খলীফা হিসাবে হাসান (রাঃ) :
আব্দুল্লাহ ইব্নু আহমাদ আবূ আলী সুওয়াইদ আল-তাহহান সাফীনা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার পর ৩০ বছর খেলাফত ভিত্তিক শাসন অব্যাহত থাকবে’।[1] এ বাণী শুনে জনৈক শ্রোতা বলল, ঐ ৩০ বছরের মধ্যে ৬ মাস হ’ল আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর শাসনকাল। তখন সাফীনা বলেন, ‘ঐ ৬ মাস কেমন করে মু‘আবিয়ার শাসনামলে সংযোজিত হবে? ঐ ছয় মাস বরং গণ্য হবে হাসান (রাঃ)-এর শাসনকাল। কারণ বৈধ খলীফা হিসাবে জনসাধারণ হাসান (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করেছিল। প্রায় ৪০ বা ৪২ হাযার লোক তখন খলীফারূপে হাসান (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করেছিলেন।[2]
খালিদ ইবনু আহমাদ বলেছেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, ৯০ হাযার লোক হাসান (রাঃ)-এর হাতে রায়‘আত করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি খেলাফত থেকে সরে দাঁড়ান এবং আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর সাথে আপোষ-মীমাংসায় উপনীত হন। হাসান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে সামান্য রক্তপাতও ঘটেনি। এমনকি এক শিংগা পরিমাণ রক্তও ঝরেনি। ইবনু আবী খায়ছামা ইবনু জারীর থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আলী (রাঃ) যখন নিহত হ’লেন, তখন কূফার লোকেরা হাসান (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করেছিল। তারা তাঁর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করেছিল এবং তারা তাঁকে আলী (রাঃ)-এর চাইতেও অধিক ভালবেসেছিল।
ইবনু আবী খায়ছামা হারূণ ইবনু মা‘রূফ ইব‡ন শাওয়াব থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আলী (রাঃ)-এর হত্যাকান্ডের পর হাসান (রাঃ) ইরাকীদের নিকট গেলেন, আর মু‘আবিয়া সিরীয়দের সাথে মিলিত হ’লেন। তারপর উভয় পক্ষ যুদ্ধের মুখোমুখি হ’ল। হাসান (রাঃ) যুদ্ধ-বিগ্রহ অপসন্দ করলেন এবং এই শর্তে মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর সাথে সমঝোতা করলেন যে, তাঁর শাসনামলের পর হাসান (রাঃ)-এর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর হাসান (রাঃ)-এর সমর্থকগণ এই আপোষ-মীমাংসায় ক্ষুব্ধ হয়ে হাসান (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলত, ‘হে মুমিনদের গ্লানি! উত্তরে হাসান (রাঃ) বলতেন, ‘জাহান্নামের আগুন অপেক্ষা দুনিয়ার গ্লানি ও অপমান শ্রেয়’।[3]
আবূ বকর ইবনু আবিদ দুনিয়া আববাস ইবনু হিশামের পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আলী (রাঃ) নিহত হবার পর তাঁর পুত্র হাসান (রাঃ)-এর হাতে জনসাধারণ বায়‘আত করেছিল। তারপর তিনি ৭ মাস ১১ দিন খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। ইবনু আসাকির বলেন, তিনি ৭ মাস ৭ দিন খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন।[4] আববাস ব্যতীত অন্য ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, আলী (রাঃ) নিহত হবার পর কূফার অধিবাসীগণ হাসান (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করেছিল, আর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর হাতে সিরীয়গণ বায়তুল মুক্বাদ্দাসে বায়‘আত করেছিল। ৪০ হিজরী সনের শেষ দিকে জুম‘আর দিনে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে সার্বজনীন বায়‘আত অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ৪১ সনে হাসান (রাঃ) কূফা রাজ্যের এক জনপদে এক গৃহে মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। উভয়ে তখন সমঝোতায় উপনীত হন এবং হাসান (রাঃ) তখনকার মত মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। অন্য মতে, আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর কূফা গমন এবং উভয়ের মধ্যে সমঝোতায় উপনীত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল ৪১ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে।[5]
মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর সাথে সন্ধির পরে হাসান (রাঃ)-এর ভাষণ :
৪০ হিজরীর ১৭ই রামাযান আলী (রাঃ)-এর মৃত্যুর পর ইরাক, মক্কা, মদীনা ও ইয়ামনবাসী হাসান ইবনু আলী (রাঃ)-এর হাতে খেলাফতের বায়‘আত গ্রহণ করলে তার নেতৃত্বেই পঞ্চম খলীফার অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং তিনি ছয় মাস খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। এর দ্বারা রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী ‘আমার পরে খেলাফত ত্রিশ বছর থাকবে’[6] কার্যকর হয়। কিন্তু শামবাসী মু‘আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান (রাঃ)-এর হাতে খেলাফতের বায়‘আত গ্রহণ করে এবং মিসরবাসী বিভক্ত হয়ে দু’পক্ষ দু’দলকে সমর্থন দেয়। হাসান (রাঃ) মু‘আবিয়া (রাঃ)-কে আনুগত্যের শপথ নেওয়ার জন্য আহবান জানালে তিনি অস্বীকার করেন। এমতাবস্থায় হাসান (রাঃ) মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে এক বিশাল সৈন্য দল প্রস্ত্তত করে শাম-এর উদ্দেশ্যে বের হয়ে ‘মাসকিন’ নামক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। বিপক্ষে মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর বিশাল সৈন্যদলও মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এমতাবস্থায় মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাব সম্বলিত চিঠি আসলে হাসান (রাঃ) নিজ পক্ষের ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করে মুসলিম ঐক্য অটুট রাখার এবং রক্তপাত এড়ানোর বৃহত্তর স্বার্থে মু‘আবিয়া (রাঃ)-কে মুসলমানদের খলীফা হিসাবে মেনে নেন।[7] যার ইঙ্গিত রাসূল (ছাঃ) তাঁর বাণীতে দিয়ে যান।[8]
মু‘আবিয়া (রাঃ) ও হাসান (রাঃ)-এর সমঝোতার বিষয়টি ছহীহ বুখারীতে এভাবে এসেছে যে, হাসান (বছরী) (রহঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! হাসান ইবনু আলী (রাঃ) পর্বত প্রমাণ সেনাদল নিয়ে মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মুখোমুখী হ’লেন। আমর ইবনুল আছ (রাঃ) বললেন, আমি এমন সেনাদল দেখতে পাচ্ছি, যারা প্রতিপক্ষকে হত্যা না করে ফিরে যাবে না। মু‘আবিয়া (রাঃ) তখন বললেন, আল্লাহর কসম! (মু‘আবিয়াহ ও আমর ইবনুল আছ) উভয়ের মধ্যে মু‘আবিয়াহ (রাঃ) ছিলেন উত্তম ব্যক্তি, হে আমর! এরা ওদের এবং ওরা এদের হত্যা করলে, আমি কাকে দিয়ে লোকের সমস্যার সমাধান করব? তাদের নারীদের কে তত্ত্বাবধান করবে? তাদের দুর্বল ও শিশুদের কে রক্ষণাবেক্ষণ করবে? অতঃপর তিনি কুরায়শের বনু আবদে শামস শাখার দু’ব্যক্তি আব্দুর রহমান বিন সামুরাহ ও আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ)-কে হাসান (রাঃ)-এর নিকটে পাঠালেন। তিনি তাদের বললেন, তোমরা উভয়ে এ ব্যক্তির নিকটে যাও এবং তাঁর নিকটে সন্ধির প্রস্তাব পেশ করো, তার সঙ্গে আলোচনা কর ও তাঁর বক্তব্য জানতে চেষ্টা কর। তারা তাঁর নিকটে গেলেন এবং তাঁর সঙ্গে কথা বললেন, আলাপ-আলোচনা করলেন এবং তাঁর বক্তব্য জানলেন। হাসান ইবনু আলী (রাঃ) তাদের বললেন, আমরা আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান, এই সম্পদ আমরা পেয়েছি। আর এরা রক্তপাতে লিপ্ত হয়েছে। তারা উভয়ে বললেন, তিনি (মু‘আবিয়াহ রাঃ) আপনার নিকটে এরূপ বক্তব্য পেশ করেছেন। আর আপনার বক্তব্যও জানতে চেয়েছেন ও সন্ধি কামনা করেছেন। তিনি বললেন, এ দায়িত্ব কে নেবে? তারা বললেন, আমরা এ দায়িত্ব নিচ্ছি। অতঃপর তিনি তাঁর সঙ্গে সন্ধি করলেন। হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, আমি আবূ বাকরাহ (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে আমি মিম্বরের উপর দেখেছি, হাসান বিন আলী (রাঃ) তাঁর পাশে ছিলেন। তিনি একবার লোকদের দিকে আরেকবার তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘আমার এ সন্তান একজন নেতা। সম্ভবত তার মাধ্যমে আল্লাহ মুসলিমদের দু’টি বড় দলের মধ্যে মীমাংসা করাবেন’।[9]
সন্ধির পরে হাসান (রাঃ) দাঁড়িয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বললেন, ‘হে লোক সকল! আপনারা যদি সুদূর জাবলাক নগরী ও জাবরাম নগরীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এমন একজন পুরুষ লোক খোঁজেন যার নানা স্বয়ং নবী করীম (ছাঃ) তাহ’লে আমি ও আমার ভাই ছাড়া কাউকে পাবেন না। এই মুহূর্তে আমরা মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছি। আমরা ভেবে দেখেছি যে, মুসলমানদের রক্তপাত ঘটানোর চাইতে রক্তপাত বন্ধ করা কল্যাণকর। তবে আমি জানি না এটি আপনাদের জন্যে পরীক্ষা এবং অল্পদিনের ভোগ-বিলাসও হ’তে পারে। এই কথায় তিনি আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। ফলে মু‘আবিয়া (রাঃ) রেগে গেলেন এবং হাসান (রাঃ)-কে বললেন, ‘এর দ্বারা আপনি কি বুঝাতে চেয়েছেন? উত্তরে হাসান (রাঃ) বললেন, ‘আমি এর দ্বারা তা-ই বুঝাতে চেয়েছি আল্লাহ যা বুঝিয়েছেন’।[10] অন্যত্র এসেছে, তিনি বলেন,فإن أكيسَ الكيس التُّقى، وأحمق الحمق الفجور، وإن هذا الأمر الذي اختلفت فيه أنا ومعاوية، إما أن يكون حق امرئ فهو أحقُّ به مني، وإما أن يكون حقًّا هو لي، فقد تركته إرادةَ إصلاح الأمة وحقن دمائها، ثم التفت إلى معاوية، فقال ‘নিশ্চয়ই সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা হচ্ছে আল্লাহভীতি এবং সর্বোচ্চ নির্বুদ্ধিতা হচ্ছে পাপাচার। আর এ বিষয় যা নিয়ে আমার ও মু‘আবিয়ার মাঝে মতভেদ রয়েছে, আমি এ বিষয়ে হকদার হ’লেও তিনি আমার চেয়ে অধিক হকদার। আর এটা আমার হক হ’লেও উম্মতের কল্যাণ এবং তাদের রক্তপাত বন্ধ করার জন্য আমি তা ত্যাগ করলাম’। অতঃপর তিনি মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর দিকে ফিরে বললেন,وَإِنْ أَدْرِي لَعَلَّهُ فِتْنَةٌ لَكُمْ وَمَتَاعٌ إِلَى حِينٍ ‘আমি জানি না হয়ত বিলম্বের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে পরীক্ষা এবং রয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগের সুযোগ’ (আম্বিয়া ২১/১১১)।[11]
অন্যত্র এসেছে, মু‘আবিয়া (রাঃ) হাসান (রাঃ)-কে ভাষণ দেওয়ার অনুরোধ করলেন। হাসান (রাঃ) ভাষণ দানের জন্য দাঁড়ালেন। ভাষণে তিনি আল্লাহর প্রশংসা, গুণগান ও রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠের পর বললেন, হে জনগণ! আমাদের প্রথম ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে আল্লাহ আপনাদেরকে সত্য পথের দিশা দিয়েছেন। আর আমাদের শেষ ব্যক্তি (হাসান, নিজের প্রতি ইঙ্গিত করেন) দ্বারা আপনাদেরকে রক্তপাত থেকে রক্ষা করেছেন। শাসন ক্ষমতার একটি মেয়াদ নির্ধারিত রয়েছে। আর দুনিয়া হ’ল কূপ থেকে পানি তোলার বালতি সদৃশ। কখনো এর হাতে কখনো ওর হাতে। আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেছেন,وَإِنْ أَدْرِي لَعَلَّهُ فِتْنَةٌ لَكُمْ وَمَتَاعٌ إِلَى حِينٍ ‘আমি জানি না হয়ত বিলম্বের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে পরীক্ষা এবং রয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগের সুযোগ’ (আম্বিয়া ২১/১১১)।[12]
খেলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তরের কারণ সম্পর্কে হাসান (রাঃ)-এর বক্তব্য স্পষ্ট ছিল। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) উল্লেখ করেন, মুহাম্মাদ ইবনু সা‘দ আলী ইবনে মুহাম্মাদ যায়দ ইব‡ন আসলাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, হাসান (রাঃ)-এর নিকট এক লোক উপস্থিত হ’ল। তিনি তখন মদীনাতে অবস্থান করছিলেন। তাঁর হাতে ছিল ছোট্ট একটি পুস্তিকা। লোকটি তাঁকে জিজ্ঞেস করল, এটি কি? উত্তরে হাসান (রাঃ) বললেন, মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর পুত্র এই পত্রের মাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে সীমালংঘন করতে চায় ও আমাকে ভয় দেখায়। লোকটি বলল, আপনি অর্ধেক রাজত্বের মালিক। হাসান (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ, তা বটে। তবে আমি এই ভয় করেছিলাম যে, ৭০/৮০ হাযার লোক যদি রক্তক্ষরণ নিয়ে কিংবা ৭০/৮০ হাযারের চাইতে কম বা বেশী ক্বিয়ামতের দিন উপস্থিত হয় এবং আল্লাহর দরবারে তাদের রক্তপাতের কারণ জানতে চায়, এজন্যে খেলাফত ত্যাগ করে রক্তপাত বন্ধ করেছি।[13] মু‘আবিয়া (রাঃ) ৪১ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে মুসলিম জাহানের খলীফা নির্বাচিত হন এবং প্রায় বিশ বছর তাঁর নেতৃত্বে ইসলামী শাসন পরিচালিত হয়।[14] ইবনু আব্দিল বার্র (রহঃ) বলেন, হাসান (রাঃ) ৪১ হিজরীর জুমাদাল উলা মাসের মাঝামাঝিতে মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর নিকটে খেলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। তখন মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর বয়স হয়েছিল ২ মাস কম ৪৬ বছর।[15]
হাসান (রাঃ) ইসলামের পঞ্চম খলীফা :
হাসান (রাঃ)-এর খেলাফতকাল অতি অল্প সময়ের জন্য হ’লেও তিনিই ইসলামের পঞ্চম খলীফা হিসাবে পরিগণিত হন। কেননা নবী করীম (ছাঃ)-এর উক্তি,الخِلَافَةُ فِي أُمَّتِي ثَلَاثُونَ سَنَةً ‘আমার উম্মাতের খেলাফতের সময়কাল (শাসনকাল) হবে ত্রিশ বছর’।[16] আর এই ত্রিশ বছর পূর্ণ হয় হাসান (রাঃ)-এর খেলাফতের মাধ্যমে। এজন্য তাকে ইসলামের পঞ্চম খলীফা হিসাবে গণ্য করা হয়।[17] ড. আলী আছ-ছাল্লাবী বলেন,وقد قرر جمع من أهل العلم عند شرحهم لقوله صلى الله عليه وسلم الخِلَافَةُ فِي أُمَّتِي ثَلَاثُونَ سَنَةً أن الاشهر التي تولى فيها الحسن بن على بعد موت أبيه كانت داخله في خلافة النبوة، ‘বিদ্বানগণের একটি দল ‘আমার উম্মাতের খেলাফতের সময়কাল হবে ত্রিশ বছর’ এই হাদীছের ব্যাখ্যায় স্বীকার করেন যে, হাসান (রাঃ) তাঁর পিতার পরে যে কয় মাস দায়িত্ব পালন করেছিল, তা নবুওয়াতের খেলাফতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত’।[18] আবু বকর আল-আরাবী ও কাযী আয়ায (রহঃ), ইমাম ত্বাহাবী, আল-মানাবী ও ইবনু হাজার আল-হায়তামী (রহঃ)ও অনুরূপ বলেছেন। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,وَالدَّلِيلُ عَلَى أَنَّهُ أَحَدُ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْحَدِيثُ الَّذِي أَوْرَدْنَاهُ فِي دَلَائِلِ النُّبُوَّةِ، ‘দালাইলুন নবুওয়াত’ গ্রন্থে আমরা যে হাদীছ উল্লেখ করেছি, সেটাই প্রমাণ তিনি (হাসান) খুলাফায়ে রাশেদীনের অন্যতম ছিলেন’।[19]
উষ্ট্রের যুদ্ধে হাসান (রাঃ)-এর ভূমিকা :
৩৫ হিজরীর যিলহজ্জ মাসে ওছমান (রাঃ) বিদ্রোহীদের হাতে শাহাদত বরণ করলে লোকেরা আলী (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করে। বিদ্রোহীরাও আলী (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত নেয়। আলী (রাঃ) প্রথমে রাষ্ট্রীয় শৃংখলা ফিরিয়ে আনা এবং বিদ্রোহীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কিছুটা বিলম্ব করেন। এতে কেউ কেউ আলী (রাঃ)-এর প্রতি রুষ্ট হন। অন্যদিকে হজ্জের মওসুম হওয়ায় রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণ সহ বহু ছাহাবী হজ্জব্রত পালনে মক্কায় ছিলেন। এভাবে চার মাস অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর ত্বালহা ও যুবায়ের (রাঃ) মক্কায় গমন করেন। সেখানেই ওছমান হত্যার ক্বিছাছ (হত্যার বদলে হত্যা) গ্রহণের প্রস্ত্ততি নেওয়ার জন্য বছরায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং আয়েশা (রাঃ), ত্বালহা, যুবায়ের প্রমুখ ছাহাবী বছরার পথে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে আয়েশা (রাঃ) বছরার নিকটবর্তী ‘হাওআব’ (ماء الحوأب) নামক স্থানে পৌঁছলে কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। তখন রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ তাঁর স্মরণ হয়ে যায়। একদা তাঁকে রাসূল (ছাঃ) বলেন,كَيْفَ بِإِحْدَاكُنَّ تَنْبَحُ عَلَيْهَا كِلاَبُ الْحَوْأَبِ، ‘তোমাদের মধ্যকার একজনের অবস্থা কেমন হবে, যখন হাওআবের কুকুর তার বিরুদ্ধে ঘেউ ঘেউ করবে’?[20] অন্যত্র তিনি বলেন,أَيَّتُكُنَّ صَاحِبَةُ الْجَمَلِ الْأَدْبَبِ، تَخْرُجُ فَيَنْبَحُهَا كِلاَبُ حَوْأَبٍ، يُقْتَلُ عَنْ يَمِيْنِهَا وَعَنْ يَسَارِهَا قَتْلَى كَثِيْرٌ، ثُمَّ تَنْجُو بَعْدَمَا كَادَتْ- ‘তোমাদের মধ্যে উটে আরোহণকারিণীর অবস্থা কি হবে, যখন সে বের হবে? অতঃপর তার বিরুদ্ধে হাওআবের কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করবে? তার ডানে ও বামে বহু মানুষ নিহত হবে। এরপর কোন মতে সে প্রাণে রক্ষা পাবে’।[21] তখন আয়েশা (রাঃ) বাড়িতে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করলেন। এসময় যুবায়ের (রাঃ) বললেন, বরং আপনি সামনে অগ্রসর হন। লোকেরা আপনাকে দেখে হয়তো সন্ধিতে চলে আসবে। আল্লাহ আপনার মাধ্যমে হয়তো বিবদমান দু’টি দলের (আলী ও মু‘আবিয়ার) মধ্যে মীমাংসা করে দিবেন। তখন তিনি সামনে অগ্রসর হন’।[22]
অন্যদিকে তাদের এই পদক্ষেপকে আলী (রাঃ) খেলাফতের অখন্ডতার জন্য হুমকি মনে করেন এবং সেনাবাহিনী সহ বছরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অনেক প্রসিদ্ধ ছাহাবী তাঁর এই পদক্ষেপ থেকে নিজেদের দূরে রাখেন। এমনকি হাসান বিন আলী (রাঃ) স্বীয় পিতাকে এ পদক্ষেপ থেকে ফিরানোর জন্য বহু চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আমরা উষ্ট্রের যুদ্ধে ৬০০ লোক বের হ’লাম। আমরা ‘রাবযাহ’ নামক স্থালে পৌঁছলে হাসান (রাঃ) দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। তখন আলী (রাঃ) বললেন, কথা বল, কুমারী মেয়েদের মত কান্না বন্ধ কর। তখন হাসান (রাঃ) বললেন, إني كنت أشرتُ عليك بالمقام؛ (أي: بعدم الخروج لقتال طلحة والزبير)، وأنا أشيره الآن، ‘আমি আপনাকে এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। (অর্থাৎ ত্বালহা ও যুবায়েরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বের না হ’তে)। এখনও আমি আপনাকে সেই দিকে ইশারা করছি’।[23]
এদিকে আলী (রাঃ) প্রথমে আয়েশা, ত্বালহা ও যুবায়ের (রাঃ)-এর নিকটে কা‘কা‘ বিন আমরকে মুসলমানদের একতা ও ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার আহবান জানিয়ে প্রেরণ করেন। এসময় আয়েশা (রাঃ) জবাব দেন যে, আমরা মুসলমানদের মধ্যে মীমাংসা করতে এসেছি। কা‘কা‘ বিন আমর উক্ত সংবাদ আলী (রাঃ)-এর নিকট পেশ করলে তিনি খুশী হন। আয়েশা (রাঃ) আলীর নিকট দূত পাঠিয়ে বলেন, আমরা যুদ্ধের জন্য আসিনি। বরং মীমাংসার জন্য এসেছি। এরপর আলী (রাঃ) লোকদের শান্ত করতে বিভিন্ন ঘটনা স্মরণ করিয়ে ভাষণ দেন। যাতে তিনি বলেন, আমরা আগামীকাল চলে যাব, ওছমান হত্যায় যারা জড়িত তারা ব্যতীত সকলে আমাদের সাথে যাবে।
ফলে ফিৎনাবাজ আশতার, শুরাইহ বিন আওফা, আব্দুল্লাহ বিন সাবা ও ওছমান হত্যার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আড়াই হাযার লোক ভীত হয়ে গোপন চক্রান্তে লিপ্ত হয় (এদের মধ্যে কোন ছাহাবী ছিলেন না)। প্রথমে তারা আলী (রাঃ)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। কিন্তু তা অসম্ভব দেখে অন্য ষড়যন্ত্র করে। রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তারা ত্বালহা ও যুবায়ের (রাঃ)-এর বাহিনীর উপর হামলা করে এবং ফজরের পূর্বেই পালিয়ে যায়। এতে ত্বালহা ও যুবায়ের (রাঃ) মনে করেন যে, এটি আলী (রাঃ)-এর বাহিনী করেছে। ফলে উভয় দলের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ বেধে যায়। আয়েশা (রাঃ) যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য উটের উপর আরোহণ করে ময়দানে অবতীর্ণ হন। কিন্তু খারেজীরা তাঁর বাহনের পায়ে তীর মারলে তিনি নীচে পড়ে যান। পরে তাঁকে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।[24]
এ যুদ্ধের মূল কারণ ছিল ওছমান হত্যার বিচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হত্যাকারীদের নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র। আয়েশা (রাঃ) এই অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ইবনু ওমর (রাঃ)-কে বলেন, হে আবু আব্দুর রহমান! আপনি আমাকে উটের যুদ্ধে যেতে বাধা দেননি কেন? উত্তরে তিনি বলেন, আপনার উপর এক ব্যক্তি (ইবনু যুবায়ের) প্রভাব বিস্তার করেছিল, এজন্য কিছু বলিনি। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আপনি নিষেধ করলে আমি যেতাম না’।[25]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমার ইচ্ছা ছিল যে, আমাকে আমার গৃহে রাসূল (ছাঃ) ও পিতা আবু বকরের পাশে দাফন করা হবে। কিন্তু রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর আমি একটি ঘটনা ঘটিয়েছি। সেজন্য তোমরা আমাকে রাসূল (ছাঃ)-এর অন্য স্ত্রীদের সাথে দাফন করবে। অতঃপর তাঁকে বাকী‘ কবরস্থানে দাফন করা হয়।[26]
আলবানী (রহঃ) বলেন, ‘আমরা এতে নিঃসন্দেহ যে, আয়েশা (রাঃ)-এর বের হওয়াটা ভুল ছিল। আর এজন্য তিনি হাওআবে নবী করীম (ছাঃ)-এর সতর্কবাণী স্মরণ হওয়ার পর ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু যুবায়ের (রাঃ) ‘আল্লাহ আপনার মাধ্যমে হয়তো বিবদমান দু’টি দলের (আলী ও মু‘আবিয়া) মধ্যে মীমাংসা করে দিবেন’ একথা বলে তাঁকে ফিরে যেতে বাধা দেন। আমরা নিঃসন্দেহ যে, তিনিও এ ব্যাপারে ভুলকারী ছিলেন’।[27]
অপরদিকে আলী (রাঃ) যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বলেছিলেন, হায় যদি আমি এর বিশ বছর পূর্বে মারা যেতাম![28] আলী (রাঃ) এজন্য অনুতপ্ত হন এবং বার বার আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।[29] অন্যদিকে যুবায়ের (রাঃ) যুদ্ধ ত্যাগ করে উপত্যকায় চলে যান। তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় আমর বিন জুরমূয হত্যা করে। আলী (রাঃ) জানতে পারলে দুঃখ করে বলেন, হে যুবায়েরের হত্যাকারী! তুমি জাহান্নামের দুঃসংবাদ গ্রহণ কর।[30] আর ত্বালহা (রাঃ) জনৈক ব্যক্তির তীরের আঘাতে নিহত হ’লে আলী (রাঃ) নিহতদের মধ্যে তাকে দেখতে পান। তখন তিনি তাঁর মুখমন্ডল থেকে ময়লা সরাতে সরাতে বলেছিলেন, হে আবু মুহাম্মাদ! আপনার প্রতি আল্লাহর রহমত নাযিল হোক। আকাশের তারকারাজির নীচে আপনাকে এ অবস্থায় দেখাটা আমার জন্য খুবই কষ্টকর’।[31]
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, আয়েশা (রাঃ) যুদ্ধ করেননি এবং যুদ্ধ করার জন্য বেরও হননি। বরং তিনি মুসলমানদের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য বের হয়েছিলেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে, তার বের হওয়াতে মুসলমানদের কল্যাণ রয়েছে। পরে তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর বের না হওয়াতেই কল্যাণ ছিল। সেজন্য উষ্ট্রের যুদ্ধে গমণের কথা স্মরণ হ’লে তিনি এত বেশী কাঁদতেন যে, তাঁর ওড়না ভিজে যেত।...অনুরূপভাবে ত্বালহা, যুবায়ের ও আলী (রাঃ) এই অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধের জন্য অনুতপ্ত হন। কারণ এটি তাঁদের কারোরই এখতিয়ারাধীন ছিল না (মিনহাজুস সুন্নাহ ১/২২৮)।[32]
স্মর্তব্য যে, ছাহাবায়ে কেরামের মতভেদপূর্ণ বিষয়ে চুপ থাকাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নীতি। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আমার ছাহাবীদের ব্যাপারে তোমরা চুপ থাকো।[33] ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হ’ল, তারা ছাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে তাদের হৃদয় ও জিহবাকে সংযত রাখেন এবং তাদের মাঝে মতভেদগত বিষয়ে চুপ থাকেন।[34]
ছিফ্ফীনের যুদ্ধে হাসান (রাঃ)-এর ভূমিকা :
৩৭ হিজরীতে সংগঠিত ছিফফীন যুদ্ধেরও মূল কারণ ছিল ওছমান (রাঃ)-এর হত্যাকারী বিদ্রোহীদের গভীর ষড়যন্ত্র। ৩৫ হিজরীর যিলহজ্জ মাসে ওছমান (রাঃ) শাহাদত বরণ করলে লোকেরা আলী (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করে। বিদ্রোহীরাও আলী (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত নেয়। আলী (রাঃ) প্রথমে রাষ্ট্রীয় শৃংখলা ফিরিয়ে আনার জন্য এবং বিদ্রোহীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে বাধ্য হয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কিছুটা বিলম্ব করেন। এতে ওছমান (রাঃ)-এর চাচাতো ভাই সিরিয়ার আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ) ও তার সাথীরা তাঁর প্রতি রুষ্ট হন। যদিও মু‘আবিয়া আলী (রাঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্বকে দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করতেন। কিন্তু তিনি ওছমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত বায়‘আত করতে অস্বীকার করেন। ফলে আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
আলী (রাঃ)-এর খেলাফত ছিল সর্বসম্মত। আর কারো অবাধ্যতার জন্য খেলাফত ত্যাগ করা হাদীছ সম্মত নয়। কেননা তাতে খেলাফতের ঐক্য বিনষ্ট হয়। যেমন ওছমান (রাঃ)-এর প্রতি অছিয়ত করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন, ‘হয়তো আল্লাহ তোমাকে একটি জামা পরিধান করাবেন। পরে যদি লোকেরা তোমার সেই জামাটি খুলে নিতে চায়, তখন তুমি তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী জামাটি খুলে ফেলো না’।[35] এখানে জামাটি অর্থ খেলাফত।[36]
অতঃপর ৩৭ হিজরীর ছফর মাসে ছিফফীন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাবেঈ বিদ্বান মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হি.)-এর ধারণা মতে, তিন দিন তিন রাতের এই যুদ্ধে ৭০ হাযার মুসলমান নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুর রহমান বিন আবযী বলেন, লোকেরা ধারণা করে যে, ৭০ হাযারের মধ্যে ৪৫ হাযার সিরীয় পক্ষে এবং ২৫ হাযার ইরাকীদের পক্ষে নিহত হন।[37] নিঃসন্দেহে এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে একটি মহা বিপর্যয়কর ঘটনা।
ছিফ্ফীনের যুদ্ধে হাসান (রাঃ)-এর ভূমিকা প্রসঙ্গে ড. আলী আছ-ছাল্লাবী বলেন,كان موقف الحسن بن علي رضي الله عنه هو موقف أهل السنة والجماعة من الحرب التي وقعت بين الصحابة الكرام رضي الله عنهم وهو الإمساك عما شجر بينهم إلا فيما يليق بهم رضي الله عنهم، ‘হাসান (রাঃ)-এর অবস্থান ছিল অনুরূপ যেরূপ ছাহাবীগণের মধ্যে সংগঠিত যুদ্ধের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অবস্থান ছিল। সেটা হ’ল- যে বিষয়ে তাঁরা মতবিরোধ করেছেন, সে ব্যাপারে নীরব থাকা। তবে যে বিষয়ে তাঁরা যথার্থ ছিলেন’।[38]
তিনি আরো বলেন,مسلك الفرقة الناجية أهل السنة والجماعة والذين من أئمتهم وسادتهم أمير المؤمنين علي وابنيه الحسن والحسين وهو الإمساك عما حصل بينهم رضي الله عنه ولا يخوض فيه إلا بما هو لائق بمقامهم،. ‘ফিরক্বা নাজিয়াহ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও তাদের ইমাম ও নেতা আমীরুল মুমিনীন আলী ও তদীয় দু’পুত্র হাসান-হুসাইন (রাঃ)-এর মাসলাক ছিল তাদের (ছাহাবীগণের) মাঝে সংগঠিত বিষয়ে নীরব থাকা। আর তাতে লিপ্ত না হওয়া, কিন্তু তাদের শানে যা উপযুক্ত’।[39]
মোদ্দাকথা অনেক ছাহাবী ওছমান হত্যার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেন। কারণ তারা ভেবেছিলেন যে, ওছমানের পক্ষ হওয়ায় তারা হেদায়াতের উপর আছেন। কিন্তু এজন্য আলী (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া তাঁদের সঠিক হয়নি। কেননা এ সময় খলীফা ছিলেন আলী (রাঃ)। সর্বাগ্রে তাঁর প্রতি শর্তহীন আনুগত্য অপরিহার্য ছিল। তাছাড়া ওছমান (রাঃ) নিজে স্বীয় খেলাফত বা জীবন রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেননি এবং অন্যদের অনুমতি দেননি। আর হত্যায় উদ্যত ব্যক্তির বিরুদ্ধে করণীয় কি হবে, সা‘দ বিন আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ)-এর এমন এক প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন, তুমি আদমের উত্তম সন্তানটির মত হও’।[40] ফিৎনার সময় করণীয় কি হবে, এমন প্রশ্নের উত্তরেও রাসূল (ছাঃ) একই কথা বলেছিলেন।[41] এজন্য বহু ছাহাবী যুদ্ধ হ’তে বিরত ছিলেন। [ক্রমশঃ]
[1]. আবূদাউদ হা/৪৬৪৬; তিরমিযী হা/২২২৬; ছহীহাহ হা/৪৫৯।
[2]. ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইস্তী‘আব, ১/৩৮৫ পৃঃ।
[3]. হুসাইন ইবনু মুহাম্মাদ ইবনে হাসান আদ-দাইয়ার আল-বাকরী (মৃঃ ৯৬৬হিঃ), তারীখুল খামীস ফী আহওয়ালে আনফুসিন নাফীস, (বৈরূত : দারু ছাদির, তাবি), ২/২৯০; আবুল ফারজ আলী ইবনু ইবরাহীম ইবনে আহমাদ আল-হালাবী (মৃঃ ১০৪৪হিঃ), আস-সীরাতুল হালাবিয়া, (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ২য় প্রকাশ, ১৪২৭ হিঃ), ৩/৪০৫।
[4]. ইবনু আসাকির (মৃত্যু ৫৭১হিঃ), তারীখু দিমাশক, ১৩/৩০৩ পৃঃ।
[5]. আল-ইস্তী‘আব, ১/৩৮৭ পৃঃ।
[6]. আবূদাঊদ হা/৪৬৪৬, তিরমিযী হা/২২২৬; মিশকাত হা/৫৩৯৫।
[7]. হাকেম হা/৪৮০৮।
[8]. বুখারী হা/২৭০৪, মিশকাত হা/৬১৩৫।
[9]. বুখারী হা/২৭০৪, ৩৬২৯, ৩৭৪৬, ৭১০৯।
[10]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/৪৬ পৃঃ।
[11]. আবু নু‘আইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া ২/৩৮; আল-ইস্তী‘আব ১/৩৮৮ পৃঃ।
[12]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/২০ পৃঃ।
[13]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/৪৬ পৃঃ।
[14]. বিস্তারিত দ্রঃ আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/১৬-১৮, ইবনুল আছীর, কামেল ফিত তারীখ ৩/৫-৮।
[15]. আল-ইস্তী‘আব ১/৩৮৭ পৃঃ।
[16]. তিরমিযী হা/২২২৬; আবু দাউদ হা/৪৬৪৬-৪৭; ছহীহাহ হা/৪৫৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৩২৫৭।
[17]. ড. আলী মুহাম্মাদ আছ-ছাল্লাবী, আমীরুল মুমিনীন হাসান ইবনু আলী ইবনে আবী তালেব: শাখছিয়াতুহু ওয়া আছরুহ, (মিশর : দারুত তাওযী‘ ওয়ান নাশর আল-ইসলামী, ১ম প্রকাশ ১৪২৫ হিঃ/২০০৪ খ্রিঃ), পৃঃ ২০৩।
[18]. আমীরুল মুমিনীন হাসান ইবনু আলী ইবনে আবী তালেব: হায়াতুহু ওয়া আছরুহ, পৃঃ ২০৩।
[19]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/১৬-১৭, ১১/১৩৪ পৃঃ।
[20]. হাকেম হা/৪৬১৩; আহমাদ হা/২৪২৯৯; ছহীহাহ হা/৪৭৪।
[21]. মুসনাদে বাযযার হা/৪৭৭৭; মাজমাঊয যাওয়ায়েদ হা/১২০২৬, সনদ ছহীহ।
[22]. হাকেম হা/৪৬১৩; আহমাদ হা/২৪২৯৯; ছহীহাহ হা/৪৭৪।
[23]. ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাকাতু কুবরা, ১/২৭৩-৭৪ পৃঃ।
[24]. আল-বিদায়াহ ৭/২২৯-২৪০।
[25]. যায়লাঈ, নাছবুর রায়াহ ৪/৭০; আল-ইস্তী‘আব ১/২৭৫; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/১৯৩, ৩/২১১; ছহীহাহ হা/৪৭৪-এর আলোচনা দ্রঃ।
[26]. হাকেম হা/৬৭১৭; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/১৯৩, সনদ ছহীহ।
[27]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪৭৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[28]. হাকেম হা/৪৫৫৭; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৫৯৯০, সনদ ছহীহ।
[29]. আল-ইস্তী‘আব ১/২৯২।
[30]. হাকেম হা/৫৫৮০; আহমাদ হা/৭৯৯, সনদ হাসান।
[31]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৭/২৪৭।
[32]. বিস্তারিত দ্রঃ সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪৭৪-এর আলোচনা; ইবনুল ‘আরাবী, আল-‘আওয়াছিম মিনাল ক্বাওয়াছিম ১/১৫৬-১৬২; সায়ফ বিন ওমর আসাদী, আল-ফিৎনাতু ওয়া ওয়াক্ব‘আতুল জামাল; ড. আকরাম যিয়া উমরী, ‘আছরুল খিলাফাতির রাশেদাহ পৃ. ৪৫০-৪৬১।
[33]. ত্বাবারাণী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৪।
[34]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/১৫৪-৫৫।
[35]. তিরমিযী হা/৩৭০৫; ইবনু মাজাহ হা/১১২; মিশকাত হা/৬০৬৮।
[36]. মোল্লা আলী ক্বারী (মৃত্যু ১০১৪হিঃ), মিরক্বাতুল মাফাতীহ শরহু মিশকাতুল মাছাবীহ (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১ম প্রকাশ, ১৪২২হিঃ/২০০২ খ্রিঃ), ৯/৩৯২৪।
[37]. আকরাম যিয়া আল-উমরী, ‘আছরুল খিলাফাহ পৃ. ৪৭১-৭২।
[38]. আমীরুল মুমিনীন হাসান ইবনু আলী ইবনে আবী তালেব, পৃঃ ১৭৯; আক্বীদাতু আহলিস সুন্নাহ ফিছ ছাহাবাতি, ২/৭২৭।
[39]. আমীরুল মুমিনীন হাসান ইবনু আলী ইবনে আবী তালেব, পৃঃ ১৭৯।
[40]. আবুদাঊদ হা/৪২৫৭।
[41]. আবুদাঊদ হা/৪২৫৯; মিশকাত হা/৫৩৯৯।