ঠাকুরগাঁও সদরের পাহাড়ভাঙা গ্রামের ডাঃ খোরশেদ আলী। ২০১৩ সালে এক বজ্রবৃষ্টির বিকেলে হঠাৎ বিকট আওয়াজে তার চোখের সামনে একটি তালগাছের উপর বজ্রপাত হয়। তাতে পলকের মধ্যে সেটি চিরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আল্লাহর বিশেষ রহমতে সেদিন বেঁচে যায় খোরশেদ আলী ও তার পরিবার।
সেদিনই তিনি নিয়ত করে ফেললেন তালগাছ লাগাবেন গ্রামজুড়ে বজ্রপাতের বর্ম হিসেবে। খোরশেদ তালের বীজ জোগাড় করতে নেমে পড়লেন। তাল পেকে ওঠার মৌসুম আশ্বিন-কার্তিক মাসে তিনি ঘুরতে থাকলেন একটা পুরানো মোটরসাইকেল নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি। একটাকা-দু’টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করতে লাগলেন তালের আঁটি।
তার নিজস্ব টালিখাতার হিসাব মতে গত ৯ বছরে খোরশেদ আলী ৫২ হাযার ৩০০টি তালগাছ লাগিয়েছেন। ঠাকুরগাঁও সদরের চিলারং, আখানগর, আকচা ও বালিয়াডাঙ্গীর দুওসুও ইউনিয়নের রাস্তার দু’ধারে হাযার হাযার তালগাছ এখন খোরশেদ আলীর জীবন্ত স্মারক।
আগে তিনি ছুটতেন রোগীর চিকিৎসায়, এখন ছোটেন তালগাছের শুশ্রূষায়। সঙ্গে থাকে শাবল আর নিড়ানি। লোক রেখেছেন ৪জন। তাদের দায়িত্ব বাড়ি বাড়ি ঘুরে তালের আঁটি জোগাড় করা। সবকিছুই করেন নিজ খরচে। এসব করতে গিয়ে জমিও খুইয়েছেন অনেক।
নৈশ অভিযান : এ বিষয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা জানিয়ে সত্তুরোর্ধ্ব বয়সের এই মানুষটি বলেন, জমির পাশে তালের আঁটি দেখলেই অনেকে ক্ষিপ্ত হয়ে যেত। তালগাছের ছায়ায় ঢাকা পড়ে শীর্ণ হয়ে যাবে অন্য কচি গাছ, সেই আশঙ্কায় রাস্তার ধারে আঁটি লাগাতে বাধা দিত তারা। শিশুরা সে আঁটি পেলে তুলে খেয়ে নিত ভেতরের শাঁস। আর আঁটি বা চারা যা-ই পেত উপড়ে ফেলত লোকেরা। এমন বৈরী পরিস্থিতিতে তিনি বেরোতে শুরু করলেন রাতের আঁধারে তালের আঁটি রোপণের অভিযানে।
২০১৪ সালে তিনি ৫ হাযার তালের আঁটি লাগান ঠাকুরগাঁও সদরের পল্লী বিদ্যুৎ এলাকা থেকে রেলগুমটি পর্যন্ত সড়কজুড়ে। সবকিছুর হিসাব লেখা রয়েছে তার নিজস্ব টালিখাতায়।
এই বয়সে এত কষ্ট করেন কেন? এর উত্তরে একগাল হেসে বুক ভরা সাদা দাড়িমন্ডিত এই বৃদ্ধ মানুষটি বলেন, তিনি পত্রিকায় পড়েছেন, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের মে পর্যন্ত দেশে নাকি বজ্রপাতে ১২টি শিশুসহ ৩৪০ জন মারা গেছেন। তালগাছ বজ্রপাত প্রতিরোধ করে। নিজের অভিজ্ঞতায়ও তিনি সেটি বাস্তবে দেখেছেন। তাছাড়া গাছে তাল ধরলে তো মানুষ খেতে পারবে। পশুপাখিও খাবে’।
তালের আঁটি কেনা ও লাগানোর খরচ জোগাড় করতে বাপ-দাদার জমি বিক্রি করতে হয়েছে তাঁকে। কয়েক মাস আগে আবারও জমি বিক্রি করতে গেলে ছেলের বাধার মুখে পড়েন তিনি।
[আমরাও তাকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই। এই পরোপকারের জন্য আল্লাহ তাকে উত্তম জাযা দান করুন! এর মধ্যে অন্যদের জন্যেও শিক্ষণীয় রয়েছে। ভূমিকম্প থেকে আত্মরক্ষার বিষয়ে ‘আবহাওয়াগত বিপর্যয়রোধে ব্যবস্থা নিন!’ শিরোনামে আমাদের সম্পাদকীয় অক্টোবর ২০২১ পাঠ করুন (স.স.)]।