দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাযার ১৪৭ টি। এর মধ্যে সরকারী বিদ্যালয়ের সংখ্যা হ’ল ৬৫ হাযার ৯০২টি। এ সমস্ত সরকারী স্কুলের শিক্ষার্থীরা সকলেই সরকারী সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত। এর বিপরীতে বাংলাদেশে ইবতেদায়ী মাদ্রাসার সংখ্যা মাত্র ১৪ হাযার ৯৮৭টি। যার মধ্যে একটি মাদ্রাসাও সরকারী নয়। এসকল মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সরকারী কোন সুযোগ-সুবিধাই পায় না। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। মেধার ভিত্তিতে এসব স্কুল শিক্ষার্থীদের বৃত্তিব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিপরীতে ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য এরকম কোন ব্যবস্থা নেই। এ জাতীয় বিভিন্ন সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে তারা শূন্যের কোঠায় রয়ে গেছে। অথচ মাদ্রাসার অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের সন্তান।
সরকারী এক হিসাব মতে, এত কিছুর পরেও সরকারী প্রাইমারী থেকে প্রতিবছর ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫২ থেকে ৫৫ শতাংশ। অন্যদিকে ইবতেদায়ী মাদ্রাসা থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০ থেকে ৪২ শতাংশ।[1] স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে সরকারী ব্যাপক সুযোগ সুবিধা। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের জন্য গড়ে উঠেছে ডিবেটিং সোসাইটি ও ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব। গড়ে উঠেছে নানা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাদের জন্য রয়েছে বিনোদনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য এ জাতীয় কোন কিছুর ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কোন সেক্টরেই তাদের জন্য এ জাতীয় কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। মাদ্রাসার এ সমস্ত বালক-বালিকা এবং কিশোর-কিশোরীরা বিনোদনের সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তারা মানবিক গুণাবলী বিকাশে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারা শুধুমাত্র রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত কিছু অনুষ্ঠান পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সকল প্রতিষ্ঠানে আবার এ অনুষ্ঠান পালিত হয় না। গুটিকয়েক মাদ্রাসা রাষ্ট্রীয় কিছু অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। সেটাও আবার নিয়ম রক্ষা ও লোক দেখানোর জন্য।
মাদ্রাসাগুলো সবচেয়ে বঞ্চিত হচ্ছে জাতীয়করণের ক্ষেত্রে। প্রতিটি সরকার তার সময়কালে দেশের স্কুল এবং কলেজ জাতীয়করণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বর্তমান সরকার ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারী ২৬ হাযার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছে। কিন্তু জাতীয়করণের এ তালিকায় কখনোই মাদ্রাসাকে যুক্ত করা হয়নি। বাংলাদেশে মাত্র তিনটি সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা রয়েছে। এর প্রথমটি হ’ল মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকা। এ মাদ্রাসাটি বাংলাদেশের কোন সরকার প্রতিষ্ঠা করেনি। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৮০ সালে। ফোর্ট
উইলিয়ামের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক কলকাতায় এটা প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদ্রাসাটি পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। দ্বিতীয় সরকারী আলিয়া মাদ্রাসাটি হ’ল সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা। এটিও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নয়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ আমলে তথা ১৯১৩ সালে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ সরকারী উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তৃতীয় সরকারী আলিয়া মাদ্রাসাটি হ’ল সরকারী মুস্তাফাবিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, বগুড়া। এটাও প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৫ সালে অর্থাৎ ব্রিটিশ পিরিয়ডে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেব আবু বকর ছিদ্দীক (রহঃ)। ১৯৮৬ সালে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদ এটাকে সরকারীকরণ করেন।
মাউশির তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৬২টি। ২০১০ সালের আগে সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল ৩৪৮টি। অর্থাৎ গত ১২ বছরে দেশে ৩১৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারী হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১২ই আগস্ট ২৭১টি কলেজকে সরকার সরকারী ঘোষণা করেছে। উল্লেখিত বর্ণনা এটাই প্রমাণ করে যে, বর্তমান সরকার শিক্ষা বান্ধব সরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হ’ল, দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা উপেক্ষিত রয়ে গেছে। অথচ দেশে ইবতেদায়ী, দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। এ বিশাল শিশু ও যুবশক্তি সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত। এছাড়া দেশে কওমী মাদ্রাসার সংখ্যা ১৪ হাযারের মতো। আর শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এ বিশাল জনশক্তি একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। ইতিপূর্বে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা দেশের শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক উন্নয়নেও তাদের অবদান উল্লেখ করার মতো। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি তারাও দেশ গড়ায় অনন্য ভূমিকা রেখেছেন।
উদাহরণ হিসাবে আমরা নবাব আব্দুল লতিফের কথা উল্লেখ করতে পারি। বাংলার বিখ্যাত এ নবাব ফরিদপুর যেলার বোয়ালমারী থানার শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসাবে পরিচিত। তিনি ছিলেন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। কর্মজীবনে রয়েছে তার অভূতপূর্ব অবদান। ১৮৪৯ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৮৭৭ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট পদে প্রমোশন পান। ১৮৬২ সালে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের সর্বপ্রথম মুসলিম সদস্য হিসাবে মনোনীত হন। ১৮৬৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো মনোনীত হন। একই সালে তিনি কলকাতা মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি গঠন করেন। তাঁর প্রচেষ্টাতে কলকাতা মাদ্রাসায় ফার্সী এবং বাংলা শিক্ষার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। তাঁরই নেতৃত্বে হাজী মুহাম্মাদ মহসিন ফান্ডের টাকা মুসলিম সন্তানদের শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়। তিনি ‘আলিগড় বৈজ্ঞানিক সোসাইটি’র সদস্য ছিলেন। উল্লেখ্য, তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের সহপাঠী ছিলেন। তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৮৮০ সালে ইংরেজরা তাকে নবাব উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে তিনি নবাব বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন। ঢাকা আলিয়ার আরেকজন উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থী হ’লেন সৈয়দ আমীর আলী। তিনি উড়িষ্যার কটকে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকালে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় (যেটা পরবর্তীতে ঢাকা আলিয়ায় রূপান্তরিত হয়) ভর্তি হন। তিনি আরবী ভাষা ও ব্যাকরণে যথেষ্ট পন্ডিত ছিলেন। ১৮৭৩ সাল থেকে ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে মুসলিম আইনের অধ্যাপক ছিলেন। ১৮৭৮-১৮৮১ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ১৮৮৪ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ঠাকুর আইনের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৮৯০ সালে তিনি কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলিম বিচারপতি নিযুক্ত হন। অর্থাৎ বৃটিশ আমলে মাদ্রাসা শিক্ষা আর কলেজ শিক্ষার মধ্যে কোন বৈষম্য ছিল না।
ঢাকা আলিয়ার অন্য একজন উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থী হ’লেন মুহাম্মাদ ফখরুদ্দীন। তিনি ১৯৬৩ সালে ঢাকা আলিয়ায় কামিল হাদীছ বিভাগে ভর্তি হন। তিনি একই মাদ্রাসায় প্রভাষক এবং উপাধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শায়খুল হাদীছ। তিনি সিলেট সরকারী আলিয়ার ২৬তম অধ্যক্ষ ছিলেন। ২০০০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন। প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনে তার সততা ও যোগ্যতা ছিল উল্লেখ করার মতো। আর একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর নাম আমরা গর্বের সাথে উল্লেখ করতে পারি। তিনি হ’লেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সিলেটের কৃতি সন্তান জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সিলেট যেলায় ১৯২৮ সালে তার জন্ম। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসায়। তিনি এ মাদ্রাসায় হাই সেকশনে ভর্তি হয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি বাংলা, ইংরেজী, উর্দূ ও অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি আরবী ভাষাতেও দক্ষ ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। ২০১৮ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়। তিনি ছিলেন দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য। ১৯৯৬ সালের ১৪ই জুলাই তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন।
এছাড়া সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকজন ছাত্র হ’লেন- আবু সাঈদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সৈয়দ লোকমান হোসেন, তিনি ঢাকা যেলার অতিরিক্ত যেলা প্রশাসক হিসাবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন। একই মাদ্রাসার ছাত্র ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সাবেক সংসদ সদস্য। উক্ত আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, অতীতে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা দেশ ও জাতি গড়ায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তারা দেশ ও জাতির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছেন।
কিন্তু বর্তমানে এ শিক্ষাব্যবস্থাকে দুঃখজনকভাবে অবহেলা করা হচ্ছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় একজন ছাত্রও পাস করেনি এমন কলেজকে সরকার জাতীয়করণ করেছে। অথচ দেশের নামকরা অসংখ্য মাদ্রাসা আছে যে সমস্ত মাদ্রাসার পাশের হার শতভাগ। এ মাদ্রাসাগুলো শুধু শতভাগ পাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এ মাদ্রাসা সমূহের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আকাশচুম্বী সাফল্য দেখাচ্ছেন। তারপরও এসমস্ত মাদ্রাসার নাম জাতীয়করণের তালিকাভুক্ত হয় না। ফলে মাদ্রাসা সমূহের দরিদ্র শিক্ষার্থীরা যুগের পর যুগ বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। মেধার স্বাক্ষর রেখেও তারা সরকারী কোন পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে না। মাসিক বিভিন্ন হারে বেতন দিয়ে তাদেরকে লেখাপড়া চালাতে হচ্ছে। এসমস্ত গরীব শিক্ষার্থী মাসে সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা বেতন দিয়ে লেখাপড়া করছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এ বেতন ৩০০ থেকে ৫০০ পর্যন্ত বৃদ্ধি হচ্ছে।
অন্যদিকে স্কুল-কলেজের চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। সেখানে একদিকে সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়া করছে। আর জাতীয়করণের সুবিধা পেয়ে তারা মাসিক মাত্র ৭ টাকা হারে বেতন দিচ্ছে। মিড ডে মিল ও উপবৃত্তি উপভোগ করছে। ফ্রি ড্রেসসহ সরকারী অন্যান্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা লাভ করছেন।
বাংলাদেশের মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতকরা ২৫ ভাগ হ’ল এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা। এরপরেও এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আজ চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী। সরকারী চাকুরি তাদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারী চাকুরিতে তাদের বিরুদ্ধে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে। দেশের সরকারী চাকুরির ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান ১০ শতাংশেরও নীচে। এ ১০ শতাংশের একজনও আবার পূর্ণাঙ্গভাবে মাদ্রাসার ছাত্র নয়। এদের সকলেই অনার্স ও মাস্টার্স করেছে কোন না কোন কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অর্থাৎ সরকারী চাকরিরত এসব মাদ্রাসার শিক্ষার্থী হাফ মাদ্রাসা ও হাফ কলেজে পড়ুয়া। তাদের অর্ধেক সার্টিফিকেট মাদ্রাসার আর বাকী অর্ধেক কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের। দাখিল এবং আলিম পাশ করে তারা অনার্স ও মাস্টার্স করেছে কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আর এই অনার্স এবং মাস্টার্স দিয়েই তারা চাকুরি করছে সরকারী কোন প্রতিষ্ঠানে। অর্থাৎ সরকারী চাকুরি পাওয়ার আশায় তারা মাদ্রাসাকে বাদ দিয়ে ছুটছে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। এতে ফাযিল এবং কামিল মাদ্রাসা সমূহ মেধাশূন্য হয়ে পড়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় মাদ্রাসায় উচ্চশিক্ষা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সরকারী চাকুরির আশায় তারা ছুটছে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। এতে স্পষ্টতই বলা যায় যে, মাদ্রাসা সমূহের উচ্চশিক্ষা লোক দেখানো মাত্র। এখানে গুণের এবং মানের কোন পৃষ্ঠপোষকতা নেই। মূলত: উচ্চ শিক্ষা বলতে জ্ঞানের সৃজনশীলতা ও গবেষণাকে বুঝায়। প্রেষণা ও উন্নত প্রশিক্ষণও উচ্চশিক্ষার অন্যতম উপাদান ও অনুষঙ্গ। আর এ প্রেষণা ও প্রশিক্ষণ জ্ঞানের সীমারেখাকে বিস্তৃত করে। উন্নত প্রশিক্ষণ একজন শিক্ষার্থীকে উদ্ভাবক ও বিশ্লেষক তৈরিতে সহায়তা করে। জ্ঞানের এ বিস্তৃত ধারা মোটামুটিভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজে চালু আছে। কিন্তু মাদ্রাসা সমূহে এগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই। এখানে স্কুল-কলেজের মত পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ নেই। প্রেষণার ধারণা নেই, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম নেই। নেই উন্নত গবেষণা জার্নাল ও শিক্ষা ছুটির কোন ব্যবস্থা। নেই কোন উন্নত অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনা। বিজ্ঞান বিভাগ থাকলেও সেখানে বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামাদি নেই। ২১৫টি কামিল মাদ্রাসার মধ্যে ৮২তে অনার্স কোর্স চালু আছে। তাও শুধু কুরআন, হাদীছ, দা‘ওয়াহ এবং ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে অনার্স আছে। এর বাইরে মাদ্রাসাগুলোতে কোন অনার্স কোর্স নেই। অর্থাৎ যুগোপযোগী অন্য কোন বিষয়ে অনার্স কোর্স মাদ্রাসাগুলোতে পড়ানো হয় না। আবার এ সমস্ত বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করে মাদ্রাসার প্রশাসনিক পদে চাকরি করার সুযোগ তাদের নেই। যা মাদ্রাসার জনবল কাঠামোতে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। এটা মাদ্রাসাশিক্ষার সাথে মারাত্মক বৈষম্যমূলক আচরণ।[2] অথচ এ আদেশটি বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮(১), ২৮(৩), ২৯(১) ও ২৯(২) ধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
মাদ্রাসার কামিল ডিগ্রীকে মাস্টার্সের মান দেয়া হ’লেও তারা কলেজের ইসলামী শিক্ষার প্রভাষক হ’তে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করার কথাতো তারা ভাবতেই পারেন না। আবার মাদ্রাসার প্রশাসনিক পদে চাকরির যোগ্যতায় তারা নিষিদ্ধ। সরকারী প্রশাসনের উচুঁ স্তরে আবেদনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এটা মাদ্রাসার সাথে এক ধরনের প্রহসন ছাড়া অন্য কিছু নয়। বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষা একেবারেই বঞ্চিত। ডয়চে ভেলের তথ্যানুযায়ী দেশে দাখিল মাদ্রাসার সংখ্যা ৯,২২১টি। আলিম মাদ্রাসা ২,৬৮৮ টি। ফাযিল মাদ্রাসা ১,৩০০টি। আর কামিল মাদ্রাসা ১৯৪টি। এগুলো এমপিওভুক্ত এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত। দেশে প্রতি বছর নিয়ম অনুযায়ী বাজেট ঘোষিত হয়। বছর যায় বছর আসে। প্রতি বছর কম-বেশী বাজেট বৃদ্ধি পায়। কিন্তু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। এ বছর বাজেট ঘোষণার তারিখ ছিল ১১ই জুন ২০২১। এটা ছিল দেশের ৪৯তম বাজেট। দেশে দুই শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। একটি হ’ল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাত। আরেকটি হ’ল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত শিক্ষাখাত। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে বাজেট ধরা হয়েছে ২৪ হাযার ৯৪০ কোটি টাকা। কিন্তু এখানে ইবতেদায়ী মাদ্রাসার জন্য কোন বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়নি। অপরদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খাতে বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৩ হাযার ১১৭ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে দাখিল-আলিম তথা মাদ্রাসার জন্য স্বতন্ত্র কোন বাজেট নির্ধারণ করা হয়নি। শুধুমাত্র কারিগরি প্রতিষ্ঠানের সাথে মাদ্রাসা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮,৩৪৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১ বাজেটে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক খাতে বাজেট বেড়েছে ৫,৪০৭ কোটি টাকা। বিপরীতে মাদ্রাসার জন্য বাজেট বেড়েছে মাত্র ৮৯৪ কোটি টাকা! সরকার স্বীকৃত ও নিয়ন্ত্রিত একটি শিক্ষা বাজেটের এই হাল সত্যি জাতির জন্য লজ্জাজনক। এটা মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য অত্যন্ত অপমানজনক একটি প্রবৃদ্ধি। এত শত অপমান আর লাঞ্ছনার মাঝেও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে বারবার। দেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তাদের রয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। সম্প্রতি তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সেরা সাফল্য অর্জন করেছে। গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে ১ম স্থানটি দখল করেছে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের মেধা তালিকায়ও ১ম হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। দেশে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ পরীক্ষায় ১ম হয়েছে মাদ্রাসার ছাত্র। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঘ’ ইইনিটে ১ম স্থান অধিকার করেছে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। বুটেক্সে ১ম হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)-এ প্রথম হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। হাযারো বিপত্তি, বাধা আর বঞ্চিত থাকার পরেও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের এসব সাফল্য চোখে পড়ার মতো।
এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা অনুষদের ‘খ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে যাকারিয়া। সে ঢাকার দারুন্নাজাত ছিদ্দীকিয়া কামিল মাদ্রাসার ছাত্র। এছাড়া বিগত এক যুগব্যাপী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আকাশচুম্বী সাফল্য দেখিয়েছে। প্রথম স্থানসহ অনেক শীর্ষস্থান তারাই দখল করে আসছে। উল্লেখ্য, ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ‘খ’ ইউনিটে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল মাদ্রাসার ছাত্র আব্দুল খালেক। সেবছর প্রথম ১০ জনের ৪ জনই ছিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষে ‘খ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আব্দুল আলীম। দ্বিতীয় হয়েছিল আরেক মাদ্রাসার ছাত্র সেলিমুল কাদের। এছাড়া তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ স্থান অধিকারীও ছিল মাদ্রাসার ছাত্র। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয় মাদ্রাসার ছাত্র এলিস জাহান। দ্বিতীয় হয় মাদ্রাসা ছাত্র মীযানুল হক। চতুর্থ ও একাদশ স্থানটিও দখল করেছিল ২জন মাদ্রাসা ছাত্র। ২০১০-২০১১ সেশনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা প্রথম হয় মাদ্রাসা ছাত্র মাসরূর বিন আনছারী। ‘ঘ’ ইউনিটে প্রথম হন মাদ্রাসা ছাত্র আসাদুয্যামান। দ্বিতীয় স্থান অধিকারীও ছিল অন্য একজন মাদ্রাসার ছাত্র। এছাড়া ‘খ’ ইউনিটে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ১৬তম, ১৭তম ও ১৮তম হয় মাদ্রাসা ছাত্র। ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ‘খ’ ইউনিটে প্রথম হয় মাদ্রাসার ছাত্র আব্দুর রহমান মজুমদার। একই বছরে সে ‘ঘ’ ইউনিটেও প্রথম স্থান অধিকার করে।
উল্লেখ্য, মেধাতালিকায় ১০ জনের মধ্যে এ বছর মাদ্রাসার ছাত্র ছিল তিনজন। আব্দুর রহমান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েও সর্বাধিক নম্বর পেয়েছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা ছিল ২,২২১টি। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল ৪০ হাযারের অধিক শিক্ষার্থী। আর উত্তীর্ণ হয়েছিল মাত্র ৩,৮৭৪ জন। আর অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩৫ হাযার ৩৮০ জন। আরও মজার ব্যাপার হ’ল, এ বছরের ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজীতে পাশ করার শর্ত ছিল ১৫ নম্বর পাওয়া। উত্তীর্ণ ৩,৮৭৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ইংরেজীতে ১৫ নম্বর পেয়ে পাশ করেছিল কলেজের মাত্র দু’জন ছাত্র। আর মাদ্রাসার ছাত্র আব্দুর রহমানের ইংরেজীতে প্রাপ্ত নম্বর ছিল ২৮.৫০। মাদ্রাসার অন্য দু’জন ছাত্রের ইংরেজীতে প্রাপ্ত নম্বর ছিল ১৫ এর উপরে। অন্যদিকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে আসা কলেজ ছাত্রদের ইংরেজীতে সর্বোচ্চ নম্বর ছিল ২২.৫০।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য কথা হ’ল, মাদ্রাসাছাত্রের সাফল্যে সবসময়ই একধরনের জ্ঞানপাপীর গাত্রদাহ শুরু হয়। এত সাফল্যের পরেও তারা মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে দুর্বল বলে অভিহিত করেন। মাদ্রাসায় প্রণীত ১০০ নম্বরের ইংরেজী ও ১০০ নম্বরের বাংলা নাকি এ দুর্বলতার মূল কারণ। অভিযোগের কারণে ২০১৫ সাল থেকে মাদ্রাসাগুলোতে ২০০ নম্বরের ইংরেজী ও ২০০ নম্বরের বাংলা নতুন করে বাধ্যতামূলক করা হয়। এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ভর্তি হ’তে না পারে। কিন্তু এক্ষেত্রেও মাদ্রাসা ছাত্ররা জ্ঞানপাপীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়। ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পাশের হার ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এতদসত্ত্বেও ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয় মাদ্রাসাছাত্র আব্দুল্লাহ আল-মামূন। একই ইউনিটে মানবিক শাখা থেকে পরীক্ষা দেয়া মাদ্রাসাছাত্র আব্দুছ ছামাদ প্রথম হয়। ‘খ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয় মাদ্রাসাছাত্র রিজাত হোসাইন। ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষের ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় একইভাবে প্রথম স্থান অধিকার করে মাদ্রাসা ছাত্র আব্দুল্লাহ মজুমদার। এ বছর পাসের হার ছিল ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। কিন্তু শুধুমাত্র মাদ্রাসা ছাত্র হওয়ার কারণে আব্দুল্লাহ মজুমদারকে তার পসন্দের বিষয় পড়তে দেয়া হয়নি। অনৈতিক ক্ষমতাবলে কর্তৃপক্ষ আব্দুল্লাহর প্রাপ্য অধিকারকে খর্ব করে দিয়েছেন। যা সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। এত অনৈতিক বাধা-বিপত্তির পরেও ২০১৭-২০১৮ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অবস্থান ছিল জয়জয়কার। এ বছর ঢাবির ‘খ’ ইউনিটে একটি মাদ্রাসা থেকেই ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল ৮৪ জন ছাত্র। এর মধ্যে ছাত্রী ছিল ৫ জন।
এত সাফল্যের পরেও একটি মাদ্রসাকেও সরকারী করা হচ্ছে না। প্রতিবছর শতশত প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হ’লেও মাদ্রাসাগুলো থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত। অথচ এমন অনেক কলেজ আছে যেখানে একজন ছাত্রও পাস করেনি। কিন্তু শুধুমাত্র কলেজ হওয়ার কারণে সেটা জাতীয়করণ হয়ে গেছে।[3] প্রতিবছরই মাদ্রাসা ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে। এমনকি টপ ২০ জনের মধ্যে ১০ জনই থাকে মাদ্রাসা থেকে আগত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করেন। তাদেরকে ভালো বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ দেন না। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ৭ কলেজের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে গত ১৭ই নভেম্বর ২০২১। এ কলেজগুলোতে কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২১ হাযার ১৩২ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ১৪ হাযার ৩৮২ জন। আর এদের মধ্যেও প্রথম হয়েছে ঢাকার দারুন্নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদ্রাসার ছাত্র নাজমুল ইসলাম। ১২০ নম্বরের মধ্যে সে পেয়েছে ১০৭ নম্বর।[4] একইভাবে ২০২০-২১ সালের গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে গত ১৭ই নভেম্বর ২০২১। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৫,৫৪৫ জন। উত্তীর্ণ হয়েছে চার হাযার ৪৯৫ জন। আর প্রথম হয়েছে তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা মহিলা শাখার ছাত্রী হামীদা ইসলাম।
দেশের মোট জনশক্তি এখন ১৬ কোটি ৯১ লাখ। বাংলাদেশ সবেমাত্র এল.সি.ডি অতিক্রম করলেও দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কম নয়। ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২১’এ ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬তম। অথচ বর্তমান সরকারের টার্গেট ২০৪১ সালে দেশকে স্বনির্ভর উন্নত বাংলাদেশ উপহার দেয়া। কিন্তু মাদ্রাসায় পড়ুয়া অর্ধকোটি জনশক্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে সে টার্গেটে পৌঁছানো আদৌ সম্ভব নয়। তাদেরকে অবহেলিত রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ তারাও এদেশের মানুষ। তারা এদেশটাকে তাদের প্রাণের চেয়েও ভালোবাসে। এ বিশাল জনশক্তিকে তাই যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া প্রয়োজন। দেশের জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ দূরীকরণে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরাই একমাত্র কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সুতরাং সরকারের উচিত তাদেরকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা। তাদের মাঝে প্রগাঢ় মূল্যবোধ রয়েছে। তাদেরকে এখন কর্মমুখী ও জীবনমুখী করে গড়ে তোলা সময়ের দাবী। তাদের মাঝে ধর্মের যথেষ্ট জ্ঞান আছে। তাদেরকে সতিনের ছেলের মতো দূরে ঠেলে দেয়া উচিত হবে না। বরং তাদেরকে কাছে টেনে আপন করা উচিত। তাদেরকে বিজ্ঞান ও আবিষ্কারমুখী করে গড়ে তোলা উচিত। স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার মাঝে সৃষ্ট বিভেদদেয়াল দূরীভূত করা উচিত। তাদেরকে প্রশিক্ষণের আওতায় এনে স্ব স্ব ক্ষেত্রে কর্মোদ্যোগী করা উচিত। এতে দেশের সমন্বিত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। পরস্পরের মনস্তাত্বিক ব্যবধান দূর হবে। ফলে কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদের ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কেবল সরকারের উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হ’তে পারে।
ড. মুহাম্মাদ কামরুয্যামান
অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
[1]. shikhabarta.com, ১২ই সেপ্টেম্বর ২০২১।
[2]. সূত্রঃ বিশ্ববিদ্যালয় প্রবিধান ২০১৯, অনুচ্ছেদ ২.১, পৃষ্ঠা ৭।
[3]. দৈনিক কালের কন্ঠ, ১৪ই অক্টোবর ২০১৬।
[4]. bdnews24.com, ১৭ই নভেম্বর ২০২১।