পারিবারিক অপরাধ দমনে ইসলামের নির্দেশনা

ইসলাম সকল প্রকারের অন্যায় ও অপরাধকে কঠোর হস্তে দমন করার নির্দেশ প্রদান করেছে। পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধ সমূহ দূর করতে হ’লে ইসলামী আইনের শরণাপন্ন হ’তে হবে। এক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীছের নির্দেশনা ও বিধিবিধান পালন করতে হবে। পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধ দমনে ইসলামী নির্দেশনার কতিপয় দিক নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-

(১) নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা :

পারিবারিক অপরাধ সমূহ দমন করতে হ’লে প্রথমে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা করতে হবে। পরিবারের বিভিন্ন সদস্য বিশেষ করে পিতা-মাতা ও শিশু-কিশোরদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সকলকে নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হ’তে হবে। আর এ ব্যাপারে মহানবী (ছাঃ) বলেছেন,بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الأَخْلاقِ ‘আমি মানব চরিত্রের পরিপূর্ণতা দানের জন্যই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছি’।[1] নৈতিক মূল্যবোধ মানব চরিত্রকে সুষমামন্ডিত করে তুলে। এটা মানুষকে দেয় প্রবল ও দৃঢ় মানসিক শক্তি, যার বলে বলীয়ান হয়ে মানুষ যাবতীয় অন্যায় ও অপরাধ থেকে দূরে থাকে।

(২) পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা :

পারিবারিক বন্ধন দুর্বল বা নষ্ট হ’লে পরিবারে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব-কলহ ও অপরাধ সংঘটিত হয়। তাই এ ধরনের অপরাধ দমন করতে হ’লে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করার কোন বিকল্প নেই। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী ও বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে সুগভীর ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক যোরদার করতে হবে। পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় রাখার ব্যাপারে ইসলামে বহু নির্দেশনা রয়েছে। এ ব্যাপারে মহাগ্রন্থ কুরআনে বলা হয়েছে,وَهُوَ الَّذي خَلَقَ مِنَ المَاءِ بَشَراً فَجَعَلَه نَسَبًا وَصِهْراً- ‘তিনিই মানুষকে পানি হ’তে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি তার বংশগত ও বিবাহগত সম্পর্ক নির্ধারণ করেছেন’ (ফুরক্বান ২৫/৫৪)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, يايُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا قُوْا اَنْفُسَكُمْ وَاَهْلِيْكُمْ نَاَراً ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও’ (তাহরীম ৬৬/৬)। পারিবারিক বন্ধন ছাড়া পবিত্র কুরআনের এসব নির্দেশ ও দৃষ্টিভঙ্গি কিছুতেই বাস্তবায়িত হ’তে পারে না। পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করার মাধ্যমে শান্তিময় দাম্পত্য জীবন লাভ করা সম্ভব।

(৩) ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা :

পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধ সমূহ দূর করতে হ’লে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসনই পারে অপরাধ প্রবণতাকে শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আসতে। ধর্মীয় জীবন ব্যবস্থা থেকে বিচ্যুতিই পারিবারিক অপরাধকে বাড়িয়ে দিয়েছে। সুতরাং সকলকেই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন পালন না করার কারণেই সর্বত্র অশান্তি বিরাজ করছে। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে সামাজিক অবক্ষয়, বিশৃঙ্খলা ও অপরাধ রোধ করা সম্ভব। ধর্মের কারণেই মানুষ শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন যাপন করে এবং অপরাধ করা থেকে বিরত থাকে।

(৪) স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের উন্নতি :

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হ’তে হবে অত্যন্ত সুগভীর, মধুর ও ভালোবাসাপূর্ণ। এ সম্পর্ক হ’ল খুবই পবিত্র। এ সম্পর্কে অবনতি হ’লে পরিবারে অশান্তি নেমে আসে এবং পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক ও সহযোগী। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বলা হয়েছে,هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَاَنْمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ، ‘তারা তোমাদের পোষাক এবং তোমরা তাদের পোষাক’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭)

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরলে বিভিন্ন পারিবারিক অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরী হয়। কাজেই পারিবারিক অপরাধ রোধ করতে হ’লে স্বামী ও সত্রীর মধ্যে সুগভীর সম্পর্ক থাকতে হবে। স্বামীর অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এমন কোন কাজ করলে স্বামীর উচিত ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা। স্ত্রী শরী‘আত বিরোধী কোন কাজ না করলে অযথা তার প্রতি রাগান্বিত হওয়া সুন্নাহ বিরোধী কাজ। এক্ষেত্রে একজন মুমিন ব্যক্তির করণীয় সম্পর্কে মহানবী (ছাঃ) বলেছেন,لاَيَفْرَكْ مُؤْمِنَةً اِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِيَ مِنْهَا اخَرَ- ‘কোন মুমিন পুরুষ যেন কোন মুমিন নারীর প্রতি (স্বামী স্ত্রীর প্রতি) ঘৃণা-বিদ্বেষ বা শত্রুতা পোষণ না করে। কারণ তার একটি স্বভাব পসন্দনীয় না হ’লেও অন্য কোন একটি স্বভাব পসন্দনীয় হবে’।[2]

(৫) সুশিক্ষা প্রদান :

নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষা না থাকায় মানুষ শিক্ষিত হয়েও বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে বিনয়ী, সভ্য, ভদ্র ও মার্জিত করে গড়ে তুলে। নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি জ্ঞানের মশাল নিয়ে সে তার পরিবার ও সমাজকে আলোকিত করতে পারে। পারিবারিক অপরাধসহ সকল ধরনের অপরাধ দূর করতে হ’লে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হ’তে হবে। এক্ষেত্রে কুরআনের ঘোষণা হ’ল, اِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (আলাক ৯৬/১)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذيْنَ يَعْلَمُوْنَ وَالَّذِيْنَ لاَ يَعْلَمُوْنَ ‘তুমি বল, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান?’ (যুমার ৩৯/৯)। অপর এক আয়াতে আরো বলা হয়েছেيَرْفَعِ اَللهُ الْذِيْنَ أَمَنُوامِنْكُم وَالَّذِيْنَ اُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاَللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْر- ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন। আর তোমরা যা কর আল্লাহ তা ভালভাবে খবর রাখেন’ (মুজাদালা ৫৮/১১)

জ্ঞান অর্জনের আবশ্যকতা বর্ণনা করতে গিয়ে মহানবী (ছাঃ) বলেছেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلي كُلِّ مُسْلِمٍ ‘ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরয’।[3] এই হাদীছে যে কোন জ্ঞানকে ফরয করা হয়নি; বরং যে জ্ঞান ব্যক্তিকে সত্যিকারের মানুষ ও মুসলিম বানায় সে জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। এ জ্ঞানের প্রকৃত ধারক-বাহক যারা তারা যাবতীয় অন্যায় ও অপরাধ থেকে বিরত থাকে। আর এজন্য কুরআন-হাদীছ অধ্যয়ন, নবী-রাসূলগণের জীবনী, ছাহাবী, তাবেঈ ও মুসলিম মনীষীদের জীবনী এবং ইসলামী সাহিত্য নিয়মিত অধ্যয়ন করতে হবে।

(৬) দ্বীনী তা‘লীম দেওয়া :

পারিবারিক অপরাধ রোধ করতে হ’লে শিশু-কিশোরদের শৈশবকাল থেকেই শরী‘আতের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ সম্পর্কে মহানবী (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা নিজ সন্তানদের শরী‘আতের আদিষ্ট বিষয়াদি পালনে এবং নিষিদ্ধ বিষয়াদি থেকে বিরত থাকার হুকুম দাও। কারণ এটিই হ’ল জাহান্নাম থেকে নিরাপদ থাকার উপায়’।[4] প্রতিটি পিতা-মাতার উচিত সন্তানদের তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা প্রদান করা। তাদের কর্তব্য হ’ল সন্তানদের ইসলামী আদব-কায়দার তা‘লীম দেওয়া। শৈশবকাল থেকেই যদি তাদের নীতি-নৈতিকতা শেখানো হয় তবে তারা যাবতীয় অপরাধ থেকে দূরে থাকবে।

(৭) সন্তানদের শিষ্টাচার শিক্ষা দান :

পিতা-মাতার উচিত শৈশবকাল থেকেই সন্তানদের শিষ্টাচার শিক্ষা দান করা। কাজেই প্রতিটি পরিবার থেকেই যদি শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া হয় তবে পারিবারিক অপরাধসমূহ দমন করা অনেকটাই সহজ হবে।

(৮) সন্তানকে শারঈ বিধানমতে বিবাহ দান :

পারিবারিক জীবনে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয় তার মূলে রয়েছে বিয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও বিশৃংখলা। অধিকাংশ পরিবারে বিবাহের ক্ষেত্রে ইসলামী নীতির অনুসরণ করা হয় না। পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে দ্বীনদারীকে সবচেয়ে বেশী অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। এ ব্যাপারে মহানবী (ছাঃ)-এর ঘোষণা হ’ল,تُنْكَحُ الْمَرْأةُ لِاَرْبَعٍ : لِمَالِهَا وَلِحَسَبِهَا وَلِجَمَالِهَا وَلِدِيْنِهَا فَاظْفَرْ بِذَاتِ الدِّيْنَ تَرِبَتْ يَدَاكَ- ‘চারটি গুণ দেখে মেয়েদের বিবাহ করা হয়। আর তা হ’ল- তার ধন-সম্পদ, বংশ মর্যাদা, রূপ-সৌন্দর্য ও দ্বীনদারী। সুতরাং তুমি দ্বীনদার মহিলাকেই প্রাধান্য দিবে। অন্যথা তোমার দু’হাত ধূলায় ধুসরিত হবে। অর্থাৎ তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে’।[5]

কাজেই বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্রী নির্বাচনে যদি দ্বীনদারীকে অগ্রাধিকার দেওয়া না হয় তবে সে পরিবারে নেমে আসতে পারে মহাবিপর্যয়। অনুরূপভাবে মেয়ে বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ছেলের দ্বীনদারী দেখার কথাও বলা হয়েছে। মহানবী (ছাঃ) এ ব্যাপারে বলেছেন,اِذَاخَطَبَ اِلَيْكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِيْنَهُ وَخُلُقَهُ فَزَوِّجُوْهُ اِلَّاَ تَفْعَلُوْا تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادٌ عَرِيْضٌ، ‘তোমাদের নিকট যদি এমন কারো বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আসে, যার দ্বীনদারী ও চরিত্র সন্তোষজনক, তাহ’লে তার সাথে বিয়ে দাও। অন্যথা যমীনে ফিৎনা ও মহাবিপর্যয় দেখা দিবে’।[6]

উল্লেখ্য যে, পাত্র/পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভুল করলে পারিবারিক জীবনে অশান্তি, ঝগড়া-বিবাদ, নির্যাতনসহ অসংখ্য অপরাধের জন্ম হয়। তাই প্রত্যেকের উচিত, বিবাহের জন্য দ্বীনদার পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করা।

(৯) সদাচরণ করা :

পারিবারিক অপরাধ রোধ করতে হ’লে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একে অপরের প্রতি সদাচরণ করা উচিত। বিশেষ করে সন্তানদের উচিত পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করা। তাদের সাথে সদাচরণ না করলে জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। তাই এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার ঘোষণা হ’ল-وَوَصَّيْنَا الْاِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنَا، ‘আর আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি যেন তারা পিতা-মাতার সাথে (কথায় ও কাজে) উত্তম ব্যবহার করে’ (আনকাবূত ২৯/৮)

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে,وَقَـضى رَبُّكَ اَلاَّ تَعْبُدُوْا اِلاَّ اِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ اِحْسَانًا، ‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারু উপাসনা করো না এবং তোমরা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/২৩)

সুতরাং ছেলে-মেয়েদের সাথে সদাচরণ করা হ’লে পারিবারিক অপরাধ দমন করা অনেকটাই সম্ভব হবে। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তানরাই বেশী পারিবারিক অপরাধ ঘটায়। তাই পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করার মাধ্যমেই একদিকে যেমন পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় হয় অপরদিকে পারিবারিক জীবনে অপরাধ সংঘটনের হারও ক্রমশ হ্রাস পাবে।

(১০) সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের নীতি অনুসরণ :

পরিবার ও পরিবারের বাইরে সর্বত্রই একে অপরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে হবে। ছোটদের সেণহ ও আদর করতে হবে এবং বড়দের সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হবে। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রকাশ্য ঘোষণা হ’ল-مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيْرَنَا وَيَعْرِفْ حَقَّ كَبِيْرِنَا فَلَيْسَ مِنَّا، ‘যে আমাদের ছোটদের প্রতি সেণহ করে না এবং বড়দের হক বোঝে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’।[7] সুতরাং পরিবার ও পরিবারের বাইরের সবাই এ হাদীছটি অনুসরণ করে যদি ছোটদের প্রতি সেণহ করত এবং বড়দেরকে সম্মান করত তবে আমাদের পারিবারিক বন্ধন আরো সুদৃঢ় হ’ত এবং অপরাধ প্রবণতাও অনেক হ্রাস পেত।

(১১) পর্দার বিধান মেনে চলা :

পর্দা নারীর সৌন্দর্য ও মর্যাদার প্রতীক এবং নারীর সতীত্ব ও ইযয্ত-আব্রুর রক্ষাকবচ। নারী-পুরুষ উভয়ের চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার অতি সহজ ও কার্যকর উপায়। পারিবারিক অপরাধ সংঘটনের পিছনে যতগুলো কারণ আছে তার অন্যতম হ’ল ব্যক্তি জীবনে পর্দার বিধান মেনে না চলা। পর্দার বিধান মেনে না চলার কারণেই অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা, অপকর্ম, ব্যভিচার, ইভটিজিং, ধর্ষণ ও পরকীয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। কাজেই পরিবার ও পরিবারের বাইরে প্রত্যেক নারী-পুরুষের জন্য পর্দার বিধান মেনে চলতে হবে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর ঘোষণা হ’ল-قُلْ لِّلْمُؤْمِنِيْنَ يَغُضُّوْا مِنْ اَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُمْ، ذَالِكَ اَزْكى لَهُمْ، اِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا يَصْنَعُوْنَ- ‘তুমি মুমিন পুরুষদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এটা তাদের জন্য পবিত্রতর। নিশ্চয়ই তারা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবহিত’ (নূর ২৪/৩০)

হাদীছে পর্দার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,اَلْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ فَاِذَا خَرَجَتْ اِسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانَ- ‘নারী আবৃত থাকার বস্ত্ত। সে যখন পর্দাহীন হয়ে বের হয় তখন শয়তান তাকে আকর্ষণীয় করে দেখায়’।[8]

পর্দা ইসলামের একটি ফরয বিধান। কুরআন ও হাদীছে এ ব্যাপারে বহু দলীল রয়েছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পর্দার বিধান বাস্তবায়ন করা হ’লে একদিকে যেমন নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, তেমনি বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যা সৃষ্টির পথও বন্ধ হবে।

(১২) আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা :

পারিবারিক অপরাধ রোধ করতে হ’লে আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট ও অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা গুনাহ। ইসলাম আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর জন্য কঠিন শাস্তির কথা ঘোষণা করেছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বলা হয়েছে,وَالَّذِيْنَ يَنْقُضُوْنَ عَهْدَ اللهِ مِنْ بَعْدِ مِيْثَاقِهِ وَيَقْطَعُوْنَ مَا اَمَرَاللهِ بِه اَنْ يُّوْصَلَ وَيُفْسِدُوْنَ فِى الْاَرْضِ اُوْلئكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوْءُ الدَّارِ- ‘পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে এবং যে সম্পর্ক অটুট রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে ও পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে, তাদের জন্য রয়েছে অভিসম্পাৎ এবং তাদের জন্য রয়েছে মন্দ আবাস’ (রা‘দ ১৩/২৫)

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে,لاَتَعْبُدُوْنَ اِلاَّاللهَ وَبِالْوَالِدَيْنِ اِحْسَنًا وَّذِى الْقُرْبى وَالْيَتَمى وَالْمَسَكِيْنِ، ‘তোমরা আল্লাহ ব্যতীত কারু দাসত্ব করবে না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীনদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে’ (বাক্বা্রাহ ২/৮৩)। আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখতে হাদীছেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জুবাইর ইবনু মুতঈম (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعٌ ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[9]

(১৩) মাদকদ্রব্যের ব্যবহার নির্মূল করা :

পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধগুলোর মধ্যে মাদকাসক্তি অন্যতম কারণ। ইসলাম মাদকের ব্যাপারে কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করেছে। মদ হারাম হওয়ার ব্যাপারে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বাণী হ’ল,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ- ‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ধারক তীর সমূহ শয়তানের নাপাক কর্ম বৈ কিছুই নয়। অতএব এগুলি থেকে বিরত হও। তাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হবে’ (মায়েদা ৫/৯০)

হাদীছেও মাদককে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মহানবী (ছাঃ) বলেছেন,كُلُّ مُسْكِرِ خَمْرٌ وَكُلُّ مُسْكِرِ حَرَامٌ- ‘প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী বস্ত্তই মদ এবং প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী বস্ত্তই হারাম’।[10] আরেকটি হাদীছে এসেছে, ওছমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তোমরা মাদকদ্রব্য পরিত্যাগ কর, কেননা তা নানা প্রকার অপকর্মের প্রসূতি। তোমাদের পূর্ববর্তী যুগে এক আবেদ ব্যক্তি ছিল। এক কুলটা রমণী তাকে নিজের ধোঁকাবাজির জালে আবদ্ধ করতে মনস্থ করে। এজন্য সে তার এক দাসীকে তার নিকট প্রেরণ করে তাকে সাক্ষ্যদানের জন্য ডেকে পাঠাল। তখন ঐ আবেদ ব্যক্তি ঐ দাসীর সাথে গমন করল। সে যখনই কোন দরজা অতিক্রম করত, দাসী পেছন থেকে সেটি বন্ধ করে দিত। এভাবে সেই আবেদ ব্যক্তি এক অতি সুন্দরী নারীর সামনে উপস্থিত হ’ল আর তার সামনে ছিল একটি ছেলে এবং এক পেয়ালা মদ। সেই নারী আবেদকে বলল, আল্লাহর শপথ! আমি আপনাকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডেকে পাঠাইনি, বরং এজন্য ডেকে পাঠিয়েছি যে, আপনি আমার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হবেন অথবা এই মদ পান করবেন অথবা এই ছেলেকে হত্যা করবেন। সেই আবেদ বলল, আমাকে এই মদের একটি মাত্র পেয়ালা দাও। ঐ নারী তাকে এক পেয়ালা মদ পান করাল। তখন সে বলল, আরও দাও। মোটকথা ঐ আবেদ আর থামল না, যাবৎ না সে তার সাথে ব্যভিচার করল এবং ঐ ছেলেকেও হত্যা করল। অতএব তোমরা মদ পরিত্যাগ কর। কেননা আল্লাহর শপথ! মদ ও ঈমান কখন সহাবস্থান করে না। এর একটি অন্যটিকে বের করে দেয়।[11]

মাদকদ্রব্য সুস্থ সমাজের জন্য একটি বড় অভিশাপ। এর ছোবলে আজ হারিয়ে যাচ্ছে অজস্র সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী। দেশে এর বিরূপ প্রভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কাজেই পারিবারিক অপরাধ রোধ করতে হ’লে মাদকমুক্ত দেশ গড়ার শপথ নিতে হবে।

(১৪) পরিবারে ছালাত প্রতিষ্ঠা করা :

ছালাত ব্যক্তি ও সমাজ সংস্কারের অন্যতম একটি মাধ্যম। এটা মানুষের চরিত্র গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ছালাত ব্যক্তিকে পাপাচার ও অপরাধ করা থেকে দূরে রাখে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর ঘোষণা হ’ল,وَاَقِمِ الصَّلاَةَ اِنَّ الصَّلاَةَ تَنْهى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ- ‘ছালাত কায়েম কর। নিশ্চয়ই ছালাত যাবতীয় অশ্লীলতা ও গর্হিত কর্ম হ’তে বিরত রাখে’ (আনকাবূত ২৯/৪৫)। ছালাত মানুষকে বিনয়ী, নম্র ও ভদ্র করে তুলে। পরিবার ও সমাজের সকল সদস্যরা যদি ছালাত আদায় করে তবে পারিবারিক অপরাধ হ্রাস করা অনেকটাই সম্ভব হবে। অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে মানুষ যাতে বিরত থাকে, তার প্রতিষেধক হিসাবে ছালাত ফরয করা হয়েছে।

(১৫) কঠোর আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ :

যারা অপরাধ করে তারা পাপী, এরা পরিবার ও সমাজ ধ্বংসকারী। তাই পারিবারিক জীবনে যারা অপরাধ করে তাদের বিচার করে তার প্রাপ্য শাস্তি প্রদানের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন, দায়েরকৃত মামলার ন্যায় বিচার নিশ্চিতকরণ এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অপরাধ দমনে দেশীয় আইনের পাশাপাশি ধর্মীয় আইন চালু করতে হবে। ইসলাম অপরাধের ক্ষেত্রভেদে বেত্রাঘাত (নূর ২ ও ৪) রজম[12] ও শিরশ্ছেদের (আনফাল-১২, মুহাম্মদ-৪) বিধান দিয়েছে। আর এ শাস্তিগুলো জনসমক্ষে[13] প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাতে সবাই শাস্তির কঠোরতা দেখে অপরাধ থেকে বিরত থাকে।

উপসংহার : 

অপরাধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিপন্থী। এটা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে টেনে আনে চরম দুর্ভাগ্য ও হতাশা। অপরাধ শান্তি ও নিরাপত্তাকে বাধাগ্রস্ত করে। উপরোল্লেখিত অপরাধগুলো নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় ও বর্জনীয় কাজ। যারা এসব অপরাধের সাথে জড়িত সমাজের কেউ তাদের ভালো চোখে দেখে না। একটি কলুষতামুক্ত, নিরাপদ ও শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণের জন্য উল্লেখিত অপরাধ সমূহ অবশ্যই পরিহার করতে হবে এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয়, পরস্পরের প্রতি যে দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে তা যথাযথভাবে পালন, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বর্জন এবং মৌলিক মানবীয় গুণাবলী অর্জন প্রভৃতির মাধ্যমে অপরাধ দমন করা সম্ভব।

মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন

প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, খাসেরচর মাহমূদিয়া সিনিয়র ফাযিল মাদ্রাসা, ধল্লাবাজার, সিংগাইর, মানিকগঞ্জ।


[1]. হাকেম হা/৪২২১; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/২১৩০১; ছীহহাহ হা/৪৫।

[2]. মুসলিম হা/৩২৪০; আহমাদ হা/৮৩৪৫; ছহীহুত তারগীব হা/১৯২৮।

[3].ইবনু মাজাহ হা/২২৪; ছহীহুত তারগীব হা/৭২; মিশকাত হা/২১৮।

[4]. ইবনে জারীর তাবারী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫১।

[5].বুখারী হা/৫০৯০; মুসলিম হা/১৪৬৬; মিশকাত হা/৩০৮২।

[6]. তিরমিযী হা/১০৮৪; ইরওয়া হা/১৬৬৮; মিশকাত হা/৩০৯০।

[7]. আবূদাঊদ হা/৪৯৪৩; আহমাদ হা/৭০৭৩; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৩৫৩।

[8]. তিরমিযী হা/১১৭৩; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৫৫৯৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৬৯০; ছহীহুত তারগীব হা/৩৪৪।

[9]. বুখারী হা/৫৯৮৪; মুসলিম হা/২৫৫৬; আবুদাঊদ হা/১৬৯৮; তিরমিযী হা/১৯০৯; মিশকাত হা/৪৯২২।

[10]. মুসলিম হা/২০০৩; আবূদাঊদ হা/৩৬৭৯; মিশকাত হা/৩৬৩৮।

[11]. নাসাঈ হা/৫৬৬৬-৬৭, সনদ ছহীহ।

[12]. রজম অর্থ প্রস্তর নিক্ষেপ (প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদন্ড)। শব্দটি কুরআনে এসেছে ৬৫ বার। ‘লা রাজামা’ অর্থাৎ অপরাধ করো না, শব্দটি এসেছে ৫ বার (সূরা হূদ ২২, নাহল ২৩, ৬২, ১০৯ ও গাফির ৪৩।

[13]. জনসমক্ষে শাস্তির বিধান : সূরা নূর ২ ও ৪, মুসলিম হা/৪৩৬৮, ৪৩৬৯ ও ৪৩৭০; বুখারী হা/১৪৮, ২৮০।






বিষয়সমূহ: বিবিধ
বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য (পূর্বে প্রকাশিতের পর) - ইহসান ইলাহী যহীর
কুরআন তেলাওয়াতের আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
অনুমতি গ্রহণের আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
রাসূল (ছাঃ)-এর দো‘আয় শামিল হওয়ার উপায় - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণ - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
পাপাচার থেকে পরিত্রাণের উপায় সমূহ (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা - মীযানুর রহমান মাদানী
সফল মাতা-পিতার জন্য যা করণীয় - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
পলাশী ট্রাজেডি এবং প্রাসঙ্গিক কিছু বাস্তবতা - ড. ইফতিখারুল আলম মাসঊদ
আমানত - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (শেষ কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আরও
আরও
.