গত ৬ই ডিসেম্বর’১৭ বুধবার আমেরিকার প্রেসিডেণ্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ বায়তুল আক্বছা তথা যেরুসালেমকে অবৈধ ইহূদী রাষ্ট্র ইস্রাঈলের রাজধানী ঘোষণা করেছেন। যাদের রাষ্ট্র তারা ঘোষণা করার সাহস করেনি। ঘোষণা করলেন যিনি, তিনি সেই রাষ্ট্রের নাগরিক নন। এমনকি ইহূদীও নন, বরং খ্রিষ্টান। তাহ’লে কি স্বার্থ তাদের এখানে? তৃতীয় হারামটি দখলের পর তারা এগোবে বাকী দুই হারাম দখলের দিকে। ইতিমধ্যে দুই হারামের তত্ত্বাবধায়কদের তারা বগলদাবায় নিয়েছে। এর মাধ্যমে ট্রাম্প মুসলমানদের ঈমানের প্রতি তাচ্ছিল্য করেছেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ‘ভার্সাই চুক্তি’র বলে বৃটেন ফিলিস্তীনকে নিজ কব্জায় নিয়ে নেয়। অতঃপর ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর বৃটেন কর্তৃক ‘বেলফোর ঘোষণা’র ভিত্তিতে ১৯১৮ সাল থেকে বহিরাগত ইহূদীদের জন্য ফিলিস্তীনের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সাথে সাথে তাদের যাবতীয় নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণাধিকার নিয়ে আইন পাস করা হয়। ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে বহিরাগত ইহূদীরা এসে সেখানে বসতি স্থাপন শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে যখন বৃটেন ইস্রাঈল ত্যাগ করে, তখন ফিলিস্তীনের লোকসংখ্যা ছিল ১৯ লক্ষ ৫০ হাযার। যার মধ্যে দু’লাখ দেশীয় ইহূদী, ৪ লাখ বহিরাগত ইহূদী ও বাদ বাকী সাড়ে ১৩ লাখ সুন্নী মুসলিম।   

বৃটেন ফিলিস্তীন ত্যাগ করার সাথে সাথে ইহূদী নেতারা স্বাধীন ইস্রাঈল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন এবং তার কয়েক মিনিট পরেই আমেরিকা ইস্রাঈলকে স্বীকৃতি দেয়। অতঃপর ১৯৪৯ সালে বৃহৎ শক্তিবর্গ তাকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র করে নেয়। এরপর ইঙ্গ-মার্কিন ও ইস্রাঈলী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে ১০ লক্ষাধিক ফিলিস্তীনী মুসলিম স্বদেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আর ফিলিস্তীনে থেকে যায় মাত্র ২ লাখ ৪৭ হাযার নির্যাতিত আরব মুসলিম। এখন যারা ‘হামাস’ ও ‘ফাতাহ’ দুই নেতৃত্বের অধীনে বিভক্ত। ফিলিস্তীনের ৮০ শতাংশ ভূ-ভাগ দখল করে নেয় সন্ত্রাসী ইস্রাঈল। তখন থেকে এযাবৎ পর্যন্ত চলছে ফিলিস্তীনীদের রক্তঝরার ইতিহাস। চলছে পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহের শরণার্থী শিবিরগুলিতে ফিলিস্তীনীদের মানবেতর জীবন। এজন্য দায়ী কারা?

আল্লাহ বলেন, ‘ইহূদী-নাছারারা কখনোই তোমার উপর সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না তুমি তাদের ধর্মের অনুসরণ করবে। তুমি বল, নিশ্চয়ই আল্লাহর দেখানো পথই সঠিক পথ। আর যদি তুমি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর, তোমার নিকটে (অহি-র) জ্ঞান এসে যাওয়ার পরেও, তবে আল্লাহর কবল থেকে তোমাকে বাঁচাবার মতো কোন বন্ধু বা সাহায্যকারী নেই’ (বাক্বারাহ ২/১২০)। তিনি বলেন, ‘মুমিনগণ যেন মুমিনদের ছেড়ে কাফিরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে, আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে তোমরা যদি তাদের থেকে কোন অনিষ্টের আশংকা কর। আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর (প্রতিশোধ গ্রহণ) সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছেন। আর আল্লাহর কাছেই সবাইকে ফিরে যেতে হবে’ (আলে ইমরান ৩/২৮)। কুরআনের এই বাণী অগ্রাহ্য করে মুসলিম নেতারা ইহূদী-নাছারাদেরকেই বন্ধু রূপে গ্রহণ করেছেন। ফলে অবশ্যম্ভাবী রূপে আল্লাহর গযব এসে গেছে।

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের যে প্রস্তাবের ভিত্তিতে ফিলিস্তীন ভেঙে একদিকে ইহূদী রাষ্ট্র ইস্রাঈল, অন্যদিকে আরব ফিলিস্তীন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত হয়, তাতে যেরুসালেমের জন্য স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইস্রাঈল যুদ্ধের পর ইস্রাঈল পূর্ব ও পশ্চিম যেরুসালেম দখল করে নেয় এবং এককভাবে তা নিজ দেশের অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দেয়। সেই অন্তর্ভুক্তি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনো মেনে নেয়নি। ১৯৯৫ সালে ইস্রাঈল ও পিএলও স্বাক্ষরিত অসলো শান্তিচুক্তিতে উভয় পক্ষ মেনে নেয় যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে যেরুসালেমের প্রশ্নটি নির্ধারিত হবে। ১৯৪৭ সাল থেকে বিগত ৭০ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি অনুসরণ করে এসেছে। অথচ সেই নিয়ম ভেঙে প্রেসিডেণ্ট ট্রাম্প এই পবিত্র নগরীকে ইস্রাঈলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন এবং সেখানে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের নির্দেশ দিলেন। মুসলমানদের হাত থেকে যে পবিত্র ভূমি দখলের জন্য খ্রিষ্টান বিশ্ব ১০৯৫-১২৯১ খৃ. পর্যন্ত ১৯৬ বছর ক্রুসেড যুদ্ধ করেছে, সেটি এখন ট্রাম্পের কলমের এক খোঁচায় তাদের দখলে চলে গেল। যদিও ট্রাম্প দাবী করেছেন, শান্তিপ্রক্রিয়ায় নতুন পথ অনুসরণের জন্যই তার এই সিদ্ধান্ত। এতে কেউ কেউ অন্ধকারে আলোর রেখা দেখছেন। অর্থাৎ দুই পক্ষ চাইলে পূর্ব যেরুসালেমে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তীনী রাষ্ট্রের রাজধানীও হ’তে পারে। তাছাড়া পূর্বের ন্যায় আরব ও ইহূদীদের জন্য স্বতন্ত্র দু’টি রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন অব্যাহত থাকতে পারে।

মনে রাখা দরকার যে, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময় নেওয়া হ’ল, যখন ফিলিস্তীনী ও আরব বিশ্ব প্রবলভাবে বিভক্ত। ট্রাম্প তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করলেন মাত্র। কোন কোন আরব দেশ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানালেও এই প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট কোন পদক্ষেপ তারা নেবে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। তবে ওআইসি যদি সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সেটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলির সম্মতি আদায় করতে পারে, তাহ’লে ভেটোধারী আমেরিকাকে কোণঠাসা করা যাবে এবং তারা বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হবে।

যেরুসালেমের উপর ইহূদীদের দাবীর ভিত্তি হিসাবে পাশ্চাত্যে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে যে, ইহূদীরাই ফিলিস্তীনের আদিবাসী। তাদের প্রতিশ্রুত ইস্রাঈল রাষ্ট্র লোহিত সাগর থেকে জর্ডান পর্যন্ত বিস্তৃত। যার চিরকালীন রাজধানী হ’ল যেরুসালেম’। তাদের এই গল্পে বাধ সেঁধেছেন খোদ তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক শ্লোমো স্যান্ড। তিনি তাঁর ‘দি ইনভেনশন অব জুয়িশ পিপল’ এবং ‘দি ইনভেনশন অব ল্যান্ড অব ইস্রাঈল’ অর্থাৎ ‘ইহূদী জাতির আবিষ্কার’ এবং ‘ইস্রাঈল ভূমির আবিষ্কার’ গ্রন্থে এই দাবীকে ভুয়া প্রমাণ করেছেন। মূলতঃ ইহূদীদের উপর শত শত বছর ধরে অত্যাচার ও গণহত্যা চালানো পশ্চিমারা তাদের অপরাধবোধ থেকে বাঁচতে সর্বদা ইস্রাঈলের অন্যায্য দাবীর ব্যাপারে দুর্বল থাকে। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের তৈল সম্পদ ও সেখানকার ভূমি কব্জায় রাখতে ইস্রাঈলের মত একটি ধুরন্ধর অস্ত্র তাদের বড়ই প্রয়োজন।

মূলতঃ আজকের ফিলিস্তীনীরাই ফিলিস্তীনের আদি অধিবাসী। যারা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের পরপরই ইসলাম কবুল করেছিল। আর ইহূদীরাও কখনো জন্মগত ইহূদী ছিল না। তারাও পরবর্তীতে ধর্মান্তরিত ইহূদী। কিন্তু নবীদের অবাধ্যতা করার ও তাদের হত্যা করার কারণে আল্লাহর অভিশপ্ত (বাক্বারাহ ৬১) এই জাতি পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে সর্বদা নির্যাতিত ও বিতাড়িত হয়েছে। তারাই এক সময় ইহূদী ঘরের সন্তান হযরত ঈসা (আঃ)-কে নবুঅত দাবী করার অপরাধে(?) হত্যা করার চক্রান্ত করেছিল। আর আজকের জায়নবাদী ইহূদীরা হত্যা করছে সেদিনের ঈসার অনুসারী বনু ইস্রাঈলের উত্তরসূরী মুসলিম ফিলিস্তীনীদের। কিন্তু এটাই আল্লাহর ফায়ছালা যে, অভিশপ্ত ইহূদী ও পথভ্রষ্ট নাছারারা অবশ্যই ব্যর্থ হবে এবং ভূ-পৃষ্ঠের প্রতিটি ঝুপড়ি ঘরেও ইসলাম প্রবেশ করবে বিজয়ীর বেশে। তখন হয় ইহূদী-নাছারারা ইসলাম কবুল করে সম্মানিত হবে অথবা মুসলমানদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হবে’ (মিশকাত হা/৪২; ছহীহাহ হা/৩)

মুসলিম দেশগুলি পবিত্র কুরআনের আলোকে তাদের পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন না করার ফলেই ইহূদী-নাছারা পরাশক্তিগুলি আজ তাদের উপরে ছড়ি ঘুরানোর সুযোগ পেয়েছে। ২২টি রাষ্ট্রে বিভক্ত ‘আরব লীগ’ এবং ৫৭টি রাষ্ট্রে বিভক্ত ‘ওআইসি’ স্লাইস্ড পাউরুটির মত একটি শ্রুতিমধুর সংগঠন ব্যতীত কিছুই নয়। তবুও ইসলামী চেতনা ব্যতীত এদের এক হওয়ার অন্য কোন চেতনা নেই। বিপদ যখন মাথার উপরে, তখন তাদেরকে অন্য সব স্বার্থ পিছনে ফেলে বায়তুল আক্বছার পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহবান জানাচ্ছি এবং সেই সাথে মুসলিম রাষ্ট্রনেতাদেরকে কুরআনী নির্দেশের দিকে ফিরে আসার আহবান জানাচ্ছি। তারা যেন অতি দ্রুত ‘ওআইসি’-কে সক্রিয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক জোটে রূপান্তরিত করেন। তাহ’লে শুধু ইস্রাঈল নয়, কাশ্মীর, আফগানিস্তান, ইরাক ও মিয়ানমার সহ বিশ্বের সকল স্থান হ’তে মুসলিম নির্যাতন অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ বিষয়টি যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল। ইতিমধ্যেই গত ১৩ই ডিসেম্বর তুরষ্কের রাজধানীতে আয়োজিত ওআইসির ৬ষ্ঠ বিশেষ সম্মেলনে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং পূর্ব যেরুসালেমকে স্বাধীন ফিলিস্তীন রাষ্ট্রের রাজধানী ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও ঐ সম্মেলনে সঊদী আরব ও মিসর সহ কয়েকটি আরব রাষ্ট্রপ্রধান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যোগদান করেননি। বরং নিম্নস্তরের কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছেন। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন!

(এই সঙ্গে পাঠ করুন সম্পাদকীয় সমূহ : ৪/২ সংখ্যা নভেম্বর ২০০০, দিগদর্শন ১/২১৬ পৃ.; ৫/৭ সংখ্যা এপ্রিল-মে ২০০২ দিগদর্শন ১/২২৭ পৃ.; ৮/৩ সংখ্যা ডিসেম্বর ২০০৪ দিগদর্শন ১/২৪৬ পৃ. এবং ১৯/৩ সংখ্যা ডিসেম্বর ২০১৫)






রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি ব্যঙ্গোক্তি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বাংলা একাডেমীর বইমেলা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নির্বাচনী দ্বন্দ্ব নিরসনে আমাদের প্রস্তাব - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সত্য-মিথ্যার মানদন্ড - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নারীর উপর সহিংসতা : কারণ ও প্রতিকার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নৃশংসতার প্রাদুর্ভাব : কারণ ও প্রতিকার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শান্তির ধর্ম ইসলাম - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বাংলাদেশের সংবিধান হৌক ইসলাম - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হানাহানি কাম্য নয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বর্ণবাদী আমেরিকার মুক্তির পথ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার উপায় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.