হঠাৎ শ্বাসকষ্ট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য আরিজোনার ফিনিক্স এরিনা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দু’দিন পর স্থানীয় সময় ৩রা জুন শুক্রবার দিবাগত রাতে ৭৪ বছর বয়সে মুহাম্মাদ আলী ক্লে ইন্তেকাল করেন। ইনণা লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। ১৯৮৪ সাল থেকে দীর্ঘ প্রায় ৩২ বছর ধরে তিনি দুরারোগ্য পারকিনসন্স রোগে ভুগছিলেন। ফলে তাঁর কথা বলার ক্ষমতা অনেকটাই কমে গিয়েছিল। সর্বশেষ এ বছরের এপ্রিল মাসে একটি সেলিব্রেটি ফাইট নাইট ডিনারে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। সেখান থেকে আয়কৃত অর্থ পারকিনসন্স রোগীদের চিকিৎসার কাজে ব্যয় করা হয়।
জন্ম ও বাল্যকাল :
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি রাজ্যের লুইসভিলে ১৯৪২ সালের ১৭ই জানুয়ারী এক খ্রিস্টান পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম ছিল ক্যাসিয়াস ক্লে জুনিয়র। ১২ বছর বয়সে তাঁর বাইসেইকেলটি চুরি হয়ে গেলে তিনি স্থানীয় থানায় গিয়ে পুলিশ অফিসারকে বলেন যত দ্রুত সম্ভব চোরকে খুজে বের করতে হবে এবং বলেন যে, তিনি নিজ হাতে চোরকে পিটাবেন। এতে জো মার্টিন নামের বক্সিং প্রশিক্ষক ঐ পুলিশ অফিসার তাকে বক্সিং শিখে তারপর চোরকে পিটানোর হুমকি দেয়া উচিৎ বলে মন্তব্য করেন। ফলে তার প্রশিক্ষণেই শুরু হয় তাঁর বক্সিং-য়ে হাতেখড়ি।
বক্সিং জগতে আলী :
১৯৬০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে প্রথমবারের মত বক্সিং-য়ে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হয়ে তিনি সারাবিশ্বে চমক সৃষ্টি করেন। অতঃপর ১৯৬৪ সালে ২২ বছর বয়সে দ্বিতীয়বারের মত চ্যাম্পিয়ন শিরোপা জয় করেন। এসময় তিনি ইসলাম কবুল করেন এবং নিজেকে একজন ‘মুসলিম’ বলে ঘোষণা করেন ও নাম পাল্টিয়ে ‘মুহাম্মাদ আলী’ নাম ধারণ করেন। ১৯৬৫ সালে তাঁকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগদানের আহবান জানানো হ’লে তিনি এ যুদ্ধকে ‘অনৈতিক’ বলে তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে মার্কিন সরকার তাঁর বক্সিং লাইসেন্স ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপের খেতাব কেড়ে নেয়। অতঃপর তিনি এর বিরুদ্ধে আড়াই বছর যাবৎ আইনী লড়াই করে জিতে যান ও চ্যাম্পিয়নশীপের খেতাব ফিরে পান। অতঃপর রিংয়ে ফিরে এসে তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন জর্জ ফোরম্যানকে পরাজিত করে পুনরায় বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন। এরপর ১৯৭৪ সালের বিশ্ব অলিম্পিকে তখনকার বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন জো ফ্রেজিয়ারকে হারিয়ে তৃতীয়বারের মত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন। যে রেকর্ড আজ পর্যন্ত কেউই ভাঙতে পারেনি। ১৯৮১ সালে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত ৩০ বছরের ক্যারিয়ারে সর্বমোট ৬১টি লড়াইয়ের মধ্যে ৫৬টিতে জিতে তিনি এক অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করেন।
ইসলাম ও মানবতার সেবায় আলী :
আলী শুধুমাত্র একজন শ্রেষ্ঠতম মুষ্টিযোদ্ধাই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন মানবদরদী এবং ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক ও প্রচারক। নিজে একজন কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণে নির্যাতিত মানবতার কান্না তিনি বুঝতেন। ফলে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও ইসলামের শান্তি, সাম্য ও সৌহার্দ্যের নীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর অবসর গ্রহণের পর থেকে আমৃত্যু তিনি ইসলাম প্রচার ও দুস্থ মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
বাংলাদেশ সফর :
মুহাম্মাদ আলীর সাথে বাংলাদেশের মানুষের ছিল এক নিবিড় বন্ধন। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমন্ত্রণে ১৯৭৮ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী তিনি পিতা ক্যাসিয়াস মারসিলাস ক্লে, মাতা ওডেসা গ্রেডি ক্লে, ভাই রহমান আলী, তৃতীয়া স্ত্রী ভেরোনিকা এবং কন্যা লায়লা আলী সহ সপরিবারে বাংলাদেশ সফরে আসেন। এসময় ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে লাখো মানুষের ঢল নামে। অতঃপর ঢাকা স্টেডিয়ামে তাঁকে ঐতিহাসিক গণসম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সেদিন তিনি স্টেডিয়ামের চারপাশ ঘুরে ঘুরে উৎসুক ভক্তদের প্রতি হাত তুলে তাদের সালামের প্রত্যুত্তর দেন। এসময় সারা স্টেডিয়াম আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন সময়ে উক্ত ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন।
ক্ষুদে মুষ্টিযোদ্ধার সাথে লড়াই :
সেদিন পল্টনে অবস্থিত ঢাকা স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক। আলী চোখে কালো চশমা সাদা শার্ট পরে যখন সেখানে প্রবেশ করলেন তখন বিপুল করতালির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানালেন হাযার হাযার দর্শক। মাঠের মাঝখানে স্থাপন করা বক্সিং রিংয়ের কর্মকর্তা, রেফারী, প্রতিদ্বন্দ্বী, সবাই প্রস্ত্তত। গোটা গ্যালারির দৃষ্টি নিবদ্ধ সেদিকেই। রিংয়ে প্রবেশ করলেন মুহাম্মদ আলী ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ১২ বছর বয়সী বাংলাদেশী কিশোর গিয়াছুদ্দীন। লড়াইয়ের শুরুতেই আলী দেখালেন তার সেই দুনিয়া মাতানো ‘প্রজাপতি নৃত্য’। তবে প্রতিদ্বন্দ্বীও কিন্তু কম গেল না- আলীর সঙ্গে সমান তালে নাচের মতোই লড়ছে সে এবং লড়তে লড়তে আচমকা মুহাম্মদ আলীকে লাগিয়ে দিল এক পাঞ্চ। তাই তো একেবারে কুপোকাত হয়ে বীর আলী পড়ে গেলেন মঞ্চে। এমন অভূতপূর্ব দৃশ্যে উল্লাসে ফেটে পড়ল সারা স্টেডিয়াম।
তিনি যে আসলেই ‘গ্রেট’ সেটা বোঝা গেল যখন তিনি অভিনয় করে দেখালেন কিশোরের ঘুষি খেয়ে তিনি কত কাতর হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন। এরপর বহু কষ্টে ভূমিশয্যা থেকে যেন কোনমতে উঠে দাঁড়ালেন। আর এভাবেই দ্য গ্রেটেস্ট সেদিন মাতিয়েছিলেন গ্যালারি ভর্তি দর্শকদের। এই সফরের সময় তিনি উদ্বোধন করেছিলেন ঢাকার মুহাম্মাদ আলী বক্সিং স্টেডিয়াম। যা আজও তাঁর স্মৃতি বহন করে আছে।
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান :
প্রেসিডেন্ট জিয়া বঙ্গভবনের দরবার হলে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন ও স্বহস্তে বাংলাদেশের পাসপোর্ট তাঁর হাতে তুলে দেন। এই সময় তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেল পদে নিযুক্তি দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বাংলাদেশের পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরী করে যখন তাঁকে হস্তান্তর করা হয়, তখন তিনি এই রাজকীয় সম্মানে আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, ‘যদি আমেরিকা আমাকে তাড়িয়ে দেয়, তাহ’লে বাংলাদেশ রইল আমার জন্য’।
অতঃপর সপ্তাহব্যাপী বাংলাদেশ সফরে তিনি সিলেটের চা বাগান, কক্সবাজার ও সুন্দরবন সহ বাংলাদেশের পাহাড়, নদী, সমুদ্র প্রভৃতি নানাপ্রান্তে ভ্রমণ করেন।
জমি প্রদান :
মুহাম্মদ আলী তার সফরে কক্সবাজার ভ্রমণ করেন। মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। এসময় মুহাম্মদ আলীর ভক্ত কক্সবাজার শহরের কলাতলীর বাসিন্দা বিশিষ্ট ক্রীড়ামোদী আখতার নেওয়াজ খান বাবুল তাঁকে বাড়ি করার জন্য উপহার দেন এক বিঘা জমি। সময়ের বিবর্তনে সেই জমি এখন সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে।
আলীর রেখে যাওয়া সম্পদ ও স্ত্রী-সন্তানাদি :
তাঁর রেখে যাওয়া অর্থসম্পদের মূল্যমান আট কোটি মার্কিন ডলার বলে মনে করা হচ্ছে। মোহাম্মদ আলী বিয়ে করেছিলেন চারবার। তাঁর মোট ছেলে-মেয়ের সংখ্যা নয়জন।
[আমরা তাঁর রূহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং তাঁর আদর্শের অনুসারী পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি (স.স.)]