ভূমিকা :
রিয়া বা লৌকিকতা সৎআমল বিধ্বংসী নীরব ঘাতক। মনের অজান্তেই মানুষের অন্তরে এই রোগ বাসা বাঁধে। এটি মুখোশধারী প্রতারক। যে অবগুণ্ঠনের আড়ালে তার বীভৎস চেহারা আড়াল করে রাখে। মানুষকে দেখানো বা শুনানোর জন্য যখন কোন সৎকর্ম বা ইবাদত সম্পাদিত হয়, তখন সেটি ইখলাছ ও অন্তসারশূন্য হয়ে পড়ে। আমলের খোলস থাকে বটে কিন্তু তার ভিতরে কোন সারবত্তা থাকে না। একজন পাক্কা মুছল্লী ও তাহাজ্জুদগুযার ব্যক্তিও যেকোন মুহূর্তে আক্রান্ত হ’তে পারে প্রদর্শনেচ্ছার এই দুরারোগ্য ব্যাধিতে। নানান বর্ণে ও রূপে ক্ষণে ক্ষণে রং পরিবর্তন করে এই জাতশত্রু হাযির হয় মুমিন-মুসলিমের মানস্পটে। ইউসুফ বিন হুসাইন আর-রাযী তাইতো বলেছেন, أعز شيء في الدنيا : الإخلاص. وكم أجتهد في اسقاط الرياء عن قلبي، فكأنه ينبت على لون آخر، ‘দুনিয়াতে ইখলাছের চেয়ে দুর্লভ আর কোন জিনিস নেই। কতবার যে আমি আমার মন থেকে রিয়া বা লৌকিকতার মূলোৎপাটন করতে চেয়েছি, কিন্তু তা নতুনভাবে আবার জন্ম নেয়’।[1] আলোচ্য প্রবন্ধে রিয়ার পরিচিতি ও প্রকারভেদ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হ’ল-
রিয়া-এর আভিধানিক অর্থ :
রিয়া (الرِّيَاءُ) আরবী শব্দ, যা اَلرُّؤْيَةُ শব্দ থেকে নির্গত। অর্থ লৌকিকতা, প্রদর্শন, কপটতা প্রভৃতি। এটি বাবে مفاعلة এর মাছদার বা ক্রিয়ামূল। রিয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ হল, إظْهَارُ الشَّيْءِ عَلَى خِلَافِ مَا هُوَ عَلَيْهِ، ‘কোন জিনিসের আসলের বিপরীত প্রকাশ করা’।[2] অভিধানবেত্তা ফিরোযাবাদী বলেন, رَاءَيْتُه مُراآةً ورِئَاءً: أرَيْتُه على خلافِ مَا أَنَا عَلَيْهِ، ‘আমি তাকে রিয়া প্রদর্শন করেছি। অর্থাৎ আমি যার উপরে আছি তার বিপরীত তাকে দেখিয়েছি’।[3]
রিয়া-এর পারিভাষিক সংজ্ঞা :
হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, إِظْهَارُ الْعِبَادَةِ لِقَصْدِ رُؤْيَةِ النَّاسِ لَهَا فَيَحْمَدُوا صَاحِبَهَا ‘মানুষকে দেখানোর জন্য
ইবাদত যাহির করা। যেন তারা ইবাদতকারীর প্রশংসা করে’।[4]
মুনাবী (৯৫২-১০৩১ হি.) বলেন,الرياء: الفعل المقصود به رؤية الخلق غفلة عن الخالق وعماية عنه، ‘স্রষ্টাকে উপেক্ষা করে ও ভুলে গিয়ে সৃষ্টিকে দেখানোর উদ্দেশ্যে যে কাজ করা হয় তাকে রিয়া বলে’।[5]
ইয্যুদ্দীন বিন আব্দুস সালাম বলেন,الرِّيَاءُ: إظْهَارُ عَمَلِ الْعِبَادَةِ لِيَنَالَ مُظْهِرُهَا عَرَضًا دُنْيَوِيًّا إمَّا بِجَلْبِ نَفْعٍ دُنْيَوِيٍّ، أَوْ لِدَفْعِ ضَرَرٍ دُنْيَوِيٍّ، أَوْ تَعْظِيمٍ أَوْ إجْلَالٍ- ‘দুনিয়াবী স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ইবাদতকারীর ইবাদত যাহির করাকে রিয়া বলে। হতে পারে সেটি পার্থিব কোন উপকার লাভ বা কোন ক্ষতি প্রতিহত করা অথবা সম্মান-মর্যাদা লাভ করা’।[6]
ইমাম কুরতুবী বলেন, حقيقة الرياء طلب ما في الدنيا بالعبادة، وأصله طلب المنزلة في قلوب الناس ‘ইবাদতের মাধ্যমে দুনিয়াবী কোন কিছু অর্জন করার ইচ্ছা পোষণ করাকে রিয়া বা লৌকিকতা বলে। এর মূল হ’ল, মানুষের অন্তরে জায়গা করে নেয়ার মনোবাসনা’।[7]
শরীফ জুরজানী বলেন,الرياء: ترك الإخلاص في العمل بملاحظة غير الله فيه ‘গায়রুল্লাহর প্রতি মনোসংযোগ প্রদানের মাধ্যমে আমলের ক্ষেত্রে ইখলাছ বর্জন করাকে রিয়া বলা হয়’।[8]
ইবনু আব্দিল বার্র (৩৬৮-৪৬৩হি.) বলেন, إِنَّهُ الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ وَلَا يَزْكُو مَعَهُ عَمَلٌ ‘রিয়া হ’ল ছোট শিরক। এর উপস্থিতিতে কোন আমল পরিশুদ্ধ হয় না’।[9]
মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ বলেন, الرياء : هو أن يعمل الرجل عملا شرعيا، يقصد به غير وجه الله. ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তি কোন শারঈ আমল করলে তাকে রিয়া বলে’।[10]
মোটকথা, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদত সম্পাদন না করে লোক দেখানোর জন্য বা কোন দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিলের জন্য কর্ম সম্পাদন করাকে রিয়া বলে।
লৌকিকতা ও শ্রুতির মধ্যে পার্থক্য :
রিয়া বা লৌকিকতা এবং শ্রুতির (السُّمْعَةُ)-এর মধ্যে পার্থক্য হল, মানুষকে দেখানোর জন্য কাজ করাকে রিয়া এবং মানুষকে শুনানোর জন্য কাজ করাকে সুম‘আ বা শ্রুতি বলে। সুতরাং রিয়া দর্শনেন্দ্রিয়ের সাথে এবং সুম‘আ শ্রবণেন্দ্রিয়ের সাথে সম্পৃক্ত।[11]
মুহাম্মাদ বিন আলী থানবীর মতে, রিয়া ও সুম‘আ-র মধ্যে পার্থক্য হ’ল, রিয়া কর্মের ক্ষেত্রে এবং সুম‘আ কথার ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।[12]
‘ফাতহুল মাজীদ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে,والفرق بينه وبين السمعة : أن الرياء لما يُرى من العمل كالصلاة، والسمعة لما يُسمع كالقراءة والوعظ والذكر، ويدخل في ذلك التحدث بما عمله. ‘রিয়া ও সুম‘আ-এর মধ্যে পার্থক্য হল, যে আমল বা কাজ দেখানো হয় তা রিয়া। যেমন : ছালাত। আর যা শোনানো হয় তা সুম‘আ। যেমন : কুরআন পাঠ, ওয়ায-নছীহত, যিকির। আমলকারী যা আমল করেছে তা বলে বেড়ানোও সুম‘আর অন্তর্ভুক্ত হবে’।[13]
ইয্যুদ্দীন বিন আব্দুস সালাম বলেন, الرِّيَاءُ أَنْ يَعْمَلَ لِغَيْرِ اللهِ وَالسُّمْعَةُ أَنْ يُخْفِيَ عَمَلَهُ لِلَّهِ ثُمَّ يُحَدِّثَ بِهِ النَّاسَ ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য আমল করা হ’ল রিয়া। পক্ষান্তরে আল্লাহর জন্য বান্দা কর্তৃক আমলকে গোপন করে রাখা অতঃপর সেই আমলের কথা মানুষকে বলে বেড়ানো হ’ল সুম‘আ বা শ্রুতি’।[14]
উল্লেখ্য যে, ইয্যুদ্দীন বিন আব্দুস সালাম সুম‘আ বা শ্রুতিকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা :-
১. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য আমল সম্পাদন করা। অতঃপর মানুষের নিকট সেই আমলের কথা প্রকাশ করা এবং মানুষকে তা শুনানো। যাতে তারা তাকে সম্মান করে, তার উপকার করে এবং তাকে কষ্ট না দেয়। এটি হারাম। এই প্রকারকে তিনি تَسْمِيعُ الصَّادِقِينَ ‘সত্যবাদীদের শ্রুতি’ হিসাবে অভিহিত করেছেন।
২. কেউ ছালাত আদায় না করেই বলল, আমি ছালাত আদায় করেছি। যাকাত প্রদান না করেই বলল, আমি যাকাত দিয়েছি। ছিয়াম না রেখেই বলল, আমি ছিয়াম রেখেছি। হজ্জ পালন না করেই বলল, আমি হজ্জ পালন করেছি। যুদ্ধ-জিহাদ না করেই বলল, আমি যুদ্ধ করেছি। এই প্রকার শ্রুতিকে তিনি تَسْمِيعُ الْكَاذِبِينَ ‘মিথ্যাবাদীদের শ্রুতি’ বলে অভিহিত করেছেন।
প্রথম প্রকারের চেয়ে দ্বিতীয় প্রকারের পাপ ভয়াবহ। কেননা এখানে সে মানুষকে শোনানোর পাপের সাথে মিথ্যার পাপ যুক্ত করেছে। এর মাধ্যমে সে দু’টি নিকৃষ্ট পাপকার্য সম্পাদন করেছে। কিন্তু প্রথম প্রকারে সে শুধু মানুষকে শোনানোর দোষে পাপী।[15]
ইয্যুদ্দীন বিন আব্দুস সালাম বলেন,وَكَذَلِكَ لَوْ رَاءَى بِعِبَادَاتٍ ثُمَّ سَمَّعَ مُوهِمًا لِإِخْلَاصِهَا فَإِنَّهُ يَأْثَمُ بِالتَّسْمِيعِ وَالرِّيَاءِ جَمِيعًا. وَإِثْمُ هَذَا أَشَدُّ إثْمًا مِنْ الْكَاذِبِ الَّذِي لَمْ يَفْعَلْ مَا سَمَّعَ بِهِ، لِأَنَّ هَذَا أَثِمَ بِرِيَائِهِ وَتَسْمِيعِهِ وَكَذِبِهِ ثَلَاثَةَ آثَامٍ- ‘অনুরূপভাবে সে লোক দেখানোর জন্য যদি কিছু ইবাদত করে অতঃপর সেটি ইখলাছের সাথে সম্পাদিত হয়েছে এই ধারণা প্রদানের জন্য তা মানুষকে শোনায়, তাহলে সে লৌকিকতা ও শ্রুতি উভয় দোষে পাপী সাব্যস্ত হবে। এর পাপ ঐ মিথ্যুকের পাপের চেয়ে বেশী হবে যে আদতে কোন কর্ম না করেই তা মানুষকে শুনিয়েছে। কেননা এই ব্যক্তি তার লৌকিকতা, শ্রুতি ও মিথ্যা এই তিন অপরাধের কারণে পাপী সাব্যস্ত হয়েছে’।[16]
রিয়া ও ‘উজব-এর মধ্যে পার্থক্য :
العُجْبُ শব্দের অর্থ হল অহংকার, দম্ভ, আত্মম্ভরিতা প্রভৃতি। যেমন বলা হয়, فلانٌ مُعْجَبٌ بِنَفْسِهِ ‘অমুক আত্মমুগ্ধ বা আত্মম্ভরী’।[17] পরিভাষায় ‘উজব বলা হয়, العجب: هو عبارة عن تصور استحقاق الشخص رتبة لا يكون مستحقًا لها ‘কোন ব্যক্তির নিজেকে এমন মর্যাদার হকদার মনে করা, যার প্রকৃত হকদার সে নয়’।[18]
রিয়া ও ‘উজব-এর মধ্যে পার্থক্য হল, রিয়াকারী তার আমল বা কাজের মাধ্যমে মানুষের প্রশংসা পাওয়ার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আর যার মধ্যে ‘উজব বা আত্মম্ভরিতা আছে সে নিজেকে বড় মনে করে। এটি অহংকার ও দাম্ভিকতার নামান্তর।[19]
আবূ ওয়াহাব আল-মারওয়াযী বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারককে জিজ্ঞাসা করলাম, কিবর বা অহংকার কি? তিনি বললেন, أن تزدري الناس ‘মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করা’। অতঃপর আমি তাঁকে ‘উজব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, أن ترى أن عندك شيئا ليس عند غيرك، لا أعلم في المصلين شيئًا شرا من العُجب، ‘তোমার মধ্যে এমন কিছু গুণ আছে যা অন্যের মধ্যে নেই- এমন ধারণা পোষণ করাই হল ‘উজব বা আত্মম্ভরিতা। মুছল্লীদের মধ্যে আত্মম্ভরিতার চেয়ে নিকৃষ্ট কোন দোষ আছে বলে আমি জানি না’।[20]
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, وَكَثِيرًا مَا يَقْرِنُ النَّاسُ بَيْنَ الرِّيَاءِ وَالْعُجْبِ فَالرِّيَاءُ مِنْ بَابِ الْإِشْرَاكِ بِالْخَلْقِ وَالْعُجْبُ مِنْ بَابِ الْإِشْرَاكِ بِالنَّفْسِ وَهَذَا حَالُ الْمُسْتَكْبِرِ فَالْمُرَائِي لَا يُحَقِّقُ قَوْلَهُ : {إيَّاكَ نَعْبُدُ} وَالْمُعْجَبُ لَا يُحَقِّقُ قَوْلَهُ : {وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ} فَمَنْ حَقَّقَ قَوْلَهُ : {إيَّاكَ نَعْبُدُ} خَرَجَ عَنِ الرِّيَاءِ وَمَنْ حَقَّقَ قَوْلَهُ {وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ} خَرَجَ عَنِ الْإِعْجَابِ ‘মানুষ প্রায়শই লৌকিকতা ও আত্মম্ভরিতাকে একই জিনিস মনে করে। অথচ রিয়া হ’ল সৃষ্টির মাধ্যমে শরীক করা আর ‘উজব বা আত্মম্ভরিতা হ’ল নিজের নফসের মাধ্যমে শরীক করা। আর এটি অহংকারীর অবস্থা। রিয়াকারী আল্লাহর বাণী ‘আমরা কেবলমাত্র তোমারই ইবাদত করি’ (ফাতেহা ৫)-কে বাস্তবে রূপদান করে না আর আত্মম্ভরী ব্যক্তি তাঁর বাণী ‘এবং কেবলমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি’ (ফাতেহা ৫)-কে বাস্তবায়ন করে না। যে আল্লাহর বাণী ‘আমরা কেবলমাত্র তোমারই ইবাদত করি’-কে বাস্তবে রূপ দিবে সে রিয়া থেকে মুক্ত হয়ে যাবে আর যে ‘এবং কেবলমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি’-কে বাস্তবায়ন করবে সে আত্মম্ভরিতা থেকে বেঁচে যাবে’।[21]
রিয়ার প্রকারভেদ :
প্রকাশগত দিক থেকে রিয়া পাঁচ প্রকার। যথা :-
১. দৈহিক রিয়া (الرياءالبدني) :
মানুষ ইবাদতকারী ও পরকালের ভয়ে ভীত ভাববে মনে করে নিজের শরীরকে জীর্ণ-দুর্বল ও বিবর্ণ-ফ্যাকাশে হিসাবে প্রকাশ করা। মাথার চুলগুলোকে এলোমেলো রাখা। যাতে মানুষ মনে করে, এই ব্যক্তি দ্বীনের বিষয় নিয়ে এতই চিন্তামগ্ন যে, সে তার কেশ বিন্যাস করার সুযোগ পায়নি। এই ধরনের লৌকিকতাকে দৈহিক রিয়া বলা হয়। কণ্ঠস্বর নীচু করা, চোখ দু’টিকে গর্তে ঢুকিয়ে দেয়া, ঠোঁট দু’টিকে শুষ্ক দেখানোর প্রবণতার মাধ্যমেও রিয়া হতে পারে। যদি এর মাধ্যমে নিজেকে ছায়েম বা রোযাদার হিসাবে যাহির করার মনোবাসনা থাকে।
২. পোষাকী রিয়া (الرياء باللباس والزي) : জীর্ণ-শীর্ণ ও জোড়া-তালি দেওয়া পোষাক পরিধান করা। যাতে মানুষ তাকে দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত বা দুনিয়াত্যাগী বলে। অথবা আলেমদের পোষাক পরা। যেন মানুষ তাকে আলেম বলে। ইবনুল জাওযী এ ধরনের ভন্ড যাহেদ বা দরবেশ-সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে বলেছেন,رأيت في زهاد زماننا من الكبر، وحفظ الناموس، ورتبة الجاه في قلوب العامة، ما كدت أقطع به على أنهم أهل رياء ونفاق ‘আমাদের কালের দরবেশ-সন্ন্যাসীদের মধ্যে অহংকার, বাহ্যিক রীতি-নীতির প্রকাশ ও সাধারণ মানুষের অন্তরে স্থান করে নেওয়ার প্রবণতা দেখে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, এরা রিয়াকারী ও মুনাফিক’। তাদের কাউকে আপনি দেখবেন যে, মানুষ তাকে দরবেশ ও দুনিয়াত্যাগী মনে করবে এমন পোষাক পরিধান করে। অথচ ভালো ভালো খাবার খায়, দেশবাসীর উপর বড়াই করে, ধনীদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, গরীব-মিসকীনদেরকে এড়িয়ে চলে, মাওলানা সম্বোধনে ডাকা পসন্দ করে, হেলেদুলে হাঁটে, অনর্থক ক্রিয়াকলাপে সময় নষ্ট করে এবং মানুষের দয়া-দাক্ষিণ্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে’।
ইবনুল জাওযী আরো বলেন, ولو أن أفعاله ناسبت ثيابه لهان الأمر، لكنهم بهرجوا على من لا يخفى أمرهم عليه من الخلق، فكيف الخالق سبحانه وتعالى؟ ‘যদি তাদের কাজকর্ম তাদের পোষাকের সাথে মানানসই হত তাহলে হয়তো ব্যাপারটি স্বাভাবিক মনে হত। কিন্তু তারা এমন ব্যক্তির কাছে এসব ছদ্মবেশ ধারণ করেছে, যে তাদের সম্পর্কে সম্যক অবগত। তাহলে মহান স্রষ্টা তো তাদের সম্পর্কে আরো বেশী অবগত’?[22]
হাঁটার সময় মাথা নীচু করা, চেহারায় সিজদার চিহ্ন প্রকাশ করা, ছূফীদের মত মোটা, খসখসে ও নীল রংয়ের পোষাক পরিধান করা, কাপড় অত্যধিক গুটিয়ে পরা, জামার হাতা অতিরিক্ত খাটো করা প্রভৃতিও এ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত।
৩. বাচনিক রিয়া (الرياء بالقول) : সাধারণত ধার্মিক ব্যক্তিরা মানুষকে ওয়ায-নছীহত করা, ইলমী গভীরতা প্রকাশ, বাহাছ-মুনাযারা ও বিতর্কে নিজেকে যাহির করার জন্য বিভিন্ন হাদীছ, আছার ও উদ্ধৃতি উল্লেখের মাধ্যমে বাচনিক রিয়ায় জড়িয়ে পড়েন। রাস্তা-ঘাটে এবং হাটে-বাজারে তাসবীহ হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, জনসম্মুখে ঠোঁট নাড়িয়ে যিকির করা, দুনিয়াবাসীর উপর ক্ষোভ প্রকাশ করা, নিজের পাশে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে কুরআন তেলাওয়াতের সময় স্বর নিম্ন ও নরম করা প্রভৃতি বাচনিক রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। এজন্য আধুনিক লেখক ও গবেষক ড. সাইয়িদ বিন হুসাইন আল-‘আফফানী বলেন,والرياء بالقول كثير وأنواعه لا تنحصر ‘কথার মাধ্যমে নানা ধরনের রিয়া সংঘটিত হয়ে থাকে। এর প্রকার-প্রকরণ অগণিত’।[23]
৪ আমলগত রিয়া (الرياء بالعمل) : লোক দেখানোর জন্য ছালাতে মুছল্লীর দীর্ঘ ক্বিয়াম বা দাঁড়িয়ে থাকা, রুকু-সিজদা লম্বা করা এবং বিনয়-নম্রতা প্রকাশ করা। এজন্য ইবনু কুদামা আল-মাকদেসী বলেছেন, وكذلك لو حسَّن الصلاة بين أيديهم ليعتقدوا فيه الخشوع. فإنه يكون مرائياً بذلك ‘যদি মুছল্লী মানুষের সামনে সুন্দর করে ছালাত আদায় করে এজন্য যে, ছালাতের মধ্যে তার একাগ্রতা আছে বলে মানুষ মনে করবে, তাহলে এর মাধ্যমে সে নিজেকে রিয়াকারী হিসাবে প্রমাণ করবে’।[24]
অনুরূপভাবে লোক দেখানোর জন্য দান-ছাদাক্বাহ করা এবং ছিয়াম ও হজ্জ পালন করা।
৫. সাহচর্যগত রিয়া (الرياء بالأصحاب والزائرين) : যেমন কোন ব্যক্তির কোন আলেমকে তার সাথে সাক্ষাতের আহবান জানানো। যাতে বলা হয়, অমুক আলেম অমুক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। মানুষকে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য দাওয়াত দেওয়া। যেন বলা হয়, দ্বীনদার-পরহেযগার ব্যক্তিরা তার বাড়িতে যাতায়াত করেন। অনুরূপভাবে অনেকে শায়েখ বা শিক্ষকের সংখ্যা বেশী হওয়া নিয়ে গর্ব করে।
তর্ক-বিতর্কের সময় নিজের ইলমী যোগ্যতা ও পান্ডিত্য যাহির করার জন্য বলে, আমি অমুক অমুক শায়েখের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। আমার শিক্ষকের সংখ্যা বহু। তুমি কোন কোন শায়েখের সাথে সাক্ষাৎ করেছ? তোমার ওস্তাদের সংখ্যা কয়জন প্রভৃতি।[25] ইবনু কুদামা আল-মাকদেসী বলেন, فهذه مجامع ما يرائي به المراؤون، يطلبون بذلك الجاه والمنزلة في قلوب العباد ‘রিয়াকারীরা যে সকল বিষয় লোকদের দেখায় এগুলি হল তার সারনির্যাস। এর মাধ্যমে তারা মান-মর্যাদা লাভ ও মানুষের অন্তরে জায়গা করে নেওয়ার কামনা রাখে’।[26]
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায়, অনুক্ষণ চরিত্র বদলের ফলে রিয়া বা লৌকিকতা থেকে আত্মরক্ষা করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার। বিভিন্নভাবে নানান মোড়কে রিয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে থাকে। রিয়ার প্রকারভেদ থেকে যা আমাদের কাছ পূর্ণিমা রাতে মেঘমুক্ত আকাশ উদিত চন্দ্রের ন্যায় সুস্পষ্ট। এজন্য হাদীছে রিয়াকে ‘গোপন শিরক’ (الشرك الخفي) এবং ‘ছোট শিরক’ (الشرك الأصغر) বলা হয়েছে।[27] আল্লাহ আমাদেরকে এই গোপন শিরক থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন! আমীন!!
ভাইস প্রিন্সিপাল,
আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিইয়াহ, মাদারিজুস সালিকীন (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি.), ২/৭৭।
[2]. মুহাম্মাদ আবূ সাঈদ আল-খাদামী (১১১৩-১১৭৬ হি.), বারীক্বাহ মাহমূদিয়াহ (দামেশক : মাতবা‘আতুল হালাবী, ১৩৪৮হি.) ২/৮৪।
[3]. মাজদুদ্দীন ফিরোযাবাদী, আল-ক্বামূসুল মুহীত্ব (বৈরূত : মুআস্সাসাতুর রিসালাহ, ৮ম মুদ্রণ, ১৪২৬হি./২০০৫খৃ.), পৃ. ১২৮৫।
[4]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাতহুল বারী (রিয়াদ : দারুস সালাম, ১ম প্রকাশ, ১৪২১ হি./২০০০ খৃ.), ১১/৪০৮।
[5]. আব্দুর রঊফ মুনাবী, আত-তাওকীফ ‘আলা মুহিম্মা-তিত তা‘আরীফ (কায়রো : আলামুল কুতুব, ১ম প্রকাশ, ১৪১০ হি./১৯৯৯ খৃ.), পৃ. ১৮৪।
[6]. ইয্যুদ্দীন বিন আব্দুস সালাম, ক্বাওয়াইদুল আহকাম ফী ইছলাহিল আনাম (দামেশক : দারুল কলম), ১/২০৬।
[7]. তাফসীরে কুরতুবী ২০/২১২।
[8]. শরীফ জুরজানী, কিতাবুত তা‘রীফাত (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, ১ম মুদ্রণ, ১৪০৩হি./১৯৮৩খৃ.), পৃ. ১১৩।
[9]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী (সঊদী আরব : দারু ইবনিল জাওযী, ১ম মুদ্রণ, ১৪১৪হি./১৯৯৪খৃ.), ১/৬৮১।
[10]. মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আ‘মালুল কুলূব (সঊদী আরব : মাজমূ‘আতু যাদ, ১ম প্রকাশ, ১৪৩৮ হি./২০১৭ খ্রি.), পৃ. ৪৫।
[11]. ফাতহুল বারী ১১/৪০৮; ড. সাইয়িদ বিন হুসাইন আল-‘আফফানী, তা‘তীরুল আনফাস মিন হাদীছিল ইখলাছ (মিসর : মাকতাবাতু মু‘আয বিন জাবাল, ১ম প্রকাশ, ১৪২১ হি./২০০১ খৃ.), পৃ. ৫৮২।
[12]. কাশশাফু ইছতিলাহাতিল ফুনূন ৩/৬০৮।
[13]. শায়েখ আব্দুর রহমান বিন হাসান আলে শায়েখ, ফাতহুল মাজীদ শারহু কিতাবিত তাওহীদ, তাহকীক : শায়েখ মুহাম্মাদ হামিদ আল-ফিকী, তা‘লীক : শায়খ বিন বায (মদীনা মুনাউওয়ারা : মাকতাবাতু দারিল কিতাব আল-ইসলামী, তাবি), পৃ. ৪৪৬।
[14]. ফাতহুল বারী ১১/৪০৮।
[15]. ক্বাওয়াইদুল আহকাম ১/২০৬-২০৭।
[16]. ঐ, ১/২০৭।
[17]. রাগের ইস্পাহানী, আল-মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খৃ.), পৃ. ৩২৫।
[18]. কিতাবুত তা‘রীফাত, পৃ. ১৪৭।
[19]. ড. ওমর আব্দুল আযীয বূরীনী, মুহবিতাতুল আ‘মাল ফিল কুরআনিল কারীম দিরাসাতুন মাওযূইয়াহ (জামে‘আতুল আযহার, হাওলিইয়াতু কুল্লিয়াতুল লুগাহ আল-আরাবিইয়াহ বানীন বি-জিরজা, ২৩তম সংখ্যা, ১৪৪০হি./২০১৯খৃ.), পৃ. ৩৭৯৫।
[20]. বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান হা/৮২৬০; যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৮/৪০৭।
[21]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ১০/২৭৭; আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা ৫/২৪৭-২৪৮।
[22]. ইবনুল জাওযী, ছায়দুল খাতের (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৪১২ হি./১৯৯২ খ্রি.), পৃ. ৩৭৫।
[23]. তা‘তীরুল আনফাস, পৃ. ৪৯৯।
[24]. ইবনু কুদামা আল-মাকদেসী, মুখতাছার মিনহাজুল কাছেদীন, তা‘লীক : শু‘আইব আরনাঊত ও আব্দুল কাদের আরনাঊত (দামেশক : মাকতাবাতু দারিল বায়ান, ১৩৯৮ হি./১৯৭৮ খ্রি.), পৃ. ২১১।
[25]. আলোচনা দ্র. আবূ হামিদ গাযালী, ইহয়াউ উলূমিদ্দীন (বৈরূত: দারুল মা‘রিফাহ, তাবি), ৩/২৯৭-২৯৯; মুখতাছার মিনহাজুল কাছেদীন, পৃ. ২১৪-২১৬; ড. ওমর সুলাইমান আল-আশকার, মাকাছিদুল মুকাল্লিফীন (কুয়েত : মাকতাবাতুল ফালাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪০১হি./১৯৮১ খ্রি.), পৃ. ৪৪২-৪৪৩; ড. সাঈদ বিন আলী বিন ওয়াহাফ আল-কাহতানী, নূরুল ইখলাছ (১ম প্রকাশ : ১৪২০ হি./১০৯৯ খ্রি.), পৃ. ৩৬-৩৭; তা‘তীরুল আনফাস, পৃ. ৪৯৭-৫০১।
[26]. মুখতাছার মিনহাজুল কাছেদীন, পৃ. ২১৬।
[27]. ইবনু মাজাহ হা/৪২০৪; আহমাদ, বায়হাকী, মিশকাত হা/৫৩৩৩-৩৪; সনদ জাইয়িদ; সিলসিলা ছহীহা হা/৯৫১; ছহীহ তারগীব হা/৩২।