প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য থেকে শুরু করে অব্যবহৃত বর্জ্যগুলো থেকে এক টন বর্জ্যে ১৩শ’ লিটার ডিজেল, ১০টি সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাস ও ২৩ লিটার অ্যাভিয়েশন বা জেট ফুয়েল উৎপাদনের যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত মার্কিন বিজ্ঞানী দম্পত্তি। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিজ্ঞানী ড. মইনুদ্দীন সরকার বাদল ও ড. আনজুমান সেলী শুধুমাত্র যন্ত্র আবিষ্কার করেননি, উৎপাদনও করেছেন। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই টেকনোলজি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে বাংলাদেশ নিজেদের মাতৃভূমি হওয়ায় এশিয়ার মধ্যে এটাকেই প্রাণকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে চান তারা। বিজ্ঞানী দম্পত্তির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

এই আবিষ্কারের ফলে যেমন ঢাকাসহ সারাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে, তেমনি খুব অল্প খরচে জ্বালানী উৎপাদন করে বাজারের চলমান চাহিদাও পূরণ করা সম্ভব হবে। তাদের আবিষ্কৃত মেশিনারিজ (যন্ত্রপাতি) দিয়ে বাংলাদেশে প্লান্ট (বর্জ্য থেকে জ্বালানী) তৈরী করতে চান। এজন্য সরকারী-বেসরকারী তথা ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন এই দম্পত্তি।

ড. মইনুদ্দীন সরকার জানান, পৃথিবীতে দিনে দিনে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বাড়ছে, সেই সঙ্গে আমাদের চার পাশে জমছে প্লাস্টিক বর্জ্য। যা হয়ে ওঠেছে আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। প্লাস্টিক পচনশীল নয় বিধায় মাটি হারাচ্ছে তার উর্বর শক্তি। খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, নদী তার নাব্যতা হারাচ্ছে। ড্রেনের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা রোধ হচ্ছে। ফলে মশা মাছির প্রকোপ বেড়েই যাচ্ছে এবং বৃষ্টি হ’লে শহরে নৌকা চালাতে হচ্ছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের প্রাদুর্ভাবে বন ও জলজ জীব বৈচিত্র ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে।

ড. মইনুদ্দীন বলেন, বাংলাদেশের বিশেষ করে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা কোন কিছুই ফেলনা নয়। প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য থেকে শুরু করে অব্যবহৃত বর্জ্যগুলো থেকে প্রতিটন বর্জ্যে ১৩০০ লিটার ডিজেল, ১০টি সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাস ও ২৩ লিটার অ্যাভিয়েশন বা জেট ফুয়েল উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থপনাকে পরিবেশ বান্ধব রেখে তাদের আবিষ্কৃত যন্ত্র দিয়ে প্লান্ট স্থাপন করে জ্বালানী তেল উৎপাদন করা সম্ভব। এই প্লান্ট থেকে উৎপাদিত প্রতি লিটার ডিজেলের দাম পড়বে ২০ বা ২১ টাকা। আর জেট ফুয়েল ও সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাস উৎপাদন এই খরচেই হয়ে যাবে। তবে এই প্লান্ট স্থাপনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী সহযোগিতা ও বিনিয়োগের প্রয়োজন।

তথ্যমতে, শুধু আমেরিকাতেই প্রতিবছর ৮০ বিলিয়ন পাউন্ড প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয়। যার মাত্র ছয় শতাংশ অর্থাৎ ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন পাউন্ড পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৮ মিলিয়ন মেট্রিকটন মিউনিসিপ্যাল সলিড ওয়াস্ট (এমএস ডবি­উ) বর্জ্য উৎপাদন হয়। যার মধ্যে ১৫ শতাংশই প্লাস্টিক অর্থাৎ ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন প্লাস্টিক। যার মাত্র ১০ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হয়। বাকিটা পরিবেশের ক্ষতি করছে। ১৯৫০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারাবিশ্বে প্রায় ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়েছে, যার মাত্র নয় শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ সম্ভব হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে গত ৮ই অক্টোবর সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক সংবাদ সম্মেলনেও তাদের আবিষ্কার নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন। নিজেদের গবেষণা নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ড. মইনুদ্দীন সরকার বলেন, ২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন টন বর্জ্যপ্লাস্টিক সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। যা প্রায় ৭০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তাই বর্জ্য প্লাস্টিকের সমস্যা সমাধানের জন্য ২০০৫ সাল থেকে আমরা গবেষণা শুরু করি। ২০১০ সালে প্লাস্টিক থেকে তেল উৎপাদনের একটি প্রযুক্তি ও তার পেটেন্ট তৈরী করি। যা নবায়নযোগ্য শক্তি, যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রায় দুই দশক গবেষণার পর সাফল্যের সাথে একটি প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে সক্ষম হই, যার প্রতি টন পরিত্যাক্ত প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য থেকে ১৩শ’ লিটার জ্বালানী তেল, ১০ সিলিন্ডার এল.পি.জি গ্যাস এবং ২৩ লিটার জেট ফুয়েল উৎপাদন করা সম্ভব।

তিনি বলেন, ‘নিজের গবেষণার সাফল্যকে বাস্তব রূপ দিতে আমেরিকায় নিউইয়র্কের ব্রিজপোর্ট ও নিউজার্সিতে প্লান্ট গড়ে তুলেছি। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক থেকে জ্বালানী উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলছি। উৎপাদন কোম্পানীর নাম ওয়াস্ট টেকনোলজিস এলএলসি, আমেরিকা। বর্তমানে কোম্পানীটি বাংলাদেশেও এ রকমের প্লান্ট করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এই কেন্দ্র স্থাপন হ’লে একাধারে যেমন দেশকে ক্ষতিকারক প্লাস্টিকের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে, তেমনি দেশের স্বল্পশিক্ষিত থেকে শুরু করে শিক্ষিত যুবকদের ব্যাপক কর্মসংস্থান ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভুমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। তখন আর হয়তো বিদেশ থেকে জ্বালানী আমদানী করার প্রয়োজন হবে না। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাও বাড়ানো যাবে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হিসাবে তারা এই দেশকেই গুরুত্ব দিতে চান। একারণেই এশিয়ার বর্জ্য প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের হাব হিসাবে (কেন্দ্র) পরিচিতি প্রদানের মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে দেশের আলাদা একটি জায়গা করে দিতে চান তারা।

ড. আনজুমান সেলী বলেন, প­াস্টিক ছাড়া বর্তমান পৃথিবীর কথা ভাবা যায় না। একুশ শতকে পৃথিবীর ব্যাপক পরিবর্তন মানুষকে প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলেছে। তারা নিয়মিতভাবে সহজলভ্য প­াস্টিক পণ্য ব্যবহার করছে। গবেষণায় দেখেছি, বিশ শতকে পৃথিবীতে উৎপাদিত হয়েছে ৬০০ কোটি টন প্লাস্টিক। যে প্লাস্টিক মানুষ ব্যবহার করে তা পরিবেশের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। কারণ প্লাস্টিকের ক্ষয় হয় না, নষ্ট হয় না। ড্রেন, নালা, শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। এর ফলে জলাবদ্ধতা তৈরী হয়। প্লাস্টিক বর্জ্যের ঝুঁকি মোকাবেলা ও বিকল্প জ্বালানী তৈরী নিয়ে গবেষণা শুরু করি। আমরা সফল হয়েছি। প্লাস্টিক আসলে এক ধরনের অশোধিত তেল। এ তেল ঠান্ডা করে যে কোন আকৃতি দেওয়া যায় ও সংরক্ষণ করা যায়। এর একটি অংশ দিয়ে শপিং ব্যাগ, পাত্র, খেলনা ও নানা রকমের শো-পিস তৈরী করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। সেসব বাধা অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে উৎপন্ন ৯৫ শতাংশ তেল, বাকি দুই ভাগ হালকা গ্যাস, দুই ভাগ সিস্টেম লস। এ প্রক্রিয়ায় কোন বর্জ্য অবশিষ্ট থাকবে না বলে দাবী করেন তিনি।

সূত্র মতে, বিজ্ঞানী দম্পত্তি ড. মইনুদ্দীন সরকার বাদল ও আনজুমান আরা সেলীর কোম্পানী ওয়াস্ট টেকনোলজিস এলএলসি, আমেরিকা-এর উৎপাদিত তেলের নাম এনএসআর ফুয়েল। ড. সরকার এ প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট, উদ্ভাবক ও বিজ্ঞানীদের প্রধান। আনজুমান আরা প্রতিষ্ঠানের কো-ফাউন্ডার ও নির্বাহী পরিচালক। এনএসআর ফুয়েলের বিশেষত্ব এটি পরিবেশবান্ধব। এতে কোন সালফার থাকবে না। অন্য যারা এ জ্বালানী তৈরী করছে তাতে সালফার রয়েছে। সালফার থাকার কারণে এগুলো যখন ব্যবহার হচ্ছে তখন বাতাসে সালফার-ডাই-অক্সাইড ছড়াচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। উল্লেখ্য, মইনুদ্দীন সরকার বাদল ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এমএসসি পাস করে বিদেশে পাড়ি জমান। ১৯৯৬ সালে লন্ডনের ম্যানচেস্টার ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে পি.এইচ.ডি অর্জন করেন। প্রায় একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান আনজুমান আরা সেলী। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে গবেষক হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তাইওয়ান, কানাডা ও নেদারল্যান্ডস, জার্মানীসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করেছেন এই দম্পত্তি। জন্মসূত্রে মইনুদ্দীন সরকার বাদল কুমিল­া ও ড. আনজুমান আরা সেলী বরিশালের বাসিন্দা।






আরও
আরও
.