়ের শীতলতা আমার বুকে অনুভব করলাম। তখন তিনি বললেন, أَلاَ أُعَلِّمُكُمَا خَيْرًا مِمَّا سَأَلْتُمَانِي، إِذَا أَخَذْتُمَا مَضَاجِعَكُمَا تُكَبِّرَا أَرْبَعًا وَثَلاَثِينَ، وَتُسَبِّحَا ثَلاَثًا وَثَلاَثِينَ، وَتَحْمَدَا ثَلاَثًا وَثَلاَثِينَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمَا مِنْ خَادِمٍ، ‘তোমরা আমার কাছে যা চেয়েছ, আমি কি তোমাদেরকে তার চেয়ে উত্তম কিছু শিখাবো না? যখন তোমরা বিছানায় যাবে, তখন ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’, ৩৩ বার ‘সুব্হানাল্লাহ’ এবং ৩৩ ‘আল্হামদুলিল্লাহ’ বলবে, এটা তোমাদের জন্য একজন খাদেমের চেয়েও উত্তম’।[40]

আলী (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এই যিক্রটা শেখার পরে জীবনে কখনো এটা পড়তে ভুলিনি। তাকে জিজ্ঞাসা করা হ’ল, ছিফ্ফীন যুদ্ধের রাতেও কি ভুলেননি? তিনি বললেন, ‘না, ছিফ্ফীন যুদ্ধের রাতেও আমি এই আমল করতে ভুলিনি’।[41] ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি ঘুমের আগে নিয়মিত এই যিক্রগুলো পাঠ করবে, আল্লাহ তার দেহ-মনে এমন শক্তিমত্তা দান করবেন যে, সে শত ব্যস্ততার মাঝেও কাজ করে ক্লান্ত হবে না।[42] অর্থাৎ কেউ যদি ঘুমের আগে পঠিতব্য এই যিকরে অভ্যস্ত হয়, তবে আল্লাহ তাকে এমন শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য দান করবেন যে, সে একাই কয়েকজন মানুষের সমান শক্তি নিয়ে কাজ করতে সক্ষম হবে এবং তার কর্মেদ্যোমে কখনো ভাটা পড়বে না।

ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, যিকরের মাধ্যমে যিকরকারী এমন শক্তিমত্তার অধিকারী হয়, যা সে কল্পনাই করতে পারবে না। আমি শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়ার মাঝে এই শক্তিমত্তার বিস্ময়কর প্রভাব দেখেছি। তিনি একদিনে যে লেখালেখি করতেন, সেই লেখার অনুলিপি করতে লিপিকারদের এক সপ্তাহের বেশী সময় লেগে যেত। তিনি জিহাদের ময়দানেও ছিলেন প্রচন্ড শক্তিশালী বীর। তার এই শক্তিমত্তার মূল উৎস ছিল যিক্র-আযকার।[43] ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) ফজরের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত কারো সাথে কথা বলতেন না; বরং যিক্রে নিমগ্ন থাকতেন। যখনই সময় পেতেন আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন হয়ে যেতেন। ফলে তিনি শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে এবং সময়ে এলাহী তাওফীক্ব অর্জন করে এমন কিছু করতে সক্ষম হয়ে ছিলেন, যা স্বাভাবিকভাবে অন্য কারু পক্ষে সম্ভব ছিল না।

যিকরের মাধ্যমে তাওফীক্ব লাভের উদাহরণ দিয়ে শায়খুল ইসলাম বলেন, ‘যখন আরশ বহন করার জন্য ফেরেশতাদের নির্দেশ দেওয়া হ’ল, তখন ফেরেশতারা বলল, হে আমাদের রব! আমরা কিভাবে আপনার আরশ বহন করব, অথচ এর

উপরে আপনার বড়ত্ব ও মহত্ব প্রতিষ্ঠিত? তখন আল্লাহ বললেন, তোমরা বল, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা-বিল্লা-হ’। ফেরেশতার যখন এই বাক্যটি বলল, তখন তারা আরশ বহনে সক্ষম হয়ে গেল।[44] সুতরাং আমরাও যদি আমাদের ইবাদত-বন্দেগীতে, কাজ-কর্মে, লেখাপড়া-গবেষণায় প্রভৃতি ক্ষেত্রে এলাহী তাওফীক্ব হাছিল করতে চাই, তবে আমাদেরকে বেশী বেশী আল্লাহর যিক্র করা উচিত। মহান আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!

আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ

এমফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


[1]. মুহাম্মাদ ইবনে মুখতার আশ-শানক্বীতী, মা‘আলিমু তারবাবিইয়াহ, পৃ. ৩৯।

[2]. বুখারী হা/২৮০৮।

[3]. বিস্তারিত দ্রঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুল রাসূল (ছাঃ), পৃ. ৩৮০-৩৮১।

[4]. আত-তাফসীরুল মুয়াস্সার ১/২০৯।

[5]. আবুল লাইছ সামারকান্দী, তাম্বীহুল গাফিলীন, পৃ. ৩৩।

[6]. ইবনুল ক্বাইয়িম, রওযাতুল মুহিববীন, পৃ. ৬৪০।

[7]. সাফ্ফারীনী, গিযাউল আলবাব, ২/৪৫৮।

[8]. আব্দুল আযীয সালমান, মাওয়ারিযুয যামআন ৩/১৮৬।

[9]. মুসলিম হা/২৩৩; রাবী আবূ হুরায়রা (রাঃ)।

[10]. ইবনে তায়মিয়া, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২/৩০৪; ইবনু আবী ইয়া‘লা, তাবাক্বাতুল হানাবিলা ২/৪১; খত্বীব বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ ১৪/১৩৬।

[11]. সূরা তাহরীম ৬৬/৮।

[12]. তাফসীর কুরতুবী, ১৮/৩০২-৩০৩।

[13]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৮/২৩৩ পৃ.।

[14]. কূতুল কুলূব ফী মু‘আমালাতিল মাহবূব, ১/১৫৭।

[15]. আবূদাঊদ হা/৫৪৭; মিশকাত হা/১০৬৭; সনদ হাসান।

[16]. শাওকানী, ফাৎহুল কাদীর ২/৫৮৯।

[17]. আবুল হাসান আল-মাওয়ার্দী, আহকামুস সুলতানিয়াহ, পৃ. ৮০।

[18]. ইবনে তায়মিয়াহ, আমরাযুল কুলূব ওয়া শিফাউহা, পৃ. ৫১।

[19]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন ১/১০৩।

[20]. তাফসীরে কুরতুবী ১৬/১৮।

[21]. তাফসীরে ক্বাসেমী (মাহাসিনুত তা’বীল) ৮/৩৬২।

[22]. তিরমিযী হা/২৪৬৫, সনদ ছহীহ।

[23]. তাফসীরে মারাগী ৩/৪২।

[24]. বুখারী হা/৭১; মুসলিম হা/১০৩৭।

[25]. আব্দুল কারীম আল-খুযাইর, শারহু কিতাবিল ইলম লি আবী খাইছামা, ১/১১।

[26]. আবূ নু‘আইম আস্ফাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া ২/৩৭৮।

[27]. মুহাম্মাদ খাদেমী, বারীক্বাহ মাহমূদিয়্যাহ ১/২৯৯।

[28]. ড. সাঈদ আল-ক্বাহত্বানী, নূরুত তাক্বওয়া ওয়া যুলুমাতুন নূর, পৃ. ২১

[29]. বুখারী হা/১৩৬২; মিশকাত হা/৮৫।

[30]. ইবনু রজব হাম্বলী, জামে‘উল উলূম ওয়াল হিকাম ২/১৩৭।

[31]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মিফতাহু দারিস সা‘আদাত, ১/২৯৯; আরশীফু মুলতাক্বা আহলিল হাদীছ, পৃ. ৩২১।

[32]. হিলয়াতুল আওলিয়া ২/১৭৭; ইবনুল জাওযী ছিফাতুছ ছাফওয়া ১/৩৪৯।

[33]. তিরমিযী হা/২১৬৫; মিশকাত হা/৬০১২, সনদ ছহীহ।

[34]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার, ৮/৩৬১।

[35]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৮/৩১৮।

[36]. ইবনু সা‘দ, আত-তাবাক্বাতুল কুবরা ৭/১৪৯।

[37]. তিরমিযী হা/ ২৮৬৩; ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৫, সনদ ছহীহ।

[38]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ওয়াবিলুছ ছাইয়িব, পৃ. ৩৭।

[39]. ইবনু মাজাহ হা/৩৭৯২; মিশকাত হা/২২৮৫, সনদ ছহীহ।

[40]. বুখারী হা/৩৭০৫; মুসলিম হা/২৭২৭; মিশকাত হা/২৩৮৭।

[41]. আহমাদ হা/১২২৯; সনদ ছহীহ।

[42]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-কালিমুত ত্বাইয়িব, পৃ.২৮; আল-মুস্তাদরাক আলা মাজমূ‘ইল ফাতাওয়া ১/১৫৭।

[43]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ওয়াবিলুছ ছাইয়িব, পৃ. ৭৭।

[44]. আল-মুস্তাদরাক আলা মাজমূ‘ইল ফাতাওয়া ১/১৫৮; আল-ওয়াবিলুছ ছাইয়িব, পৃ. ৭৭।






লাইলাতুল মি‘রাজ রজনীতে করণীয় ও বর্জনীয় - আত-তাহরীক ডেস্ক
আল-কুরআনের আলোকে জাহান্নামের বিবরণ (শেষ কিস্তি) - বযলুর রশীদ
প্রগতি ও সংকট - আফতাব আহমদ রহমানী
যে সকল কর্ম লা‘নত ডেকে আনে (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
ছাওম ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞান - শামসুল আলম
ইসলামে শিষ্টাচারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মাদ্রাসার পাঠ্যবই সমূহের অন্তরালে (৫ম কিস্তি) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
অশ্লীলতার পরিণাম ঘাতক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব - লিলবর আল-বারাদী - যশপুর, তানোর, রাজশাহী
হজ্জের ন্যায় ফযীলতপূর্ণ আমল - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আমানত (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
আরও
আরও
.