ভূমিকা :
কুরআন মানব জীবনের সংবিধান। এটা স্রেফ ধর্মীয় গ্রন্থ নয়। এটা মানুষের জীবনবোধের কথা বলে। আখেরাত ও দুনিয়াবী জীবনের সার্বিক কল্যাণের বার্তা তুলে ধরে। এই কিতাব মুমিন বান্দার হৃদয়ে সৃষ্টি করে ঈমানের বুনিয়াদ। এলাহী দ্যোতনায় তার জীবনকে করে তোলে সুরভিত ও সুসজ্জিত। অন্তরজগৎকে তাক্বওয়ার বারিধারায় সিক্ত করে দু’চোখ ছাপিয়ে প্রশান্তির বান ডেকে আনে। কুরআনের ছোঁয়ায় বান্দার জীবন আখেরাতমুখী হয়ে ওঠে এবং পৃথিবীতে আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠা করাই হয় তার একমাত্র লক্ষ্য। তবে শুধু তেলাওয়াত করে কুরআনের মাধ্যমে উপকৃত হওয়া সম্ভব নয়; বরং যারা ঈমানী চেতনায় কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে, জীবনকে কুরআনের রঙে রঙিয়ে তোলার চেষ্টা করে, কেবল তারাই কুরআনের মাধ্যমে উপকৃত হ’তে পারে। এজন্য মহান আল্লাহ কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার নির্দেশ দিয়েছেন।
কুরআনের শাব্দিক তেলাওয়াত ও অর্থ বুঝে তেলাওয়াত :
শায়খ ওছায়মীন (রহঃ) বলেন, কুরআন তেলাওয়াত দুই প্রকার- (১) শাব্দিক তেলাওয়াত। এই তেলাওয়াতের মাধ্যমে প্রতি হরফে দশটি করে নেকী লাভ করা যায়।[1] (২) হুকমী বা প্রায়োগিক তেলাওয়াত। অর্থাৎ কুরআন তেলাওয়াত করে এর যাবতীয় বিধি-বিধানকে অনুধাবন করে আদিষ্ট বিষয়গুলো পালন করা এবং নিষিদ্ধ বিষয়গুলো বর্জন করা।[2] মোটকথা চিন্তা-ভাবনার সাথে তেলাওয়াত করাই হ’ল হুকমী তেলাওয়াত। মূলতঃ এই তেলাওয়াতের জন্যই কুরআন নাযিল হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ- ‘এটি এক বরকতমন্ডিত কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি। যাতে লোকেরা এর আয়াত সমূহ অনুধাবন করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৯)।
কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার বিধান
আল্লাহর জাত ও সত্তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা নিষিদ্ধ। তবে আল্লাহর সৃষ্টিরাজি ও তাঁর ছিফাত নিয়ে চিন্তা করতে বান্দা আদিষ্ট। মহান আল্লাহ তাঁর কালাম নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআন তেলাওয়াত অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফযীলতপূর্ণ ইবাদত। তবে শুধু তেলাওয়াতের জন্য কুরআন নাযিল করা হয়নি; বরং কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য হচ্ছে- মানুষ যেন তেলাওয়াতের পাশাপাশি চিন্তার মাধ্যমে এর সঠিক মর্ম উপলব্ধি করে এবং এর বিধান অনুযায়ী তাদের সার্বিক জীবন পরিচালনা করে। এজন্য কুরআন অনুধাবন করা এবং তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা মুসলমানদের উপর ওয়াজিব। আল্লাহ বলেন, أَفَلَا يَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا، ‘তবে কি তারা কুরআন অনুধাবন করে না? নাকি তাদের হৃদয়গুলি তালাবদ্ধ? (মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)। তিনি বলেন, أَفَلَمْ يَدَّبَّرُوا الْقَوْلَ أَمْ جَاءَهُمْ مَا لَمْ يَأْتِ آبَاءَهُمُ الْأَوَّلِينَ، ‘তবে কি তারা এই বাণী অনুধাবন করে না? নাকি তাদের কাছে কোন (নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি) এসেছে, যা তাদের পূর্ব পুরুষদের কাছে আসেনি?’ (মু’মিনূন ২৩/৬৮)। উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন,أفلا يتفكرون فيرون تصديق بعضه لبعض وما فيه من الواعظ والذكر والأمر والنهي، وأن أحداً من الخلق لا يقدر عليه، ‘তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না, তবে তো তারা দেখতে পেত- কুরআনের এক অংশ অপর অংশকে সত্যায়ন করছে। আর জানতে পারত- এতে কি নছীহত, উপদেশ, আদেশ ও নিষেধ রয়েছে। সৃষ্টিকূলের কেউ কুরআনের উপর কর্তৃত্ব করতে সক্ষম নয়’। নবাব ছিদ্দীক্ব হাসান খান ভূপালী (রহঃ) বলেন, এই আয়াতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, কুরআনের মর্ম উপলব্ধি করার জন্য এর আয়াতসমূহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ওয়াজিব।[3]
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, من لم يقرأ القرآن فقد هجره، ومن قرأ القرآن ولم يتدبره فقد هجره، ومن قرأ القرآن وتدبره ولم يعمل به فقد هجره، ‘যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত করে না, সে কুরআনকে পরিত্যাগ করল। যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত করে, কিন্তু তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে না, সে-ও কুরআনকে পরিত্যাগ করল। আর যে কুরআন তেলাওয়াত করল এবং তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করল, কিন্তু সেই অনুযায়ী আমল করল না, সে ব্যক্তিও কুরআনকে পরিত্যাগ করল’। তারা সবাই আল্লাহর সেই আয়াতে শামিল হবে, যেখানে তিনি বলেছেন,وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآنَ مَهْجُوراً- ‘(সেদিন) রাসূল বলবে, হে আমার রব! আমার সম্প্রদায় তো এই কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছিল’ (ফুরক্বান ২৫/৩০)।[4]
সুতরাং আমল করার ঐকান্তিক মানসিকতা নিয়ে কুরআন অনুধাবনের চেষ্টা করতে হবে। কারণ কুরআনের আয়াত নিয়ে শুধু গবেষণা করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং এর প্রতি ঈমান আনা এবং সে অনুযায়ী আমল করাও আবশ্যক। আল্লাহ বলেন,وَمِنْهُمْ مَنْ يَسْتَمِعُ إِلَيْكَ حَتَّى إِذَا خَرَجُوا مِنْ عِنْدِكَ قَالُوا لِلَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مَاذَا قَالَ آنِفًا أُولَئِكَ الَّذِينَ طَبَعَ اللهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ وَاتَّبَعُوا أَهْوَاءَهُمْ، ‘আর তাদের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা তোমার কথা কান পেতে শোনে। তারপর তোমার কাছ থেকে বেরিয়ে জ্ঞানীদের কাছে গিয়ে বলে, এইমাত্র উনি কি বললেন? ওরা হ’ল সেই সব লোক যাদের অন্তর সমূহে আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তারা নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৬)।
ইবনু উছায়মীন (রহঃ) বলেন, অত্র আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ সাবধান করে দিয়েছেন, যাতে মানুষ উপকৃত হওয়ার ইচ্ছা ছাড়া কুরআন না শোনে। কারণ এটা কাফেরদের বদ অভ্যাস। সুতরাং একজন মুসলিম যখন কুরআন তেলাওয়াত করবে বা শুনবে, তখন পূর্ণ মনোযোগের সাথে সেটা শ্রবণ করবে এবং গভীর চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে আল্লাহর কালাম অনুধাবনের চেষ্টা করবে। শুধু কুরআনের ক্ষেত্রে নয়; বরং আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের হাদীছ উভয় ক্ষেত্রেই আমল করার উদ্দেশ্য নিয়ে তা অনুধাবনে প্রবৃত্ত হ’তে হবে।[5]
মোটকথা কুরআনের প্রকৃত মর্ম অনুধাবনের জন্য কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা যরূরী। আর সেই চিন্তা-গবেষণা হ’তে হবে পূর্ণ ঈমান ও ইখলাছের সাথে, যাতে এর মাধ্যমে বান্দার হৃদয় আল্লাহমুখী হয় এবং তাঁর আনুগত্যে সার্বিক জীবন পরিচালনা করার ইলাহী প্রেরণা জাগ্রত হয়।
কিভাবে কুরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তা করব?
সালাফে ছালেহীন ও ওলামায়ে কেরাম কুরআন অনুধাবনের বিভিন্ন পদ্ধতি আলোচনা করেছেন এবং এর আয়াত সমূহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার নানাবিধ উপায় বর্ণনা করেছেন। কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার কয়েকটি স্তর আছে। কারণ ফক্বীহ-মুজতাহিদগণের কুরআন অনুধাবন আর সাধারণ মুসলমানের কুরআনের অনুধাবনের মাত্রা কখনই সমান হ’তে পারে না। সুতরাং আমরা এখানে সাধারণ মুসলমানের জন্য কুরআন নিয়ে চিন্তা করার তিনটি পদ্ধতি উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ।
১. আরবী ভাষা জানা :
কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার জন্য সর্বপ্রথম আরবী ভাষা জানা আবশ্যক। কেননা মহান আল্লাহ আরবী ভাষায় পবিত্র কুরআন নাযিল করেছেন। আরবী ভাষায় দক্ষতা অর্জন ব্যতীত সঠিকভাবে কুরআনের মর্ম উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এজন্য ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর মতে আরবী ভাষা জানা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয।[6]
ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, ‘আরবী ভাষা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। এ ভাষা জানা ফরয। কারণ কুরআন ও হাদীছের জ্ঞান অর্জন করা ফরয। আর আরবী ভাষাজ্ঞান ছাড়া এই ফরয বিধান পালন করা সম্ভব হয় না। সুতরাং যা ছাড়া ওয়াজিব পূর্ণতা পায় না, তা অর্জন করাও ওয়াজিব’।[7] যেহেতু তৎকালীন সময়ে অনারবদের জন্য আরবী ভাষা জানা ব্যতিরেকে কুরআন অনুধাবন করা সম্ভব ছিল না, কুরআনের কোন তরজমা ছিল না। সেহেতু সেই সময় আরবী ভাষা জানা আবশ্যক ছিল।
তবে বর্তমানে যেহেতু বিভিন্ন ভাষায় কুরআনের অনুবাদ হয়েছে, প্রসিদ্ধ তাফসীরের অনুবাদ হয়েছে এবং নির্ভরযোগ্য আলেমদের মাধ্যমে বিবিধ তাফসীর সংকলিত হয়েছে, সেহেতু আবরী ভাষা জানেন না এমন ব্যক্তিও কুরআন অনুধাবনে সচেষ্ট হ’তে পারেন। তবে এর মানে এই নয় যে, আবরী ভাষা জানার কোন চেষ্টাই তিনি করবেন না; বরং প্রত্যেক মুসলমান সাধ্যানুযায়ী আবরী ভাষা জানার চেষ্টা করবেন। কারণ আরবী ভাষা জানার মাধ্যমে আল্লাহর কালামের যত গভীরে প্রবেশ করা যায়, কুরআনের ভাষার লালিত্যে যেভাবে অবগাহন করা যায়, এর শব্দালংকার ও বাক্যশৈলীতে যেভাবে বিমোহিত হওয়া যায়- ভিন্ন ভাষার তরজমা পড়ে সেটা আদৌ সম্ভব নয়। তাই কুরআনকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হ’লে আরবী ভাষা জানার কোন বিকল্প নেই।
২. কুরআনের অনুবাদ ও তাফসীর অধ্যয়ন করা :
আরবী ভাষায় দক্ষতা অর্জিত হ’লেও পবিত্র কুরআনের এমন অনেক আয়াত পাওয়া যাবে, যেখানে শুধু আরবী ভাষার পান্ডিত্য দিয়ে সঠিক মর্ম উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তাই কুরআন বোঝার জন্য ছহীহ হাদীছ, ছাহাবায়ে কেরামের উক্তি ও বিশুদ্ধ তাফসীরের দারস্থ হ’তে হয়। কারণ কুরআন অনুধাবনের শর্ত হ’ল- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম যেভাবে কুরআন বুঝেছেন, সেভাবেই বুঝার চেষ্টা করা। কারো মস্তিষ্ক প্রসূত ব্যাখ্যা অথবা নিজের মনগড়া অর্থ দিয়ে কুরআন বোঝার চেষ্টা করা যাবে না। নইলে বিপথগামী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। সুতরাং চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে কুরআনের মর্ম উপলব্ধি করার জন্য বিশুদ্ধ তাফসীর অধ্যয়ন করা অবশ্য কর্তব্য। আর আমরা যেহেতু বাংলাভাষী, আমাদের জন্য বিদগ্ধ ওলামায়ে কেরাম কুরআনের অনুবাদ করেছেন।[8] তবে যার-তার অনূদিত কুরআনের তরজমা পড়া থেকে বিরত থাকা যরূরী। কেননা বাংলাভাষী অনেকেই কুরআন তরজমা করতে গিয়ে মনগড়া ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। বিশেষ করে আল্লাহর ছিফাত সম্বলিত আয়াতের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে। সুতরাং অনুবাদ পড়ার পাশাপাশি বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য তাফসীর অধ্যয়নের মাধ্যমে আল্লাহর কালাম নিয়ে তাদাববুর ও তাফাক্কুর করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত।
৩. মনোযোগী হৃদয়ে নিয়মিত কুরআন চর্চা করা :
মনোযোগী না হয়ে কুরআন তেলাওয়াত করলে মর্মের গভীরে প্রবেশ করা এবং এর মাধ্যমে প্রভাবিত হওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ বলেন, كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا ‘এটি এক বরকতমন্ডিত কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি। যাতে লোকেরা এর আয়াত সমূহ অনুধাবন করে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৯)। অত্র আয়াতে মনোযোগী হয়ে কুরআন তেলাওয়াতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমনকি কুরআন শ্রবণ করার সময়ও মনোযোগী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন,وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ، ‘আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাকো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হ’তে পার’ (আ‘রাফ ৭/২০৪)।
অত্র আয়াতে কুরআন তেলাওয়াতের প্রাক্কালে চুপ থেকে মনোযোগ দিয়ে আল্লাহর বাণী শ্রবণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ছালাতের মধ্যকার এবং বাহিরের সকল তেলাওয়াত এখানে অন্তর্ভুক্ত। আর মনোযোগ দিয়ে কুরআন শ্রবণ করার অর্থ হ’ল- উপস্থিত মন নিয়ে গভীর অভিনিবেশে কুরআন শ্রবণ করা, যেন আয়াতের মর্ম সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায় এবং তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যায়। কেউ যদি এই দু’টি গুণ অর্জন করতে পারে, অর্থাৎ কুরআন তেলাওয়াতের সময় চুপ থাকবে এবং চিন্তাশীল হয়ে মনোযোগ সহকারে তা শ্রবণ করে, তবে সে সার্বিক জীবনে আল্লাহর রহমতের ফল্গুধারায় সিক্ত হবে।[9]
সুতরাং কুরআন তেলাওয়াত এবং শ্রবণের সময় গভীর মনোযোগী হ’তে হবে। তাহ’লে কুরআন থেকে আলো গ্রহণ করা সম্ভব হবে, আল্লাহর কালাম নিয়ে ভাবনার সাগরে ডুব দেওয়া যাবে এবং চিন্তার ইবাদতে আত্মনিয়োগ করা সম্ভব হবে। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘মানুষ যদি জানতো অনুধাবন করে কুরআন তেলাওয়াতের মাঝে কত কল্যাণ নিহিত আছে, তাহ’লে তারা সব কাজ ফেলে রেখে কুরআন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। যখন সে চিন্তা-ভাবনা করে তেলাওয়াত করবে, তখন একটা আয়াত অতিক্রম না করতেই সে তার অন্তরের রোগমুক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে। একই আয়াত বারবার তেলাওয়াত করবে। হয়ত আয়াতটি একশ’ বার পড়বে। সারা রাত ধরে পড়বে। সুতরাং অনুধাবন না করে ও না বুঝে কুরআন খতম করার চেয়ে চিন্তা-ভাবনা করে বুঝে বুঝে একটি আয়াত তেলাওয়াত করা অধিকতর উত্তম। এটাই হবে তার হৃদয়ের জন্য অধিক উপকারী এবং ঈমান প্রাপ্তি ও কুরআনের স্বাদ আস্বাদনে অধিকতর উপযোগী’।[10] কুরআনের মাধ্যমে প্রভাবিত ও আলোকিত হওয়ার জন্য নিয়মিত কুরআন অনুধাবন করা যরূরী।
কুরআন নিয়ে চিন্তা করার স্বরূপ
১. চিন্তাশীল হৃদয়ে কুরআন তেলাওয়াত করা :
আল্লাহর কালাম নিয়ে গভীর মনোনিবেশে চিন্তা না করলে এর মর্ম উদ্ধার করা সম্ভব নয়। আরবী ভাষায় দক্ষতা যাদের আছে, তারা এই কুরআন নিয়ে যতই চিন্তা-গবেষণা করবে, ততই তারা নতুন নতুন বিষয়ের জ্ঞানার্জন করতে সক্ষম হবে। আল্লাহ বলেন, وَما أَرْسَلْنا مِنْ قَبْلِكَ إِلَّا رِجالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ فَسْئَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ، بِالْبَيِّناتِ وَالزُّبُرِ وَأَنْزَلْنا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ ما نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ- ‘আর আমরা তোমার পূর্বে অহি সহ কেবল পুরুষদেরই পাঠিয়েছিলাম। যদি তোমরা না জানো, তাহ’লে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর। প্রেরণ করেছিলাম স্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও কিতাব সহ। আর আমরা তোমার নিকটে কুরআন নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদের নিকট বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দাও যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (নাহল ১৬/৪৩-৪৪)। উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ মানুষকে কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ চিন্তাশীল বান্দারাই কুরআনের সঠিক মর্ম উপলব্ধি করার তাওফীক্ব অর্জন করে।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন,لَا تَهُذُّوا الْقُرْآنَ هَذَّ الشِّعْرِ، وَلَا تَنْثُرُوهُ نَثْرَ الدَّقَلِ، وَقِفُوا عِنْدَ عَجَائِبِهِ، وَحَرِّكُوا بِهِ الْقُلُوبَ، وَلَا يَكُنْ هَمُّ أَحَدِكُمْ آخِرَ السُّورَةِ، ‘তোমরা কবিতার মতো দ্রুত কুরআন পাঠ করো না এবং এটাকে নষ্ট খেজুরের মতো ছিটিয়ে দিয়ো না। এর আশ্চর্য বিষয় নিয়ে একটু ভাবো। কুরআন দিয়ে দিলকে একটু নাড়া দাও। (তেলাওয়াতের সময়) সূরা শেষ করাই যেন তোমাদের একমাত্র চিন্তা না হয়’।[11] বিশর ইবনে সার্রী (রহঃ) বলেন,إنَّما الآيةُ مثلُ التمرة، كلما مضغتَها استخرجت حلاوتَها، ‘কুরআনের আয়াত খেজুরের মত। তুমি এটা যখনই চিবাবে, তখনই এর মিষ্টতা বের করতে পারবে’।[12] ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘কুরআন নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে তাদাববুর করা এবং এর অর্থ বোঝার জন্য চিন্তা-ফিকির করার চেয়ে বান্দার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে উপকারী ও তার মুক্তির নিকটবর্তী কোন আমল নেই। কারণ এটি বান্দাকে ভালো-মন্দের নির্দেশাবলী, এর পথসমূহ, এর উপকরণ, উদ্দেশ্য, পরিণতি, ফলাফল, ভালো-মন্দ লোকের শেষ ঠিকানা ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত করে। এই কুরআন তাকে সৌভাগ্যের উপকরণ এবং উপকারী জ্ঞান-ভান্ডার দান করে। তার অন্তরে ঈমানের শিকড় মযবূতভাবে প্রোথিত করে, এর ভিত্তি সুদৃঢ় করে, তার অন্তরে দুনিয়া-আখেরাত এবং জান্নাত-জাহান্নামের সঠিক চিত্র তুলে ধরে। অন্যান্য জাতির অবস্থা, তাদের থেকে বিভিন্ন সময় আল্লাহ কি কি পরীক্ষা নিয়েছেন সে সম্পর্কে জানিয়ে দেয় এবং তাকে উপদেশ ও শিক্ষা লাভের স্থানসমূহ দেখিয়ে দেয়’।[13]
এজন্য শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, الْقِرَاءَةُ الْقَلِيلَةُ بِتَفَكُّرٍ أَفْضَلُ مِنْ الْكَثِيرَةِ بِلَا تَفَكُّرٍ، ‘না বুঝে অনেক বেশী কুরআন তেলাওয়াত করার চেয়ে চিন্তা-ভাবনা করে অল্প তেলাওয়াত করা অতি উত্তম’।[14] বান্দা যখন চিন্তা-গবেষণা করে কুরআন তেলাওয়াত করে এবং এর বিধি-বিধান উপলব্ধি করার চেষ্টা করে, তখন তার হৃদয়ে কুরআনের প্রভাব পড়ে। সেই অমলিন প্রভাবে তার হৃদয়জূড়ে এলাহী নূর বিচ্ছূরিত হয়। তার আমল-আখলাক্ব থেকে কুরআনের সুবাস ছড়ায়। সেই সুবাসে মুগ্ধ হয় জগদ্বাসী।
ড. মুছতফা সিবা‘ঈ (রহঃ) বলেন, ‘মুমিনের অন্তরে কুরআনের প্রভাব পড়ে এর মর্মার্থের কারণে; শাব্দিক সুর ব্যঞ্জনার কারণে নয়। যারা কুরআনের প্রতি আমল করে তাদের তেলাওয়াতের মাধ্যমে হৃদয় প্রভাবিত হয়, কিন্তু যারা কুরআনকে উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছে, তাদের সুমধুর বিশুদ্ধ তেলাওয়াতের মাধ্যমে অন্তর প্রভাবিত হয় না। কুরআনের প্রতি বিশ^াসী মুমিনরাই পৃথিবীকে কাঁপিয়ে তুলেছিল, যখন কুরআনের মর্ম তাদের হৃদয়কে আন্দোলিত করেছিল। যখন কুরআনের বিধান তাদের মনের কপাট খুলে দিল, তখন তারা এর মাধ্যমে বিশ^কে জয় করে নিয়েছিল। কুরআনের নীতিমালা যখন তাদের আখলাকে ফুটে উঠল, তখন তারা পৃথিবীতে রাজত্ব কায়েম করেছিল। সুতরাং এই কুরআনের মাধ্যমেই আবারো সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানো সম্ভব’।[15]
২. আমল করার উদ্দেশ্য নিয়ে তেলাওয়াত করা :
অধিকাংশ মুসলমান কুরআন তেলাওয়াত করে শুধু ছওয়াব ও বরকত লাভের জন্য। কুরআনের বিধান অনুযায়ী জীবন গঠন করার সংকল্প নিয়ে এবং এর বিধি-বিধান অনুযায়ী আমল করার মানসিকতা নিয়ে তেলাওয়াতকারীর সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। যদিও কুরআন তেলাওয়াত শ্রেষ্ঠ ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত এবং এর তেলাওয়াতে অশেষ নেকী হাছিল হয়। কিন্তু শুধু ছওয়াব ও বরকত লাভের জন্য কুরআন নাযিল হয়নি; বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অহি-র বিধান বাস্তবায়নের জন্য মহান আল্লাহ মানবজাতির উদ্দেশ্যে কুরআন নাযিল করেছেন।
ফুযাইল ইবনে ইয়ায (রহঃ) বলেন, ‘কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আমল করার জন্য। সেজন্য আমল করার নিয়তেই কুরআন তেলাওয়াত করা কর্তব্য। তাকে বলা হ’ল- কুরআনের ওপর আমল করা হয় কিভাবে? জবাবে তিনি বলেন, কুরআন যা হালাল করেছে, সেটাকে হালাল হিসাবে গ্রহণ করা। যা হারাম ঘোষণা করেছে, তা হারাম হিসাবে মেনে নেওয়া। কুরআনে যা কিছু নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা এবং যা থেকে নিষেধ করা হয়েছে, তা থেকে পরিপূর্ণরূপে বিরত থাকা। আর তেলাওয়াতের প্রাক্কালে আশ্চর্যজনক বিষয় সমূহ আসলে থেমে যাওয়া এবং চিন্তা-ভাবনা করা’।[16] হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন,نزل القرآن ليُتدبَّر ويُعمَل به، فاتَّخَذوا تلاوته عملًا، ‘কুরআন নাযিল হয়েছে যাতে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হয় এবং সে অনুযায়ী আমল করা হয়। সুতরাং তোমরা কুরআন তেলাওয়াত করাকে আমল হিসাবে গ্রহণ কর’।[17] তিনি আরো বলেন,وَاللَّهِ مَا تَدَبُّره بِحِفْظِ حُرُوفِهِ وَإِضَاعَةِ حُدُودِهِ، حَتَّى إِنَّ أَحَدَهُمْ لَيَقُولُ: قَرَأْتُ الْقُرْآنَ كُلَّهُ- مَا يُرَى لَهُ القرآنُ فِي خُلُقٍ وَلَا عَمَلٍ ‘আল্লাহর কসম! কুরআন অনুধাবনের অর্থ কেবল এর হরফগুলি হেফয করা এবং এর হুদূদ বা সীমারেখাগুলি বিনষ্ট করা নয়। যাতে একজন বলবে যে, সমস্ত কুরআন শেষ করেছি। অথচ তার চরিত্রে ও কর্মে কুরআন নেই’।[18]
ছাহাবায়ে কেরাম যখন কুরআন তেলাওয়াত করতেন, তখন আমল করার নিয়তে তেলাওয়াত করতেন। আর যখন কোন আয়াত শিখতেন বা মুখস্থ করতেন, তখন সেই আয়াতগুলোর প্রতি আমল না করা পর্যন্ত অপর আয়াত শেখা শুরু করতেন না। আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন,كانَ الرجل مِنَّا إذا تعلَّم عَشْر آياتٍ لم يجاوزهُنّ حتى يعرف معانيهُنَّ، والعملَ بهنَّ، ‘আমাদের মধ্যকার কোন লোক যখন দশটি আয়াত শিখতেন, তখন সেই আয়াতগুলো অতিক্রম করতেন না যতক্ষণ না এগুলোর অর্থ জানতে পারতেন এবং আমল করতে পারতেন’।[19] তিনি আরো বলেন,إِنَّا صَعُبَ عَلَيْنَا حِفْظُ أَلْفَاظِ الْقُرْآنِ، وَسَهُلَ عَلَيْنَا الْعَمَلُ بِهِ، وَإِنَّ مَنْ بَعْدَنَا يَسْهُلُ عَلَيْهِمْ حِفْظُ الْقُرْآنِ، وَيَصْعُبُ عَلَيْهِمُ الْعَمَلُ بِهِ، ‘আমাদের জন্য কুরআনের শব্দাবলী মুখস্থ করা কঠিন। কিন্তু এর উপর আমল করা সহজ। আর আমাদের পরের লোকদের অবস্থা হবে এই যে, তাদের জন্য কুরআন হেফয করা সহজ হবে। কিন্তু তার উপর আমল করা কঠিন হবে’।[20] ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর এই কথাটি একদম বাস্তব সম্মত। বর্তমানে হাফেযে কুরআনের সংখ্যা অনেক; কিন্তু সমাজে এমন লোকের বড়ই অভাব, যারা কুরআনের বিধান অনুযায়ী জীবনকে সাজানোর চেষ্টা করে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন অনুযায়ী সার্বিক জীবন পরিচালনার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
৩. তাওহীদের উপাদান খুঁজে বের করা :
কুরআনের পাতায় পাতায় তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বের উপাদান ছড়িয়ে আছে। আল্লাহর উজূদ, রবূবিয়্যাত, উলূহিয়্যাত ও আসমা ওয়া ছিফাতের দৃষ্টান্ত ও নমুনা পবিত্র কুরআনে বিধৃত হয়েছে। যাতে বান্দা তেলাওয়াতের সময় তাঁর রবের পরিচয় জানতে পারে। আর কুরআন নাযিলের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য এটাই যে, বান্দা তার রবের পরিচয় জানবে এবং তাঁর দিক-নির্দেশনা মোতাবেক ইবাদত করে তাঁর নৈকট্য হাছিল করবে। পবিত্র কুরআনে যত আয়াত আছে, তন্মধ্যে তাওহীদের বর্ণনা সম্বলিত আয়াতের মর্যাদা বেশী। তাওহীদের বর্ণনা থাকার কারণে আয়াতুল কুরসী কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ আয়াত,[21] সূরা ইখলাছ কুরআনের শ্রেষ্ঠ সূরা, যা কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান মর্যাদাপূর্ণ।[22] আবার একই কারণে সূরা কাফিরূণের মর্যাদা কুরআনের এক-চতুর্থাংশের সমান।[23] সুতরাং কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর একত্বের প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা করা কর্তব্য। বান্দা যদি গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে কুরআন তেলাওয়াত করে, তবে তিনি দেখতে পাবেন কুরআনের প্রতিটি আয়াতই যেন তাওহীদের ঘোষণা দিচ্ছে। একদম সূরা ফাতেহা থেকে সূরা নাস পর্যন্ত।
আমরা যদি কুরআনের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তবে দেখতে পাব- পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সর্বপ্রথম তাওহীদের নির্দেশ দিয়েছেন এবং সর্বপ্রথম নিষেধ করেছেন শিরক থেকে। তিনি কুরআনের শুরুতে সূরা ফাতেহায় কোন নির্দেশ দেননি, কোনকিছু থেকে নিষেধও করেননি। অতঃপর সূরা বাক্বারার শুরুতে মুত্তাক্বী, কাফের ও মুনাফিক্বদের বর্ননা দিয়ে তাওহীদে ইবাদতের নির্দেশ দিয়ে বলেন, يَاأَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ، ‘হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের দাসত্ব কর। যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা (জাহান্নাম থেকে) বাঁচতে পারো’ (বাক্বারাহ ২/২১)। এরপর তিনি নিজের পরিচয় তুলে ধরে বান্দাকে সর্বপ্রথম শিরক থেকে নিষেধ করেন।
পরের আয়াতে তিনি বলেন,الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ، ‘যিনি তোমাদের জন্য ভূ-পৃষ্ঠকে বিছানা স্বরূপ ও আকাশকে ছাদ স্বরূপ করেছেন এবং যিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। অতঃপর তা দিয়ে তোমাদের জীবিকার জন্য ফল-শস্যাদি উৎপাদন করেন। অতএব তোমরা জেনে-শুনে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না’ (বাক্বারাহ ২/২২)।
এভাবে কুরআনের অসংখ্য জায়গায় আল্লাহর পরিচয়, তাঁর আরশ, মালিকানা, রাজত্ব, ক্ষমতা, সৃষ্টিকৌশল, দাসত্ব, দিগ-দিগন্তে ছাড়িয়ে থাকা নিদর্শনাবলী প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে, যেন মানুষ এগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তাঁর রবের পরিচয় জানতে পারে এবং সার্বিক জীবনে তাঁর দাসত্ব করতে পারে। যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপাসনা করে, তাদের অসারতা প্রমাণ করে অসংখ্য দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। যাতে মানুষ শিরক থেকে বিরত থেকে তাঁর দিকে ফিরে আসে। আল্লাহ বলেন,وَاتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ آلِهَةً لَا يَخْلُقُونَ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ وَلَا يَمْلِكُونَ لِأَنْفُسِهِمْ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا وَلَا يَمْلِكُونَ مَوْتًا وَلَا حَيَاةً وَلَا نُشُورًا- ‘অবিশ্বাসীরা তাঁকে ছেড়ে অন্যদেরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে। যারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট। আর তারা নিজেদের ভাল-মন্দ কিছুই করতে পারে না এবং তারা মৃত্যু, জীবন ও পুনরুত্থান কোনটারই মালিক নয়’ (ফুরক্বান ২৫/৩)।
কুরআনের অসংখ্য আয়াতে কাফের-মুশরিকদের চিন্তাকে নাড়া দেওয়া হয়েছে, যেন তারা মূর্তি-প্রতিমা, চন্দ্র-সূর্য, গাছ-গাছালী প্রভৃতিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ না করে; বরং এগুলোর সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহকে ইলাহরূপে গ্রহণ করে। অতঃপর শিরকের ভয়াবহতা ও কঠিন শাস্তির কথাও বর্ণনা করেছেন, যেন বান্দা তার জীবদ্দশাতেই তাঁর রবের দিকে ফিরে আসে। তিনি বান্দাকে সর্তক করে বলেন, أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ، ‘মনে রেখ! সৃষ্টি ও আদেশের মালিক কেবল তিনিই। বিশ্বপালক আল্লাহ (শিরক হ’তে) মহাপবিত্র’ (আ‘রাফ ৭/৫৪)। অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন, لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللهُ لَفَسَدَتَا فَسُبْحَانَ اللهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ، ‘যদি আকাশ ও পৃথিবীতে আল্লাহ ব্যতীত বহু উপাস্য থাকত, তাহ’লে উভয়টিই ধবংস হয়ে যেত। অতএব তারা যা বলে, তা থেকে আরশের মালিক আল্লাহ মহা পবিত্র’ (আম্বিয়া ২১/২২)।
তাওহীদের ভাবনা নিয়ে কুরআন অধ্যয়ন ও তাফসীর চর্চার মাধ্যমেই মূলত কুরআনের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করা যায়, হৃদয়জুড়ে প্রশান্তির প্রভাব অনুভব করা যায় এবং জ্ঞানের বিবিধ শাখা-প্রশাখার সাথে পরিচিত হওয়া যায়।
৪. কুরআনের সংবাদ ও বর্ণনা বুঝে তেলাওয়াত করা :
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে অনেক গায়েবী বিষয়ের সংবাদ দান করেছেন, জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনা দিয়েছেন, মানবসৃষ্টির বিবরণ দিয়েছেন, বিবিধ বিজ্ঞানের তথ্য প্রদান করেছেন। আকাশ-যমীন, চন্দ্র-সূর্য, রাত-দিন, পাহাড়-পর্বত, আলো-অন্ধকার, গাছ-পালা, আগুন-পানি, মেঘ-বৃষ্টি, পশু-পাখি, সমুদ্র-নদী সহ প্রভৃতি সৃষ্টি ও ধ্বংসের বিবরণ তুলে ধরেছেন, যাতে বান্দা এগুলো নিয়ে চিন্তা করে আল্লাহর আস্তিত্বের প্রমাণ খুঁজে পায় এবং ঈমানকে পাকাপোক্ত করতে পারে। বান্দা এগুলো বিষয় নিয়ে যতই চিন্তা করবে, তার ভাবনার জগৎ ততই সমৃদ্ধ হবে এবং ঈমান সুদৃঢ় হবে। তাছাড়া এই কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির সংবিধান স্বরূপ। এখানে সার্বিক জীবন পরিচালানার সকল উপায় বাৎলে দেওয়া হয়েছে। এজন্য সালাফগণ কুরআনকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ বার্তা হিসাবে গ্রহণ করতেন। হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, إن من كان قبلكم رأوا القرآن رسائل من ربهم فكانوا يتدبرونها بالليل ويتفقدونها في النهار، ‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা কুরআনকে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বিশেষ বার্তা মনে করতেন। তারা রাতের বেলা এটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন এবং দিনের বেলা সেগুলোর তত্ত্ব অনুসন্ধান করতেন’।[24] তিনি আরো বলেন, وَاللهِ، يَا ابْنَ آدَمَ لَئِنْ قَرَأْتَ الْقُرْآنَ ثُمَّ آمَنْتَ بِهِ لَيَطُولَنَّ فِي الدُّنْيَا حُزْنُكَ وَلَيَشْتَدَّنَّ فِي الدُّنْيَا خَوْفُكَ، وَلَيَكْثُرَنَّ فِي الدُّنْيَا بُكَاؤُكَ، ‘আল্লাহর কসম! হে আদম সন্তান! তুমি যদি কুরআন তেলাওয়াত কর এবং এর প্রতি ঈমান আনো, তবে পার্থিব জীবনে তোমার চিন্তা বেড়ে যাবে, ভয়-ভীতি প্রচন্ড হবে এবং অধিক পরিমাণে কান্না আসবে’।[25]
আহমাদ ইবনে আবুল হাওয়ারী (রহঃ) বলেন, ‘কুরআন পড়ার সময় আমি যখন একের পর এক আয়াতের দিকে তাকাই, তখন হতবম্ভ হয়ে যাই! হাফেযদের কথা ভেবে যারপরনাই অবাক হই। কিভাবে তারা তেলাওয়াত না করে সারারাত ঘুমিয়ে কাটায়? কিভাবে তারা এই কুরআন ছেড়ে দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে? দয়াময় আল্লাহর যে কালাম তারা তেলাওয়াত করে, এর অর্থ যদি তারা বুঝত, তাহ’লে এর হক জানতে পারত; এর মাঝেই খুঁজে পেত প্রশান্তি। আর এর দ্বারা আল্লাহকে ডাকার যে কি শান্তি, তা যদি তারা অনুধাবন করতে পারত, তাহ’লে তারা আনন্দের আতিশয্যে নির্ঘুম কাটিয়ে দিত সারারাত; এই কারণে যে- তারা কত বড়
নে‘মত লাভ করেছে’।[26] ইমাম শা‘বী (রহঃ) বলেন,إذا قرأت
القرآن فأفهمه قلبك واسمعه أذنيك فإن الأذنين عدل بين القلب واللسان فإن مررت بذكر الله فاذكر الله، وإن مررت بذكر النار فاستعذ بالله منها، وإن مررت بذكر الجنة فسلها الله عز وجل، ‘যখন তুমি কুরআন তেলাওয়াত করবে, তখন অন্তরকে তা বুঝাবে এবং কানকে শুনাবে। কেননা অন্তর ও জিহবার মাঝে ইনছাফ স্থাপন করে দু’কান। সুতরাং যখন তুমি যিকিরের আয়াত অতিক্রম করবে, তখন আল্লাহর যিকির করবে। যখন জাহান্নামের বর্ণনা আসবে, তখন এত্থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইবে। আর যখন জান্নাতের বর্ণনা সম্বলিত আয়াত অতিক্রম করবে, তখন আল্লাহর কাছে জান্নাত কামনা করবে’।[27] [ক্রমশঃ]
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এমফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক,
আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. তিরমিযী হ/২৯১০; মিশকাত হা/২১৩৭; সনদ ছহীহ।
[2]. ইবনু ওছাইমীন, মাজালিসু শাহরি রামাযান, পৃ. ৬৩।
[3]. নবাব ছিদ্দীক হাসান খান, ফাৎহুল বায়ান ফী মাক্বাছিদিল কুরআন (বৈরূত: আল-মাকতাবাতুল আছরিয়্যাহ, ১৪১২হি./১৯৯২খ্রি.) ৩য় খ., পৃ. ১৮৬।
[4]. আবূ যর ক্বালামূনী, ফাফির্রূ ইলাল্লাহ, পৃ. ২৯৫; ই‘লামুল আছহাব, পৃ. ৬০৬।
[5]. তাফসীরুল উছায়মীন (সূরা আন‘আম) পৃ. ১৩৫।
[6]. মুহাম্মাদ মুনীর মুরসী, (মিসর : আলামুল কুতুব, আত-তারবিয়াতুল ইসলামিয়্যাহ ১৪২৫হি./২০০৫খৃ.) পৃ. ২৫৯।
[7]. ইবনে তায়ামিয়া, ইক্বতিযাউছ ছিরাতিল মুস্তাক্বীম, ১/৫২৭।
[8]. হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত এবং মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব অনূদিত পবিত্র কুরআনের নির্ভরযোগ্য বঙ্গানুবাদ ‘তরজমাতুল কুরআন’ নিত্যদিনের পাঠ্যতালিকায় থাকতে পারে।- লেখক।
[9]. তাফসীরে সা‘দী, পৃ. ৩১৪।
[10]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মিফতাহু দারিস সা‘আদাত, ১/১৮৭।
[11]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ, ১/৩২৯।
[12]. বদরুদ্দীন যারকাশী, আল-বুরহান ফী ‘উলূমিল কুরআন, মুহাক্কিক্ব : মুহাম্মাদ আবুল ফায়ছাল ইবরাহীম (বৈরূত, লেবানন : দারু ইহ্য়াইল কুতুব আল-আরাবিইয়াহ, ১ম মুদ্রণ, ১৩৭৬হি./১৯৫৭খৃ.), ১/৪৭১।
[13]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন, ১/৪৫০।
[14]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-ফাতাওয়াল কুবরা, ৫/৩৩৪।
[15]. মুছতফা সিবা‘ঈ, হাকাযা আল্লামাতনীল হায়াত (মিসর : মাকতাবুল ইসলামী, ৪র্থ মুদ্রণ, ১৪১৮হি./১৯৯৭খৃ.), পৃ. ২৪৮।
[16]. খত্বীব বাগদাদী, ইক্বতিযাউল ইলমি আল-আমাল, মুহাক্কিক্ব: নাছিরুদ্দীন আলবানী (বৈরূত : আল-মাকতাব আল-ইসলামী, ৫ম মুদ্রণ, ১৪০৪হি./১৯৭৪খৃ.) পৃ. ৭৬।
[17]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন, ১/৪৫০।
[18]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ছোয়াদ ২৯ আয়াত।
[19]. তাফসীরে তাবারী, ১/৮০।
[20]. তাফসীরে কুরতুবী ১/৪০।
[21]. মুসলিম হা/৮১০; মিশকাত হা/২১২২।
[22]. বুখারী হা/৬৬৪৩; মুসলিম হা/৮১১।
[23]. তিরমিযী হা/২৮৯৪; মিশকাত হা/২১৫৬; সনদ ছহীহ।
[24]. মুহিউদ্দীন নববী, আত-তিবয়ান ফী আদাবি হামালাতিল কুরআন, তাহক্বীক্ব ও তা‘লীক্ব : মুহাম্মাদ আল-হাজ্জার (বৈরূত : দারু ইবনে হাযম, তাবি) পৃ. ৫৪।
[25]. আহমাদ ইবনে হাম্বল, আয-যুহদ, পৃ. ২১০।
[26]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া, ২/৩৯০।
[27]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান ২/৩৭৬।