আহলেহাদীছের বৈশিষ্ট্য সমূহ
গত কয়েক বছর থেকে আহলেহাদীছের বিরুদ্ধে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির বিষোদ্গার ও সহিংসতা চলছে। সম্প্রতি সেটা বেড়ে গেছে। তাতে যোগ দিয়েছেন সরকারী ও বিরোধী দলের কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধি। কোন কোন অঞ্চলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। এমতাবস্থায় মযলূম আহলেহাদীছদের পথ খোলা আছে দু’টি। ১- যেকোন মূল্যে নিজেদের বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমলের উপর দৃঢ় থাকা এবং ২- এজন্য ছবর ও ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্যা কামনা করা (বাক্বারাহ ২/৪৫)।
ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদাই হ’ল আহলেহাদীছের আক্বীদা। আর ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমল সেটাই, যা নবী যুগে ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে ছিল। পরবর্তীতে যেসব শিরকী ও বিদ‘আতী আক্বীদা ও রীতি-নীতি মুসলিম সমাজে চালু হয়েছে, আহলেহাদীছগণ সেসব থেকে মুক্ত। তারা সর্বদা বিশুদ্ধ ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এবং সমাজ সংস্কারে রত থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রেওয়াজপন্থী লোকেরা কোনরূপ সংস্কার পসন্দ করে না। বরং তারা উপদেশ দাতাদের শত্রু মনে করেন। বস্ত্ততঃ আদর্শ ও বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে মানুষের পরিচয় হয়। আহলেহাদীছের তেমনি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যার মাধ্যমে অন্যদের থেকে তাদের স্বাতন্ত্র্য ফুটে ওঠে। নিম্নে তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হ’ল।-
(১) আহলেহাদীছগণ আদমের সন্তান হিসাবে সকল মানুষের প্রতি সর্বোচ্চ মানবিক আচরণ প্রদর্শন করে থাকেন। অতঃপর একই ক্বিবলার অনুসারী সকল মুসলিমকে তারা ‘ভাই’ মনে করেন। আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে তারা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের অনুসরণ করেন। (২) তারা আল্লাহর নাম ও গুণাবলীকে আল্লাহর সত্তার সাথে অবিচ্ছিন্ন ও সনাতন বলে বিশ্বাস করেন। যা বান্দার নাম ও গুণাবলীর সাথে তুলনীয় নয়। তারা সরাসরি আল্লাহকে ডাকেন এবং তাঁকে ডাকার জন্য জীবিত বা মৃত কাউকে অসীলা বা শরীক সাব্যস্ত করেন না। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে আল্লাহর নাম ও গুণাবলী যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তারা সেভাবেই তা প্রকাশ্য অর্থে বিশ্বাস করেন। কোন রূপক কিংবা দূরতম ব্যাখ্যা করেন না বা অন্যের সদৃশ কল্পনা করেন না। তাদের নিকট আল্লাহ নিরাকার বা নির্গুণ সত্তা নন। বরং তাঁর নিজস্ব আকার আছে, যা তাঁর উপযোগী। যা কারু সাথে তুলনীয় নয়। তিনি সবকিছু শোনেন ও দেখেন (শূরা ৪২/১১)। যেমন ভিডিও-ক্যামেরা সবকিছু শোনে ও দেখে। তার আকার তার মত। যা অন্যের সাথে তুলনীয় নয়। আল্লাহ সাত আসমানের উপর আরশে সমুন্নীত। কিন্তু তাঁর জ্ঞান ও শক্তি সর্বত্র বিরাজিত। জান্নাতে মুমিনগণ আল্লাহকে মেঘমুক্ত আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় স্পষ্ট দেখবে’ (বুঃ মুঃ প্রভৃতি)। আর সেটাই হবে তাদের জন্য সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত (মুসলিম)। কিন্তু কাফির-মুনাফিকরা তাদের অবিশ্বাস ও কপট বিশ্বাসের কারণে তাঁকে দেখতে পাবে না (মুত্বাফফেফীন ৮৩/১৫)। আহলেহাদীছগণ সৃষ্টিকে সৃষ্টিকর্তার অংশ মনে করে ‘যত কল্লা তত আল্লাহ’ বলেন না। তারা বান্দার ক্বলবে আল্লাহর আরশ থাকে বা পীরের আত্মা ও মুরীদের আত্মা মিলিত হয়ে আল্লাহর পরমাত্মায় লীন হয়ে ফানা ফিল্লাহ ও বাক্বা বিল্লাহর প্রচলিত মা‘রেফতী ধারণাকে স্রেফ শয়তানী প্রতারণা মনে করেন। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে আল্লাহর নূর ধারণা করে তারা তাঁকে ‘নূরের নবী’ বলেন না। বরং তাঁকে ‘মানুষ নবী’ হিসাবে (কাহফ ১৮/১১০) বিশ্বাস করেন। তারা অতি যুক্তিবাদী ভ্রান্ত ফির্কা মু‘তাযিলাদের ন্যায় কুরআনকে মাখলূক্ব বা সৃষ্টবস্ত্ত বলেন না। বরং তাকে সরাসরি আল্লাহর কালাম হিসাবে বিশ্বাস করেন। যার প্রতিটি বাক্য, শব্দ ও বর্ণ সবই আল্লাহর। যা সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। যাকে পরিবর্তনকারী কেউ নেই (আন‘আম ৬/১১৫)। যাতে কোনভাবেই কোন মিথ্যা প্রবেশের সুযোগ নেই (হামীম সাজদাহ ৪১/৪২)। তারা ছহীহ হাদীছকে অহিয়ে গায়ের মাতলু মনে করেন। কেননা রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর অহি ব্যতীত শারঈ বিষয়ে কোন কথা বলতেন না (নাজম ৫৩/৩-৪) এবং তাঁর যবান থেকে হক ব্যতীত কোন কথা বের হতো না (আহমাদ হা/৬৫১০)। আহলেহাদীছদের নিকট বান্দা ‘ইচ্ছা ও কর্মশক্তিহীন বাধ্যগত জীব’ নয়। বরং সে তার কর্মশক্তি প্রয়োগে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী (দাহর ৭৬/৩)। তাদের নিকটে আল্লাহ হ’লেন ভাল-মন্দ সকল কর্মের স্রষ্টা (ছাফফাত ৩৭/৯৬) এবং বান্দা হ’ল কর্মের বাস্তবায়নকারী (জাছিয়াহ ৪৫/১৫)। আর সেকারণেই সে তার কর্মফল পাবে।
(৩) আহলেহাদীছের নিকটে ‘ঈমান’ হ’ল হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত নাম। যা আনুগত্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ও গোনাহে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। বিশ্বাস ও স্বীকৃতি হ’ল মূল এবং কর্ম হ’ল শাখা। যেটা না থাকলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না। খারেজীগণ তিনটি বিষয়কেই ঈমানের মূল হিসাবে গণ্য করেন। সেকারণ কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি তাদের মতে কাফের ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং তাদের রক্ত হালাল। এদের বিপরীতে জাহমিয়াগণ কেবল বিশ্বাসকে এবং মুরজিয়াগণ বিশ্বাস ও স্বীকৃতিকেই ‘ঈমান’ বলেন। ‘কর্ম’ ঈমানের অংশ নয় এবং ঈমানের কোন হ্রাস-বৃদ্ধি নেই। ফলে তাদের মতে ছালাত-ছিয়ামে ঈমান বৃদ্ধি পায় না বা যেনা ও মদ্যপানে ঈমান হ্রাস পায় না। সেকারণ কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি তাদের নিকট পূর্ণ ঈমানদার। আমলহীন শৈথিল্যবাদী মুসলমানদের অধিকাংশ নামে-বেনামে এই দলভুক্ত। পক্ষান্তরে খারেজী আক্বীদার অনুসারীরা চরমপন্থী হয়ে থাকে। উক্ত দুই চরমপন্থী ও শৈথিল্যবাদী আক্বীদার মধ্যবর্তী হ’ল আহলেহাদীছের আক্বীদা। এই আক্বীদার অনুসারীগণ কবীরা গোনাহগার ব্যক্তিকে কাফের বলেন না। বরং ফাসেক বা ত্রুটিপূর্ণ ঈমানদার বলেন। আর এটাই হ’ল আহলে সুন্নাতের বিশুদ্ধ আক্বীদা।
(৪) আহলেহাদীছের আক্বীদা মতে ইবাদতের জন্য যেমন আল্লাহ্কে একক গণ্য করতে হবে, অনুসরণের জন্য তেমনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে একক গণ্য করতে হবে। ইবাদাত ও মু‘আমালাত সকল ক্ষেত্রেই এই নীতি প্রযোজ্য। এক্ষণে যারা মানুষের জীবনকে বিচ্ছিন্ন ভাবেন এবং বৈষয়িক ব্যাপারসমূহ পরিচালনার জন্য ইসলামী শরী‘আত যথেষ্ট নয় বরং নিজেদের মনগড়া আইনকে আল্লাহর আইনের চাইতে উত্তম বলে মনে করেন, তারা প্রকারান্তরে মানবজাতির বৈষয়িক বিষয় সমূহের জন্য আরেকজন রাসূল কামনা করেন (নাঊযুবিল্লাহ)। এভাবে একদল লোক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মানুষের ‘রব’-এর আসন দখল করে আছে। অথচ সকল ক্ষেত্রেই কেবল আল্লাহর দাসত্ব কাম্য (যারিয়াত ৫১/৫৬)। (৫) আহলেহাদীছগণ শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত ইসলামী শরী‘আতের যথাযথ ও সার্বিক অনুসরণকে (বাক্বারাহ ২/২০৮) মানবজাতির ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তির আবশ্যিক পূর্বশর্ত বলে বিশ্বাস করেন। (৬) আহলেহাদীছগণ আক্বীদা ও আহকাম বিষয়ে ‘যঈফ’ হাদীছ থেকে দলীল গ্রহণ করেন না এবং ‘মুতাওয়াতির’ ও ‘আহা-দ’ পর্যায়ের ছহীহ হাদীছকে ইসলামী আইনের উৎস হিসাবে গণ্য করেন।
(৭) আহলেহাদীছগণ বিশ্বাস করেন যে, ক্বিয়ামতের দিন কবীরা গোনাহগারদের জন্য আল্লাহর হুকুমে রাসূল (ছাঃ) শাফা‘আত করবেন। সেকারণ দুনিয়ায় থাকতে আগেভাগে কাউকে আল্লাহর নিকট সুফারিশকারী বা অসীলা সাব্যস্ত করার কোন উপায় নেই। এই অসীলা বেছে নেওয়ার ফলেই ইহূদী-নাছারা ও মুশরিকগণ দুনিয়াতে একদল লোককে রব-এর আসনে বসিয়েছে। ভ্রান্ত মুসলমানরাও সেটা করে থাকে। (৮) আহলেহাদীছগণ খতমে নবুঅতে বিশ্বাসী এবং এই বিশ্বাসকে মুমিন হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত বলে মনে করেন। যারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে শেষনবী হিসাবে মানতে অস্বীকার করে বা তাতে সন্দেহ পোষণ করে, তারা নিঃসন্দেহে ‘কাফির’। (৯) আহলেহাদীছগণ কারামাতে আউলিয়ায় বিশ্বাস করেন। এটি আল্লাহর পক্ষ হ’তে তাঁর কোন নেক বান্দার প্রতি কারামত বা বিশেষ সম্মান প্রদর্শন বৈ কিছু নয়। এতে বান্দার কোন এখতিয়ার নেই। বিগত যুগে মূসা ও ঈসা (আঃ)-এর মাকে এবং ইসলামী যুগে অনেক ছাহাবী-তাবেঈকে আল্লাহ এই কারামত প্রদান করেছেন। যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে। এটি শরী‘আতের কোন দলীল নয় বা এজন্য কেউ আল্লাহর পক্ষ হ’তে ‘বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত’ ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হবেন না। (১০) আহলেহাদীছগণ ভাল-মন্দ সকল ইমামের পিছনে ছালাত জায়েয বলেন এবং ভাল-মন্দ সকল মুসলিম শাসকের আনুগত্য করেন। যদিও শরী‘আত বিরোধী কোন হুকুম মানতে মুসলিম প্রজাসাধারণ বাধ্য নন। শাসক অপসন্দনীয় হ’লে তারা ছবর করেন ও তার হেদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করেন। কিন্তু কোন অবস্থায় বিদ্রোহ ও বিপর্যয় সৃষ্টি জায়েয মনে করেন না।
(১১) আহলেহাদীছগণ বিশ্বাস করেন যে, ছালাত-ছিয়াম, যাকাত-হজ্জ প্রভৃতি ইবাদতের বিষয়গুলি তাওক্বীফী। যাতে কোনরূপ কমবেশী করার অধিকার কারু নেই। এসব বিষয়ে ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত বিষয়গুলিই মাত্র গ্রহণীয়। বাকী সবই পরিত্যাজ্য। বিশেষ করে ছালাত হ’ল সবার উপরে। যে বিষয়ে ক্বিয়ামতের দিন প্রথম প্রশ্ন করা হবে। এটি সঠিক হ’লে বাকী সব আমল সঠিক বলে গণ্য হবে। আর এটি বেঠিক হ’লে বাকী সব আমল ব্যর্থ হবে (ছহীহাহ হা/১৩৫৮; মিশকাত হা/১৩৩০)। সেকারণ স্বয়ং জিব্রীল এসে রাসূল (ছাঃ)-কে ছালাতের বাস্তব প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং রাসূল (ছাঃ) স্বীয় উম্মতকে বলেছেন, তোমরা ছালাত আদায় কর, যেভাবে আমাকে ছালাত আদায় করতে দেখছ (বুখারী হা/৬৩১)। উক্ত ছালাত অসংখ্য ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। অথচ উপমহাদেশে এই ছালাতই সবচেয়ে বেশী মাযহাবী হামলার শিকার হয়েছে। যেমন (ক) ওযূ-ছালাত, ছিয়াম ও হজ্জ সহ প্রত্যেক ইবাদতের শুরুতে নিয়ত পাঠ করা। অথচ নিয়ত অর্থ হৃদয়ে সংকল্প করা। মুখে নিয়ত পাঠ করা সম্পূর্ণরূপে বিদ‘আতী প্রথা। (খ) ওযূতে গর্দান মাসাহ করা। অতঃপর ছালাত শুরুর আগে জায়নামাযের দো‘আ পাঠ করা ও পরে নাওয়ায়তু আন পড়া। (গ) কাতারে দুই মুছল্লীর মাঝে ফাঁক রাখা। ঐ ফাঁকা স্থানে হাদীছের ভাষায় ‘শয়তান ছোট কালো বকরীর ন্যায় ঢুকে পড়ে’ (আবুদাঊদ হা/৬৬৬-৬৭)। অথচ আমরা সেটাই করছি। (ঘ) পুরুষের জন্য নাভীর নীচে হাত বাঁধা ও মহিলাদের জন্য বুকে হাত বাঁধা। অথচ নারী-পুরুষ সকলের জন্য বুকে হাত বাঁধা সুন্নাত। রাসূল (ছাঃ) থেকে এর বিপরীত কিছুই বর্ণিত হয়নি এবং এটাই জমহূর ছাহাবা ও তাবেঈনের অনুসৃত পদ্ধতি (নায়লুল আওত্বার প্রভৃতি)। (ঙ) জেহরী ছালাতে মুক্তাদীর জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ না করা। অথচ এটি পাঠ না করলে ছালাতই হয় না (বুখারী-মুসলিম প্রভৃতি)। অসংখ্য ছহীহ হাদীছ ছাড়াও অধিকাংশ ছাহাবী-তাবেঈ ও প্রসিদ্ধ চার ইমামের তিন ইমাম উক্ত আমল করতেন। মুখে চার মাযহাব ফরয বললেও তাক্বলীদের কারণে তারা কেবল নিজেদেরটাই মানেন, অন্যদেরটা মানতে নিষেধ করেন। পক্ষান্তরে আহলেহাদীছগণ নিরপেক্ষভাবে চার মাযহাবের ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক মাসআলাগুলি মেনে চলেন। (চ) জেহরী ছালাতে ইমাম-মুক্তাদী সকলের জন্য সূরা ফাতিহা শেষে সশব্দে আমীন বলা সুন্নাত। যা বুখারী-মুসলিম সহ অসংখ্য ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত এবং ছাহাবা, তাবেঈন ও মুজতাহিদ ইমামগণ দ্বারা পালিত। অথচ মাযহাবী তাক্বলীদের কারণে এদেশে এ সুন্নাতটি পরিত্যক্ত। (ছ) ছালাতে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। যার পক্ষে ছহীহ হাদীছ ও আছারের সংখ্যা অন্যূন চারশত। যা ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ভুক্ত। অথচ এই সুন্নাতটিও পরিত্যক্ত হয়েছে কেবল মাযহাবী কারণে। (জ) একই কারণে দুই সিজদার মধ্যবর্তী বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ দো‘আটিও পরিত্যক্ত হয়েছে (মিশকাত হা/৯০০ প্রভৃতি)। যার ফলে ছালাত হয়ে পড়েছে দ্রুত ও কাকের ঠোকরের মত। এরপর রয়েছে সালাম ফিরানোর পর দলবদ্ধ মুনাজাত এবং রয়েছে আখেরী মুনাজাত। যার কোন ভিত্তি নেই। (ঝ) তারাবীহর ছালাতে বিতর সহ ১১ রাক‘আতের সুন্নাত বাতিল হয়ে গেছে। অথচ রাসূল (ছাঃ) রামাযান ও তার বাইরে কখনো ১১ বা ১৩ রাক‘আতের ঊর্ধ্বে রাত্রির নফল ছালাত আদায় করেননি (বুখারী, মুসলিম প্রভৃতি)। এছাড়া ১ রাক‘আত বিতরের সুন্নাত পরিত্যক্ত হয়েছে। (ঞ) ঈদায়নের ছালাতে প্রচলিত নিয়মে ৬ তাকবীর পাঠের পক্ষে ছহীহ-যঈফ কোন হাদীছ নেই। অথচ মাযহাবের দোহাই দিয়ে সেটাই চলছে এবং ১২ তাকবীরের বিশুদ্ধ সুন্নাত থেকে মানুষকে বিরত রাখা হয়েছে। (ট) মাতৃভাষায় জুম‘আর খুৎবা দান করা সুন্নাত। রাসূল (ছাঃ) নিজ মাতৃভাষা আরবীতে খুৎবা দিতেন। অথচ দু’টি খুৎবার সুন্নাত পরিত্যাগ করে মূল খুৎবার পূর্বে ‘বয়ানের’ নামে আরেকটি খুৎবা চালু করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণরূপে বিদ‘আতী প্রথা। (ঠ) জানাযার ছালাতে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়া সুন্নাত (বুখারী হা/১৩৩৫; নাসাঈ হা/১৯৮৭;, ৮৯)। অথচ সেই সুন্নাত পরিত্যক্ত হয়েছে এবং মুক্তাদীদের জোরে জোরে নিয়ত পাঠ করানো হচ্ছে। (ড) সফরে জমা ও ক্বছরের সহজ নিয়ম বাতিল হয়ে গেছে। এমনকি হজ্জের সময় আরাফাতের ময়দানেও এটি করা হয় না। অথচ রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম এটি করেছেন (বুখারী হা/১৬৬২)। এছাড়া মক্কা থেকে তানঈম বারবার ওমরাহ করা হয়। যার কোন ভিত্তি নেই (ঢ) এক মজলিসে তিন তালাককে তিন তালাক বায়েন গণ্য করা কুরআনী আইনের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তা চলছে কেবল মাযহাবের দোহাই দিয়ে। যার কুফল হিসাবে হিল্লার মত এক নোংরা জাহেলী প্রথাকে জায়েয করা হয়েছে। এভাবে অসংখ্য মুসলিম নারী-পুরুষ হর-হামেশা ধর্মের নামে এই নিকৃষ্ট প্রথার অসহায় শিকার হচ্ছে।
এছাড়া (১২) ধর্মের নামে মীলাদ-ক্বিয়াম, শবেবরাত, শবে মে‘রাজ, কুলখানী-চেহলাম প্রভৃতি বিদ‘আতী প্রথা সমূহ চালু করা হয়েছে। যেসবের কোন ভিত্তি নবী ও ছাহাবীগণের যামানায় ছিল না। (১৩) মৃত ব্যক্তি কখনো শুনতে পায় না এবং কারু কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না। কারণ দুনিয়াবী জীবন থেকে তাদের উপর পর্দা পড়ে যায় ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত (মুমিনূন ২৩/১০০)। অথচ কথিত পীর-আউলিয়াগণ কবরে থেকে ভক্তদের ভাল-মন্দ করার ক্ষমতা রাখেন, এরূপ ভিত্তিহীন ধারণা ছড়িয়ে দিয়ে যত্রতত্র চালু করা হয়েছে কবরপূজার জঘন্যতম শিরক। লাখো মুসলমান সেখানে নযর-নেয়ায নিয়ে হাযির হচ্ছে ও মৃত পীরবাবার আশীর্বাদ কামনা করছে।
যারা এসব শিরক ও বিদ‘আত থেকে তওবা করে ফিরে আসেন ও ছহীহ হাদীছের উপর আমল করেন, তারা তাদের বৈশিষ্ট্যগত কারণে ‘আহলেহাদীছ’ বলে অভিহিত হয়ে থাকেন। একারণেই তাদের পরিচালিত মসজিদগুলি ‘আহলেহাদীছ মসজিদ’ বলে পরিচিত। যদিও সেখানে সকল মুসলমানের ছালাতের অধিকার অবারিত। নবীযুগে মদীনায় মসজিদে বনু যুরায়েক্ব (বুখারী হা/৪২০), মসজিদে বনু মু‘আবিয়া (মুসলিম হা/২৮৯০) প্রভৃতি নামে পরিচিত মসজিদসমূহ ছিল। বস্ত্ততঃ সাধারণ মানুষ এখন দ্রুত বিশুদ্ধ ইসলামের দিকে ফিরে আসছে। আর সেটাই হ’ল বিরোধীদের গাত্রদাহের কারণ।
বড় বড় মাদ্রাসাগুলিতে সব ক্লাসে নিজেদের মাযহাবী ফিক্বহ পড়িয়ে শেষে দাওরা ক্লাসে একবছর কুতুবে সিত্তাহ পড়ানো বরকতের নামে হাদীছের সাথে তামাশা ছাড়া কি হ’তে পারে? এরপর বুখারী শরীফের শেষ হাদীছটি পড়িয়ে খতমে বুখারীর জমকালো অনুষ্ঠান করার অর্থ কি? অথচ বুখারীর হাদীছের উপর আমল নেই। এজন্যই তো তাদের অনূদিত ছহীহ বুখারীকে অনেক বিজ্ঞ পাঠক ‘রাদ্দুল বুখারী’ বলেন। একই অবস্থা অন্যান্য হাদীছের ও কুরআনের তাফসীরের। একজন শাফেঈ ও একজন আহলেহাদীছের ছালাতের নিয়ম একই। কিন্তু একজনের আনুগত্য তার মাযহাবের নিকট, অন্যজনের আনুগত্য হাদীছের নিকট। দু’জনের নেকী সমান হবে কি? তারা নিজ মাযহাবের আলোকে হাদীছের ব্যাখ্যা করেন ও মাযহাবী ফক্বীহ ও মুফতী সৃষ্টি করেন। পক্ষান্তরে আহলেহাদীছগণ নির্দিষ্টভাবে কারু রায়-এর ভিত্তিতে কুরআন-হাদীছ ব্যাখ্যা করেন না। বরং কুরআন-হাদীছের ভিত্তিতে রায়-এর ব্যাখ্যা করেন। এটিই আহলেহাদীছের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। আর মানুষের সার্বিক জীবনকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে পরিচালনার গভীর প্রেরণাই হ’ল ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনে’র নৈতিক ভিত্তি। এই ভিত্তি ধ্বংস করা কারু পক্ষে সম্ভব নয়। প্রকৃত আহলেহাদীছ কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সর্বোচ্চ মর্যাদা কখনোই ক্ষুণ্ণ করেন না।
আহলেহাদীছরা ১৯ শতকে ‘বৃটিশের অনুমোদিত নতুন দল’ বলে তাচ্ছিল্য করা বিজ্ঞদের জন্য শোভনীয় নয় (দ্রঃ থিসিস ২৭৫ পৃ.)। একইভাবে উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে আহলেহাদীছের কোন ভূমিকা ছিল না বলে যারা দাবী করেন, তারা সত্যকে পাশ কাটিয়ে যান। ইতিহাসের একজন সাধারণ পাঠকও জানেন বালাকোট-বাঁশের কেল্লা কাদের সোনালী উত্তরাধিকার। যখন শী‘আ-সুন্নী পীর-আউলিয়ারা ইংরেজ তোষণে ও দরগা-খানক্বাহ নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন, তখন আহলেহাদীছ নেতারা বৃটিশের গুলি ও জেল-যুলুমের লোভনীয় শিকার ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের খবর যারা রাখেন, তারাও সেখানে বহু আহলেহাদীছ ঘরের বীর সন্তানদের গৌরবময় ইতিহাস পাবেন। কিন্তু কোথাও একজন পীর-আউলিয়ার নাম খুঁজে পাওয়া যাবে কি? অতএব আহলেহাদীছদের মসজিদ-মাদ্রাসা দখল করার কপট চিন্তা ছেড়ে এবং সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি না করে জাতির মঙ্গল চিন্তা করুন।
পবিত্র রামাযান মাসে জুম‘আর দিন আলেমদের যেসব সংগঠন দলবল নিয়ে আহলেহাদীছ মসজিদ দখলের জন্য অশ্রাব্য গালি-গালাজ করে মিটিং-মিছিল করেন, তারা কোন স্তরের আলেম একবার ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। তারাতো কোন মদের আড্ডা বা ব্যভিচারের আড্ডা ভাঙতে যান না। তার চাইতে কি আহলেহাদীছের মসজিদ ভাঙ্গায় নেকী বেশী? তবুও ভালো যে তারা ৬৫৬ হিজরীতে বাগদাদে হানাফী-শাফেঈ দাঙ্গার সময় উভয় পক্ষের আলেমগণের ন্যায় রামাযানের ফরয ছিয়াম স্থগিতের ফৎওয়া দেননি (ফিরকাবন্দী ২৬ পৃ.)। আফসোস! শত আফসোস! এরাই আবার ইসলামী খেলাফত ও ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েমের শ্লোগান দেন। সর্বাগ্রে নিজেদের আচরণে ইসলাম কায়েম করুন। তারপর দেশে কায়েম করা যাবে কি-না ভেবে দেখবেন। পরিশেষে বলব, চার ইমামের নির্দেশ অনুযায়ী তাক্বলীদ ছেড়ে নিরপেক্ষভাবে ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করুন এবং মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের পথ দেখান। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন (স.স.)।