ইসলামের প্রাথমিক যুগে নবী করীম (ছাঃ) ও তাঁর সাথীদের আর্থিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। তিন বেলা পেট পুরে আহার করার মত সংগতি অনেকেরই ছিল না। তবুও তাঁরা ছিলেন দুনিয়া বিমুখ। বরং তাদের প্রচেষ্টা ও সাধনা ছিল পরকালে মুক্তি ও জান্নাত লাভের জন্য কাজ করা। সম্পদ লাভের লোভ-লালসা তাদের মাঝে ছিল না। এমনকি পেলে খেতেন, না পেলে না খেয়ে পেটে পাথর বেঁধে থাকতেন। নিম্নের হাদীছটিই তার প্রমাণ।
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! তিনি ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই। আমি ক্ষুধার তাড়নায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকতাম। আবার কখনো পেটে পাথর বেঁধে রাখতাম। একদিন আমি (ক্ষুধার যন্ত্রণায়) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবীগণের রাস্তায় বসে থাকলাম। আবুবকর (রাঃ) পাশ দিয়ে গেলেন। আমি তাকে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি আমাকে তৃপ্তি সহকারে খাওয়াবেন। কিন্তু তিনি কিছু না করেই চলে গেলেন। অতঃপর ওমর (রাঃ) অতিক্রম করলেন। তাকেও একইভাবে প্রশ্ন করলাম। তিনিও কোন কিছু না করে চলে গেলেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) যাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে দেখে মুচকি হাসলেন। আমার মন ও চেহারার অবস্থা তিনি বুঝতে পারলেন। বললেন, আবু হুরায়রা! আমার সাথে চল। আমি তাঁর সাথে চললাম। তিনি নিজ গৃহে পৌঁছে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন এবং আমাকেও অনুমতি দিলেন। ঘরে গিয়ে তিনি একটি পেয়ালায় কিছু দুধ পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এই দুধ কোথা থেকে এলো। তারা (গৃহবাসী) বলল, অমুকের পক্ষ থেকে হাদিয়া স্বরূপ দেওয়া হয়েছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে আবু হুরায়রা! ‘আহলে ছুফফা’র নিকটে যাও এবং তাদেরকে ডেকে নিয়ে আস।
রাবী বলেন, ছুফফাবাসীরা ছিল ইসলামের মেহমান। তাদের কোন পরিবার, সম্পদ বা কারো উপর নির্ভর করার মত কেউ ছিল না। যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে কোন ছাদাক্বা আসত, তখন তিনি নিজে কিছু গ্রহণ না করে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। আর যখন কোন হাদিয়া আসত, তখন তার কিছু অংশ তাদেরকে দিতেন। কিছু অংশ নিজের জন্য রাখতেন। (আবু হুরায়রা বলেন) এ আদেশ শুনে আমি নিরাশ হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম যে, এ সামান্য দুধ দিয়ে ছুফফাবাসীদের কি হবে? এ সামান্য দুধ তো আমার জন্যই যথেষ্ট হ’ত। এটা পান করে আমার শরীরে শক্তি ফিরে আসত।
এদিকে তিনি আমাকে আদেশ দিলেন আমিই যেন দুধটুকু তাদের মাঝে পরিবেশন করি। ফলে আমার আর কোন আশাই থাকল না যে, আমি এই দুধ থেকে কিছু পাব। কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ না মেনে কোন উপায় নেই। তাই তাদের কাছে গিয়ে তাদেরকে ডেকে আনলাম। ঘরে প্রবেশ করে তারা বসলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আবু হুরায়রা পেয়ালাটি নাও এবং তাদের মধ্যে পরিবেশন কর। আমি পেয়ালাটি নিয়ে তাদের একজনকে দিলাম। তিনি তৃপ্তি সহকারে পান করে পেয়ালাটি ফেরত দিলেন। অতঃপর আরেকজনকে পেয়ালাটি দিলাম। তিনিও তৃপ্তি সহকারে পান করে আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। এভাবে দিতে দিতে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। তারা সবাই তৃপ্তি সহকারে পান করলেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পেয়ালাটি নিজ হাতে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন এবং বললেন, হে আবু হুরায়রা এখনতো তুমি আর আমি আছি। আমি বললাম, আপনি ঠিক বলেছেন হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, তুমি বস এবং পান কর। তখন আমি বসে পান করলাম। তিনি বললেন, আরও পান কর। আমি আরও পান করলাম। তিনি আমাকে পান করার নির্দেশ দিতেই থাকলেন। এমনকি আমি বললাম যে, আর না। ঐ সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন, আমার পেটে আর জায়গা নেই। তিনি বললেন, তাহ’লে আমাকে দাও। আমি পেয়ালাটি তাঁকে দিলাম। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন ও বিসমিল্লাহ বলে বাকী দুধটুকু পান করলেন’ (বুখারী হা/৬৪৫২)।
শিক্ষা :
(১) সর্বাবস্থায় আল্লাহ ও তদীয় রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশ-নিষেধকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া।
(২) নিজেদের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অন্যকে প্রাধান্য দেয়া।
(৩) অভাব-অনটনের কথা প্রকাশ না করে তা গোপন রাখা এবং প্রয়োজনের ইঙ্গিত দেয়া উত্তম।
(৪) বিনা অনুমতিতে আমন্ত্রণকারীর বাড়ীতে প্রবেশ না করা।
(৫) নবী করীম (ছাঃ) হাদিয়া বা উপঢৌকন গ্রহণ করতেন। কিন্তু ছাদাক্বাহ খেতেন না। বরং তা হক্বদারদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন।
(৬) পরিবেশনকারীর শেষে গ্রহণ করা।
(৭) বসে পান করা এবং শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ ও শেষে ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বলা।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে উপরোক্ত হাদীছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন- আমীন!
মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
পিঞ্জুরী, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ।