নিম অতি
পরিচিত একটি নাম। কোনও কিছুর স্বাদ তিতা হ’লেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা নিমের সাথে
তুলনা করি। কিন্তু তিতা হ’লেও নিম মানুষের অতি উপকারী বৃক্ষ। নিম গাছের
নির্মল হাওয়া যেমন উপকারী, তেমনি এ গাছের বিভিন্ন অংশ, পাতা, ফুল, ফল ও ছাল
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ‘পঞ্চামৃত’ নামে অভিহিত। নিমের ডাল যেমন দাঁতন হিসাবে
ব্যবহৃত হয়, তেমনই প্রসূতিগৃহে, অসুস্থ রোগীর বিছানায় নিমের পাতা এখনও
স্থান পায়। বাড়ীর দক্ষিণে নিমগাছ থাকলে সে বাড়িতে কোনও রোগ-ব্যাধি ঢুকতে
পারে না, এমন কথা সুপরিচিত।
পাশ্চাত্যে নিম গাছকে ‘মিরাকল ট্রি’ বা অলৌকিক বৃক্ষ বলে। এই গাছ ‘ভিলেজ ফার্মেসী’ হিসাবে পরিচিত। নিম গাছের শিকড়, কান্ড, ডাল, পাতা, ফুল ও ফল-সবই মানুষের উপকারে লাগে।
* নিম চাষ খুবই সহজ। শুধু রোপণ করলেই হয়। এর বংশবিস্তার বীজ দিয়ে এবং শাখা কলমের মাধ্যমে করা যায়। নিম গাছ সারা বছর রোপণ করা যায়। তবে উপযুক্ত সময় হচ্ছে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। জুন-জুলাই মাসে বীজ সংগ্রহ করে ১০-১৫ দিনের মধ্যে বীজ বপন করতে হয় চারা উৎপাদন করার জন্য। চারার বয়স এক বছর হ’লে রোপণ করা যায়। প্রায় সব মাটিতে নিম ভাল হয়। স্বল্পকালীন বন্যা সহ্য করতে পারে। পোকামাকড় ও রোগবালাই দ্বারা আক্রান্ত হয় না। নিম গাছ দ্রুত বাড়ে।
নিমের ভেষজগুণ ছাড়াও অধুনা গবেষকগণ নিমকে নানাভাবে ব্যবহার করছেন।
(১) এ গাছের আঠা কেমিক্যাল শিল্পের কাঁচামাল ও রেশম কাপড়ের রং হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
(২) নিম বীজের তেল ব্যাপকভাবে প্রসাধন শিল্পে এবং সাবান ও কীটনাশক হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
(৩) নিমের তেল এমনকি রকেটের জ্বালানীতে রূপান্তরিত করা সম্ভব হয়েছে।
(৪) নিমের পাতার রস ঘা, ফোঁড়া, চুলকানি, চর্মরোগ, গুটি বসন্ত, খোস-পাঁচড়া, পানি বসন্ত, হাম, ব্রণ, জ্বর, সর্দি-কাশি, অরুচি, বদহযম, কৃমি, কফ, বমি, কুষ্ঠ, হিক্কা, প্রমেহ রোগ সারায়।
(৫) নিমের বীজের তেল মাথা ঠান্ডা রাখে, উঁকুন মারে, চুল বাড়ায়, চুলপড়া বন্ধ করে, খুশকি দূর করে।
(৬) নিমের বাকল বাতরোগ ও জ্বরে খুব উপকারী।
(৭) নিম গাছের ডাল দিয়ে প্রতিদিন দাঁত মাজলে দাঁতের রোগ হয় না ও মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়।
(৮) নিমের আঠা ও ফল থেকে শক্তিবর্ধক টনিক তৈরী হয়।
(৯) কাঁচা হলুদ ও নিমপাতা বাঁটা বসন্তের গুটিতে দিলে গুটি দ্রুত শুকিয়ে যায়।
(১০) ১০টি পাতা ও ৫টি গোল মরিচ একত্র চিবিয়ে খেলে রক্তের শর্করা কমিয়ে ডায়বেটিস রোগীদের উপকার করে।
(১১) নিম বীজের তেল দিয়ে প্রায় ২০০ প্রজাতির ক্ষতিকারক পোকামাকড় দমন করা যায়। গুদামের শস্যের মধ্যে নিমপাতা গুঁড়া করে দিলে পোকা আক্রামণ করে না। মশা দমনের জন্য নিমের তেল খুব কার্যকরী।
(১২) নিম বীজের খৈল গবাদি পশুর খাদ্য ও সার হিসাবে জমিতে প্রয়োগ হয়।
(১৩) নিম গাছের কাছে মশা যায় না। নিম তেল দ্বারা তৈরী কেরোনিম লিকুইড ১০ মিলিলিটারে ১ লিটার মিশিয়ে মশার উৎপত্তি স্থানে স্প্রে করলে মশা নির্মূল হয়।
(১৪) ইউরিয়া সারের সাথে নিম পাউডার মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করলে ২৫ ভাগ ফলন বেশী হয়।
(১৫) নিমের গুঁড়া উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান মাটিতে সংরক্ষণ করে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও মাটির ক্ষতিকারক পোকামাকড় ধ্বংস করে।
(১৬) আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) পরীক্ষা করে দেখেছে যে, নিমের খৈল ধানের সহজলভ্য এমোনিয়াম নাইট্রোজেনকে নাইট্রেটে রূপান্তরিত করে, যা মাটিকে নাইট্রেট লবণমুক্ত করতে সাহায্য করে।
(১৭) নিম গাছ ভূমিক্ষয় রোধ করে তামপাত্রা কমায়।
(১৮) নিমের তেল দিয়ে বাতি জ্বালানো যায়।
(১৯) বীজের মন্ড দিয়ে মিথেন তৈরী করা যায়।
(২০) পাতার গুঁড়া দিয়ে ফেসক্রিম এবং তেল দিয়ে বিভিন্ন কসমেটিক্স তৈরী হচ্ছে, যার কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
(২১) নিমের টুথপেস্ট, সাবান, তেল, লোশন, শ্যাম্পু বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে।
(২২) নিমের কাঠ খুব উন্নতমানের। এতে ঘুণ ধরে না। নিম কাঠে গৃহ নির্মাণ, আসবাবপত্র তৈরী, নৌকা ও জাহায নির্মাণ করা যায়।
নিমের ক্ষতিকর ব্যবহার :
(১) নিম প্রাচীনকাল থেকেই গর্ভনিরোধক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। তাই গর্ভাবস্থায় বা সন্তান নিতে ইচ্ছুক হ’লে নিমের তেল বা নিম পাতা থেকে তৈরি ট্যাবলেট এড়িয়ে চলা উচিৎ। এটা উর্বরতা কমায় ও গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায়।
(২) এটি রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। তাই যাদের নিম্ন রক্তচাপ রয়েছে তারা নিমের ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
(৩) অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ডায়াবেটিস এড়াতে নিম পাতা বা নিমের রস পান করা শুরু করেন। অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষরা নিমের রস বেশি পান করলে তা ওষুধের পরিবর্তে বিষ হিসাবে কাজ করতে পারে। এর ফলে স্পার্ম কাউন্ট সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হ’তে পারে।
(৪) এছাড়া আপনার শরীরে আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী টানা কতদিন নিম পাতা খাওয়া যেতে পারে সেটা একজন বিশেষজ্ঞের থেকে জেনে নেওয়া উচিত। কারণ একনাগাড়ে এটি খেতে থাকলে শরীরের নানা ক্ষতি দেখা যায়।