ছিফফীনের যুদ্ধে শালিস নিয়োগকে কেন্দ্র করে ৮ হাযার লোক আলী (রাঃ)-এর দল ত্যাগ করে চলে যায়। তারা হারূরা নামক স্থানে সমবেত হয়। তাদেরকে হারূরী বা খারেজী বলা হয়। তাদের দল ত্যাগ সম্পর্কে নিম্নের হাদীছ।-

ওবায়দুল্লাহ বিন ইয়ায বিন আমর আল-ক্বারী বলেছেন, আব্দুল্লাহ বিন শাদ্দাদ আলী (রাঃ)-এর নিহত হওয়ার কয়েক দিন পর ইরাক থেকে ফিরে আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে আসলেন। আমরা তখন আয়েশা (রাঃ)-এর নিকটে বসেছিলাম। আয়েশা (রাঃ) তাকে বললেন, হে আব্দুল্লাহ বিন শাদ্দাদ! আমি যা তোমাকে জিজ্ঞেস করব তুমি কি তার জবাবে আমাকে সত্য বলবে? আলী (রাঃ) কর্তৃক নিহত লোকদের ঘটনা আমাকে বর্ণনা কর। সে বলল, আমার কী হয়েছে যে, আপনার কাছে সত্য বলব না? আয়েশা (রাঃ) বলেন, তাদের কাহিনী আমাকে বল। তিনি বললেন, আলী (রাঃ) যখন মু‘আবিয়ার সাথে চুক্তিবদ্ধ হ’লেন এবং দু’জন শালিসে তাদের সিদ্ধান্ত দিলেন, তখন আট হাযার কুরআনের পাঠক (হাফেয) তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসল। তারা ‘হারূরা’ নামক স্থানে কূফার দিক থেকে এসে সমবেত হ’ল এবং তারা এই বলে (আলী রাঃ-কে) ভৎর্সনা করল, যে জামাটি আল্লাহ আপনাকে পরিয়েছিলেন, (অর্থাৎ খিলাফত) তা আপনি খুলে ফেলেছেন এবং যে নামে আল্লাহ আপনাকে নামকরণ করেছিলেন তা আপনি খুইয়ে ফেলেছেন। তারপর আপনি এতদূর গিয়েছেন যে, আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে অন্যদের শালিস মেনেছেন। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া আর কারো শাসন নয় (অর্থাৎ আপনাকে শাসক মানি না)। আলী (রাঃ) যখন তাদের এই ভৎর্সনা ও তাদের পক্ষ থেকে তাকে ত্যাগ করার খবর শুনলেন, তখন জনৈক ঘোষণাকারীকে দিয়ে এই ঘোষণা জারী করালেন যে, আমীরুল মুমিনীনের কাছে কুরআন বহনকারী ছাড়া আর কেউ যেন না আসে।

(এ ঘোষণার ফলে) যখন আলী (রাঃ)-এর বাড়ি হাফেযদের দ্বারা পূর্ণ হয়ে গেল, তখন একটি বড় আকারের কুরআন মাজীদ তাঁর কাছে নিয়ে আসার আদেশ দিলেন। সেই কুরআন মাজীদটি তাঁর সামনে রাখা হ’ল। তিনি তার উপর হাত রেখে বললেন, ওহে কুরআন মাজীদ! মানুষকে জানাও। লোকেরা তাঁকে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! তার কাছে আপনি কি জানতে চাইছেন? সেতো একটা কাগজের ওপর কিছু কালি ছাড়া কিছু নয়। আর আমরা বলছি, আমাদের পক্ষ থেকে যা বর্ণনা করা হয়েছে সে সম্পর্কে। সুতরাং আপনি কি চান?

আলী (রাঃ) বললেন, তোমাদের এসব সাথী, যারা বিদ্রোহ করেছে, তাদের ও আমাদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব ফায়ছালাকারী হিসাবে বিদ্যমান। আল্লাহ তাঁর কিতাবে একজন পুরুষ ও স্ত্রী সম্পর্কে বলেছেন,وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا    إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللهُ بَيْنَهُمَا ‘আর যদি তোমরা (স্বামী-স্ত্রী) উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশংকা কর, তাহ’লে স্বামীর পরিবার থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন শালিস নিযুক্ত কর। যদি তারা উভয়ে মীমাংসা চায়, তাহ’লে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে (সম্প্রীতির) তাওফীক্ব দান করবেন’ (নিসা ৪/৩৫)। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মতের রক্ত ও সম্মান একজন স্বামী ও স্ত্রীর চেয়ে অনেক বেশী মর্যাদা সম্পন্ন। তারা আমার উপর রাগান্বিত এজন্য যে, আমি মু‘আবিয়ার সাথে সন্ধি করেছি। অথচ আবু তালিবের ছেলে আলী চুক্তি লিখেছিল। আর সুহাইল বিন আমর এসেছিল এবং আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। সেসময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর নিজ গোত্র কুরাইশের সাথে হুদায়বিদায়ার সন্ধি করেছিলেন।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) লিখলেন, ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’। সুহাইল বলল, ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’ লিখবেন না। তিনি বললেন, তাহ’লে কিভাবে লিখব? সে বলল, লিখুন, ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, লেখ ‘আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ’। সুহাইল (বাধা দিয়ে) বলল, আমরা যদি আপনাকে আল্লাহর রাসূল মানতাম, তাহ’লে তো আপনার বিরোধিতা করতাম না। তাই রাসূল (ছাঃ) লিখলেন, ‘এটা সেই সন্ধি, যা আব্দুল্লাহর ছেলে মুহাম্মাদ কুরাইশের সাথে স্থাপন করেছেন’। আল্লাহ তাঁর কিতাবে বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে’ (আহযাব ৩৩/২১)।  অতঃপর আলী (রাঃ) তাদের নিকট আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)-কে পাঠালেন। আমিও তার সাথে রওনা হ’লাম। যখন তাদের বাহিনীর মাঝে পৌঁছলাম, তখন ইবনু কাওয়া জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতে লাগল। সে বলল, হে কুরআন বহনকারীগণ! এ হচ্ছে আব্দুল্লাহ ইবনুল আববাস। তাঁকে যারা চেনে না, আমি তাদের সামনে আল্লাহর কিতাব থেকে তাঁর পরিচয় তুলে ধরছি। এই ব্যক্তি তাদেরই একজন, যাদের সম্পর্কে কুরআনে নাযিল হয়েছে قَوْمٌ خَصِمُوْنَ ‘তারা একটি ঝগড়াটে জাতি’ (যুখরুফ ৪৩/৫৮)। সুতরাং তাকে তার বন্ধুর কাছে (আলীর কাছে) ফেরত পাঠাও এবং তার সাথে আল্লাহর কিতাব দ্বারা বাজি ধর না।

তৎক্ষণাৎ তাদের মধ্য থেকে অন্যান্য ভাষণদাতা উঠে বলল, আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই তার সাথে আল্লাহর কিতাব দ্বারা বাজি ধরব। সে যদি সত্য ও সঠিক বক্তব্য নিয়ে আসে এবং আমরা তা বুঝতে পারি তাহ’লে আমরা অবশ্যই তা মেনে চলব। আর যদি অসত্য নিয়ে আসে, তাহ’লে আমরা তাকে অবশ্যই তার বাতিল যুক্তিকে পরাজিত করব। তারপর তারা আব্দুল্লাহর সাথে তিনদিন আল্লাহর কিতাবের বাজি ধরে রইল। এরপর তাদের (মু‘আবিয়ার পক্ষের) মধ্য থেকে চার হাযার ব্যক্তি (তাদের বাজি প্রত্যাহার করল এবং প্রত্যেকে) তওবা করল। ইবনুল কাওয়াও তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি তাদের সবাইকে কূফায় আলীর নিকট হাযির করলেন।

আলী (রাঃ) অবশিষ্ট লোকদের নিকট এই মর্মে বার্তা পাঠালেন যে, ইতিমধ্যে আমাদের ও জনগণের মধ্যে যা হয়েছে, তা তো তোমরা দেখতেই পেয়েছ। সুতরাং তোমরা যেখানে চাও, স্থির হও, যতক্ষণ মুহাম্মাদ (রাঃ)-এর উম্মত আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমবেত না হয়। তোমরা কোন অবৈধ রক্তপাত কর না। ডাকাতি, রাহাজানি কর না। যিম্মীদের ওপর যুলুম কর না। যদি এসব কর, তাহ’লে আমরাও একইভাবে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাসঘাতকদেরকে পসন্দ করেন না। আয়েশা (রাঃ) তাকে বললেন, হে ইবনে শাদ্দাদ! আলী কি তাদেরকে হত্যা করেছিলেন? ইবনে শাদ্দাদ বললেন, আল্লাহর কসম! তাদের কাছে আলী (রাঃ) কোন বাহিনী ততক্ষণ পাঠাননি, যতক্ষণ না তারা ডাকাতি ও লুটপাট চালিয়েছে, রক্তপাত করেছে এবং যিম্মীদের (অমুসলিমদের) ওপর অত্যাচার চালিয়েছে।

আয়েশা (রাঃ) বললেন, সত্যি? সে বলল, আল্লাহর কসম! যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। এটাই ঘটেছিল। আয়েশা (রাঃ) বললেন, তাহ’লে ইরাকীদের সম্পর্কে আমি যে শুনলাম, তারা বলাবলি করে, ‘উন্নত বক্ষা নারীদের মালিক, উন্নত বক্ষা নারীদের মালিক’- এটা কি? ইবনে শাদ্দাদ বললেন, (যে ব্যক্তি এ রকম রটনা করে) তাকে আমি দেখেছি এবং আলীকে সাথে নিয়ে নিহতদের মধ্যে তার জানাযা পড়েছি। তিনি লোকজনকে ডাকলেন এবং বললেন, তোমরা কি একে চেন? বহুলোক এসে বলল, ওকে অমুক গোত্রের মসজিদে ছালাত আদায় করতে দেখেছি, অমুক মসজিদে ছালাত আদায় করতে দেখেছি। কিন্তু এটুকু ছাড়া কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কেউ দিতে পারল না।

আয়েশা (রাঃ) বললেন, আলী (রাঃ) যখন তার জানাযা পড়লেন, তখন ইরাকবাসী যে ধারণা পোষণ করে, তার সম্পর্কে তিনি কি বললেন? ইবনে শাদ্দাদ বললেন, তাকে বলতে শুনলাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্য বলেছেন। আয়েশা (রাঃ) বললেন, তাকে কি অন্য কিছু বলতে শুনেছ? ইবনে শাদ্দাদ বললেন, আল্লাহর কসম! না। আয়েশা (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্যই বলেছেন। আল্লাহ আলীর ওপর রহমত করুন। কারণ তিনি যে কোন বিস্ময়কর ব্যাপার দেখলেই বলতেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্য বলেছেন। অথচ ইরাকবাসী তাঁর ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে ও অতিরঞ্জিত কথা বলে (মুসনাদে আহমাদ হা/৬৫৬, সনদ হাসান)


পরিশেষে বলব, পবিত্র কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। যার আদেশ-নিষেধ মানুষ মেনে চলবে এবং এর বিধান মানুষ বাস্তবায়ন করবে। আর এজন্য সালাফে ছালেহীনের মানহাজ বা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!







নবী-রাসূলগণের পরিত্যক্ত সম্পত্তি ছাদাক্বা হিসাবে গণ্য হয় - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
আল্লাহর উপর ভরসার প্রতিদান - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
সৌন্দর্যই মর্যাদার মাপকাঠি নয় - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ইবাদত পালনে আবুবকর (রাঃ)-এর ত্যাগ ও রাসূল (ছাঃ)-এর হিজরত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
রাসূল (ছাঃ) ও মুজাহিদদের সম্পদে বরকত - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
যাকাত না দেওয়ার পরিণাম - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
জন্মভূমি থেকে আবুবকর (রাঃ)-কে বহিষ্কার ও তাঁর অসীম ধৈর্য - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
মদীনার পথে - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
সালমান ফারেসী (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
যু-কারদ ও খায়বার যুদ্ধে ছাহাবীগণের বীরত্বের কিছু ঘটনা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
আসমা বিনতু আবী বকর (রাঃ)-এর সীমাহীন দৃঢ়তা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
ইয়ামামাবাসীর নেতা ছুমামাহ বিন উছাল (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
আরও
আরও
.