বিশ্বে
প্রথমবারের মতো দেশের জাতীয় মাছ ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং
সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড.
মুহাম্মাদ শামসুল আলমের নেতৃত্বে গবেষক দলের অন্যান্যরা হলেন পোল্ট্রি
বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান মোল্লা, বায়োটেকনোলজি
বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ শহীদুল ইসলাম ও ফিশারিজ বায়োলজি এন্ড
জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ গোলাম কাদের খান। গত ৮ই সেপ্টেম্বর
শনিবার সকাল ৯-টার দিকে বাকৃবি সাংবাদিক সমিতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ
সম্মেলনে এই কথা জানান গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ শামসুল
আলম। তিনি জানান, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে দুই বছর গবেষণার পর এ সাফল্য
পেয়েছেন তারা। প্রথমে দেশের বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা থেকে পূর্ণবয়স্ক ইলিশ মাছ
সংগ্রহ করেন তারা। এরপর বাকৃবি ফিস জেনেটিক্স এন্ড বায়োটেকনোলজি এবং
পোল্ট্রি বায়োটেকনোলজি এন্ড জিনোমি ল্যাবরেটরি থেকে সংগৃহীত ইলিশের উচ্চ
গুণগত মানের জিনোমিক ডিএনএ প্রস্ত্তত করা হয়। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের
জিনউইজ জিনোম সিকোয়েন্সিং সেন্টার থেকে সংগৃহীত ইলিশের পৃথকভাবে প্রাথমিক
জিনোম তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের উচ্চ ক্ষমতা
সম্পন্ন সার্ভার কম্পিউটারে বিভিন্ন বায়োইনফরম্যাটিক্স প্রোগ্রাম ব্যবহার
করে সংগৃহীত প্রাথমিক তথ্য থেকে ইলিশের পূর্ণাঙ্গ ডি-নোভো জিনোম সিকুয়েন্স
বা জীবন রহস্য আবিষ্কার করা হয়। ইলিশের জিনোমে ৭৬ লক্ষ ৮০ হাযার
নিউক্লিওটাইড রয়েছে, যা মানুষের জিনোমের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। তবে পূর্ণাঙ্গ
জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে ইলিশ জিনোমে জিনের সংখ্যা জানার কাজ অব্যাহত
রয়েছে বলেও জানান তিনি।
বর্তমানে ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স অবহিত হওয়ার মাধ্যমে অসংখ্য অজানা প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে খুব সহজেই। বাংলাদেশের পানিসীমার মধ্যে ইলিশের স্টকের সংখ্যা (একটি এলাকায় মাছের বিস্তৃতির পরিসীমা) কতটি এবং দেশের পদ্মা ও মেঘনা নদীর মোহনায় প্রজননকারী ইলিশগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্টক কি-না তা জানা যাবে এই জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে। বছরে দুইবার ইলিশ প্রজনন করে থাকে।
জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে এই দুই সময়ের ইলিশ জীনগতভাবে পৃথক কি-না তা জানা যাবে। এমনকি কোন নির্দিষ্ট নদীতে জন্ম নেয়া পোনা সাগরে যাওয়ার পর বড় হয়ে প্রজননের জন্য আবার একই নদীতেই ফিরে আসে কি-না সেসব তথ্যও জানা যাবে এই জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে। ইলিশ মাছের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের প্রয়োজনীতা সম্পর্কে প্রধান গবেষক প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ শামসুল আলম বলেন, ইলিশ (Tenualosa ilisha) বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। দেশে এর চাহিদার পাশাপাশি বিদেশেও চাহিদা রয়েছে প্রচুর। যেহেতু পৃথিবীর মোট ইলিশ উৎপাদনের প্রায় ষাট ভাগ উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। তাই দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। আর ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে আমাদের জানতে হবে এর জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজননসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। যেহেতু জিনোম হচ্ছে কোন জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। জীবের জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াসহ সকল জৈবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় জিনোম দ্বারা। আর এই পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকুয়েন্স থেকেই জানা যাবে এরা কখন, কোথায় ডিম দেবে। আর এসব জানা গেলে সরকার খুব সহজেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে ইলিশের টেকসই আহরণ এবং উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারবে।
তিনি আরও জানান, ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশীয় ইলিশের একটি রেফারেন্স জিনোম প্রস্ত্তত করা এবং জিনোমিক তথ্যভান্ডার স্থাপন করা। এই তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে পরবর্তীতে গবেষকরা ইলিশের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করতে পারবেন। তবে ইলিশের সার্বিক উন্নয়নে পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং বা জীবন রহস্য উদঘাটনের এই জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ফলপ্রসূভাবে কাজে লাগাতে হ’লে এ বিষয়ে গবেষণা আরও জোরদার করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা।
উল্লেখ্য যে, জাতীয় মাছ ইলিশের পূর্ণাঙ্গ ডি-নোভো জিনোম সিকোয়েন্সিং-এর গবেষণা কার্যক্রমটি গবেষকবৃন্দের নিজস্ব উদ্যোগ, স্বেচ্ছাশ্রম এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়েছে। এ গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলদেশের মৎস্য সেক্টর পূর্ণাঙ্গ জিনোম গবেষণার যুগে প্রবেশ করল।
গবেষকগণ বলেন, জীবন রহস্য উম্মোচনের মাধ্যমে ইলিশ গবেষণার একটি প্রশস্ত দরজা খুলে গেল। তবে এটি জানতে ও বুঝতে আমাদের আরো সময় লাগবে। এ থেকে সুফল পেতে আরো ধারাবাহিক গবেষণা প্রয়োজন। ইলিশ রক্ষায় অনেক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। যেমন অভাশ্রয়ম প্রতিষ্ঠা, নির্দিষ্ট সময়ে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা ইত্যাদি। এটা সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে হচ্ছে কিনা, ইলিশ সাগর থেকে নদীতে কেন আসে, আবার প্রজননের পর আদৌ সাগরে ফিরে যায় কি-না এমন অনেক তথ্যই আমরা আবিষ্কৃত জিনোম সিকোয়েন্স থেকে জানতে পারব যা ইলিশের টেকসই আহরণ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে।
গবেষক দলের প্রধান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ সামসুল আলম বলেছেন, ইলিশের জীবন রহস্য উম্মোচনের গবেষণার ক্রেডিটকে হ্যাইজাক করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। ইলিশের জীবন রহস্য উম্মোচনের গবেষণার কাজটি তারাই প্রথম করেছেন। সম্প্রতি এটি নিয়ে দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উঠলেও এর দাবীদার কেবল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
[আমরা গবেষকদলের এই শুভ উদ্যোগ ও সফলতাকে সাধুবাদ জানাই। আল্লাহ এভাবেই তার বিভিন্ন বান্দাকে দিয়ে তার সৃষ্টি রহস্য উদঘাটন করে থাকেন। যাতে মানুষ তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে ও তার প্রতি সিজদাবনত হয় (স.স.)]