সম্প্রতি ভারতের কর্ণাটক
রাজ্যের উদুপী যেলার সরকারী কলেজে কয়েক সপ্তাহ যাবত ৬ জন মুসলিম ছাত্রীর
হিজাব পরতে বাধা দেওয়া হয় এবং একে তাদের কলেজের ইউনিফর্ম বিরোধী বলে
আখ্যায়িত করা হয়। ফলে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে কলিকাতা সহ ভারতের প্রায় সকল বড় বড়
শহরে। ইতিমধ্যে এটি আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করেছে। ২০১৪ সালে নোবেল জয়ী
পাকিস্তানী তরুণী মালালা ইউসুফ জাই ভারত সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, মুসলিম
নারীদের কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা বন্ধ করুন!’ অন্য ঘটনায় ৮ই ফেব্রুয়ারী
মঙ্গলবার মান্ডিয়া যেলার মান্ডিয়া প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজে ‘মুসকান’ নামের
একজন মুসলিম ছাত্রীর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে যে, সে
নেক্বাব সহ সর্বাঙ্গ আবৃত ঢিলা-ঢালা কালো বোরকা পরে কলেজ ক্যাম্পাসে স্কুটি
থেকে নেমে তার ক্লাসের দিকে যাচ্ছে। পিছনে একদল গেরুয়া বসনধারী যুবক ‘জয়
শ্রীরাম’ শ্লোগান দিতে দিতে তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তখন মেয়েটি বাম হাত
উঁচিয়ে তাদের দিকে চিৎকার দিয়ে বারবার ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিচ্ছে। পরে
কলেজ কর্তৃপক্ষ এসে তাকে ভিতরে নিয়ে যায়। দৃশ্যটি সারা দুনিয়াকে নাড়িয়ে
দিয়েছে। নিঃসন্দেহে ‘মুসকান’ এখন সাহসের প্রতীক। পাকিস্তানের মালালার মতো
সেও এ বছর নোবেলজয়ী হবে বলে আশা করা যায়। ইতিমধ্যে ভারতের ‘জমঈয়তে ওলামায়ে
হিন্দ’ তার জন্য ৫ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করেছে। আমরাও তাকে অভিনন্দন
জানাচ্ছি এবং তার জন্য প্রাণখোলা দো‘আ করছি।
ইতিপূর্বে ২০১৯ সালে ডিসেম্বরের শেষ দিকে ভারতের পন্ডিচেরী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গণযোগাযোগ’ বিষয়ে মাস্টার্সে সর্বোচ্চ নম্বরধারী রাবেয়া আব্দুর রহীমকে স্রেফ হিজাবের কারণে পুলিশ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঢুকতে দেয়নি। যেখানে প্রধান অতিথি দেশের রাষ্ট্রপতির নিকট থেকে তার ‘স্বর্ণপদক’ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাধা পেয়ে সে স্বর্ণপদক ছেড়ে বাসায় ফিরে আসে। তাতে দেশব্যাপী তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এভাবে ভারতে এখন রাষ্ট্রীয় মদদে পদে পদে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন সে দেশের মুসলিম নাগরিকরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও চলছে নানা বর্ণ বৈষম্য। অথচ ভারতীয় সংবিধানের ১৪ ও ২৫ অনুচ্ছেদে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের মৌলিক ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আর এই বৈচিত্র্যকে সম্মান করার চেতনায় ভারতীয় জাতিরাষ্ট্রের বিকাশ ঘটেছে। সেখানে হিন্দুরা তিলক পরে, শিখরা দাড়ি ও পাগড়ি পরে, মুসলমানরা টুপী ও বোরকা পরে। এগুলি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। বর্তমানে যেটি হচ্ছে, সেটি রাজনীতিক নামধারী উগ্র ভোট ব্যবসায়ীদের কারসাজি মাত্র।
ভারতের বর্তমান হিন্দুত্ববাদী মোদী সরকারের বিপরীতে যদি আমরা নিউজিল্যান্ডের মহিলা প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডার তুলনা করি, তাহ’লে দেখব যে সেখানের ক্রাইস্টচার্চে ২০১৯ সালের ১৫ই মার্চ মুসলমানদের দু’টি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা হ’লে তিনি দ্রুত মুসলমানদের পক্ষে বিবৃতি দেন। পার্লামেন্টের যরূরী অধিবেশন আহবান করেন। নিজে সর্বাঙ্গ কালো পোশাকে ঢেকে পার্লামেন্টে আসেন। জুববা ও টুপী পরিহিত একজন মুসলিম আলেমকে পাশে বসিয়ে কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু করেন। ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি আসসালামু ‘আলায়কুম বলে বক্তব্য শুরু করেন। অতঃপর হামলার দিনটিকে তিনি মুসলিম কমিউনিটির জন্য ‘অন্ধকারতম দিবস’ হিসাবে আখ্যায়িত করেন। তিনি সন্ত্রাসীদের দ্রুত বিচারের আশ্বাস দেন এবং নিহত ৫২ জনের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা ও তাদের পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। তিনি দেশের সকল রেডিও ও টেলিভিশনকে নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত ও আযান প্রচারের নির্দেশ দেন। সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি ক্ষমতাসীন সরকারের এরূপ সহমর্মিতার নযীর এ যুগে বিরল। অথচ ভারতে ২৫ কোটি মুসলমানের বিপরীতে নিউজিল্যান্ডে ২০১৬ সালের হিসাবে মুসলিমদের সংখ্যা মাত্র ৪৬ হাযার। যা সেদেশের মোট জনসংখ্যার ১.১ শতাংশ। আর ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা ১৪.২ শতাংশ ২০১৯ সালের হিসাবে।
হিজাব নারীর অঙ্গভূষণ। এটি তার রক্ষাকবচ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এটি প্রত্যেক নারীর স্বভাবগত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য যথাযোগ্য পর্দা পালনের নির্দেশ দিয়েছে (নূর ২৪/৩০-৩১)। বিশেষভাবে নারীকে ঢিলা-ঢালা বড় চাদর পরিধানের মাধ্যমে সর্বাঙ্গ ঢাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে (আহযাব ৩৩/৫৯)। কে না জানে যেটি যত মূল্যবান, সেটিকে তত বেশী গোপন রাখতে হয়। মণি-মুক্তা, স্বর্ণ-রৌপ্য কি যেখানে-সেখানে পাওয়া যায়? খোসা ছাড়ানো কলা কি কেউ কিনে খেতে চায়? হরিণ ও ছাগল দু’টিই পশু। কিন্তু হরিণ কেন বনের মধ্যে গোপন থাকে? কারণ তার নাভিতে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ‘কস্ত্তরী’। যাকে ‘মৃগনাভি’ বলা হয়। নারীর গর্ভ থেকেই বেরিয়ে এসেছে পৃথিবীর সেরা সৃষ্টি নবী-রাসূল, সমাজনেতা-রাষ্ট্রনেতা ও যুগ সংস্কারকগণ। যারা বিশ্বের মৃগনাভি তুল্য। মাঠের ঘাস হয় শক্ত ও খসখসে। কিন্তু সেটি চাপা দিয়ে রাখলে সেগুলি হয় নরম ও মোলায়েম। যার অনুভূতি মানুষকে শিহরিত করে। পূণ্যশীলা নারী তেমনি নিরাশ হৃদয়ে আশার শিহরণ জাগিয়ে তোলে। চাকায় টায়ার-টিউব দু’টিই থাকে, কিন্তু টায়ার থাকে বাইরে এবং টিউব থাকে ভিতরে। যদি কেউ টিউবকে বাইরে ও টায়ারকে ভিতরে দিতে চায়, তাহ’লে গাড়ী অচল হয়ে যাবে। একইভাবে নারী ও পুরুষকে যথাযোগ্য স্থানে না রাখলে সমাজ ধ্বংস হবে। মানব সমাজের সবচাইতে মূল্যবান অংশ হ’ল নারী জাতি। পুরুষরা তাদের অভিভাবক (নিসা ৪/৩৪)। স্বামী, পুত্র, ভাই ও পিতা তার প্রধান চার রক্ষাব্যুহ। এছাড়াও নারীর সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পুরুষ সমাজের। তাদেরকে সে দায়িত্ব অবশ্যই পালন করতে হবে।
সৃষ্টিগতভাবেই পুরুষ ও নারীর শারীরিক ও মানসিক কাঠামো পৃথক। এই পার্থক্যকে অস্বীকার করা চৈত্রের খরতাপ ও বসন্তের পেলব-পরশকে অস্বীকার করার শামিল। নারীকে আল্লাহ আকর্ষণীয় করে সৃষ্টি করেছেন। তাই শালীন পোশাক তার জন্য অপরিহার্য। বাড়ির মালিক কোথাও বের হ’লে যেমন দরজা-জানালা বন্ধ করে বের হন, তেমনিভাবে নারী ঘরের বাইরে গেলে তার দৈহিক সৌন্দর্য্যকে নেক্বাব ও ঢিলা বোরকার আড়ালে লুকিয়ে বাইরে যাবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নারী হ’ল পর্দার জাতি। যখনই সে বের হয়, তখনই শয়তান তার দিকে চোখ তুলে তাকায়’ (তিরমিযী হা/১১৭৩; মিশকাত হা/৩১০৯)। আল্লাহ বলেন, নারীরা যেন এমনভাবে চলাফেরা না করে, যাতে তাদের গোপন সৌন্দর্য্য প্রকট হয়ে পড়ে’ (নূর ২৪/৩১)। হাদীছে পরপুরুষ ও পরনারীর পরস্পরের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ, পরস্পরের কণ্ঠস্বর, হাতের স্পর্শ, কুচিন্তা, অবৈধ উদ্দেশ্যে গমন সবকিছুকে ‘যেনা’ বলা হয়েছে। যার বাস্তবায়ন হয় ব্যভিচারের মাধ্যমে (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৮৬)। অতএব সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য হবে যেকোন মূল্যে নারীর মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করা এবং সমাজদেহকে কলুষমুক্ত রাখা। ভারত ও বাংলাদেশের সরকারগুলিকে আমরা এ বিষয়ে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার আহবান জানাই। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।